এতিমদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতেও বাধা by সালমা বেগম
জন্মের
পর থেকে বাবা-মা’র আদর থেকে তারা বঞ্চিত। সামাজিকভাবে স্বীকৃতি না পাওয়ায়
যাদের ঠিকানা এতিমখানা বা শিশু নিবাস। পিতা-মাতার পরিচয় হয় তো আর কোনোদিন
মিলবে না। রাষ্ট্রই যাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। সেই শিশু নিবাসের বাসিন্দাদের
রাষ্ট্রীয় পরিচয় পেতে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এদের একজন সমাজকল্যাণ
অধিদপ্তারের আওতাধীন ছোটমণি নিবাসের আয়া মমতাজ বেগম। কাগজে-কলমে বয়স তেইশ
বছর হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজনীয়তা কখনো অনুভব করেননি তিনি। সরকারি
প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করায় কর্মকর্তা কর্মচারীদের জাতীয়
পরিচয়পত্রের মাধ্যমে নতুন বেতন স্কেলের আওতায় আনা হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের
প্রয়োজন হওয়ায় নিজের পরিচয়পত্রের জন্য যান আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনের
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগে। পিতামাতার নাম অজ্ঞাত থাকায় জাতীয়
পরিচয় নিবন্ধন করতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে মমতাজ বেগমকে। জন্ম নিবন্ধন
কার্ডে পিতামাতার নাম অজ্ঞাত থাকায় মমতাজের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া সম্ভব নয়
বলে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়। এরপর মমতাজকে উপ-পরিচালক বরাবর দরখাস্ত করতে বলা
হয়। মমতাজ বেগম জানান, গত সপ্তাহে আবার তিনি পরিচয়পত্রের জন্য গেলে অন্য
একজন কর্মচারী তার শিশু নিবাসের সনদ, জন্ম নিবন্ধন কার্ড এবং বিভিন্ন
কাগজপত্র দেখে পরিচয়পত্রের জন্য অনুমোদন করেন। এভাবে জন্মনিবন্ধন ও জাতীয়
পরিচয়পত্র পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন জন্ম-পরিচয়হীন নাগরিকরা।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, জন্মের পরই প্রতিটি শিশুর জন্ম নিবন্ধনের জন্য
দেশে আইন করা হয়েছে। নিয়ম থাকলেও পরিত্যক্ত এবং পিতামাতার নাম অজ্ঞাত
শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। শুধু জন্ম নিবন্ধন নয়,
পিতামাতার নাম অজ্ঞাত থাকলে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্যও ভোগান্তির শিকার
হচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনাও নেই এনআইডি উইং
কর্মকর্তাদের প্রতি। জানতে চাইলে এনআইডি উইংয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আশিকুর
রহমান জানান, এখন পর্যন্ত পরিত্যক্ত কিংবা পিতামাতা অজ্ঞাত এমন কাউকে জাতীয়
পরিচয়পত্র নিতে আসেননি তাদের কাছে। তাই এই বিষয়ে কোনো ধারণা নেই তার।
তেজগাঁও শিশু পরিবারের উপ তত্ত্বাবধায়ক বেগম ঝর্ণা জাহিন জানান, অধিকাংশ
সময় বিভিন্ন বেবি হোম বা ছোটমণি নিবাস থেকে আসা শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করতে
সমস্যায় পড়তে হয়। যেসব শিশুর পিতামাতা দু’জনই অজ্ঞাত থাকে তাদের জন্ম
নিবন্ধনের জন্য সঠিক নীতিমালা নেই। তিনি জানান, জন্ম নিবন্ধন যেহেতু
শিশুদের অধিকারের অনেক বিষয় জড়িত তাই চাইলেই নিজের নাম দিয়ে এসব শিশুদের
জন্ম নিবন্ধন করা সম্ভব হয় না। যে কারণে অনেক সময় পিতামাতার নাম মৃত আদম
এবং মৃত হাওয়া দিয়েই নিবন্ধন করতে হয়। যেটা সঠিক কোন পদ্ধতি নয়। এই
উপ-তত্ত্ববধায়ক আরও জানান, অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্টাফের মৃত
দাদা-নানার নাম ব্যবহার করে পরিত্যক্ত এবং অজ্ঞাত শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করা
হয়। তবে বিভিন্ন সময় ফোরাম এবং সেমিনারে এসব নিয়ে অধীনস্থ পরিচালকদের
জানানো হলেও এখন পর্যন্ত সঠিক কোন নিতিমালা তৈরি হয়নি। প্রতিষ্ঠানের নাম
কিংবা পদবি ব্যবহার করে এইসব শিশুদের জন্ম নিবন্ধনের নিয়ম করা হলে
পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হবে না। জাহিন আরও
বলেন, যেহেতু এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাষ্টীয় খরচে বড় করা হচ্ছে। তাহলে সঠিক
নীতিমালা প্রয়োগ করে তাদের রাষ্ট্রীয় নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন।
জাতীয় পরিচয়পত্রের বিষয়ে এই উপতত্ত্বাবধায়ক জানান, জন্ম নিবন্ধন সঠিকভাবে
হলেই জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। বর্তমানে তেজগাঁও শিশু পরিবারের একশ’
পঁচাত্তর জন নিবাসীর মধ্যে বারো জনের পিতামাতার নাম অজ্ঞাত। যদিও এখন
পর্যন্ত অজ্ঞাত একজন নিবাসি তেজগাঁও শিশু পরিবার থেকে বের হয়েছেন। তবে ওই
সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন না হওয়ায় সেটা নিয়ে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
ছোটমণি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক সেলিনা আক্তার বলেন, রাষ্ট্রের খরচে একটি
বিশাল জনগোষ্ঠী বড় হচ্ছে। কিন্তু সঠিক নীতিমালা প্রয়োগ করে তাদের রাষ্টীয়
নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে না। কোন প্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া
হচ্ছে। এদের কিছু রাষ্ট্রীয় অধিকার আছে। তিনি বলেন, প্রতিনিয়তই সরকারি শিশু
পরিবার এবং ছোটমণি নিবাসে পরিত্যক্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। সরকার এই
পরিত্যক্ত জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বলে ঘোষণা করে নাগরিকত্ব না দিলে এরা
কোথায় যাবে। তিনি জানান, তার অধীনস্থ ছোটমণি নিবাসে বর্তমানে চব্বিশ জন
শিশু আছে। তাদের মধ্যে আট জনের পিতা-মাতা অজ্ঞাত দেয়া আছে। সেক্ষেত্রে
তাদের সঠিক নীতিমালা অনুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র না দেয়া হলে সরকারি সুবিধা
থেকে তারা বঞ্চিত হবে।
No comments