অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
দিল্লির কেরালা ভবনে পুলিশের অভিযান কেন্দ্র–রাজ্য বিরোধের জন্ম দেয় |
গরুর
মাংস খাওয়া বন্ধ করতে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলো যেভাবে অতি উৎসাহী হয়ে
উঠছিল, তা নিয়ে এই কাগজে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম কিছুদিন আগে। সেই সময়
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, কে কী খাবে সেটা মানুষের ওপর জবরদস্তি
চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। সর্বোচ্চ আদালতের ওই অভিমত একটা ভরসা জুগিয়েছিল।
মনে হয়েছিল, দেশে এবার হয়তো গরু-সংক্রান্ত পাগলামি কমবে, মানুষ ঠান্ডা
মাথায় সবদিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে এবং অযথা উত্তেজনা সৃষ্টিতে
উসকানি দেবে না। সেই মনে হওয়াটা যে ভুল ছিল, অল্প দিনেই তা বোঝা গেল। আরও
বোঝা গেল ঐতিহ্য, আদর্শ, নীতি ও সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে কিছু মানুষ এই দেশের
চরিত্রটা বদলে দিতে উঠেপড়ে নেমেছে। তাতে হাওয়া দিচ্ছে দেশের শাসকশ্রেণির
একটা বড় অংশ।
ওই নিবন্ধ প্রকাশের পরপরই বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে যায়। অযথা কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে। অনর্থক অশান্তি সৃষ্টি হয় রাজ্যে রাজ্যে। দেশজুড়ে শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। সেই বিতর্ক আজও অব্যাহত। গরু-বিতর্কে দেশটা যে এত তাড়াতাড়ি এভাবে টানটান হয়ে উঠবে, তখন বোঝা যায়নি। এখন বুঝছি, গরু অতি বিষম বস্তু।
প্রথম ঘটনাটা ঘটল রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে উত্তর প্রদেশের দাদরি এলাকার বিসাদা গ্রামে। সেই গ্রামে স্মরণকালের মধ্যে কোনো দিন হিন্দু-মুসলমানে মারামারি হয়নি। দাঙ্গা তো দূরের কথা। বরং দোল-দীপাবলি—ঈদ দুই সম্প্রদায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্যাপন করে এসেছে। এ রকম একটা গ্রামে মোহাম্মদ ইকলাখ নামে মাঝ-পঞ্চাশের এক প্রৌঢ়কে গ্রামেরই পরিচিতরা পিটিয়ে মেরে ফেলে স্রেফ একটা গুজব শুনে। গুজবটা গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে। এরই পিঠাপিঠি জম্মু-কাশ্মীরের উধমপুর এলাকায় একটি ট্রাকে পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। অভিযোগ, ট্রাকে করে গরু পাচার হচ্ছিল। সেই ঘটনায় এক মুসলমান যুবকের মৃত্যু হয়। পুলিশ তদন্ত করে দেখে দুটি ঘটনারই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আরও একটি ঘটনা ঘটে উত্তর প্রদেশেই। একটি গরুর চামড়া ছাড়াচ্ছিল দুই যুবক। কিছু মানুষ তা দেখে তাদের বেদম প্রহার করে। পরে জানা যায় গরুটির স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তার মালিক ওই যুবকদের ছাল ছাড়ানোর কাজে লাগিয়েছিল। প্রায় নিয়মিত কোনো না-কোনো দিন দেশের কোথাও না-কোথাও এই ধরনের গরু-বৃত্তান্ত শোনা যাচ্ছে। সুস্থ মানুষ প্রতিবাদ জানালেও অসুস্থ মানুষজন ভ্রুক্ষেপ করছে না। এ এক বিতিকিচ্ছির পরিস্থিতি।
পরিস্থিতি কতটা ঘোরাল, তা বোঝা গেল খোদ রাজধানীতে কেরালা ভবনের ঘটনায়। নয়াদিল্লি দেশের রাজধানী এবং সেখানে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের অনবরত আসতে হয় বলে স্বাধীনতার কিছু কাল পরে প্রতিটি রাজ্য সরকারকে সেখানে সস্তায় জমি দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, রাজ্যগুলো তাদের টাকায় সেই জমিতে ভবন তৈরি করুক। সেখানে সস্তায় থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করুক, যাতে যারাই সেখানে থাকবে তাদের থাকা ও খাওয়ায় অসুবিধা না হয়। কেরালা ভবনও তেমন আর পাঁচটা ভবনের মতো। এই ভবনগুলোর চৌহদ্দি রাজ্য সরকারের এখতিয়ারে। থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক রাজ্য সরকারই।
সেই কেরালা ভবনের ক্যানটিনে বহু বছর ধরেই গরুর মাংস বিক্রি হয়ে আসছে। গরু বলতে অবশ্য মহিষের মাংস। লোকজন চেটেপুটে খায়। অযোধ্যায় বিজেপির রামমন্দিরের আন্দোলনের সময় দেশের আনাচকানাচে বেশ কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে যায়। সেই রকমই একটা অতি অল্পপরিচিত সংগঠন, যার নাম হিন্দু সেনা, তারই দু-একজন নেতা পুলিশকে জানায়, কেরালা ভবনে খুল্লাম খুল্লা গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। পুলিশও খবর পাওয়ামাত্রই বিশাল এক বাহিনী নিয়ে কেরালা ভবনে চলে যায় এবং অধিকারের বেড়া টপকে সোজা ক্যানটিনে গিয়ে ‘বিফ ফ্রাই’ বিক্রি বন্ধের হুকুম জারি করে। এ যেন কানে হাত দিয়ে না দেখে চিলের পেছনে ছোটার গল্প। নির্বোধ পুলিশ এটা করে নিজেদের টেনে আনে বিতর্কের আবর্তে। শুরু হয় কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ। পুলিশ কমিশনার নিজে আইনের দোহাই দিয়ে গলা উঁচিয়ে যা-করেছি-ঠিক-করেছি সাফাই গেয়ে নিজেকে নির্বোধ পুলিশের নির্বোধ নেতা প্রতিপন্ন করে ফেললেন। বুঝলেন না, রাজ্যের এখতিয়ারে ওই ভাবে নাক না গলিয়ে তাঁর উচিত ছিল আগে কেরালা ভবনের সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলা। এই কদিন হলো, দিল্লি পুলিশ সার্কুলার জারি করে বলেছে, কোনো রাজ্যের ভবনে প্রবেশের আগে যেন কর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়।
গরু নিয়ে এই কাণ্ড-কারখানা শুরুর এক মাস আগে দেশের অতিপরিচিত যুক্তিবাদী লেখক এম এম কুলবর্গী নিজের বাড়ির সামনে খুন হন। এই মৃত্যুর আগে একইভাবে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীরা খুন করেছে যুক্তিবাদী লেখক গোবিন্দ পানসারে ও নরেন্দ্র দাভোলকরকে। তদন্তকারী পুলিশের সন্দেহ, এসব খুনের পেছনে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের যোগ রয়েছে। সংগঠনের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা সবাই সুপরিচিতই শুধু নন, কেউ কেউ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তও। অথচ সাহিত্য একাডেমি মূক ও বধির সেজে বসে! দেশের লেখককুল যখন এই অসহিষ্ণুতায় চঞ্চল, তখনই ঘটে যায় বিসাদা গ্রামের হত্যাকাণ্ড। দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির দলীয় সভাপতি কেউই ঘটনার নিন্দা করে কড়া কোনো বিবৃতি দিচ্ছেন না। ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত অশীতিপর নয়নতারা সায়গল প্রথম প্রতিবাদী হয়ে ফিরিয়ে দিলেন সাহিত্য একাডেমির পুরস্কার। তাঁর দেখাদেখি অন্যরা।
বিষয়টা শুধু লেখকদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকল না। দিন দিন অসহিষ্ণুতার মাথাচাড়া দেওয়া এবং এই প্রবণতাকে রুখতে প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে কোনো কড়া নিদান না আসায় সুস্থ মানুষ অসহায় বোধ করতে থাকলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই মৌনব্রতের কারণে তাঁরই দল ও সমভাবাপন্ন সংগঠনগুলোর কর্তারা উৎসাহী হয়ে দ্বিগুণ তেজে এমন সব কথাবার্তা শুরু করলেন, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে আশঙ্কিত করে তুলল। উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি শেষ পর্যন্ত মুখ খুললেন। বহুত্ববাদী চরিত্রই যে ভারতের শক্তি এবং সেটাই যে উত্তরণের একমাত্র পথ, খুব স্পষ্ট করে সেই বার্তা তিনি দিলেন। একবার নয়, দুবার নয়, তিন তিনবার। এরপরও প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে এমন কোনো বার্তা দেননি, যা মানুষজনকে আশ্বস্ত করতে পারে। যা তিনি বলেছেন, তা সরাসরি কোনো বার্তা নয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা। কিন্তু সেই বলার মাঝেও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ঘটনার জন্য কেন কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষী ঠাওরানো হবে?
বিতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার এই কৌশল নরেন্দ্র মোদি কেন নিয়েছেন তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দুটি। প্রথমটি হলো তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাস, যা তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছেন। সেই বিশ্বাসের সঙ্গে দেশের বহুত্ববাদী চরিত্রের স্পষ্ট বিরোধ রয়েছে, যা তাঁরা সরাসরি বলেও থাকেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পর সেই বিশ্বাসের সঙ্গে কর্তব্যের অনিবার্য সংঘাতে তিনি তাঁর প্রকৃত ভূমিকাটা আঁকড়ে ধরতে পারছেন না। দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন। রাষ্ট্রের কর্তব্য তাঁর মাধ্যমেই পালিত হওয়ার কথা। সেই কর্তব্য করতে গেলে বিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। ফলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি নিজেকে অসহায় করে তুলেছেন।
দ্বিতীয় কারণটি বিহারের ভোট। লক্ষ করলে দেখা যাবে, অসহিষ্ণুতা মাত্রাছাড়া হওয়া ও সেই ধোঁয়ায় বাতাস দেওয়া শুরু বিহারের ভোট-পর্ব এগিয়ে আসার সময় থেকে। ২০ বছরের শত্রুতা শিকেয় তুলে লালু প্রসাদ ও নীতিশ কুমার যে জোট বাঁধবেন এবং সেই জোটের শরিক করবেন তাঁদের এযাবৎকালের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে, বিজেপি তা বুঝতে পারেনি। হেলায় লঙ্কা জয়ের মতো মোদি-হাওয়ায় ভর করে লোকসভার মতো বিধানসভাতেও বিজেপি বিহারের দখল নেবে, বিজেপির এই ভাবনাটা ক্রমেই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে যায়। লড়াইটা যত কঠিন হতে থাকে, ততই দানা বাঁধতে থাকে গরু-বিতর্ক। মাথাচাড়া দিতে থাকে অসহিষ্ণুতা। তুচ্ছ তুচ্ছ অজুহাত সৃষ্টি করতে থাকে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় সংঘাতের, যা ধর্মীয় মেরুকরণের পথ প্রশস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। নরেন্দ্র মোদিও কড়া ভাষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সাংবিধানিক চরিত্র অটুট রাখার কথা বলছেন না পাছে বিহার হাত থেকে ফসকে যায়, সেই আশঙ্কায়। তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, বিহার তাঁর ও টিম মোদির কাছে মরণ-বাঁচনের লড়াই। এই লড়াইয়ে হার মানে তাঁর জৌলুশ ফিকে হয়ে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কিন্তু মনে রাখা দরকার, দেশের মানুষ ভোটটা দিয়েছে স্রেফ তাঁকে দেখে। দিয়েছে সুশাসনের আশায়। তিনিও প্রথম দিন থেকেই বোঝাতে চেয়েছেন, নিছকই দলীয় নেতা নন, তিনি একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক হতে চান, যা সবদিক থেকে ভারতের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে।
মোদির মৌনতা ও অসহিষ্ণুতা প্রতিবাদীদের বৃত্তটিকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। লেখকদের পর এবার প্রতিবাদী স্বর শোনা যাচ্ছে বিজ্ঞানী মহল, ঐতিহাসিক, শিক্ষাবিদ ও বিনোদনের জগৎ থেকে। বিজেপি কিন্তু এখনো এই প্রবণতাকে সমস্যা বলে স্বীকার করতে রাজি নয়। বরং গলা উঁচিয়ে তারা যা বলছে, তার সারকথা, প্রতিবাদীরা সবাই কংগ্রেস ঘরানার মানুষ। বিজেপি-বিরোধিতাই যাদের ধর্ম। রাজনৈতিক যুক্তি রাজনীতির মানুষজন দেবেনই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও টিম মোদির এটা জানা দরকার, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
আরও জানা দরকার, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার দরুন আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও প্রশ্ন উঠছে। বহির্বিশ্ব দেখছে, নরেন্দ্র মোদির কথায় ও আচরণে বিস্তর ফারাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তুলেছে, জার্মানিতে সংশয় দানা বাঁধছে, পাকিস্তান পর্যন্ত খোঁটা দিতে ছাড়ছে না। এই যে ঘটা করে ইন্ডিয়া-আফ্রিকা ফোরামের শীর্ষ বৈঠক হয়ে গেল, সেখানেও নিভৃতে গরু-বিতর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সারকথাটি শুনিয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ‘রেটিং এজেন্সি’ মুডিজ। ভণিতা না করে তারা সোজাসাপটা বলে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি দলীয় সদস্যদের রাশ টানতে না পারেন, তা হলে দেশে ও বিদেশে তিনি দ্রুত নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলবেন।
মোদি আর যাই হোন উটপাখি নন। ভোটে জেতার আগে থেকে ভারতকে তিনি যে উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নের কথা শুনিয়ে আসছেন, তা সফল করতে তাঁকে জাগতেই হবে। মুডিজ সরাসরি সেই ‘ওয়ার্নিং’ তাঁকে দিয়ে রাখল।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
ওই নিবন্ধ প্রকাশের পরপরই বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে যায়। অযথা কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে। অনর্থক অশান্তি সৃষ্টি হয় রাজ্যে রাজ্যে। দেশজুড়ে শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। সেই বিতর্ক আজও অব্যাহত। গরু-বিতর্কে দেশটা যে এত তাড়াতাড়ি এভাবে টানটান হয়ে উঠবে, তখন বোঝা যায়নি। এখন বুঝছি, গরু অতি বিষম বস্তু।
প্রথম ঘটনাটা ঘটল রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে উত্তর প্রদেশের দাদরি এলাকার বিসাদা গ্রামে। সেই গ্রামে স্মরণকালের মধ্যে কোনো দিন হিন্দু-মুসলমানে মারামারি হয়নি। দাঙ্গা তো দূরের কথা। বরং দোল-দীপাবলি—ঈদ দুই সম্প্রদায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্যাপন করে এসেছে। এ রকম একটা গ্রামে মোহাম্মদ ইকলাখ নামে মাঝ-পঞ্চাশের এক প্রৌঢ়কে গ্রামেরই পরিচিতরা পিটিয়ে মেরে ফেলে স্রেফ একটা গুজব শুনে। গুজবটা গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে। এরই পিঠাপিঠি জম্মু-কাশ্মীরের উধমপুর এলাকায় একটি ট্রাকে পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। অভিযোগ, ট্রাকে করে গরু পাচার হচ্ছিল। সেই ঘটনায় এক মুসলমান যুবকের মৃত্যু হয়। পুলিশ তদন্ত করে দেখে দুটি ঘটনারই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আরও একটি ঘটনা ঘটে উত্তর প্রদেশেই। একটি গরুর চামড়া ছাড়াচ্ছিল দুই যুবক। কিছু মানুষ তা দেখে তাদের বেদম প্রহার করে। পরে জানা যায় গরুটির স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তার মালিক ওই যুবকদের ছাল ছাড়ানোর কাজে লাগিয়েছিল। প্রায় নিয়মিত কোনো না-কোনো দিন দেশের কোথাও না-কোথাও এই ধরনের গরু-বৃত্তান্ত শোনা যাচ্ছে। সুস্থ মানুষ প্রতিবাদ জানালেও অসুস্থ মানুষজন ভ্রুক্ষেপ করছে না। এ এক বিতিকিচ্ছির পরিস্থিতি।
পরিস্থিতি কতটা ঘোরাল, তা বোঝা গেল খোদ রাজধানীতে কেরালা ভবনের ঘটনায়। নয়াদিল্লি দেশের রাজধানী এবং সেখানে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের অনবরত আসতে হয় বলে স্বাধীনতার কিছু কাল পরে প্রতিটি রাজ্য সরকারকে সেখানে সস্তায় জমি দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, রাজ্যগুলো তাদের টাকায় সেই জমিতে ভবন তৈরি করুক। সেখানে সস্তায় থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করুক, যাতে যারাই সেখানে থাকবে তাদের থাকা ও খাওয়ায় অসুবিধা না হয়। কেরালা ভবনও তেমন আর পাঁচটা ভবনের মতো। এই ভবনগুলোর চৌহদ্দি রাজ্য সরকারের এখতিয়ারে। থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক রাজ্য সরকারই।
সেই কেরালা ভবনের ক্যানটিনে বহু বছর ধরেই গরুর মাংস বিক্রি হয়ে আসছে। গরু বলতে অবশ্য মহিষের মাংস। লোকজন চেটেপুটে খায়। অযোধ্যায় বিজেপির রামমন্দিরের আন্দোলনের সময় দেশের আনাচকানাচে বেশ কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে যায়। সেই রকমই একটা অতি অল্পপরিচিত সংগঠন, যার নাম হিন্দু সেনা, তারই দু-একজন নেতা পুলিশকে জানায়, কেরালা ভবনে খুল্লাম খুল্লা গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। পুলিশও খবর পাওয়ামাত্রই বিশাল এক বাহিনী নিয়ে কেরালা ভবনে চলে যায় এবং অধিকারের বেড়া টপকে সোজা ক্যানটিনে গিয়ে ‘বিফ ফ্রাই’ বিক্রি বন্ধের হুকুম জারি করে। এ যেন কানে হাত দিয়ে না দেখে চিলের পেছনে ছোটার গল্প। নির্বোধ পুলিশ এটা করে নিজেদের টেনে আনে বিতর্কের আবর্তে। শুরু হয় কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ। পুলিশ কমিশনার নিজে আইনের দোহাই দিয়ে গলা উঁচিয়ে যা-করেছি-ঠিক-করেছি সাফাই গেয়ে নিজেকে নির্বোধ পুলিশের নির্বোধ নেতা প্রতিপন্ন করে ফেললেন। বুঝলেন না, রাজ্যের এখতিয়ারে ওই ভাবে নাক না গলিয়ে তাঁর উচিত ছিল আগে কেরালা ভবনের সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলা। এই কদিন হলো, দিল্লি পুলিশ সার্কুলার জারি করে বলেছে, কোনো রাজ্যের ভবনে প্রবেশের আগে যেন কর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়।
গরু নিয়ে এই কাণ্ড-কারখানা শুরুর এক মাস আগে দেশের অতিপরিচিত যুক্তিবাদী লেখক এম এম কুলবর্গী নিজের বাড়ির সামনে খুন হন। এই মৃত্যুর আগে একইভাবে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীরা খুন করেছে যুক্তিবাদী লেখক গোবিন্দ পানসারে ও নরেন্দ্র দাভোলকরকে। তদন্তকারী পুলিশের সন্দেহ, এসব খুনের পেছনে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের যোগ রয়েছে। সংগঠনের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা সবাই সুপরিচিতই শুধু নন, কেউ কেউ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তও। অথচ সাহিত্য একাডেমি মূক ও বধির সেজে বসে! দেশের লেখককুল যখন এই অসহিষ্ণুতায় চঞ্চল, তখনই ঘটে যায় বিসাদা গ্রামের হত্যাকাণ্ড। দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির দলীয় সভাপতি কেউই ঘটনার নিন্দা করে কড়া কোনো বিবৃতি দিচ্ছেন না। ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত অশীতিপর নয়নতারা সায়গল প্রথম প্রতিবাদী হয়ে ফিরিয়ে দিলেন সাহিত্য একাডেমির পুরস্কার। তাঁর দেখাদেখি অন্যরা।
বিষয়টা শুধু লেখকদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকল না। দিন দিন অসহিষ্ণুতার মাথাচাড়া দেওয়া এবং এই প্রবণতাকে রুখতে প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে কোনো কড়া নিদান না আসায় সুস্থ মানুষ অসহায় বোধ করতে থাকলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই মৌনব্রতের কারণে তাঁরই দল ও সমভাবাপন্ন সংগঠনগুলোর কর্তারা উৎসাহী হয়ে দ্বিগুণ তেজে এমন সব কথাবার্তা শুরু করলেন, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে আশঙ্কিত করে তুলল। উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি শেষ পর্যন্ত মুখ খুললেন। বহুত্ববাদী চরিত্রই যে ভারতের শক্তি এবং সেটাই যে উত্তরণের একমাত্র পথ, খুব স্পষ্ট করে সেই বার্তা তিনি দিলেন। একবার নয়, দুবার নয়, তিন তিনবার। এরপরও প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে এমন কোনো বার্তা দেননি, যা মানুষজনকে আশ্বস্ত করতে পারে। যা তিনি বলেছেন, তা সরাসরি কোনো বার্তা নয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা। কিন্তু সেই বলার মাঝেও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ঘটনার জন্য কেন কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষী ঠাওরানো হবে?
বিতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার এই কৌশল নরেন্দ্র মোদি কেন নিয়েছেন তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দুটি। প্রথমটি হলো তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্বাস, যা তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছেন। সেই বিশ্বাসের সঙ্গে দেশের বহুত্ববাদী চরিত্রের স্পষ্ট বিরোধ রয়েছে, যা তাঁরা সরাসরি বলেও থাকেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পর সেই বিশ্বাসের সঙ্গে কর্তব্যের অনিবার্য সংঘাতে তিনি তাঁর প্রকৃত ভূমিকাটা আঁকড়ে ধরতে পারছেন না। দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন। রাষ্ট্রের কর্তব্য তাঁর মাধ্যমেই পালিত হওয়ার কথা। সেই কর্তব্য করতে গেলে বিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। ফলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তিনি নিজেকে অসহায় করে তুলেছেন।
দ্বিতীয় কারণটি বিহারের ভোট। লক্ষ করলে দেখা যাবে, অসহিষ্ণুতা মাত্রাছাড়া হওয়া ও সেই ধোঁয়ায় বাতাস দেওয়া শুরু বিহারের ভোট-পর্ব এগিয়ে আসার সময় থেকে। ২০ বছরের শত্রুতা শিকেয় তুলে লালু প্রসাদ ও নীতিশ কুমার যে জোট বাঁধবেন এবং সেই জোটের শরিক করবেন তাঁদের এযাবৎকালের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে, বিজেপি তা বুঝতে পারেনি। হেলায় লঙ্কা জয়ের মতো মোদি-হাওয়ায় ভর করে লোকসভার মতো বিধানসভাতেও বিজেপি বিহারের দখল নেবে, বিজেপির এই ভাবনাটা ক্রমেই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে যায়। লড়াইটা যত কঠিন হতে থাকে, ততই দানা বাঁধতে থাকে গরু-বিতর্ক। মাথাচাড়া দিতে থাকে অসহিষ্ণুতা। তুচ্ছ তুচ্ছ অজুহাত সৃষ্টি করতে থাকে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় সংঘাতের, যা ধর্মীয় মেরুকরণের পথ প্রশস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। নরেন্দ্র মোদিও কড়া ভাষায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সাংবিধানিক চরিত্র অটুট রাখার কথা বলছেন না পাছে বিহার হাত থেকে ফসকে যায়, সেই আশঙ্কায়। তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, বিহার তাঁর ও টিম মোদির কাছে মরণ-বাঁচনের লড়াই। এই লড়াইয়ে হার মানে তাঁর জৌলুশ ফিকে হয়ে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রীর কিন্তু মনে রাখা দরকার, দেশের মানুষ ভোটটা দিয়েছে স্রেফ তাঁকে দেখে। দিয়েছে সুশাসনের আশায়। তিনিও প্রথম দিন থেকেই বোঝাতে চেয়েছেন, নিছকই দলীয় নেতা নন, তিনি একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক হতে চান, যা সবদিক থেকে ভারতের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে।
মোদির মৌনতা ও অসহিষ্ণুতা প্রতিবাদীদের বৃত্তটিকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। লেখকদের পর এবার প্রতিবাদী স্বর শোনা যাচ্ছে বিজ্ঞানী মহল, ঐতিহাসিক, শিক্ষাবিদ ও বিনোদনের জগৎ থেকে। বিজেপি কিন্তু এখনো এই প্রবণতাকে সমস্যা বলে স্বীকার করতে রাজি নয়। বরং গলা উঁচিয়ে তারা যা বলছে, তার সারকথা, প্রতিবাদীরা সবাই কংগ্রেস ঘরানার মানুষ। বিজেপি-বিরোধিতাই যাদের ধর্ম। রাজনৈতিক যুক্তি রাজনীতির মানুষজন দেবেনই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও টিম মোদির এটা জানা দরকার, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।
আরও জানা দরকার, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার দরুন আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও প্রশ্ন উঠছে। বহির্বিশ্ব দেখছে, নরেন্দ্র মোদির কথায় ও আচরণে বিস্তর ফারাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তুলেছে, জার্মানিতে সংশয় দানা বাঁধছে, পাকিস্তান পর্যন্ত খোঁটা দিতে ছাড়ছে না। এই যে ঘটা করে ইন্ডিয়া-আফ্রিকা ফোরামের শীর্ষ বৈঠক হয়ে গেল, সেখানেও নিভৃতে গরু-বিতর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সারকথাটি শুনিয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ‘রেটিং এজেন্সি’ মুডিজ। ভণিতা না করে তারা সোজাসাপটা বলে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি দলীয় সদস্যদের রাশ টানতে না পারেন, তা হলে দেশে ও বিদেশে তিনি দ্রুত নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলবেন।
মোদি আর যাই হোন উটপাখি নন। ভোটে জেতার আগে থেকে ভারতকে তিনি যে উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নের কথা শুনিয়ে আসছেন, তা সফল করতে তাঁকে জাগতেই হবে। মুডিজ সরাসরি সেই ‘ওয়ার্নিং’ তাঁকে দিয়ে রাখল।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments