‘পারলে গলায় পাড়া দিয়া ট্যাকা নেয়’ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
জীবিকার
প্রয়োজনে অথবা অন্য দরকারে মানুষকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়
যাতায়াত করতে হয়। নিজস্ব যানবাহন আছে খুব কম মানুষের। গণপরিবহন
বাস-মিনিবাস প্রভৃতিতে যাতায়াত করে ৯০ শতাংশ মানুষ। তাদের ৭০ শতাংশ অতি
নিম্ন আয়ের মানুষ। অধিকাংশই সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের
অল্প ও মাঝারি আয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। গণপরিবহনে যাতায়াতকারীদের একটি
বিরাট অংশ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আধা বেকার যুবক-যুবতী,
যাঁরা জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করেন—বাস-মিনিবাস
প্রভৃতির যাত্রীদের একটি অংশ তাঁরাও।
বাংলাদেশের অধিপতি শ্রেণির মানুষ, যাঁদের নিজস্ব গাড়ি রয়েছে এবং কোনো কোনো পরিবারে কয়েকটি গাড়ি, তাঁদের পক্ষে গণপরিবহনে যাতায়াতকারী মানুষের দুর্ভোগের মাত্রাটি উপলব্ধি করা একেবারেই সম্ভব নয়। বর্তমান বাজারে যাঁর গড় আয় ১০-১২ হাজার টাকা, তাঁকে যদি হঠাৎ মাসে এক-দেড় হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়, তা তাঁর ওপরে জুলুম। বর্তমানে গণপরিবহনে যাতায়াত ও বাড়তি ভাড়া নিয়ে যে নৈরাজ্য চলছে, তাতে সেই রকম জুলুমের শিকার কোটি কোটি মানুষ। অসহায় মানুষের সেই দুর্দশা দেখে নাগরিক সমাজের আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না। সে জন্য যাত্রীদের মুখে তাঁদের দুর্দশার কথা শুনতে আমরা গণশুনানির আয়োজন করেছি।
পোশাকশিল্পে কাজ করে এমন একটি মেয়ে বলল, ‘বাসভাড়ায় এখন কুড়ি টাকা আগের চেয়ে বেশি লাগতেছে। বাজার করুম কী দিয়া?’ অর্থাৎ যাঁর মাসিক আয় সাত হাজার টাকার মতো, তাঁর যদি হাজার দেড়েক টাকা বাসভাড়াতেই চলে যায়, তিনি খাবেন কী? ফার্মগেটে এক নারী বিবিসির সংবাদদাতাকে বললেন, ‘পারলে গলায় পাড়া দিয়া ট্যাকা নেয়।’
বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ বাস-মিনিবাসে যাতায়াত করতে বাধ্য হয়। তাতে জোর-জুলুম করে বর্ধিত ভাড়া আদায় বাস মালিক-কর্মচারীদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ভাড়া সরকার নির্ধারণ করেছে বড় বাসের জন্য সাত টাকা, সেখানে যাত্রীদের থেকে আদায় করা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১০ পয়সা। সে হিসাবে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে বাড়তি দিতে হতে পারে এক থেকে তিন টাকা, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে পাঁচ থেকে আট টাকা বেশি।
আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের কোনো ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব নেই। আমরা গণপরিবহনের মালিকদের ন্যায্য ভাড়া নিতে বাধ্য করতে পারি না। কর্মচারীরা কেন অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে—সে কথাও আমরা কোনো বাস-মিনিবাস চালক বা হেলপারকে জিজ্ঞেস করি না। সে অধিকার আমাদের নেই। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা শুধু জিজ্ঞেস করে কোন জায়গা থেকে কোন দূরত্বে নির্ধারিত ভাড়া কত আর যাত্রীদের থেকে আদায় করা হচ্ছে কত?
