সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ দরকার
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রয়োজনের সময় ধনী-দরিদ্র সবারই সেবা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সমিন্বতভাবে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচতনতা বাড়ানো দরকার। গতকাল রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ শীর্ষক গোলেটেবিল বৈঠকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা এসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে প্রথম আলোকে সহযোগিতা করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবিলক হেলথ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠান ইউএসএআইডি। বৈঠকে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসসহ স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি নামে দিশারী প্রকল্প শুরু করেছে। এর আওতায় ৫০ ধরনের রোগের ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। ওই তিন উপজেলার অভিজ্ঞতার আলোকে এই কর্মসূচি দেশের অন্য জায়গায় বিস্তৃত করার পরিকল্পনা আছে। তিনি বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা স্লোগান হিসেবে শুনতে ভালো। কিন্তু এই জনবহুল দেশে বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। অর্থ ছাড়া মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। সর্বজনীনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। গোলটেবিল বৈঠকের মূল বিষয়ের ওপর বক্তব্য উপস্থাপনের সময় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য খাতের বাইরের কিছু বিষয় স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে চলেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, নগরায়ণ, অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি—এগুলো তার উদাহরণ। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকে এখন কৌশলগত খাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই খাতের অর্থনৈতিক মাত্রা আছে। স্বাস্থ্য উন্নত হলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। তবে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে জোরালো যুক্তি দরকার। যেমন প্রবৃদ্ধি বেশি হবে, দারিদ্র্য কমবে ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে বিভিন্ন খাতের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে জানা ও সহমতে পৌঁছানো দরকার। আলোচনার শুরুতে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, প্রথম আলো সাংবাদিকতার বাইরেও কিছু কাজ করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক আলোচনার উদ্যোগ নেয় এবং তা সাধারণ মানুষ বা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়। তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা, আরও অনেকের মিলিত চেষ্টার ফলে স্বাস্থ্য খাতের সফলতা এসেছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে দেখা হচ্ছে। আলমা আটা ঘোষণায় ২০০০ সালের মধ্যে ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ এমন কথা বলা হয়েছিল। তাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তবে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানুষের সেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণা ছিল। প্রায় তিন ঘণ্টর এই আলোচনায় একাধিক আলোচক বলেন, জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও একে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মাহমুদ হাসান বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনেরর জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ জনবল দরকার। দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও নার্স ও টেকনিশিয়ানের ঘাটতি আছে। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এর দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের ৯৪ শতাংশ অদক্ষ। চিকিৎসক তৈরির সব প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন নয়। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক এম ইকবাল আর্সলান বলেন, সরকারের উচিত পেশাজীবীদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা। সংগঠনের নেতাদের উচিত পেশাজীবীদের উদ্বুদ্ধ করা, সচেতন করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া।
কিন্তু সংগঠনগুলো উন্নয়নে কাজ না করে ট্রেড ইউনিয়নিজম করে। এই চিকিৎসক নেতা বলেন, ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ কম হলে আউট অব পকেট খরচ বা রোগীর ব্যয় কমে যাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালেয়র পরিকল্পনা শাখার জয়েন্ট চিফ এ ই মো. মহিউদ্দিন ওসমান বলেন, পরবর্তী স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচিতে অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্যাকেজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে মূলত সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে। তিনি বলেন, সুশাসন, নিরাপত্তা, সুন্দর পরিবেশ, দক্ষ জনবল—এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ। অনুষ্ঠান সঞ্চলাক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব পায়। আলোচনায় অংশ নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, ওষুধ ঠিক না ভেজাল, তা জানার একটা উপায় হচ্ছে প্যাকেটের গায়ে অধিদপ্তরের নিবন্ধন নম্বর ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা আছে কি না, তা দেখে নেওয়া। তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যে মডেল ফার্মেসি চালু করছে। এসব ফার্মেসিতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি হবে না। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মানসম্পন্ন ওষুধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমান হক বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা ভালো কাজ করলে পুরস্কৃত করতে হবে। অন্যদিকে কাজ না করলে শাস্তির বিধান রাখতে হবে।
সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনার ওপর জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটউটের (পিআইবি) মহাপরিচালক মো. শাহ আলমগীর। তিনি বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি সাংবাদিকদের জন্য এ নিয়ে বই প্রকাশ করেছে পিআইবি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য প্রত্যেকের নিজের মতো করে ভূমিকা রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট দ্বিগুণ করার চেষ্টা চলছে। জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবিলক হেলথের শিক্ষা বিভাগের প্রধান হোসেন ইশরাত আদিব বলেন, নীতিনির্ধারণে গবেষণা ফলাফল ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের মাত্র ২ শতাংশ রাখা হয় গবেষণায়। যে গবেষণা হচ্ছে, তা কে ব্যবহার করছে, কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষ জানতে পারে না। অন্যদিকে কিছু গবেষকও প্রকাশনা ও সেমিনারের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেন। বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ শাকিল আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নে দাতারা কিছু পরিবর্তন আনছে। এখন অর্থায়ন হবে কর্ম সম্পাদনের মান ও পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে।
ইউএসএআইডির স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষা শাখার উপপরিচালক মিরান্দা বেকহাম বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতের বহু বছরের সহযোগী ইউএসএআইডি। ইউএসএআইডির অর্থায়নের কৌশলগত পরিকল্পনা সরকারের নতুন স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘সীমিত সম্পদ আমরা কোথায় ব্যবহার করে ভালো ফল পেতে পারি, সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত।’ আলোচনার শেষ দিকে হোসেন জিল্লুর রহমান সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে জনস্বাস্থ্য, ব্যয় হ্রাস, সামাজিক বিমা ও কমিউনিটি সম্পৃক্ততার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করেন। একাধিক আলোচক বিষয়গুলো নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করেন। সমাপনী বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ৬ হাজার নতুন চিকিৎসককে নিজ জেলায় চাকরি দেওয়া হয়েছিল। ১০ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকার আন্তরিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ করছে। সরকারের এসব অর্জন গণমাধ্যমে আসা উচিত।
No comments