‘এই যে মেরুদণ্ড, একদম সোজা’ by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
বাংলাদেশে
কত যে আজব ঘটনা ঘটে, তার কোনো শেষ নেই। বিনা ভোটে যারা মন্ত্রী-এমপি
হয়েছেন, তাদের দাপটেরও শেষ নেই। অনেক ছোট ছোট মুখ অনেক বড় বড় কথা বলছে। কেউ
কেউ বুঝতেও পারছেন না, কী তার ক্ষমতা, কী তার যোগ্যতা। তাদের মধ্যে কেউ
কেউ ধরাকে একেবারে সরাজ্ঞান করছেন। কেউ কেউ বিদেশীদের বিরুদ্ধে কঠোর
ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। সেসব বিদেশী এদের হয়তো বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে
চলছেন। লজ্জা যেন অনেকের অভিধান থেকে হারিয়ে গেছে। আর এদের যারা সরকারের
ইচ্ছামাফিক ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষণা করেছেন, সেটা হলো নির্বাচন কমিশন। এদের
অনেকের ভূমিকা ইতোমধ্যে নাট্যমঞ্চের রসিকতাকে হার মানিয়ে দিয়েছে। উদাহরণ
হিসেবে বলা যায়, যখন এই নির্বাচন কমিশনকে অনেকেই মেরুদণ্ডহীন বলে অভিহিত
করছিল, তখন এই কমিশনের এক কমিশনার সাংবাদিকদের সামনে চেয়ার থেকে উঠে
দাঁড়িয়ে এক পাক ঘুরে কোমর দুলিয়ে বললেন, কই আমি মেরুদণ্ডহীন, এই যে আমার
মেরুদণ্ড আছে এবং তা এখনো সোজা। তাহলে মেরুদণ্ডহীন হলাম কোথায়? অর্থাৎ
তাদের কাণ্ডজ্ঞানে প্রচুর ঘাটতি আছে বলেই মনে হয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রহসনমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন সাজায় সরকার। এদের কেউ দুগ্ধপোষ্য শিশু নন, প্রত্যেকেরই বয়স হয়েছে। যা এদের কারো কারো ভেতরে তৈরি হয়নি, তা হলো মেরুদণ্ড ও আত্মমর্যাদাবোধ। মানুষের আত্মমর্যাদাবোধের সৃষ্টি হয় উপযুক্ত শিক্ষা থেকে। চরিত্রের দিক থেকে এরা নতজানু হিসেবে তৈরি হয়েছেন। আর সরকারও খুঁজে খুঁজে এমন প্রার্থীদেরই এনে নির্বাচন কমিশনে বসিয়েছে। এরা যে ধরনের লোকই হোন না কেন, যে পদে তাদের বসানো হয়েছে, তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি উপলব্ধি করার ক্ষমতাও যেন এদের নেই। ফলে ব্যর্থ হয়ে গেল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকুতি : ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’। মেরুদণ্ডহীনদের হাতে পতাকা তুলে দেয়া হলো বটে, কিন্তু সে পতাকার ভার বইবার শক্তি তাদের ছিল না। ফলে তারা কুণ্ডুলি পাকিয়ে গুটিয়ে গেলেন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দল ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। ফলে ভোটকেন্দ্রে আসেনি তেমন কেউ। নির্বাচনকেন্দ্র্রে কুকুরদের নরম রোদ পোহাতে দেখা গেছে। চেয়ার পেতে অলস বসেছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঘুমিয়ে ছিলেন পোলিং অফিসাররা। নারী ভলান্টিয়াররা মগ্ন ছিলেন খোশগল্পে। পাঁচ শতাংশও ভোট পড়ল না কেন্দ্রগুলোতে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেননি। বিনা ভোটে পছন্দের লোকেরা এমপি হয়ে গেছেন নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায়। প্রায় ৫০ কেন্দ্রে একজন লোকও ভোট দেয়নি। এমনকি সেখানে আওয়ামী লীগসহ তাদের মহাজোটের কয়েক হালি করে কর্মী-সমর্থক উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন পোলিং এজেন্টরা। কিন্তু তারা কেউ নিজের ভোট দেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করেননি। অর্থাৎ নির্বাচনের নামে যে তামাশা হচ্ছিল সেটা তারাও উপলব্ধি করেছিলেন। কেবল উপলব্ধি করতে পারলেন না নির্বাচন কমিশনার। তারা বেশ কয়েক দিন পর সরকারের ইচ্ছামাফিক গরমিলের হিসাবে বলে দিলেন, নির্বাচনে ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে! আত্মমর্যাদাবান তো দূরের কথা, তাদের সুস্থ মানুষ ভাবতেও কষ্ট হয়।
এই নির্বাচন দেখে সারা পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক। গোটা দুনিয়া বলল, এটা কোনো নির্বাচনই হয়নি। বাংলাদেশ যে একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এটা প্রমাণ করতে চাইলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। সরকার প্রথম দিকে মিনমিন করছিল- এটা নিয়ম রক্ষার, সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। শিগগিরই আরেকটি নির্বাচন দেয়া হবে।’ এই সরকারকে স্বীকৃতি দিলো একমাত্র ভারত। আওয়ামী লীগ সরকারকে জেতানোর জন্য ভারতের কংগ্রেস সরকার করেনি এমন কোনো কাণ্ড নেই। নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড় এরশাদকে নির্বাচনে নিতে মনমোহন সরকার তার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠিয়ে রীতিমতো থ্রেট করে গেলেন। এরশাদ সে কথা মিডিয়ায় প্রকাশও করে দিলেন। যা হোক, ভারতের সমর্থনে সরকার মনে করল- বিশ্বজয় হয়ে গেছে। তারপর সরকারের লোকেরা একেবারে বজ্রকণ্ঠে বলতে থাকলেন, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো সংসদ নির্বাচন নয়। আর সে নির্বাচনও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতোই শেখ হাসিনার অধীনেই হবে।’
তখন আনাড়ি বিশ্লেষকদের মিনমিনে একটি সমালোচনাও ছিল যে, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছে। সরকার বলল, বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এরপর একে একেবারেই ধুলায় মিশিয়ে দিতে মামলা-হামলা, গুম-খুন শুরু করল। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পোরা হলো। মহাসমারোহে শুরু হলো স্বেচ্ছাচারী শাসনকাল।
এতে বিএনপির জন্য সঙ্কটের সৃষ্টি তো হলোই; তারপর এলো উপজেলা নির্বাচন। এ কথা একটি শিশুও বোঝে যে, দেশে যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন দেশ সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখল সুষ্ঠু নির্বাচন ও একটি নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। অনেকেই আশা করতে থাকলেন, এত ঘটনার পর বোধ করি উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। অতএব, এই নির্বাচনে বিএনপির যাওয়া উচিত। তিন দফায় সে নির্বাচনের ঘোষণা দিলো নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফা নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের তুলনায় সিকি ভোটও পেলেন না আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা। সরকার কিংবা তার পছন্দসই নির্বাচন কমিশন হয়তো ধারণাও করতে পারেনি যে, কী বিপুল ধস নেমেছে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায়। তাই সম্ভবত ভোটডাকাতির চিন্তা তখন এত ব্যাপকভাবে করা হয়নি। ফলে জনগণ তাদের জবাব দিয়ে দিলো।
উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন যুক্তি করে ভোট কারচুপি ও কেন্দ্র দখলে নেমে পড়ল। র্যাব-পুলিশ-বিজিবি এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগসহ নানা কিসিমের লীগ সেই সাথে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা একত্র হয়ে ভোটডাকাতি ঘটতে থাকে। বিরোধী দলের ভোটারদের যেতে দিলো না বুথের আশপাশেও। ভোটকেন্দ্র দখল করে গণহারে সিল মারল আওয়ামী লীগের ব্যালটে। নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া গেল না। তারা পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো ব্যবস্থাই নিলেন না। তারা যেসব বিধিবিধান করেছিলেন, সেগুলো রয়ে গেল কিতাবের পাতায়। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না। তাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার নির্বাচনে বেশিসংখ্যক আসনে জয়ী ঘোষণা করা হলো আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের। সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে মানুষ দুয়ো দিলো। কিন্তু দু’কান কাটার লজ্জা থাকে না। নির্বাচন কমিশন এবার রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
এখন দেশে ২৩৫টি পৌরসভায় নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন বুঝে গেছে, এ যাত্রায় সুষ্ঠুভাবে ভোট হতে দিলে সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থনহীনতা প্রকাশ হয়ে পড়বে। আর সে কারণেই ভোট কারচুপি আর জাল ভোট গণহারে সিল মারা প্রভৃতির সুবিধার্থে ঘোষণা করা হলো, পৌরসভা নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। অর্থাৎ প্রার্থীরা নিজ নিজ দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবেন। সরকার এ নিয়ে তাড়াহুড়া করে একটি ত্রুটিপূর্ণ অধ্যাদেশ জারি করাল। তাতে বলা হলো, পৌর মেয়র ও সব কমিশনার নির্বাচন করবেন দলীয় প্রতীক নিয়ে। পরে দেখা গেল, সেটা একেবারেই অসম্ভব। ফলে সংশোধনী আনা হলো। না, শুধু মেয়ররা নির্বাচন করবেন দলীয় প্রতীকে। বাকিরা দলীয় প্রতীক পাবেন না। বারবার পরিবর্তন করতে হলো সিদ্ধান্ত। সরকারের আনাড়িপনার এটাও এক নগ্ন উদাহরণ। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলারও প্রয়োজন অনুভব করেনি। সরকার যা বলেছে, একান্ত বাধ্যগতের মতো তাই করে গেছে নির্দ্বিধায়। আবার সরকারি নির্দেশ মতোই তাদের দু’বার বিধিবিধান সংশোধন করতে হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি এবং সরকারের শরিক এরশাদ ও মেনন প্রস্তুতির জন্য নির্বাচন দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানালে কমিশন তা বিনা বাক্যব্যয়ে বাতিল করে দেয়। তারা অনুগত সরকারের; বিএনপি, এরশাদ বা মেননের নয়।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের জন্য নানা ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তা ছাড়া আগের আইনকানুন তো রয়েছেই। সেসব আইনকানুনের মধ্যে রয়েছে, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলে কাউকে বাধা দেয়া যাবে না। কোনো ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া যাবে না। কোনো মন্ত্রী-এমপি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না; ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন মাত্র মেয়র প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবেন দলের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু দেখা গেল আওয়ামী লীগ নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, তার মনোনয়ন কোনো কারণে বাতিল হয়ে গেছে। তখন নতুন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলেন নেত্রী আর নির্বাচন কমিশন সুড়সুড় করে তা মেনে নিলো। বিভিন্ন স্থানে বিএনপির শতাধিক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমাই দিতে দেয়া হলো না। সে অভিযোগ আমলে নিলো না নির্বাচন কমিশন। মনে হয় যেন ভাবখানা এ রকম যে, ‘তোমাদের তো জিততে দেয়া হচ্ছে না, তাহলে এত হল্লাচিল্লা করছ কেন। তফাত যাও।’ এমনকি আওয়ামী সরকারের অংশ এরশাদ পর্যন্ত অভিযোগ করেছেন, সরকারি দলের লোকেরা তার দলের প্রার্থীদেরও মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়নি। শুধু ফেনীতেই ৩৪টি আসনে কাউকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে এ দলের ৩৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েগেছেন।
এ দিকে কমিশন রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে প্রশাসনিক ক্যাডারদের। এক কমিশনার যুক্তি দেখালেন, তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞ কর্মকর্তা না থাকায় তারা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ধার করেছেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, ইসি আর প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মিলেমিশে একটি চমৎকার নির্বাচন উপহার দেবেন। কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার মুরোদ আছে, সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়? তারা ইতোমধ্যেই এমন কাজ করেছেন। তারা বিএনপি প্রার্থীর হলফনামা সরিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে বলেছেন, ‘তথ্যে ভুল আছে। অতএব, বিএনপি প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল।’ অথচ এসব নিয়ে ইসি একেবারেই নিশ্চুপ। উপরন্তু এই নির্বাচন কমিশন হাস্যকর রুচিহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তা না হলে তারা নারীদের নির্বাচনী প্রতীক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফ্রক, চুড়ি, পুতুল, চুলা প্রভৃতি প্রতীক বরাদ্দের সাহস পেতেন না। নারীর প্রতি এই অবমাননার দায়ে তাদের কমিশন থেকে অব্যাহতি নেয়া উচিত ছিল।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন দুই মন্ত্রী। এমপিরা তো হামেশাই করছেন। ওই দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে দায় এড়িয়ে যান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। যেন বিষয়টি দেখার দায়িত্ব তাদের নয়। নিজেদের দায়িত্ব তারা চাপিয়ে দিয়েছেন রিটার্নিং অফিসারদের ওপর। সরকারি কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, এটা কেউ চিন্তাও করতে পারেন না। আর সেটাই ভাবছে নির্বাচন কমিশন। এই কমিশন আর তাদের একই প্রকৃতির রিটার্নিং অফিসার দিয়ে হবে সুষ্ঠু নির্বাচন? দেশের মানুষ এতটা অবিবেচক হয়নি যে, এই নির্বাচন কমিশনকে তারা বিশ্বাস করে বসবে।
অতএব, পৌর নির্বাচনও সম্ভবত হতে যাচ্ছে এক বিশাল প্রহসন। আর ইতিহাস সাক্ষী, এ রকম ধড়িবাজদের পরিণতি সাধারণত বড়ই করুণ হয়ে থাকে। অতএব, সামনে ঘোর দুঃসময়!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রহসনমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন সাজায় সরকার। এদের কেউ দুগ্ধপোষ্য শিশু নন, প্রত্যেকেরই বয়স হয়েছে। যা এদের কারো কারো ভেতরে তৈরি হয়নি, তা হলো মেরুদণ্ড ও আত্মমর্যাদাবোধ। মানুষের আত্মমর্যাদাবোধের সৃষ্টি হয় উপযুক্ত শিক্ষা থেকে। চরিত্রের দিক থেকে এরা নতজানু হিসেবে তৈরি হয়েছেন। আর সরকারও খুঁজে খুঁজে এমন প্রার্থীদেরই এনে নির্বাচন কমিশনে বসিয়েছে। এরা যে ধরনের লোকই হোন না কেন, যে পদে তাদের বসানো হয়েছে, তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি উপলব্ধি করার ক্ষমতাও যেন এদের নেই। ফলে ব্যর্থ হয়ে গেল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকুতি : ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’। মেরুদণ্ডহীনদের হাতে পতাকা তুলে দেয়া হলো বটে, কিন্তু সে পতাকার ভার বইবার শক্তি তাদের ছিল না। ফলে তারা কুণ্ডুলি পাকিয়ে গুটিয়ে গেলেন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দল ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। ফলে ভোটকেন্দ্রে আসেনি তেমন কেউ। নির্বাচনকেন্দ্র্রে কুকুরদের নরম রোদ পোহাতে দেখা গেছে। চেয়ার পেতে অলস বসেছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঘুমিয়ে ছিলেন পোলিং অফিসাররা। নারী ভলান্টিয়াররা মগ্ন ছিলেন খোশগল্পে। পাঁচ শতাংশও ভোট পড়ল না কেন্দ্রগুলোতে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেননি। বিনা ভোটে পছন্দের লোকেরা এমপি হয়ে গেছেন নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায়। প্রায় ৫০ কেন্দ্রে একজন লোকও ভোট দেয়নি। এমনকি সেখানে আওয়ামী লীগসহ তাদের মহাজোটের কয়েক হালি করে কর্মী-সমর্থক উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন পোলিং এজেন্টরা। কিন্তু তারা কেউ নিজের ভোট দেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করেননি। অর্থাৎ নির্বাচনের নামে যে তামাশা হচ্ছিল সেটা তারাও উপলব্ধি করেছিলেন। কেবল উপলব্ধি করতে পারলেন না নির্বাচন কমিশনার। তারা বেশ কয়েক দিন পর সরকারের ইচ্ছামাফিক গরমিলের হিসাবে বলে দিলেন, নির্বাচনে ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে! আত্মমর্যাদাবান তো দূরের কথা, তাদের সুস্থ মানুষ ভাবতেও কষ্ট হয়।
এই নির্বাচন দেখে সারা পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক। গোটা দুনিয়া বলল, এটা কোনো নির্বাচনই হয়নি। বাংলাদেশ যে একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এটা প্রমাণ করতে চাইলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। সরকার প্রথম দিকে মিনমিন করছিল- এটা নিয়ম রক্ষার, সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। শিগগিরই আরেকটি নির্বাচন দেয়া হবে।’ এই সরকারকে স্বীকৃতি দিলো একমাত্র ভারত। আওয়ামী লীগ সরকারকে জেতানোর জন্য ভারতের কংগ্রেস সরকার করেনি এমন কোনো কাণ্ড নেই। নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড় এরশাদকে নির্বাচনে নিতে মনমোহন সরকার তার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠিয়ে রীতিমতো থ্রেট করে গেলেন। এরশাদ সে কথা মিডিয়ায় প্রকাশও করে দিলেন। যা হোক, ভারতের সমর্থনে সরকার মনে করল- বিশ্বজয় হয়ে গেছে। তারপর সরকারের লোকেরা একেবারে বজ্রকণ্ঠে বলতে থাকলেন, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো সংসদ নির্বাচন নয়। আর সে নির্বাচনও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতোই শেখ হাসিনার অধীনেই হবে।’
তখন আনাড়ি বিশ্লেষকদের মিনমিনে একটি সমালোচনাও ছিল যে, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে ভুল করেছে। সরকার বলল, বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এরপর একে একেবারেই ধুলায় মিশিয়ে দিতে মামলা-হামলা, গুম-খুন শুরু করল। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পোরা হলো। মহাসমারোহে শুরু হলো স্বেচ্ছাচারী শাসনকাল।
এতে বিএনপির জন্য সঙ্কটের সৃষ্টি তো হলোই; তারপর এলো উপজেলা নির্বাচন। এ কথা একটি শিশুও বোঝে যে, দেশে যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন দেশ সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখল সুষ্ঠু নির্বাচন ও একটি নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। অনেকেই আশা করতে থাকলেন, এত ঘটনার পর বোধ করি উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। অতএব, এই নির্বাচনে বিএনপির যাওয়া উচিত। তিন দফায় সে নির্বাচনের ঘোষণা দিলো নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফা নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের তুলনায় সিকি ভোটও পেলেন না আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা। সরকার কিংবা তার পছন্দসই নির্বাচন কমিশন হয়তো ধারণাও করতে পারেনি যে, কী বিপুল ধস নেমেছে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায়। তাই সম্ভবত ভোটডাকাতির চিন্তা তখন এত ব্যাপকভাবে করা হয়নি। ফলে জনগণ তাদের জবাব দিয়ে দিলো।
উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন যুক্তি করে ভোট কারচুপি ও কেন্দ্র দখলে নেমে পড়ল। র্যাব-পুলিশ-বিজিবি এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগসহ নানা কিসিমের লীগ সেই সাথে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা একত্র হয়ে ভোটডাকাতি ঘটতে থাকে। বিরোধী দলের ভোটারদের যেতে দিলো না বুথের আশপাশেও। ভোটকেন্দ্র দখল করে গণহারে সিল মারল আওয়ামী লীগের ব্যালটে। নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া গেল না। তারা পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো ব্যবস্থাই নিলেন না। তারা যেসব বিধিবিধান করেছিলেন, সেগুলো রয়ে গেল কিতাবের পাতায়। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না। তাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার নির্বাচনে বেশিসংখ্যক আসনে জয়ী ঘোষণা করা হলো আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের। সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে মানুষ দুয়ো দিলো। কিন্তু দু’কান কাটার লজ্জা থাকে না। নির্বাচন কমিশন এবার রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
এখন দেশে ২৩৫টি পৌরসভায় নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন বুঝে গেছে, এ যাত্রায় সুষ্ঠুভাবে ভোট হতে দিলে সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থনহীনতা প্রকাশ হয়ে পড়বে। আর সে কারণেই ভোট কারচুপি আর জাল ভোট গণহারে সিল মারা প্রভৃতির সুবিধার্থে ঘোষণা করা হলো, পৌরসভা নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। অর্থাৎ প্রার্থীরা নিজ নিজ দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবেন। সরকার এ নিয়ে তাড়াহুড়া করে একটি ত্রুটিপূর্ণ অধ্যাদেশ জারি করাল। তাতে বলা হলো, পৌর মেয়র ও সব কমিশনার নির্বাচন করবেন দলীয় প্রতীক নিয়ে। পরে দেখা গেল, সেটা একেবারেই অসম্ভব। ফলে সংশোধনী আনা হলো। না, শুধু মেয়ররা নির্বাচন করবেন দলীয় প্রতীকে। বাকিরা দলীয় প্রতীক পাবেন না। বারবার পরিবর্তন করতে হলো সিদ্ধান্ত। সরকারের আনাড়িপনার এটাও এক নগ্ন উদাহরণ। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলারও প্রয়োজন অনুভব করেনি। সরকার যা বলেছে, একান্ত বাধ্যগতের মতো তাই করে গেছে নির্দ্বিধায়। আবার সরকারি নির্দেশ মতোই তাদের দু’বার বিধিবিধান সংশোধন করতে হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি এবং সরকারের শরিক এরশাদ ও মেনন প্রস্তুতির জন্য নির্বাচন দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানালে কমিশন তা বিনা বাক্যব্যয়ে বাতিল করে দেয়। তারা অনুগত সরকারের; বিএনপি, এরশাদ বা মেননের নয়।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের জন্য নানা ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তা ছাড়া আগের আইনকানুন তো রয়েছেই। সেসব আইনকানুনের মধ্যে রয়েছে, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলে কাউকে বাধা দেয়া যাবে না। কোনো ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া যাবে না। কোনো মন্ত্রী-এমপি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না; ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন মাত্র মেয়র প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবেন দলের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে। কিন্তু দেখা গেল আওয়ামী লীগ নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, তার মনোনয়ন কোনো কারণে বাতিল হয়ে গেছে। তখন নতুন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলেন নেত্রী আর নির্বাচন কমিশন সুড়সুড় করে তা মেনে নিলো। বিভিন্ন স্থানে বিএনপির শতাধিক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমাই দিতে দেয়া হলো না। সে অভিযোগ আমলে নিলো না নির্বাচন কমিশন। মনে হয় যেন ভাবখানা এ রকম যে, ‘তোমাদের তো জিততে দেয়া হচ্ছে না, তাহলে এত হল্লাচিল্লা করছ কেন। তফাত যাও।’ এমনকি আওয়ামী সরকারের অংশ এরশাদ পর্যন্ত অভিযোগ করেছেন, সরকারি দলের লোকেরা তার দলের প্রার্থীদেরও মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়নি। শুধু ফেনীতেই ৩৪টি আসনে কাউকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে এ দলের ৩৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েগেছেন।
এ দিকে কমিশন রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে প্রশাসনিক ক্যাডারদের। এক কমিশনার যুক্তি দেখালেন, তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞ কর্মকর্তা না থাকায় তারা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ধার করেছেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, ইসি আর প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মিলেমিশে একটি চমৎকার নির্বাচন উপহার দেবেন। কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার মুরোদ আছে, সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়? তারা ইতোমধ্যেই এমন কাজ করেছেন। তারা বিএনপি প্রার্থীর হলফনামা সরিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে বলেছেন, ‘তথ্যে ভুল আছে। অতএব, বিএনপি প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল।’ অথচ এসব নিয়ে ইসি একেবারেই নিশ্চুপ। উপরন্তু এই নির্বাচন কমিশন হাস্যকর রুচিহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তা না হলে তারা নারীদের নির্বাচনী প্রতীক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফ্রক, চুড়ি, পুতুল, চুলা প্রভৃতি প্রতীক বরাদ্দের সাহস পেতেন না। নারীর প্রতি এই অবমাননার দায়ে তাদের কমিশন থেকে অব্যাহতি নেয়া উচিত ছিল।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন দুই মন্ত্রী। এমপিরা তো হামেশাই করছেন। ওই দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে দায় এড়িয়ে যান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। যেন বিষয়টি দেখার দায়িত্ব তাদের নয়। নিজেদের দায়িত্ব তারা চাপিয়ে দিয়েছেন রিটার্নিং অফিসারদের ওপর। সরকারি কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, এটা কেউ চিন্তাও করতে পারেন না। আর সেটাই ভাবছে নির্বাচন কমিশন। এই কমিশন আর তাদের একই প্রকৃতির রিটার্নিং অফিসার দিয়ে হবে সুষ্ঠু নির্বাচন? দেশের মানুষ এতটা অবিবেচক হয়নি যে, এই নির্বাচন কমিশনকে তারা বিশ্বাস করে বসবে।
অতএব, পৌর নির্বাচনও সম্ভবত হতে যাচ্ছে এক বিশাল প্রহসন। আর ইতিহাস সাক্ষী, এ রকম ধড়িবাজদের পরিণতি সাধারণত বড়ই করুণ হয়ে থাকে। অতএব, সামনে ঘোর দুঃসময়!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
No comments