নারীর ভাসমান শ্রমবাজার
কাকডাকা ভোরে বেরিয়ে পড়েন ষাটোর্ধ্ব রহিমন। দিনমজুর হিসেবে কাজ পাওয়ার আশায় বসে থাকেন রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের এক কোনায়, ফুটপাতের ওপরে। রহিমনের মতো প্রায় ১০০ জন নারী প্রতিদিন বেরিয়ে পড়েন কাজের খোঁজে। আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ডান দিক দিয়ে কবরস্থানের দিকে একটু এগোলেই তাঁদের দেখা মিলবে। ফুটপাতের ওপরে লাইন ধরে তাঁরা বসে থাকেন। অপেক্ষা করেন কেউ ভাড়া করবেন দিনমজুরের কাজে। পুরুষ দিনমজুরদের মতোই নারী দিনমজুরদের দেখা মেলে এই ভাসমান শ্রমবাজারে। রাস্তার যে পাশে বসেন পুরুষ মজুররা, তার উল্টোদিকের ফুটপাতে নারীরা বসেন। গত শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ নারীই মধ্যবয়স্ক। রহিমনের স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে। লালবাগের রসুলপুরে বাসা। কাজ করতে পারেন? প্রশ্ন শুনেই রহিমনের উল্টো প্রশ্ন, ‘খাওয়াইব কে? কামে না আইলে পেট চলব ক্যামনে?’ মাকসুদা তিন বছর ধরে এখানে বসেন। ঘরে ছোট দুটি ছেলেমেয়ে। স্বামীর খোঁজ জানেন না। কাজ পাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে মাকসুদা বলেন, ভোর ছয়টার পরে তাঁরা এখানে জড়ো হতে থাকেন। অধিকাংশ নারীই কাজ পান একজন ‘সর্দারনির’ (একধরনের যোগাযোগ সমন্বয়কারী) মাধ্যমে। মাঝে মাঝে সর্দারনি এসে বলে দেন কে কোথায় যাবেন। অথবা ফোনে নির্দেশনা দেন। যিনি সর্দারনি, তিনিও একসময় মজুর ছিলেন। কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাঁকে ৫০ টাকা দিতে হয়। কাজের সরঞ্জাম সর্দারনিই সরবরাহ করেন। তিনি বলেন, সর্দারনি ছাড়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলে সহজে কাজ মেলে না। এখানকার অধিকাংশ নারী মজুরের কাজ করেন নির্মাণশ্রমিক হিসেবে। মূলত নতুন ভবন তৈরি বা পুরোনো ভবন ভাঙার কাজ করেন। এ ছাড়া ধোয়ামোছার কাজও করতে হয়। পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, কলাবাগান ও মিরপুর এলাকাতেই তাঁদের ডাক পড়ে বেশি। প্রয়োজনে দূরেও যান। দিনে মজুরি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। নারী মজুরেরা এভাবে ফুটপাতে বসে কাজের অপেক্ষা করেন বেলা ১০-১১টা পর্যন্ত।
কাজ না জুটলে বাড়ি ফিরে যান। শনিবার সর্দারনি আসেননি। তাঁর বদলে রেজিয়া বেগম (৫০) সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রেজিয়া বলেন, ‘আমি আছি ৩০ বছর। আইজ আফায় আইব না। অহন এক গুরুপ কলাবাগান পাডামু। হেরপর আবার ফোন কইরা কইব কই কই যাওন লাগব।’ রিজিয়ার স্বামী রিকশাচালক। মেয়ে কলেজে পড়ছেন। ছেলে কাজ করেন দোকানে। সংসারে একটু ভালো থাকতেই এ পেশায় আসা। বললেন, স্বামীই বলেছেন কাজ করতে। পেটের দায়েই করতে হয়। রিজিয়া বেলন, শ খানেক নারী এখানে আসেন। বেশির ভাগই কামরাঙ্গীরচরের। মোটামুটি সবাই কাজ পান। একটু দূরে পাঁচজনের একটি দল। কাছে গিয়ে জানা গেল, তাঁরা সর্দারনির অধীনে নন। অনেকেই আসেন শ্রমিক খুঁজতে। এ ছাড়া বাসাবাড়ি পরিবর্তনের সময় ধোয়ামোছার কাজেও অনেকে তাঁদের নিয়ে যান। সবার হাতেই দুপুরের খাবারের বাক্স। কাজ পেলে দুপুরের খাবার। কয়েকজন বলেন, মালিক ভালো হলে মাঝে মাঝে খাওয়ায়। কিছু বকশিশও মেলে। উল্টোপাশের ফুটপাতে পুরুষ মজুরদের অপেক্ষা। নারীদের এভাবে কাজ করাকে কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে মো. শামছু নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘কামে হেগো চাহিদা আছে। অনেকে তো বউ লইয়াও আহে।’ কথা বলতে বলতে তিনটি দলে ১২ জন চলে গেলেন কাজে। অন্যরা অপেক্ষায়। এর মধ্যেই টিনের ছোট কৌটায় একটু চা-ও ভাগাভাগি হলো। চলল আগে-পরে পাঠানো নিয়ে মন-কষাকষি। অন্তত ১০ জন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশই হয় বিধবা, নয়তো স্বামী ছেড়ে গেছেন। থেমে থাকেননি। হাল ধরেছেন সংসারের।
No comments