বিনা পয়সায় পড়ান সানী
নিজে অর্থকষ্টের মধ্যেও পড়াশোনা করছেন। দরিদ্র পরিবারের কোনো শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হলে বিষয়টি তাঁকে পীড়িত করে। এ উপলব্ধি থেকে তিনি ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করতে নিয়েছেন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। গড়ে তুলেছেন ‘শিক্ষার আলো পাঠশালা’। শিশুদের স্কুলগামী করতে উদ্যোগ নেওয়া এ ব্যক্তি হলেন সানী রহমান ওরফে মিন্টু (২৭)। বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের গিলন্ড গ্রামে। তিনি মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ বর্ষে পড়েন। তাঁর বাবা মোতালেব হোসেন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। সানীর বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট বোন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন। ২০১১ সালের শুরুর দিকের কথা। মা মারা যাওয়ার পর গ্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র রাজিব হোসেনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি সানীকে খুব ভাবিয়ে তোলে। সানীসহ গিলন্ড গ্রামের পাঁচ বন্ধু মিলে ভাবতে শুরু করেন,
কীভাবে ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করা যায়। তাঁরা ঠিক করলেন, দরিদ্র এসব শিশুকে বিনা পয়সায় পড়াবেন। কিন্তু এর জন্য জায়গা দরকার। এর মধ্যেই তাঁরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের সমিতির একটি ঘরের খোঁজ পান। সপ্তাহে শুধু এক দিন তিন ঘণ্টা সমিতির সদস্যরা সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পাঁচ বন্ধু শিশুদের পাঠদানের জন্য ঘরটি ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করলেন। পরে সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে ঘরটি ব্যবহারের অনুমতিও মেলে। এরপর গ্রামের সাত-আটজন শিশুকে নিয়ে শুরু হয় পাঠদান। তবে চার বন্ধু সরে গেলে ২০১৩ সালের প্রথম দিকে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকার পর সানী একাই এর কার্যক্রম আবার শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে সেখানে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। সানী তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম দেন শিক্ষার আলো পাঠশালা। সমিতির সদস্য গিলন্ড গ্রামের শাজাহান মিয়া বলেন, সানী একটি মহৎ উদ্যোগের কথা জানান। বলেন, দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সা পড়াতে চাইছেন। তাই চাওয়ামাত্র ঘরটি ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় সরেজমিনে পাঠদানের দৃশ্য চোখে পড়ল। তখন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পাঠদান চলছিল। পাঠশালায় তৃতীয় শ্রেণিতে এবার ১৫ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ২২ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতে ২৩ জন, মোট ৬০ জন শিশুকে পাঠদান করা হচ্ছে। এখানে পড়াশোনা করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনেকেই ভালো করেছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস সানীকে ৯০ হাজার টাকা অনুদান দেন। সেই টাকায় তরা-ঝিটকা সড়কের গিলন্ড গ্রামে জেলা পরিষদের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া ৭ শতাংশ নিচু জায়গা ভরাট করা হয়েছে। তবে অর্থসংকটে সেখানে ঘর নির্মাণ করা যাচ্ছে না। সানী রহমান বলেন, পাঠশালায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। সকাল ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত পঞ্চম শ্রেণি এবং সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে। এরপর শিশুরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী বন্যা রাজবংশীর বাবা ঝন্টু রাজবংশী বলেন, ‘মাছ ধরে বাজারে বেইচা সামান্য ট্যাহা রোজগার করি। তাতে সংসার চালানোই যায় না। প্রাইভেট পড়াইবার ট্যাহা পামু কই? তাই ম্যায়ারে (মেয়েকে) সানীর পাঠশালায় দিছি।’ পঞ্চম শ্রেণির রবিন মিয়ার বাবা আলম মিয়া ইটের ভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘ট্যাহার অভাবে কোনো মাস্টারের কাছে ছেলেরে প্রাইভেট পড়াইতে পারি না। সে স্কুলে যাওয়াও বন্ধ কইরা দিছিল। কিন্তু সানী বিনা ট্যাহায় এখন পড়াইতাছে।’ নবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাকিব হোসেন ফরহাদ বলেন, এলাকার দরিদ্র ও ঝের পড়া শিশুদের জন্য সানীর উদ্যোগ প্রশংসনীয়। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক ছানোয়ার হোসেন বলেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিনা পয়সায় পড়ানো ও ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করতে সানী আলোর মশাল হাতে এগিয়ে যাচ্ছেন। সানী রহমান বলেন, জেলা প্রশাসকের দেওয়া টাকায় বন্দোবস্ত পাওয়া জায়গা ভরাট করা হয়েছে। কিছু আসবাবও কেনা হয়েছে। তবে সেখানে ঘর নির্মাণে আরও টাকার প্রয়োজন। জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস বলেন, ‘শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সানী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর এই ভালো কাজে অর্থ সহায়তা করতে পেরে আমি আনন্দিত।’
No comments