পরিবহন ক্ষেত্রের এই নৈরাজ্যের মূলেও দুর্নীতি। খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যেসব বাস-মিনিবাস-লেগুনা-টেম্পো রাস্তায় দেখা যায়, বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য সেগুলোই যথেষ্ট অতিরিক্ত ভাড়া আদায় শুধু বাস-মিনিবাসে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকা ও তার আশপাশের সড়কে লেগুনা, টেম্পো, হিউম্যান হলার, পিকআপ ভ্যান প্রভৃতির ভাড়াও অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে। কেন অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা যাত্রীরা জিজ্ঞেস করলে মারামারি-হাতাহাতি পর্যন্ত হচ্ছে যাত্রীদের সঙ্গে যানবাহনের কর্মচারীদের।
বাসভাড়া বাড়ানোর আগে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি বিচার-বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে যাত্রীসাধারণের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। এবার তিন বছর পর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাসে ১.৬০ থেকে ১.৭০ পয়সা এবং মিনিবাসে ১.৫০ থেকে ১.৬০ পয়সা। সেটা কাগজে, বাস্তব অবস্থা একেবারেই অন্য রকম। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কৌশল মালিক-শ্রমিকদের ভালো জানা। গেটলক ও সিটিং সার্ভিস বলে দুটি চাতুর্যের আশ্রয় নিচ্ছে তারা। গেটলক ও সিটিং সার্ভিস বলে কোনো জিনিসের অনুমোদন নেই সরকারের। সবই সাধারণ। লোকাল বাস, শুধু এসি বাস ছাড়া। ইচ্ছামতো গেটলক ও সিটিং সার্ভিস বলে মানুষকে প্রতারিত করে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে। এই অবৈধ কাণ্ড সরকার বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। চলছে লোকালের মতো, বলছে সিটিং সার্ভিস। ভাড়া দ্বিগুণ বা তারও বেশি। এই অবৈধ তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু রেখেছে। তা নিয়েও তুলকালাম কাণ্ড। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগ চলবে না। দু-চারজন বাস কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করায় এবং কয়েক দিনের জেল দেওয়ায় এক দিন ঢাকা নগর অচল করে দেওয়া হয়। সরকার নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট চারজন। কয়েক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মামলা হয়েছে অনেকগুলো। কিছু গাড়িকে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হয়নি। মালিক-শ্রমিকেরা জরিমানাও দিচ্ছে, অতিরিক্ত ভাড়াও নিচ্ছে।
মালিকপক্ষ ও সরকার মনে করছে, কয়েক দিন এভাবে চললে মানুষ বাধ্য হয়ে বর্ধিত ভাড়াই মেনে নেবে। হয়তো নেবে কিন্তু মানুষের ভেতরের অসন্তোষ বন্ধ হবে না। একটি অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর তাতে কিছুই আসে যায় না। দলকে চাঁদা দেয় পরিবহন মালিকেরা, জনগণ নয়। সুতরাং সরকারকে মালিকদের স্বার্থই রক্ষা করতে হয়—জনগণের স্বার্থ নয়।
শুধু সরকারকেই বা দোষ দেব কেন? রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা হতাশাজনক। জনস্বার্থ রক্ষায় তাদের ভূমিকা দেখি না। ২০-৩০ বছর আগে এভাবে ভাড়া বাড়ালে এবং অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত ভাড়া নিলে দলগুলো রাস্তায় নামত বা ধর্মঘট ডাকত। ক্ষমতাসীন দলগুলোর নীরবতা অর্থবহ, কিন্তু বিরোধী দল বলে যারা দাবি করে, বিশেষ করে বাম দলগুলো তারাও একটি বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব পালন করেছে।
গণপরিবহনে অরাজকতা নতুন নয়, দীর্ঘদিনের। আশির দশক থেকে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। কোনো সরকার এদিকে দৃষ্টি দেয়নি, অতি নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি দলসহ বিভিন্ন বড় দল চাঁদা তুলেছে। গত ৩০ বছরে ঢাকায় মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ, গণপরিবহনের সংখ্যা কমেছে অর্ধেক। অদ্ভুত বৈপরীত্য। পরিবহন মালিকদের সূত্রে জানলাম, ১৫ বছর আগে ঢাকায় বাস ছিল সাত হাজার, বর্তমানে কমে হয়েছে চার হাজার। চট্টগ্রামে বাস চলছে দেড় হাজার মাত্র। অতি কষ্টে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে বা দরজার হাতলে বা বাম্পারে ঝুলে যাতায়াত করে। ভাড়া নেওয়া হয় খেয়ালখুশিমতো।
বর্তমানে ঢাকায় গণপরিবহনে যাতায়াত করে প্রায় এক কোটি মানুষ। তাদের চার ভাগের এক ভাগ নারী এবং আর এক ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। কর্মজীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। গণপরিবহনে তাদের যাতায়াতে যে লাঞ্ছনা ও দুঃখ সইতে হয়, তা সীমাহীন। তাদের বসার নির্দিষ্ট আসন নেই। বঙ্গীয় পুরুষের সৌজন্যবোধ নেই। নারী দেখলে উঠে দাঁড়ায় না। জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে আকাশে তাকিয়ে থাকে না দেখার ভান করে। কেউ একটু বসার জায়গা চাইলে খেঁকিয়ে জবাব দেওয়া হয়। বাসের কর্মচারীদের থেকেও তারা সহানুভূতি পায় না। ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে অশ্লীল ভাষায় কথা শোনানো হয়। কিশোরী-যুবতীদের গায়ে হাত পর্যন্ত দেওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে ও লজ্জায় তারা তা হজম করে।
বাস-মিনিবাসের ড্রাইভার-হেলপারদের জীবনও খুবই দুঃখের। হেলপারদের অনেকেরই বয়স খুব কম। বলতে গেলে কিশোর। তারা অবহেলিত-বঞ্চিত। বেতন সামান্য। সারা দিন পরিশ্রম করতে হয়। বিশ্রামের অভাব। থাকার জায়গা নেই। যাত্রীদের অনেকেই তিরিক্ষি মেজাজের। ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষির সময় মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন। ফলে যাত্রীদের সঙ্গে ‘হেলপার’দের শুধু কথা-কাটাকাটি নয়, মারামারি পর্যন্ত ঘটে।
পরিবহন মালিকদেরও সমস্যা থাকতে পারে। সেসব দেখাও সরকারের দায়িত্ব। যেকোনো সমস্যাই আলোচনার মাধ্যমে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সমাধান সম্ভব। তবে কোনো অজুহাতেই সরকারি নীতিমালা অমান্য করার অধিকার কোনো পক্ষেরই নেই। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত রেখে কাঙ্ক্ষিত আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
ঢাকা বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগর শুধু নয়, বৃহত্তম নগর এবং প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। রাজধানী নগরের পরিবহনব্যবস্থা কী রকম হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো সরকারেরই কিছুমাত্র ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। থাকলে অবস্থাটা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করত না। স্বাধীনতার আগে বিআরটিসির বাস ছিল সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক গণপরিবহন। নষ্ট রাজনীতি ও দুর্নীতির ধাক্কায় সেটা ধ্বংস করা হয়েছে। পরিবহন ক্ষেত্রের এই নৈরাজ্যের মূলেও দুর্নীতি। খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যেসব বাস-মিনিবাস-লেগুনা-টেম্পো রাস্তায় দেখা যায়, বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য সেগুলোই যথেষ্ট।
