রাজনীতিতে ব্যবসায়ী নাকি ব্যবসার নাম ‘রাজনীতি’ by এ কে এম জাকারিয়া
গণতান্ত্রিক
দেশে যে কেউই তঁার খেয়ালখুশিমতো রাজনীতিতে আসতে পারেন, এসে এই পেশায়
থিতুও হতে পারেন। আবার কেউ দীর্ঘদিনের রাজনীতি ছেড়ে ভিন্ন পেশাও ধরেন।
এখানে কোনো বাধা নেই। রাজনীতি করাটা শুধু পেশাদার রাজনীতিবিদের মধ্যে আটকে
থাকার বিষয় নয়। তবে কিছু পেশার প্রাধান্য থাকে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী অথবা পেশাদার রাজনীতিক। তবে
ব্যবসায়ী, কৃষক, সেনা কর্মকর্তা, অধ্যাপক বা এমনকি অভিনয় পেশার লোকজনও
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
এত পেশার লোকজনের ভিড়ে কারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভালো করেছেন তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে জরিপ হয়েছে। ফলাফল মোটামুটি একই। ওয়াশিংটন, জেফারসন, লিঙ্কন, ফ্রাঙ্কলিন, রুজভেল্ট, উইলসন, ট্রুম্যান ও আইজেনহাওয়ারের নাম সব সময়ই তালিকার শুরুতে জায়গা পেয়েছে। আর একদম শেষের দিকে জায়গা পাওয়া নামগুলো হচ্ছে হেরবার্ট হুভার, কেলভিন কুলিজ, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ওয়ারেন জি হার্ডিং। হার্ডিং ব্যবসায় খুবই সফল হয়েছিলেন কিন্তু ধারাবাহিকভাবে খারাপ প্রেসিডেন্ট হিসেবে রায় পেয়েছেন। জর্জ ডব্লিউ বুশও ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্যর্থ বলেই রায় পেয়েছেন। ট্রুম্যানও ব্যবসায়ী ছিলেন, তবে ব্যবসায় সফল হননি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অবশ্য তিনি মহান বলেই বিবেচিত। এসব নানা জরিপ বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর এক সাবেক কর্নেল উইলিয়াম জি ক্যাম্পবেল একটি লেখা লিখেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ব্যবসায়ী পেশা থেকে যাঁরা এসেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁরা খুব খারাপ করেছেন। আমাদের মনে আছে, থাইল্যান্ডের সফল ব্যবসায়ী থাকসিন সিনাওয়াত্রা দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে সফল হতে পারলেন না।
বাংলাদেশ বা ভারতের মতো গণতন্ত্রে রাজনীতিতে আসার সুযোগটা আরও ছড়ানো। নানা পেশার লোকজন তো আছেই, এসব দেশে এমনকি ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড নিয়েও দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করা যায়। তাঁরা নির্বাচনে মনোনয়ন পান, নির্বাচিতও হন। ভারতের বর্তমান ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের পর কারা নির্বাচিত হয়েছেন তা নিয়ে কাটাছেঁড়া করে একটি প্রতিষ্ঠান (অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম) যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ৩৪ শতাংশেরই ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান দশম সংসদের নির্বাচিত সাংসদদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১০.৩৩ শতাংশের বিরুদ্ধে চলমান মামলা ও ৪৬ শতাংশের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। (তথ্যসূত্র: সুজন)
গণতন্ত্রে রাজনীতি আসলেই মুক্ত বিষয়। রাজনীতির দরজা সবার জন্যই খোলা। ব্যবসায়ীদের জন্যও খোলা। তবে রাজনীতিতে কোনো পেশার লোকজনের দাপট বাড়ছে বা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে চলে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার বিষয়। দেশের গণতন্ত্রের মান, অবস্থা ও এর ভবিষ্যতের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের এখানে নতুন করে আলোচনা শুরু হওয়ার কারণ রাষ্ট্রের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাম্প্রতিক মন্তব্য। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।’ (প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর) এর দিন কয়েক আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ৯০ শতাংশ সদস্য আইনের ছাত্র। বাংলাদেশের সংসদের ৮০ ভাগই ব্যবসায়ী। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে আইনের ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে (প্রথম আলো, ৪ অক্টোবর)।
ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনীতির একটি সম্পর্ক সব সময়ই রয়েছে। বিশ্বের সব দেশেই রাজনীতিবিদ ও দলগুলোর চাঁদা ও অনুদানের বড় অংশের জোগান দেয় ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যখন রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম, তখনো রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের উৎস ছিলেন ব্যবসায়ীরা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিতদের পেশা-পরিচিতি থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী নির্বাচনগুলো বিবেচনায় নিলে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের ‘অংশগ্রহণ’ বা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে তাঁদের ‘দাপট’ কতটা বেড়েছে তা আমরা টের পাব।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। এর প্রায় ২০ বছর পর অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময়ে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ৩৪ শতাংশ। মাত্র ছয় বছরে বেড়েছে ২১ শতাংশ। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। সামরিক শাসকেরা নিজেরা দল করার জন্য বা তাদের ক্ষমতা বৈধ করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে ভিড়িয়েছেন। সামরিক শাসন বাংলাদেশে রাজনীতিতে যেসব স্থায়ী ক্ষতি করে গেছে, ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে নিয়ে আসা তার অন্যতম। একবার যা শুরু হয়, তা থেকে পেছানো কঠিন। এখন যেন ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করাই নিয়ম বা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ৪৮ শতাংশ। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদে ৫২ দশমিক ১০। আর ২০০৯ সালের নবম সংসদে ৬৩ শতাংশ। (তথ্যসূত্র: ডেইলি স্টার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫)। ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ও দশম সংসদের নির্বাচন আগেরগুলোর মতো অংশগ্রহণমূলক হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়ন ও নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাঁদের নির্বাচনী হলফনামায় যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে যে ৫৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রার্থীর পেশা ব্যবসা। (তথ্যসূত্র সুজন) আমরা ধারণা করতে পারি যে এই হার আরও বেশি হবে, কারণ হলফনামায় উল্লেখ না করলেও বেনামে বা পরিবার-পরিজনের নামে ব্যবসা করার রীতি আমাদের দেশে রয়েছে।
আগেই বলেছি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি করার অধিকার যে কারোরই আছে। ব্যবসায়ীদেরও আছে। ভারতের বর্তমান লোকসভায় নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ী রয়েছেন ২০ শতাংশ। আর পেশা হিসেবে রাজনীতি ও সামাজিক কাজে জড়িত সদস্যের সংখ্যা ২৪ শতাংশ (সূত্র: অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম)। ভারতে ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশের মতো এখনো রাজনীতিতে পুরোপুরি দখলদারি কায়েম করতে পারেননি। বর্তমান মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষ মিলিয়ে সদস্যদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫৫ ভাগ ব্যবসায়ী। (সূত্র: কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস) আর ১৯৭৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলেছে, পার্লামেন্টে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কখনো ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়নি (সূত্র: দ্য ব্রিটিশ জেনারেল ইলেকশন অব ২০১০ অ্যান্ড প্রিভিয়াস এডিশনস)।
বাংলাদেশের অবস্থা সেদিক থেকে অস্বাভাবিকই। রাজনীতি এভাবে ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যাওয়া দেশ, দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির উদ্বেগের কারণটা আমরা অনুমান করতে পারি। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে ইঙ্গিত আছে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রক্ষায় বিশেষ পেশার গুরুত্ব রয়েছে। আমরা জানি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জীবনভর রাজনীতিই করে গেছেন, ছিলেন আইনজীবীও। রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়ার বিষয়টি তিনি মানতে পারছেন না। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘যেভাবেই হোক এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।’
আমাদের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের জড়িয়ে পড়া ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এবং রাজনৈতিক দলগুলো এর পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই ব্যবসায়ীরা কেন সহজে পদ ও মনোনয়ন পেয়ে যান, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের শক্তি তাঁদের টাকাপয়সা। নির্বাচনের খরচ দিনে দিনে যত বেড়েছে, নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ব্যবসায়ীদের দামও তত বেড়েছে। দলগুলোতে মনোনয়ন-বাণিজ্যের সংস্কৃতিও শুরু হয়েছে এসব কারণেই। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করতে এসে দেখেছেন যে রাজনীতি করলে ব্যবসায় সুবিধা মেলে। সবকিছুই হাতের মুঠোয় চলে আসে। এমন পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
নির্বাচিত হওয়া মানেই ব্যাংক, বিমা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হওয়ার পথ খুলে যাওয়া। কনটেইনারবাহী জাহাজের লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে সব ব্যবসা ও ব্যবসার পথই সহজ হয়ে যাওয়া। কেউ পাঁচ বছরে পাঁচ কোটি টাকায় ৭০ একর জমি কিনেছেন। ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন কোটি কোটি টাকা। যিনি ২০ একর জমির মালিক ছিলেন, পাঁচ বছরে তিনি হয়েছেন ২ হাজার ৮৬৫ একর জমির মালিক। ব্যাংকে টাকা বেড়েছে ৫৮৬ গুণ, জমি বেড়েছে ১৪৩ গুণ, বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭৯ গুণ। কারও কারও স্ত্রীর সম্পদ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। আগের নির্বাচনে দেওয়া হলফনামার সম্পদের হিসাবের সঙ্গে পরের নির্বাচনে দেওয়া সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দায়দেনার হিসাবেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণের হারের সঙ্গে আমাদের হারের এত বড় তফাত। আসলে বাংলাদেশের পরিস্থিতিটি এখন আর ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের হার বা এসব হিসাব-নিকাশের মধ্যে আটকে নেই। এখানে রাজনীতিই এখন বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র ও ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। শুধু ব্যবসায়ীরাই যে রাজনীতিতে আসছেন বা রাজনীতি দখল করে নিচ্ছেন তাই না, পেশাদার রাজনীতিকেরাও রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। নির্বাচন করে জেতার পর ব্যবসা করাটা এখানে খুব সহজ হয়ে যায়। এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি বাস্তবে এখন প্রায় শতভাগই ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মাননীয় রাষ্ট্রপতি ‘যেভাবেই হোক’ ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়া রাজনীতিকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করার আশা করছেন। বলেছেন, ‘সততা বজায় না রাখলে একজন রাজনীতিবিদ কিছুই করতে সক্ষম হবেন না। কেউ যদি অর্থবিত্ত করতে চান, তাহলে তঁাদের জন্য অনেক উপায় আছে। তঁাদের রাজনীতিতে আসা উচিত না।’ দীর্ঘ ৫০ বছর যিনি শুধু রাজনীতিই করে গেছেন, রাজনীতির বর্তমান দশায় তাঁর কষ্টটা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু কোনো দেশে রাজনীতিই যদি একটা ব্যবসায় পরিণত হয়, তবে সে দেশের রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের পকেট থেকে বের করে আনা কি আদৌ সম্ভব!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
এত পেশার লোকজনের ভিড়ে কারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভালো করেছেন তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে জরিপ হয়েছে। ফলাফল মোটামুটি একই। ওয়াশিংটন, জেফারসন, লিঙ্কন, ফ্রাঙ্কলিন, রুজভেল্ট, উইলসন, ট্রুম্যান ও আইজেনহাওয়ারের নাম সব সময়ই তালিকার শুরুতে জায়গা পেয়েছে। আর একদম শেষের দিকে জায়গা পাওয়া নামগুলো হচ্ছে হেরবার্ট হুভার, কেলভিন কুলিজ, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ওয়ারেন জি হার্ডিং। হার্ডিং ব্যবসায় খুবই সফল হয়েছিলেন কিন্তু ধারাবাহিকভাবে খারাপ প্রেসিডেন্ট হিসেবে রায় পেয়েছেন। জর্জ ডব্লিউ বুশও ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্যর্থ বলেই রায় পেয়েছেন। ট্রুম্যানও ব্যবসায়ী ছিলেন, তবে ব্যবসায় সফল হননি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অবশ্য তিনি মহান বলেই বিবেচিত। এসব নানা জরিপ বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর এক সাবেক কর্নেল উইলিয়াম জি ক্যাম্পবেল একটি লেখা লিখেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ব্যবসায়ী পেশা থেকে যাঁরা এসেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁরা খুব খারাপ করেছেন। আমাদের মনে আছে, থাইল্যান্ডের সফল ব্যবসায়ী থাকসিন সিনাওয়াত্রা দেশটির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে সফল হতে পারলেন না।
বাংলাদেশ বা ভারতের মতো গণতন্ত্রে রাজনীতিতে আসার সুযোগটা আরও ছড়ানো। নানা পেশার লোকজন তো আছেই, এসব দেশে এমনকি ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড নিয়েও দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করা যায়। তাঁরা নির্বাচনে মনোনয়ন পান, নির্বাচিতও হন। ভারতের বর্তমান ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের পর কারা নির্বাচিত হয়েছেন তা নিয়ে কাটাছেঁড়া করে একটি প্রতিষ্ঠান (অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম) যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ৩৪ শতাংশেরই ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান দশম সংসদের নির্বাচিত সাংসদদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১০.৩৩ শতাংশের বিরুদ্ধে চলমান মামলা ও ৪৬ শতাংশের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। (তথ্যসূত্র: সুজন)
গণতন্ত্রে রাজনীতি আসলেই মুক্ত বিষয়। রাজনীতির দরজা সবার জন্যই খোলা। ব্যবসায়ীদের জন্যও খোলা। তবে রাজনীতিতে কোনো পেশার লোকজনের দাপট বাড়ছে বা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে চলে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার বিষয়। দেশের গণতন্ত্রের মান, অবস্থা ও এর ভবিষ্যতের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের এখানে নতুন করে আলোচনা শুরু হওয়ার কারণ রাষ্ট্রের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাম্প্রতিক মন্তব্য। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।’ (প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর) এর দিন কয়েক আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ৯০ শতাংশ সদস্য আইনের ছাত্র। বাংলাদেশের সংসদের ৮০ ভাগই ব্যবসায়ী। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে আইনের ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে (প্রথম আলো, ৪ অক্টোবর)।
ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনীতির একটি সম্পর্ক সব সময়ই রয়েছে। বিশ্বের সব দেশেই রাজনীতিবিদ ও দলগুলোর চাঁদা ও অনুদানের বড় অংশের জোগান দেয় ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যখন রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম, তখনো রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের উৎস ছিলেন ব্যবসায়ীরা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিতদের পেশা-পরিচিতি থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী নির্বাচনগুলো বিবেচনায় নিলে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের ‘অংশগ্রহণ’ বা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে তাঁদের ‘দাপট’ কতটা বেড়েছে তা আমরা টের পাব।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। এর প্রায় ২০ বছর পর অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময়ে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ৩৪ শতাংশ। মাত্র ছয় বছরে বেড়েছে ২১ শতাংশ। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। সামরিক শাসকেরা নিজেরা দল করার জন্য বা তাদের ক্ষমতা বৈধ করার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে ভিড়িয়েছেন। সামরিক শাসন বাংলাদেশে রাজনীতিতে যেসব স্থায়ী ক্ষতি করে গেছে, ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে নিয়ে আসা তার অন্যতম। একবার যা শুরু হয়, তা থেকে পেছানো কঠিন। এখন যেন ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করাই নিয়ম বা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদে নির্বাচিতদের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ৪৮ শতাংশ। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদে ৫২ দশমিক ১০। আর ২০০৯ সালের নবম সংসদে ৬৩ শতাংশ। (তথ্যসূত্র: ডেইলি স্টার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫)। ব্যবসায়ীদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ও দশম সংসদের নির্বাচন আগেরগুলোর মতো অংশগ্রহণমূলক হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়ন ও নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাঁদের নির্বাচনী হলফনামায় যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে যে ৫৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রার্থীর পেশা ব্যবসা। (তথ্যসূত্র সুজন) আমরা ধারণা করতে পারি যে এই হার আরও বেশি হবে, কারণ হলফনামায় উল্লেখ না করলেও বেনামে বা পরিবার-পরিজনের নামে ব্যবসা করার রীতি আমাদের দেশে রয়েছে।
আগেই বলেছি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি করার অধিকার যে কারোরই আছে। ব্যবসায়ীদেরও আছে। ভারতের বর্তমান লোকসভায় নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ী রয়েছেন ২০ শতাংশ। আর পেশা হিসেবে রাজনীতি ও সামাজিক কাজে জড়িত সদস্যের সংখ্যা ২৪ শতাংশ (সূত্র: অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম)। ভারতে ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশের মতো এখনো রাজনীতিতে পুরোপুরি দখলদারি কায়েম করতে পারেননি। বর্তমান মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষ মিলিয়ে সদস্যদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫৫ ভাগ ব্যবসায়ী। (সূত্র: কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস) আর ১৯৭৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলেছে, পার্লামেন্টে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কখনো ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়নি (সূত্র: দ্য ব্রিটিশ জেনারেল ইলেকশন অব ২০১০ অ্যান্ড প্রিভিয়াস এডিশনস)।
বাংলাদেশের অবস্থা সেদিক থেকে অস্বাভাবিকই। রাজনীতি এভাবে ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যাওয়া দেশ, দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির উদ্বেগের কারণটা আমরা অনুমান করতে পারি। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে ইঙ্গিত আছে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রক্ষায় বিশেষ পেশার গুরুত্ব রয়েছে। আমরা জানি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জীবনভর রাজনীতিই করে গেছেন, ছিলেন আইনজীবীও। রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়ার বিষয়টি তিনি মানতে পারছেন না। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘যেভাবেই হোক এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।’
আমাদের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের জড়িয়ে পড়া ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এবং রাজনৈতিক দলগুলো এর পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই ব্যবসায়ীরা কেন সহজে পদ ও মনোনয়ন পেয়ে যান, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের শক্তি তাঁদের টাকাপয়সা। নির্বাচনের খরচ দিনে দিনে যত বেড়েছে, নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ব্যবসায়ীদের দামও তত বেড়েছে। দলগুলোতে মনোনয়ন-বাণিজ্যের সংস্কৃতিও শুরু হয়েছে এসব কারণেই। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করতে এসে দেখেছেন যে রাজনীতি করলে ব্যবসায় সুবিধা মেলে। সবকিছুই হাতের মুঠোয় চলে আসে। এমন পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
নির্বাচিত হওয়া মানেই ব্যাংক, বিমা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হওয়ার পথ খুলে যাওয়া। কনটেইনারবাহী জাহাজের লাইসেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে সব ব্যবসা ও ব্যবসার পথই সহজ হয়ে যাওয়া। কেউ পাঁচ বছরে পাঁচ কোটি টাকায় ৭০ একর জমি কিনেছেন। ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছেন কোটি কোটি টাকা। যিনি ২০ একর জমির মালিক ছিলেন, পাঁচ বছরে তিনি হয়েছেন ২ হাজার ৮৬৫ একর জমির মালিক। ব্যাংকে টাকা বেড়েছে ৫৮৬ গুণ, জমি বেড়েছে ১৪৩ গুণ, বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭৯ গুণ। কারও কারও স্ত্রীর সম্পদ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। আগের নির্বাচনে দেওয়া হলফনামার সম্পদের হিসাবের সঙ্গে পরের নির্বাচনে দেওয়া সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দায়দেনার হিসাবেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণের হারের সঙ্গে আমাদের হারের এত বড় তফাত। আসলে বাংলাদেশের পরিস্থিতিটি এখন আর ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের হার বা এসব হিসাব-নিকাশের মধ্যে আটকে নেই। এখানে রাজনীতিই এখন বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র ও ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। শুধু ব্যবসায়ীরাই যে রাজনীতিতে আসছেন বা রাজনীতি দখল করে নিচ্ছেন তাই না, পেশাদার রাজনীতিকেরাও রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। নির্বাচন করে জেতার পর ব্যবসা করাটা এখানে খুব সহজ হয়ে যায়। এভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি বাস্তবে এখন প্রায় শতভাগই ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মাননীয় রাষ্ট্রপতি ‘যেভাবেই হোক’ ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়া রাজনীতিকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করার আশা করছেন। বলেছেন, ‘সততা বজায় না রাখলে একজন রাজনীতিবিদ কিছুই করতে সক্ষম হবেন না। কেউ যদি অর্থবিত্ত করতে চান, তাহলে তঁাদের জন্য অনেক উপায় আছে। তঁাদের রাজনীতিতে আসা উচিত না।’ দীর্ঘ ৫০ বছর যিনি শুধু রাজনীতিই করে গেছেন, রাজনীতির বর্তমান দশায় তাঁর কষ্টটা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু কোনো দেশে রাজনীতিই যদি একটা ব্যবসায় পরিণত হয়, তবে সে দেশের রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের পকেট থেকে বের করে আনা কি আদৌ সম্ভব!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments