অর্থপাচারের মহোৎসব ও দুর্নীতি by হারুন-আর-রশিদ
বাংলাদেশে
দুর্নীতির যে মহোৎসব চলছে, সেটা টিআইবিসহ আরো বহু সংগঠন থেকে দীর্ঘ দিন
ধরে বলা হচ্ছে। সরকার বিষয়টিকে তেমন আমলে নেয়নি। গত ৯ ডিসেম্বর
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি
(জিএফআই) বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশকে অন্যায়মুক্ত করে প্রকৃত স্বাধীন দেশে রূপ দিতে না পারলে আগামী
প্রজন্ম আমাদের শাসকদের ক্ষমা করবে না। আজ বাংলাদেশ ৪৫ বছরে যে অবস্থানে
(মালয়েশিয়ার পর্যায়ে) যাওয়ার কথা ছিল, তা পারেনি অসৎ চক্রগুলোর কারণে। তারা
গণতন্ত্রকে নিজেদের আদলে গঠন করে নিয়েছে, যাতে কৌশলে লুটপাট করা সহজ হয়।
’৭১-এর স্বপ্ন যদি মানবতাবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের কবর দেয়ার স্বপ্ন হয়ে থাকে,
তাহলে বাংলাদেশ দুর্নীতি, শোষণ, বৈষম্য, বিভাজন ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত
একটি মডেল রাষ্ট্রের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। ৪৫ বছর ধরে তা হতে দেয়া হয়নি।
এটি ১৬ কোটি মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। জনগণ এর কার্যকর প্রতিবাদও গড়ে
তুলতে পারেনি। বাংলাদেশকে যারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি, তারা এক অর্থে
অপরাধী।
একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ১৯৭৫-২০১৪- এই চার দশকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে আসা দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার অনুদানের ৭৫ ভাগই লুট হয়েছে।
১০ ডিসেম্বর ২০১৫ প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার লিড নিউজ ছিল- ‘আরো ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার’। বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে হিসাব করলে দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই অর্থ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। জিএফআই সাত বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এবার ‘উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ ২০০৪-১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মূলত আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যত অর্থ পাচার হয়েছে, তা বাংলাদেশের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা ও ভৌত অবকাঠামো খাতের মোট উন্নয়নবাজেটের সমান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো: আজিজুল ইসলাম বলেছেন, তিন বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থবির হওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো, অবৈধ পথে অর্থপাচারের ঘটনা। পাচাররোধে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাজস্ব বোর্ডকে সমন্বিতভাবে অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যমে অর্থপাচারের বিষয়টি তারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘আগামী দিনেও এ দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা অব্যাহত থাকবে। কারণ, এটি অনেকাংশে সুশাসনের অভাবের সাথে জড়িত। আইন করে এটা ঠেকানো যাবে না।’ ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত উপরিউক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। মোট কথা, অর্থ পাচার হওয়া দেশগুলোর মধ্যে খারাপ অবস্থানে গেছে বাংলাদেশ।
সব মিলিয়ে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা চার লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এই পাচারকৃত অর্থ দিয়ে অন্তত দুই বছরের বাজেট তৈরি করতে পারত বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
শুধু ২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ টাকার অঙ্কে ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতের সাতটি বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ। পরিবহন খাতে বাজেট ২১ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ খাতে বাজেটে বরাদ্দ ১৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা, গৃহায়ন খাতে বাজেটে বরাদ্দ ১১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে বাজেট ১০ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা, পল্লী উন্নয়ন খাতে আট হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে ছয় হাজার ৮৩ কোটি টাকা এবং শিল্প খাতে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ এক হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি প্রতিবেদনটিকে ‘আই ওপেনিং’ বা চোখ খুলে দেয়ার প্রতিবেদন হিসেবে মনে করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সাধারণত কর ফাঁকি দিয়ে টাকা পাচার করা হয়। অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে। ১০ ডিসেম্বর রাজস্ব পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘কারো যদি হক বা অধিকার পাওনা থাকে, তা যেন দ্রুত পরিশোধ করা হয়। কর হলো রাষ্ট্রের হক।’
আমরা দেশটাকে স্বাধীন করলাম এ জন্যই কি- উপার্জন করব এ দেশে, আর টাকাগুলো পাচার করব বিদেশে? স্ত্রী-ছেলেমেয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যাতে টাকাগুলো নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে অর্থ লুণ্ঠনের সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থ লুণ্ঠনের বড় সেক্টর হলো ভূমি অধিদফতর। এই সেক্টরে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। দেশের রেলওয়ের প্রায় সাড়ে চার হাজার একর জমি ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে।
৪৪ বছর ধরে অবৈধ পথে যত টাকা একশ্রেণীর মানুষ লুটপাট করেছে, এর পরিমাণ সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞ এভাবে বক্তব্য দিয়েছেন- এই টাকা দিয়ে নতুন একটি বাংলাদেশ গড়া যায়। রাষ্ট্রের টাকা রাষ্ট্রের উন্নয়নের কাজে ব্যয় হলে বাংলাদেশ মালয়েশিয়াকে টপকে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হতো না। সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে পারিনি বলেই চার দশকে আমরা যে অবস্থানে যাওয়ার কথা, তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় তাদেরই বেশি নিতে হবে, যারা বিগত চার দশকে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। জাপান ও সিঙ্গাপুরে কোনো খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। আছে মেধা, সততা ও দেশপ্রেম। বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা হলো, মানবসম্পদ। খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। শুধু সততা ও সুশাসনের অভাবে দেশটা এগোতে পারছে না। অস্থিতিশীল রাজনীতি ও গণতন্ত্র বারবারই বেহাল দশায় পতিত হওয়া আমাদের উন্নয়নের যাত্রাপথে সব সময় প্রতিবন্ধক। রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার অভাবেও দেশটাকে আমরা সাজাতে পারিনি। এক হিসাবে, যে টাকাগুলো বিগত এক দশকে পাচার হয়েছেÑ তা দিয়ে ২০০টি ভারী শিল্পকারখানা স্থাপন করা যেত। এর ফলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। দালালের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বহু জীবনের সর্বনাশই শুধু ঘটেনি, অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। দেশটাকে আমরা জোর করে অন্ধকারের সুড়ঙ্গের কিনারে পৌঁছে দিচ্ছি। দেশে ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ দেয়া হবে। এখানে বড় অঙ্কের নিয়োগবাণিজ্য আছে বলে ধারণা করা যায়। দলীয় রাজনীতির কোটার এই নিয়োগেও যে যত বেশি অর্থ দিতে পারবে, তার চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা তত বেশি। বাকি সবাই আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্য চাকরির বিজ্ঞাপনে বন্দী হয়ে থাকবে। দেশটা যখন যে ক্ষমতায় যায় শুধু যেন তার। বাংলাদেশে ‘রাজনীতি’ মুনাফা অর্জনের সহজতম বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। এই বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় না। প্রয়োজন শুধু লবিং। দলীয় ক্যাডাররা বিনা চ্যালেঞ্জেই চাকরি পেয়ে যায়, তেমন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। পরীক্ষা নেয়া হলেও তা লোক দেখানো বা নিয়ম রক্ষার নাটক। এই যদি দেশের অবস্থা দাঁড়ায়, তাহলে পেশিশক্তির বিজয় ঘটবে। মেধা ও মানবিকতার পরাজয় ঘটবে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার একটি মূল কারণ এটি।
প্রতিদিন দেশে ধর্ষণের চিত্র ফুটে উঠছে, নারীকে যেভাবে পণ্য হিসেবে গণ্য করে দাসপ্রথার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা একটি মুসলিমপ্রধান দেশে কখনো চিন্তাই করা যায় না। রাস্তাঘাটে, ব্যানারে, টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়- নারীর দেহকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পণ্যের পর্যায়ে। ছেলেদের শরীর ঢাকা থাকলেও মেয়েদের টপলেস করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে একশ্রেণীর লোক। এটাও একধরনের বড়মাপের দুর্নীতি। সমাজ, রাষ্ট্র- সব কিছুই ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। দেশে নারী নির্যাতনের প্লাবন যে হারে বাড়ছে, তাতে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তিরা শঙ্কিত। দুর্নীতি এখন বহুমাত্রিক। আগে দুর্নীতির পরিধি ছিল সীমাবদ্ধ। এখন সব স্তরে ও পর্যায়ে দুর্নীতি অনুপ্রবেশ করেছে। দুর্নীতির এমন এক সংস্কৃতির চর্চা চলছে, যেখানে অনেক সময়ে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।
লেখক : গ্রন্থকার ও কলামিস্ট
harun rashidar@gmail.com
একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ১৯৭৫-২০১৪- এই চার দশকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে আসা দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার অনুদানের ৭৫ ভাগই লুট হয়েছে।
১০ ডিসেম্বর ২০১৫ প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার লিড নিউজ ছিল- ‘আরো ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার’। বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে হিসাব করলে দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই অর্থ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। জিএফআই সাত বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে পাচার হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এবার ‘উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ ২০০৪-১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মূলত আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যত অর্থ পাচার হয়েছে, তা বাংলাদেশের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা ও ভৌত অবকাঠামো খাতের মোট উন্নয়নবাজেটের সমান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো: আজিজুল ইসলাম বলেছেন, তিন বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থবির হওয়ার পেছনে বড় কারণ হলো, অবৈধ পথে অর্থপাচারের ঘটনা। পাচাররোধে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাজস্ব বোর্ডকে সমন্বিতভাবে অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যমে অর্থপাচারের বিষয়টি তারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘আগামী দিনেও এ দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা অব্যাহত থাকবে। কারণ, এটি অনেকাংশে সুশাসনের অভাবের সাথে জড়িত। আইন করে এটা ঠেকানো যাবে না।’ ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত উপরিউক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। মোট কথা, অর্থ পাচার হওয়া দেশগুলোর মধ্যে খারাপ অবস্থানে গেছে বাংলাদেশ।
সব মিলিয়ে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা চার লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এই পাচারকৃত অর্থ দিয়ে অন্তত দুই বছরের বাজেট তৈরি করতে পারত বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
শুধু ২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ টাকার অঙ্কে ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতের সাতটি বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ। পরিবহন খাতে বাজেট ২১ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ খাতে বাজেটে বরাদ্দ ১৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা, গৃহায়ন খাতে বাজেটে বরাদ্দ ১১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে বাজেট ১০ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা, পল্লী উন্নয়ন খাতে আট হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে ছয় হাজার ৮৩ কোটি টাকা এবং শিল্প খাতে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ এক হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি প্রতিবেদনটিকে ‘আই ওপেনিং’ বা চোখ খুলে দেয়ার প্রতিবেদন হিসেবে মনে করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সাধারণত কর ফাঁকি দিয়ে টাকা পাচার করা হয়। অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে। ১০ ডিসেম্বর রাজস্ব পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘কারো যদি হক বা অধিকার পাওনা থাকে, তা যেন দ্রুত পরিশোধ করা হয়। কর হলো রাষ্ট্রের হক।’
আমরা দেশটাকে স্বাধীন করলাম এ জন্যই কি- উপার্জন করব এ দেশে, আর টাকাগুলো পাচার করব বিদেশে? স্ত্রী-ছেলেমেয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যাতে টাকাগুলো নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে অর্থ লুণ্ঠনের সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থ লুণ্ঠনের বড় সেক্টর হলো ভূমি অধিদফতর। এই সেক্টরে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। দেশের রেলওয়ের প্রায় সাড়ে চার হাজার একর জমি ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে।
৪৪ বছর ধরে অবৈধ পথে যত টাকা একশ্রেণীর মানুষ লুটপাট করেছে, এর পরিমাণ সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞ এভাবে বক্তব্য দিয়েছেন- এই টাকা দিয়ে নতুন একটি বাংলাদেশ গড়া যায়। রাষ্ট্রের টাকা রাষ্ট্রের উন্নয়নের কাজে ব্যয় হলে বাংলাদেশ মালয়েশিয়াকে টপকে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হতো না। সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে পারিনি বলেই চার দশকে আমরা যে অবস্থানে যাওয়ার কথা, তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় তাদেরই বেশি নিতে হবে, যারা বিগত চার দশকে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। জাপান ও সিঙ্গাপুরে কোনো খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। আছে মেধা, সততা ও দেশপ্রেম। বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা হলো, মানবসম্পদ। খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। শুধু সততা ও সুশাসনের অভাবে দেশটা এগোতে পারছে না। অস্থিতিশীল রাজনীতি ও গণতন্ত্র বারবারই বেহাল দশায় পতিত হওয়া আমাদের উন্নয়নের যাত্রাপথে সব সময় প্রতিবন্ধক। রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার অভাবেও দেশটাকে আমরা সাজাতে পারিনি। এক হিসাবে, যে টাকাগুলো বিগত এক দশকে পাচার হয়েছেÑ তা দিয়ে ২০০টি ভারী শিল্পকারখানা স্থাপন করা যেত। এর ফলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। দালালের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বহু জীবনের সর্বনাশই শুধু ঘটেনি, অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। দেশটাকে আমরা জোর করে অন্ধকারের সুড়ঙ্গের কিনারে পৌঁছে দিচ্ছি। দেশে ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ দেয়া হবে। এখানে বড় অঙ্কের নিয়োগবাণিজ্য আছে বলে ধারণা করা যায়। দলীয় রাজনীতির কোটার এই নিয়োগেও যে যত বেশি অর্থ দিতে পারবে, তার চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা তত বেশি। বাকি সবাই আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্য চাকরির বিজ্ঞাপনে বন্দী হয়ে থাকবে। দেশটা যখন যে ক্ষমতায় যায় শুধু যেন তার। বাংলাদেশে ‘রাজনীতি’ মুনাফা অর্জনের সহজতম বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। এই বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় না। প্রয়োজন শুধু লবিং। দলীয় ক্যাডাররা বিনা চ্যালেঞ্জেই চাকরি পেয়ে যায়, তেমন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। পরীক্ষা নেয়া হলেও তা লোক দেখানো বা নিয়ম রক্ষার নাটক। এই যদি দেশের অবস্থা দাঁড়ায়, তাহলে পেশিশক্তির বিজয় ঘটবে। মেধা ও মানবিকতার পরাজয় ঘটবে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার একটি মূল কারণ এটি।
প্রতিদিন দেশে ধর্ষণের চিত্র ফুটে উঠছে, নারীকে যেভাবে পণ্য হিসেবে গণ্য করে দাসপ্রথার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা একটি মুসলিমপ্রধান দেশে কখনো চিন্তাই করা যায় না। রাস্তাঘাটে, ব্যানারে, টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়- নারীর দেহকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পণ্যের পর্যায়ে। ছেলেদের শরীর ঢাকা থাকলেও মেয়েদের টপলেস করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে একশ্রেণীর লোক। এটাও একধরনের বড়মাপের দুর্নীতি। সমাজ, রাষ্ট্র- সব কিছুই ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। দেশে নারী নির্যাতনের প্লাবন যে হারে বাড়ছে, তাতে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তিরা শঙ্কিত। দুর্নীতি এখন বহুমাত্রিক। আগে দুর্নীতির পরিধি ছিল সীমাবদ্ধ। এখন সব স্তরে ও পর্যায়ে দুর্নীতি অনুপ্রবেশ করেছে। দুর্নীতির এমন এক সংস্কৃতির চর্চা চলছে, যেখানে অনেক সময়ে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।
লেখক : গ্রন্থকার ও কলামিস্ট
harun rashidar@gmail.com
No comments