অপরাধীর পোয়াবারো by শেখ মামুনূর রশীদ
দায় চাপানোর সংস্কৃতি: রাজনীতিতে
দায় চাপানোর সংস্কৃতির মাশুল দিচ্ছে দেশের জনগণ। বড় দুই দলের নেতারাই
তীব্রভাবে এ অভ্যাসের চর্চা করছেন। বড় কোনো ঘটনার পরপরই অন্য দলের ওপর দোষ
চাপাতে মরিয়া হয়ে উঠছেন ক্ষমতাসীনরা। ফলে অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা প্রথম থেকেই
পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তারা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, বোমাবাজিসহ লোমহর্ষক ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এতে
রাজনীতির কাঠামোই দুর্বল হয়ে পড়ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। সমাজে তৈরি হচ্ছে
অস্থিতিশীলতা। মানুষের মাঝে বাড়ছে আতংক।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, শীর্ষ আইনজীবীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মতে, দায় চাপানোর সংস্কৃতিতে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে অপরাধীরা। কাজেই সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া পাল্টাপাল্টি আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি এক সময় দুই দলেরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, যা কারও জন্যই সুখকর হবে না। লাভবান হবে কেবল সুযোগসন্ধানী তৃতীয় পক্ষ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, আইনের শাসন আছে এমন দেশে এ ধরনের দায় চাপানোর সংস্কৃতি সত্যিই নজিরবিহীন ঘটনা। সভ্য দেশে এ রকমটা ভাবাই যায় না। তিনি আরও বলেন, প্রকাশক হত্যার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দায়ী করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রমাণ আছে বলেই তিনি এ দাবি করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘটনার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে দু’পক্ষই ঢালাও মন্তব্য করে চলেছে। এ হত্যার তদন্ত কাজ এখনও শেষ হয়নি। তার আগেই তারা কিভাবে জানলেন এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত? এম হাফিজ উদ্দিন বলেন, এ ধরনের দায় চাপানোর সংস্কৃতি আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করবে। জনমনে আতংক ও অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর দায় চাপানোর ঘটনা অপরাধীদের কাছে হবে পোয়াবারো।
শনিবার রাজধানীতে প্রায় একই সময়ে চার প্রকাশকের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এদিন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অভিজিৎ রায়ের বইয়ের আরেক প্রকাশক শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ আরও তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ব্লগার হত্যার পর এখন প্রকাশক হত্যার ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হামলার ঘটনা তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই পরস্পরের ওপর দায় চাপানো শুরু করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অথচ এ ঘটনার দায় স্বীকার করে যারা বিবৃতি দিয়েছে সেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। যারা স্বেচ্ছায় হামলার দায় মাথায় নিচ্ছে পুলিশ তাদেরই সন্দেহের চোখে দেখছে। তদন্তের নামে পুলিশ অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগ বলছে, এ হামলার সঙ্গে বিএনপি- জামায়াত জড়িত। এর আগে আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার পরও দায় চাপানো হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত শেষ হয়নি। ইতালি ও জাপানের দুই নাগরিক হত্যার পর দায় চাপানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয় দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। দুই দলের শীর্ষ নেতারা কাছাকাছি সময়ে দেশে ও বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে দায় চাপান।
প্রকাশক হত্যার পর আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন বিষয়টির রহস্য ভেদ করতে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে ঠিক তখন এ ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারন খালেদা জিয়া জড়িত বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি দুই বিদেশী ও প্রকাশক হত্যাকাণ্ডকে গুপ্তহত্যা আখ্যায়িত করে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে খালেদা জিয়া বিদেশে বসে দেশে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছেন।’ অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে নাগরিক সভায় দেশে দুরবস্থার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘আজকের এ অবস্থার জন্য সম্পূর্ণরূপে শেখ হাসিনা দায়ী।’ শেখ হাসিনার পাশাপাশি তার সরকারের মন্ত্রীরাও বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দুষছেন। একইভাবে বিএনপির নেতারাও দায় চাপাচ্ছেন সরকারি দল এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর। শীর্ষ নেতাদের দায় চাপানোর প্রবণতা প্রভাব বিস্তার করেছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে। নেতারা পরস্পরের ওপর দায় চাপানোর জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন। ফলে প্রকৃত অপরাধীর নাম হারিয়ে যায়। একপর্যায়ে দেশের সাধারণ মানুষগুলো বিশ্বাস করতে থাকে বড় অপরাধগুলোর সঙ্গে সন্ত্রাসীরা নয়, রাজনৈতিক দলের নেতারাই জড়িত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির কারণে তদন্তের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা অনেক সময় প্রভাবিত হন। তারা মনে করেন ক্ষমতাসীনরা বলছেন, ঘটনার সঙ্গে অন্য দল জড়িত। সেখানে প্রকৃত অপরাধী যার সঙ্গে ওই দলের কোনো সম্পর্ক নেই তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। এ ভয় পুলিশের প্রায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্যেই কাজ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দায় চাপানোর প্রবণতা নতুন নয়। এর আগের সরকারগুলোর আমলেও হয়েছে। যে কারণে আলোচিত অনেক ঘটনার তদন্ত হয়নি। গ্রেফতার হয়নি প্রকৃত অপরাধীরা। আইনশৃংখলা বাহিনী ক্ষমতাসীনদের বক্তৃতায় দেখানো পথের বাইরে গিয়ে তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারেনি। যে কারণে এখনও আগের মতো অপরাধগুলো প্রায় একইভাবে সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু অপরাধীরা নেতাদের বক্তৃতার মারপ্যাঁচে পার পেয়ে যাচ্ছে। আগে যেমন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানো হয়েছে। বর্তমানেও সেই পুরনো ধারাই অব্যাহত আছে। একজনের অপরাধ অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা চলছে। আগে যেমন ছাত্রদল, যুবদলের সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ সন্ত্রাসী কাজে জড়িত ছিল। এখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একই ধরনের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি করছে। দখল প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় এবং শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এদের প্রশ্রয় না দিলেই এগুলো বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
দুই বড় দলের চিরবৈরিতা এবং পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও দায় চাপানোর এ সংস্কৃতিতে উদ্বিগ্ন রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, শীর্ষ আইনজীবীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এই ধারা দেশকে ক্রমেই সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দাবি করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া একে অপরের ওপর দায় চাপানো স্পষ্টতই অবিবেচনাপ্রসূত মানসিকতা। এতে করে রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে। দেশ সংঘর্ষের দিকে ধাবিত হবে। তিনি বলেন, দুই বিদেশী নাগরিক ও প্রকাশক হত্যার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি খালেদা জিয়াকে দায়ী করেছেন। এতে করে তদন্ত কাজ প্রভাবিত হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তারাও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত করতে চাইবেন না। ফলে প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যাবে। তারা আরও অধিক মাত্রায় উৎসাহী হয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করবে।
শীর্ষ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক যুগান্তরকে বলেন, দায় চাপানোর রাজনীতি দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে। যার সুযোগ নিচ্ছে তৃতীয় পক্ষসহ সুযোগসন্ধানীরা। তিনি আরও বলেন, ‘ঢালাওভাবে দায় চাপানোর সংস্কৃতি বন্ধ করা না গেলে জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশংকা আছে। অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের মতোন বাংলাদেশও হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই একে অন্যের দিকে অভিযোগের আঙুল না তুলে, নিজেরা ঝগড়া বিবাদ না করে আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত।’ ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, ‘শেখ হাসিনা কি বলল, খালেদা জিয়া কি বলল কিংবা আমি কি বললাম- তা না ভেবে, না দেখে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার উচিত স্বাধীনভাবে কাজ করা। ঘটনার কারণ খুঁজে বের করা। প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা একপক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করেন। এটা শুধু বাংলাদেশই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এমন সংস্কৃতি বিরাজমান। কিন্তু জাতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে, বিশেষ করে নিরাপত্তা ইস্যুতে সবাইকে এক সুরে কথা বলতে হবে। বিষয়টি অভিন্ন স্বার্থেই ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, যে যাই বলুক না কেন- বাস্তবতা হচ্ছে দেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এসব ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বা একই গোষ্ঠী যে এ কাজ করছে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা কে কি বললেন সেদিকে তাকিয়ে না থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজ হবে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা। ঘটনার রহস্য ভেদ করা। তা না হলে ক্রমেই আমরা আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠব।
দায় চাপানোর এই সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে বলে দাবি করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। যুগান্তরকে তিনি বলেন, কিছু হলেই দুই বড় দল একে অপরকে দোষারোপ করছে। দুই দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। দায় চাপাচ্ছেন, যা কখনোই শুভ লক্ষণ হতে পারে না। ড. বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নেতা-নেত্রীরা একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। এতে করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। পাশাপাশি জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এদের বিস্তার ঘটবে, যা কারও জন্যই সুখকর হবে না। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্তরা কখনোই কারও বন্ধু হতে পারে না। কেউ যদি তাদের বন্ধু ভাবেন তাহলে তারা ভুল করবেন। একইভাবে কেউ যদি তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন তাহলে তারাও ভুল করছেন। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ঢালাওভাবে একে অন্যের ওপর দায় না চাপিয়ে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন এখন সময়ের দাবি। তা না হলে সংঘাত-সহিংসতা বাড়তেই থাকবে।
এ প্রসঙ্গে সপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কিছু হলেই প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং নীতিনির্ধারকরা বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর সরাসরি দায় চাপাচ্ছেন। এতে করে তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। আর তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। ফলে যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা আড়ালেই থেকে যায়। প্রকৃত রহস্য কখনোই উন্মোচিত হয় না। তিনি বলেন, তথ্য-প্রমাণ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে কারও ওপর দায় না চাপিয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, শীর্ষ আইনজীবীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মতে, দায় চাপানোর সংস্কৃতিতে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে অপরাধীরা। কাজেই সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া পাল্টাপাল্টি আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি এক সময় দুই দলেরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, যা কারও জন্যই সুখকর হবে না। লাভবান হবে কেবল সুযোগসন্ধানী তৃতীয় পক্ষ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, আইনের শাসন আছে এমন দেশে এ ধরনের দায় চাপানোর সংস্কৃতি সত্যিই নজিরবিহীন ঘটনা। সভ্য দেশে এ রকমটা ভাবাই যায় না। তিনি আরও বলেন, প্রকাশক হত্যার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দায়ী করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রমাণ আছে বলেই তিনি এ দাবি করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘটনার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে দু’পক্ষই ঢালাও মন্তব্য করে চলেছে। এ হত্যার তদন্ত কাজ এখনও শেষ হয়নি। তার আগেই তারা কিভাবে জানলেন এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত? এম হাফিজ উদ্দিন বলেন, এ ধরনের দায় চাপানোর সংস্কৃতি আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করবে। জনমনে আতংক ও অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর দায় চাপানোর ঘটনা অপরাধীদের কাছে হবে পোয়াবারো।
শনিবার রাজধানীতে প্রায় একই সময়ে চার প্রকাশকের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এদিন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অভিজিৎ রায়ের বইয়ের আরেক প্রকাশক শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ আরও তিনজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ব্লগার হত্যার পর এখন প্রকাশক হত্যার ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হামলার ঘটনা তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই পরস্পরের ওপর দায় চাপানো শুরু করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অথচ এ ঘটনার দায় স্বীকার করে যারা বিবৃতি দিয়েছে সেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। যারা স্বেচ্ছায় হামলার দায় মাথায় নিচ্ছে পুলিশ তাদেরই সন্দেহের চোখে দেখছে। তদন্তের নামে পুলিশ অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগ বলছে, এ হামলার সঙ্গে বিএনপি- জামায়াত জড়িত। এর আগে আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার পরও দায় চাপানো হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত শেষ হয়নি। ইতালি ও জাপানের দুই নাগরিক হত্যার পর দায় চাপানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয় দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। দুই দলের শীর্ষ নেতারা কাছাকাছি সময়ে দেশে ও বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে দায় চাপান।
প্রকাশক হত্যার পর আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন বিষয়টির রহস্য ভেদ করতে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে ঠিক তখন এ ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারন খালেদা জিয়া জড়িত বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি দুই বিদেশী ও প্রকাশক হত্যাকাণ্ডকে গুপ্তহত্যা আখ্যায়িত করে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে খালেদা জিয়া বিদেশে বসে দেশে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছেন।’ অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে নাগরিক সভায় দেশে দুরবস্থার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘আজকের এ অবস্থার জন্য সম্পূর্ণরূপে শেখ হাসিনা দায়ী।’ শেখ হাসিনার পাশাপাশি তার সরকারের মন্ত্রীরাও বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দুষছেন। একইভাবে বিএনপির নেতারাও দায় চাপাচ্ছেন সরকারি দল এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর। শীর্ষ নেতাদের দায় চাপানোর প্রবণতা প্রভাব বিস্তার করেছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে। নেতারা পরস্পরের ওপর দায় চাপানোর জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন। ফলে প্রকৃত অপরাধীর নাম হারিয়ে যায়। একপর্যায়ে দেশের সাধারণ মানুষগুলো বিশ্বাস করতে থাকে বড় অপরাধগুলোর সঙ্গে সন্ত্রাসীরা নয়, রাজনৈতিক দলের নেতারাই জড়িত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির কারণে তদন্তের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা অনেক সময় প্রভাবিত হন। তারা মনে করেন ক্ষমতাসীনরা বলছেন, ঘটনার সঙ্গে অন্য দল জড়িত। সেখানে প্রকৃত অপরাধী যার সঙ্গে ওই দলের কোনো সম্পর্ক নেই তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। এ ভয় পুলিশের প্রায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্যেই কাজ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দায় চাপানোর প্রবণতা নতুন নয়। এর আগের সরকারগুলোর আমলেও হয়েছে। যে কারণে আলোচিত অনেক ঘটনার তদন্ত হয়নি। গ্রেফতার হয়নি প্রকৃত অপরাধীরা। আইনশৃংখলা বাহিনী ক্ষমতাসীনদের বক্তৃতায় দেখানো পথের বাইরে গিয়ে তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারেনি। যে কারণে এখনও আগের মতো অপরাধগুলো প্রায় একইভাবে সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু অপরাধীরা নেতাদের বক্তৃতার মারপ্যাঁচে পার পেয়ে যাচ্ছে। আগে যেমন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানো হয়েছে। বর্তমানেও সেই পুরনো ধারাই অব্যাহত আছে। একজনের অপরাধ অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা চলছে। আগে যেমন ছাত্রদল, যুবদলের সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ সন্ত্রাসী কাজে জড়িত ছিল। এখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একই ধরনের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি করছে। দখল প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাঙ্গনসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় এবং শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এদের প্রশ্রয় না দিলেই এগুলো বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
দুই বড় দলের চিরবৈরিতা এবং পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও দায় চাপানোর এ সংস্কৃতিতে উদ্বিগ্ন রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, শীর্ষ আইনজীবীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এই ধারা দেশকে ক্রমেই সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দাবি করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া একে অপরের ওপর দায় চাপানো স্পষ্টতই অবিবেচনাপ্রসূত মানসিকতা। এতে করে রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে। দেশ সংঘর্ষের দিকে ধাবিত হবে। তিনি বলেন, দুই বিদেশী নাগরিক ও প্রকাশক হত্যার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি খালেদা জিয়াকে দায়ী করেছেন। এতে করে তদন্ত কাজ প্রভাবিত হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তারাও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত করতে চাইবেন না। ফলে প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যাবে। তারা আরও অধিক মাত্রায় উৎসাহী হয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করবে।
শীর্ষ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক যুগান্তরকে বলেন, দায় চাপানোর রাজনীতি দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে। যার সুযোগ নিচ্ছে তৃতীয় পক্ষসহ সুযোগসন্ধানীরা। তিনি আরও বলেন, ‘ঢালাওভাবে দায় চাপানোর সংস্কৃতি বন্ধ করা না গেলে জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশংকা আছে। অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের মতোন বাংলাদেশও হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই একে অন্যের দিকে অভিযোগের আঙুল না তুলে, নিজেরা ঝগড়া বিবাদ না করে আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত।’ ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, ‘শেখ হাসিনা কি বলল, খালেদা জিয়া কি বলল কিংবা আমি কি বললাম- তা না ভেবে, না দেখে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার উচিত স্বাধীনভাবে কাজ করা। ঘটনার কারণ খুঁজে বের করা। প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা একপক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করেন। এটা শুধু বাংলাদেশই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এমন সংস্কৃতি বিরাজমান। কিন্তু জাতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে, বিশেষ করে নিরাপত্তা ইস্যুতে সবাইকে এক সুরে কথা বলতে হবে। বিষয়টি অভিন্ন স্বার্থেই ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, যে যাই বলুক না কেন- বাস্তবতা হচ্ছে দেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এসব ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বা একই গোষ্ঠী যে এ কাজ করছে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা কে কি বললেন সেদিকে তাকিয়ে না থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজ হবে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা। ঘটনার রহস্য ভেদ করা। তা না হলে ক্রমেই আমরা আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠব।
দায় চাপানোর এই সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে বলে দাবি করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। যুগান্তরকে তিনি বলেন, কিছু হলেই দুই বড় দল একে অপরকে দোষারোপ করছে। দুই দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন। দায় চাপাচ্ছেন, যা কখনোই শুভ লক্ষণ হতে পারে না। ড. বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নেতা-নেত্রীরা একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। এতে করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। পাশাপাশি জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এদের বিস্তার ঘটবে, যা কারও জন্যই সুখকর হবে না। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্তরা কখনোই কারও বন্ধু হতে পারে না। কেউ যদি তাদের বন্ধু ভাবেন তাহলে তারা ভুল করবেন। একইভাবে কেউ যদি তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন তাহলে তারাও ভুল করছেন। ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ঢালাওভাবে একে অন্যের ওপর দায় না চাপিয়ে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন এখন সময়ের দাবি। তা না হলে সংঘাত-সহিংসতা বাড়তেই থাকবে।
এ প্রসঙ্গে সপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কিছু হলেই প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং নীতিনির্ধারকরা বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর সরাসরি দায় চাপাচ্ছেন। এতে করে তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। আর তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। ফলে যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা আড়ালেই থেকে যায়। প্রকৃত রহস্য কখনোই উন্মোচিত হয় না। তিনি বলেন, তথ্য-প্রমাণ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে কারও ওপর দায় না চাপিয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত।
No comments