এই নৈরাজ্য ও সমস্যার সমাধান কোথায়? গণপরিবহন যে একটি জটিল সমস্যা, স্বীকার করে নিয়ে তা সমাধানে গোত্র ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। থাকতে হবে যথাযথ অঙ্গীকার। সরকার একা পারবে না। মালিক-শ্রমিকসহ সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে নাগরিক সমাজকেও সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে নৈরাজ্য-অনাচার বন্ধ করতে সরকার যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জনগণ তা সমর্থন দেবে। অকারণে কঠোর হওয়ার দরকার নেই, আইনের যথাযথ প্রয়োগই সমস্যার সমাধান করতে পারে। সেই সঙ্গে দরকার সরকারি নীতিনির্ধারক এবং কর্তৃপক্ষের জনগণের বেদনা উপলব্ধি করা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
বাংলাদেশের অধিপতি শ্রেণির মানুষ, যাঁদের নিজস্ব গাড়ি রয়েছে এবং কোনো কোনো পরিবারে কয়েকটি গাড়ি, তাঁদের পক্ষে গণপরিবহনে যাতায়াতকারী মানুষের দুর্ভোগের মাত্রাটি উপলব্ধি করা একেবারেই সম্ভব নয়। বর্তমান বাজারে যাঁর গড় আয় ১০-১২ হাজার টাকা, তাঁকে যদি হঠাৎ মাসে এক-দেড় হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়, তা তাঁর ওপরে জুলুম। বর্তমানে গণপরিবহনে যাতায়াত ও বাড়তি ভাড়া নিয়ে যে নৈরাজ্য চলছে, তাতে সেই রকম জুলুমের শিকার কোটি কোটি মানুষ। অসহায় মানুষের সেই দুর্দশা দেখে নাগরিক সমাজের আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না। সে জন্য যাত্রীদের মুখে তাঁদের দুর্দশার কথা শুনতে আমরা গণশুনানির আয়োজন করেছি।
পোশাকশিল্পে কাজ করে এমন একটি মেয়ে বলল, ‘বাসভাড়ায় এখন কুড়ি টাকা আগের চেয়ে বেশি লাগতেছে। বাজার করুম কী দিয়া?’ অর্থাৎ যাঁর মাসিক আয় সাত হাজার টাকার মতো, তাঁর যদি হাজার দেড়েক টাকা বাসভাড়াতেই চলে যায়, তিনি খাবেন কী? ফার্মগেটে এক নারী বিবিসির সংবাদদাতাকে বললেন, ‘পারলে গলায় পাড়া দিয়া ট্যাকা নেয়।’
বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ বাস-মিনিবাসে যাতায়াত করতে বাধ্য হয়। তাতে জোর-জুলুম করে বর্ধিত ভাড়া আদায় বাস মালিক-কর্মচারীদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে সর্বনিম্ন ভাড়া সরকার নির্ধারণ করেছে বড় বাসের জন্য সাত টাকা, সেখানে যাত্রীদের থেকে আদায় করা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১০ পয়সা। সে হিসাবে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে বাড়তি দিতে হতে পারে এক থেকে তিন টাকা, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে পাঁচ থেকে আট টাকা বেশি।
আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের কোনো ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব নেই। আমরা গণপরিবহনের মালিকদের ন্যায্য ভাড়া নিতে বাধ্য করতে পারি না। কর্মচারীরা কেন অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে—সে কথাও আমরা কোনো বাস-মিনিবাস চালক বা হেলপারকে জিজ্ঞেস করি না। সে অধিকার আমাদের নেই। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা শুধু জিজ্ঞেস করে কোন জায়গা থেকে কোন দূরত্বে নির্ধারিত ভাড়া কত আর যাত্রীদের থেকে আদায় করা হচ্ছে কত?
পরিবহন ক্ষেত্রের এই নৈরাজ্যের মূলেও দুর্নীতি। খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যেসব বাস-মিনিবাস-লেগুনা-টেম্পো রাস্তায় দেখা যায়, বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য সেগুলোই যথেষ্ট অতিরিক্ত ভাড়া আদায় শুধু বাস-মিনিবাসে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকা ও তার আশপাশের সড়কে লেগুনা, টেম্পো, হিউম্যান হলার, পিকআপ ভ্যান প্রভৃতির ভাড়াও অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে। কেন অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা যাত্রীরা জিজ্ঞেস করলে মারামারি-হাতাহাতি পর্যন্ত হচ্ছে যাত্রীদের সঙ্গে যানবাহনের কর্মচারীদের।
বাসভাড়া বাড়ানোর আগে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি বিচার-বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে যাত্রীসাধারণের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। এবার তিন বছর পর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাসে ১.৬০ থেকে ১.৭০ পয়সা এবং মিনিবাসে ১.৫০ থেকে ১.৬০ পয়সা। সেটা কাগজে, বাস্তব অবস্থা একেবারেই অন্য রকম। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কৌশল মালিক-শ্রমিকদের ভালো জানা। গেটলক ও সিটিং সার্ভিস বলে দুটি চাতুর্যের আশ্রয় নিচ্ছে তারা। গেটলক ও সিটিং সার্ভিস বলে কোনো জিনিসের অনুমোদন নেই সরকারের। সবই সাধারণ। লোকাল বাস, শুধু এসি বাস ছাড়া। ইচ্ছামতো গেটলক ও সিটিং সার্ভিস বলে মানুষকে প্রতারিত করে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায় করছে। এই অবৈধ কাণ্ড সরকার বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। চলছে লোকালের মতো, বলছে সিটিং সার্ভিস। ভাড়া দ্বিগুণ বা তারও বেশি। এই অবৈধ তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু রেখেছে। তা নিয়েও তুলকালাম কাণ্ড। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগ চলবে না। দু-চারজন বাস কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করায় এবং কয়েক দিনের জেল দেওয়ায় এক দিন ঢাকা নগর অচল করে দেওয়া হয়। সরকার নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট চারজন। কয়েক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মামলা হয়েছে অনেকগুলো। কিছু গাড়িকে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হয়নি। মালিক-শ্রমিকেরা জরিমানাও দিচ্ছে, অতিরিক্ত ভাড়াও নিচ্ছে।
মালিকপক্ষ ও সরকার মনে করছে, কয়েক দিন এভাবে চললে মানুষ বাধ্য হয়ে বর্ধিত ভাড়াই মেনে নেবে। হয়তো নেবে কিন্তু মানুষের ভেতরের অসন্তোষ বন্ধ হবে না। একটি অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর তাতে কিছুই আসে যায় না। দলকে চাঁদা দেয় পরিবহন মালিকেরা, জনগণ নয়। সুতরাং সরকারকে মালিকদের স্বার্থই রক্ষা করতে হয়—জনগণের স্বার্থ নয়।
শুধু সরকারকেই বা দোষ দেব কেন? রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা হতাশাজনক। জনস্বার্থ রক্ষায় তাদের ভূমিকা দেখি না। ২০-৩০ বছর আগে এভাবে ভাড়া বাড়ালে এবং অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত ভাড়া নিলে দলগুলো রাস্তায় নামত বা ধর্মঘট ডাকত। ক্ষমতাসীন দলগুলোর নীরবতা অর্থবহ, কিন্তু বিরোধী দল বলে যারা দাবি করে, বিশেষ করে বাম দলগুলো তারাও একটি বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব পালন করেছে।
গণপরিবহনে অরাজকতা নতুন নয়, দীর্ঘদিনের। আশির দশক থেকে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। কোনো সরকার এদিকে দৃষ্টি দেয়নি, অতি নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারি দলসহ বিভিন্ন বড় দল চাঁদা তুলেছে। গত ৩০ বছরে ঢাকায় মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ, গণপরিবহনের সংখ্যা কমেছে অর্ধেক। অদ্ভুত বৈপরীত্য। পরিবহন মালিকদের সূত্রে জানলাম, ১৫ বছর আগে ঢাকায় বাস ছিল সাত হাজার, বর্তমানে কমে হয়েছে চার হাজার। চট্টগ্রামে বাস চলছে দেড় হাজার মাত্র। অতি কষ্টে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে বা দরজার হাতলে বা বাম্পারে ঝুলে যাতায়াত করে। ভাড়া নেওয়া হয় খেয়ালখুশিমতো।
বর্তমানে ঢাকায় গণপরিবহনে যাতায়াত করে প্রায় এক কোটি মানুষ। তাদের চার ভাগের এক ভাগ নারী এবং আর এক ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। কর্মজীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। গণপরিবহনে তাদের যাতায়াতে যে লাঞ্ছনা ও দুঃখ সইতে হয়, তা সীমাহীন। তাদের বসার নির্দিষ্ট আসন নেই। বঙ্গীয় পুরুষের সৌজন্যবোধ নেই। নারী দেখলে উঠে দাঁড়ায় না। জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে আকাশে তাকিয়ে থাকে না দেখার ভান করে। কেউ একটু বসার জায়গা চাইলে খেঁকিয়ে জবাব দেওয়া হয়। বাসের কর্মচারীদের থেকেও তারা সহানুভূতি পায় না। ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে অশ্লীল ভাষায় কথা শোনানো হয়। কিশোরী-যুবতীদের গায়ে হাত পর্যন্ত দেওয়া হয়। নিরুপায় হয়ে ও লজ্জায় তারা তা হজম করে।
বাস-মিনিবাসের ড্রাইভার-হেলপারদের জীবনও খুবই দুঃখের। হেলপারদের অনেকেরই বয়স খুব কম। বলতে গেলে কিশোর। তারা অবহেলিত-বঞ্চিত। বেতন সামান্য। সারা দিন পরিশ্রম করতে হয়। বিশ্রামের অভাব। থাকার জায়গা নেই। যাত্রীদের অনেকেই তিরিক্ষি মেজাজের। ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষির সময় মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন। ফলে যাত্রীদের সঙ্গে ‘হেলপার’দের শুধু কথা-কাটাকাটি নয়, মারামারি পর্যন্ত ঘটে।
পরিবহন মালিকদেরও সমস্যা থাকতে পারে। সেসব দেখাও সরকারের দায়িত্ব। যেকোনো সমস্যাই আলোচনার মাধ্যমে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সমাধান সম্ভব। তবে কোনো অজুহাতেই সরকারি নীতিমালা অমান্য করার অধিকার কোনো পক্ষেরই নেই। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত রেখে কাঙ্ক্ষিত আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
ঢাকা বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগর শুধু নয়, বৃহত্তম নগর এবং প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। রাজধানী নগরের পরিবহনব্যবস্থা কী রকম হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো সরকারেরই কিছুমাত্র ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। থাকলে অবস্থাটা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করত না। স্বাধীনতার আগে বিআরটিসির বাস ছিল সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক গণপরিবহন। নষ্ট রাজনীতি ও দুর্নীতির ধাক্কায় সেটা ধ্বংস করা হয়েছে। পরিবহন ক্ষেত্রের এই নৈরাজ্যের মূলেও দুর্নীতি। খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যেসব বাস-মিনিবাস-লেগুনা-টেম্পো রাস্তায় দেখা যায়, বিদেশি পর্যটকদের চোখে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য সেগুলোই যথেষ্ট।
এই নৈরাজ্য ও সমস্যার সমাধান কোথায়? গণপরিবহন যে একটি জটিল সমস্যা, স্বীকার করে নিয়ে তা সমাধানে গোত্র ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। থাকতে হবে যথাযথ অঙ্গীকার। সরকার একা পারবে না। মালিক-শ্রমিকসহ সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে নাগরিক সমাজকেও সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে নৈরাজ্য-অনাচার বন্ধ করতে সরকার যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জনগণ তা সমর্থন দেবে। অকারণে কঠোর হওয়ার দরকার নেই, আইনের যথাযথ প্রয়োগই সমস্যার সমাধান করতে পারে। সেই সঙ্গে দরকার সরকারি নীতিনির্ধারক এবং কর্তৃপক্ষের জনগণের বেদনা উপলব্ধি করা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments