দুর্গার আলেখ্য by আহমদ কবির
দোকরা পদ্ধতিতে পিতলে ঢালাই দুর্গা মূর্তি -প্রথম আলো |
বাংলাদেশ
কেবল মুসলমানের দেশ নয়, হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার
মানুষগুলোরও দেশ; বিশেষত যথেষ্ট হিন্দু বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ এবং
বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান-উৎসবগুলোও সর্বজনীন। সেখানে
মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাহাড়ি—সবাই থাকবে।
বিশ্বাসের জায়গা আলাদা রেখেও সবাই একে অপরের আমন্ত্রণে যাবে, আহার গ্রহণ
করবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করবে। সুখ-দুঃখের কথা বলবে এবং প্রীতি
বিনিময় করবে। ধর্মীয় বিভেদ-বৈষম্য থাকলে এবং আভিজাত্য ও জাত-পাতের বাছবিচার
থাকলে মনের সংকীর্ণতা কোনো দিন ঘুচবে না। তাতে মিলন উপরি উপরি থাকবে, মনের
গভীরে প্রবেশ করবে না।
সম্প্রীতি ও মিলনই হচ্ছে দুর্গার আলেখ্যের অর্থাৎ দুর্গোৎসবের মূল কথা। মুসলমানেরা তো দুর্গাপূজা করে না, কিন্তু দলে দলে তারা পূজামণ্ডপ দেখতে যায়, কেউ কেউ খেয়েও আসে এবং নৃত্যগীতেও লম্ফঝম্প দেয়, কেউ গায়ও। বাংলাদেশের মুসলমানেরা কেবল দুর্গাপূজার দর্শক হবে না, হিন্দুদের সহযোগী ও বন্ধু হবে। সম্প্রীতির কথা শুধু মুখে বললে হবে না, কাজেও দেখাতে হবে। দুর্গাপূজা একসময় বারোয়ারি ছিল, কিন্তু এটি এখন সর্বজনীন। হিন্দুর দুর্গতিতে মুসলমান এগিয়ে আসবে, এটাই প্রত্যাশিত।
পুরাণ মতে, দুর্গার বাপের বাড়ি হিমালয়, মেনকা তাঁর মা। কিন্তু পুরাণের দেবী পিত্রালয় বঙ্গে যেদিন আসেন, সেদিন হলো মহালয়া। এটি আসলে দেবীর আগমন বার্তা; আকাশে-বাতাসে, সাদা মেঘের ভেলায়, নদী কিনারে কাশফুলের স্বচ্ছ মেলায়; শিউলি ফুল ও প্রভাতের শিশিরের দ্যুতিতে। দেবী পুত্র-কন্যাদের নিয়ে আসেন; অনেকটা ঘুমের ঘোরে, অনেকটা সুপ্তিতে। এদিকে পূজার্থীরা দেবী বরণে হাজার হাজার পূজামণ্ডপ তৈরি করেন। দেবী মূর্তি তখনও চক্ষুমুদিতা, তাঁর চোখ খুলে দিয়ে তাঁকে জাগ্রত ও জীবন্ত করতে হবে, তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও। এই ধর্মীয় কৃত্যটির নাম বোধন; ষষ্ঠী পুজোর সন্ধ্যায় এটি করে নিতে হয়।
দেবী দুর্গা যে-রূপে আসেন, সেটি আবহমানকাল ধরে বাঙালির কাছে সুপরিচিত। বাঙালি ভক্তিমান পূজারিরা এই রূপটি বহু আগেই গড়ে দিয়েছে। দেবী সিংহবাহিনী, হাতে ত্রিশূল, পদদলিত মহিষাসুর; ত্রিশূল মহিষাসুরের বক্ষে প্রবিষ্ট, দেবী সর্বাঙ্গ সালংকারা; বাঙালি রমণীর মতো শাড়ি সজ্জিতা। তবে যেনতেন শাড়ি নয়, সোনালি পট্টবস্ত্র অত্যুত্তম, সূতি বস্ত্র হলে সূক্ষ্ম, মসলিন-মিহি, সাধারণত লাল বা স্বর্ণ পাড়ের, দেবী মহা মহিমা ও মহা মর্যাদার মহা উপযোগী। দেবীর মাথায় স্বর্ণমুকুট, বাহুতে কাঁকন-বলয়, সুকৃষ্ণ কেশদাম পশ্চাদ্গামিনী, মুক্ত বেণি।
দেবীর চোখ ক্রোধী নয়, তবে বিস্ফারিত দীপ্তোজ্জ্বল কঠিন। দেবী ত্রিনয়না, স্বামী শিবের আদলে এটি হয়েছে। শিবের মতো তাঁর হাতেও ত্রিশূল। দেবীর রূপবিভা ও কান্তি অভূতপূর্ব বৈভবপূর্ণ। সবটা মিলিয়ে দেবী মহা শ্রদ্ধা ও ভক্তির মহা মা, মহামায়া। হালের বাঙালি পটুয়ারা দেবীর মুখাকৃতিকে রূপসী চিত্রনায়িকার আদলে গড়লেও দেবী থেকে যান মাতৃরূপেই। দেবীর সঙ্গে দেবীর পুত্র-কন্যারাও স্ব স্ব মহিমা, পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য, সজ্জা ও বাহন নিয়ে আসেন। যেমন গণদেবতা গণেশের মুখমণ্ডলে হাতির শুঁড়-মুখ, পেট মোটা হয়েছে ওই মুখাকৃতির কারণে, সঙ্গে ইঁদুরও ঘোরাফেরা করে; মহা রূপবান দেব সেনাপতি সশস্ত্র কার্তিক ময়ূর বাহন; সর্বাঙ্গ-সালংকারা রূপৈশ্চর্য ও ধনে গরবিনী লক্ষ্মী, সঙ্গে প্যাঁচা আর বিদ্যাদেবী শুভ্র সমুজ্জ্বল সরস্বতী হংসবাহনী। দুর্গার একলা মূর্তি দিয়ে পুজো হতে পারে না তা নয়, তবে তা হয় না। পুত্র-কন্যাগণ, সিংহবাহন ও মহিষাসুর নিয়েই দুর্গামূর্তির পূর্ণতা। সব মিলিয়েই মূর্তি বাহিনীর এক পূজাপট। দুর্গার সার্বক্ষণিক বাহন সিংহ; কিন্তু দুর্গা মাঝেমধ্যে বৃষ, মর্কট, মহিষ, গরুড়, হংসকেও বাহন করে মর্ত্যে অর্থাৎ বঙ্গে আসেন; কদাচিৎ তুরঙ্গম, কখনো বহিত্র তাঁর বাহন হয়।
কিন্তু যে বাহনেই দুর্গা আসুন না কেন, শরতের নির্দিষ্ট দিনক্ষণে ও তিথিতে দুর্গার আগমনের কিছুমাত্র বিলম্ব ঘটে না। যথাসময়েই দেবী আসেন, বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসবের মধ্যমণি হয়ে। বাঙালি হিন্দুরা দেবীর পিত্রালয়-যাপনের কয়টা দিন আনন্দে-উল্লাসে, হুল্লোড়ে, কেনাকাটায়, সুখাদ্য তৈরিতে, সাংস্কৃতিক উৎসব সৃষ্টিতে, পর্যটনে, নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে, সংগীত রচনায় ও পরিবেশনায় এবং টেলিভিশনে চলচ্চিত্রে নতুন নতুন সূচি তৈরিতে স্ব স্ব ব্যস্ত থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, আসামের একাংশে এবং ভারতের ও পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাঙালি অধিবাস করছে, সেসব জায়গায়ও উৎসবের ঢল বয়ে যায়। আজকাল প্রযুক্তির বিপুল প্রসারে, বিশেষভাবে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের কল্যাণে দুর্গাপূজা বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে। দুর্গা ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের পুজো সাকার বিধায় সায়ন্তনে আলোক বিভায়, পুষ্পরাজির শোভায়, ধূপ-ধুনোয়, আরতির তুমুল নৃত্য-গানে, ঢোল-বাদ্য-ঘণ্টায় অতীব জমকালো, মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সঙ্গে থাকে পুরোহিতের বিশেষ পূতপবিত্র সজ্জা ও মুখাভাব, মন্ত্র ও ত্রোস্তের মধুর গম্ভীর সামধ্বনি। উচ্চবিত্ত বাঙালি হিন্দুর দুর্গাপূজা সব সময় জৌলুশপূর্ণ ও মহার্ঘ। নিম্নবিত্তদের পূজায় অত জৌলুশ থাকে না থাকলেও ভক্তি, প্রীতি ও আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি থাকে না। সাঁওতাল ও অন্য আদিবাসীদের পূজা সাদামাটা, মূর্তি ঝলমলে নয়, কিন্তু গভীর ভাবব্যঞ্জক। বঙ্গভূমিতে অনার্য আদিবাসীরাই দুর্গাপূজার পথিকৃৎ।
সম্প্রীতি ও মিলনই হচ্ছে দুর্গার আলেখ্যের অর্থাৎ দুর্গোৎসবের মূল কথা। মুসলমানেরা তো দুর্গাপূজা করে না, কিন্তু দলে দলে তারা পূজামণ্ডপ দেখতে যায়, কেউ কেউ খেয়েও আসে এবং নৃত্যগীতেও লম্ফঝম্প দেয়, কেউ গায়ও। বাংলাদেশের মুসলমানেরা কেবল দুর্গাপূজার দর্শক হবে না, হিন্দুদের সহযোগী ও বন্ধু হবে। সম্প্রীতির কথা শুধু মুখে বললে হবে না, কাজেও দেখাতে হবে। দুর্গাপূজা একসময় বারোয়ারি ছিল, কিন্তু এটি এখন সর্বজনীন। হিন্দুর দুর্গতিতে মুসলমান এগিয়ে আসবে, এটাই প্রত্যাশিত।
পুরাণ মতে, দুর্গার বাপের বাড়ি হিমালয়, মেনকা তাঁর মা। কিন্তু পুরাণের দেবী পিত্রালয় বঙ্গে যেদিন আসেন, সেদিন হলো মহালয়া। এটি আসলে দেবীর আগমন বার্তা; আকাশে-বাতাসে, সাদা মেঘের ভেলায়, নদী কিনারে কাশফুলের স্বচ্ছ মেলায়; শিউলি ফুল ও প্রভাতের শিশিরের দ্যুতিতে। দেবী পুত্র-কন্যাদের নিয়ে আসেন; অনেকটা ঘুমের ঘোরে, অনেকটা সুপ্তিতে। এদিকে পূজার্থীরা দেবী বরণে হাজার হাজার পূজামণ্ডপ তৈরি করেন। দেবী মূর্তি তখনও চক্ষুমুদিতা, তাঁর চোখ খুলে দিয়ে তাঁকে জাগ্রত ও জীবন্ত করতে হবে, তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও। এই ধর্মীয় কৃত্যটির নাম বোধন; ষষ্ঠী পুজোর সন্ধ্যায় এটি করে নিতে হয়।
দেবী দুর্গা যে-রূপে আসেন, সেটি আবহমানকাল ধরে বাঙালির কাছে সুপরিচিত। বাঙালি ভক্তিমান পূজারিরা এই রূপটি বহু আগেই গড়ে দিয়েছে। দেবী সিংহবাহিনী, হাতে ত্রিশূল, পদদলিত মহিষাসুর; ত্রিশূল মহিষাসুরের বক্ষে প্রবিষ্ট, দেবী সর্বাঙ্গ সালংকারা; বাঙালি রমণীর মতো শাড়ি সজ্জিতা। তবে যেনতেন শাড়ি নয়, সোনালি পট্টবস্ত্র অত্যুত্তম, সূতি বস্ত্র হলে সূক্ষ্ম, মসলিন-মিহি, সাধারণত লাল বা স্বর্ণ পাড়ের, দেবী মহা মহিমা ও মহা মর্যাদার মহা উপযোগী। দেবীর মাথায় স্বর্ণমুকুট, বাহুতে কাঁকন-বলয়, সুকৃষ্ণ কেশদাম পশ্চাদ্গামিনী, মুক্ত বেণি।
দেবীর চোখ ক্রোধী নয়, তবে বিস্ফারিত দীপ্তোজ্জ্বল কঠিন। দেবী ত্রিনয়না, স্বামী শিবের আদলে এটি হয়েছে। শিবের মতো তাঁর হাতেও ত্রিশূল। দেবীর রূপবিভা ও কান্তি অভূতপূর্ব বৈভবপূর্ণ। সবটা মিলিয়ে দেবী মহা শ্রদ্ধা ও ভক্তির মহা মা, মহামায়া। হালের বাঙালি পটুয়ারা দেবীর মুখাকৃতিকে রূপসী চিত্রনায়িকার আদলে গড়লেও দেবী থেকে যান মাতৃরূপেই। দেবীর সঙ্গে দেবীর পুত্র-কন্যারাও স্ব স্ব মহিমা, পরিচিতি, বৈশিষ্ট্য, সজ্জা ও বাহন নিয়ে আসেন। যেমন গণদেবতা গণেশের মুখমণ্ডলে হাতির শুঁড়-মুখ, পেট মোটা হয়েছে ওই মুখাকৃতির কারণে, সঙ্গে ইঁদুরও ঘোরাফেরা করে; মহা রূপবান দেব সেনাপতি সশস্ত্র কার্তিক ময়ূর বাহন; সর্বাঙ্গ-সালংকারা রূপৈশ্চর্য ও ধনে গরবিনী লক্ষ্মী, সঙ্গে প্যাঁচা আর বিদ্যাদেবী শুভ্র সমুজ্জ্বল সরস্বতী হংসবাহনী। দুর্গার একলা মূর্তি দিয়ে পুজো হতে পারে না তা নয়, তবে তা হয় না। পুত্র-কন্যাগণ, সিংহবাহন ও মহিষাসুর নিয়েই দুর্গামূর্তির পূর্ণতা। সব মিলিয়েই মূর্তি বাহিনীর এক পূজাপট। দুর্গার সার্বক্ষণিক বাহন সিংহ; কিন্তু দুর্গা মাঝেমধ্যে বৃষ, মর্কট, মহিষ, গরুড়, হংসকেও বাহন করে মর্ত্যে অর্থাৎ বঙ্গে আসেন; কদাচিৎ তুরঙ্গম, কখনো বহিত্র তাঁর বাহন হয়।
কিন্তু যে বাহনেই দুর্গা আসুন না কেন, শরতের নির্দিষ্ট দিনক্ষণে ও তিথিতে দুর্গার আগমনের কিছুমাত্র বিলম্ব ঘটে না। যথাসময়েই দেবী আসেন, বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসবের মধ্যমণি হয়ে। বাঙালি হিন্দুরা দেবীর পিত্রালয়-যাপনের কয়টা দিন আনন্দে-উল্লাসে, হুল্লোড়ে, কেনাকাটায়, সুখাদ্য তৈরিতে, সাংস্কৃতিক উৎসব সৃষ্টিতে, পর্যটনে, নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে, সংগীত রচনায় ও পরিবেশনায় এবং টেলিভিশনে চলচ্চিত্রে নতুন নতুন সূচি তৈরিতে স্ব স্ব ব্যস্ত থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, আসামের একাংশে এবং ভারতের ও পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাঙালি অধিবাস করছে, সেসব জায়গায়ও উৎসবের ঢল বয়ে যায়। আজকাল প্রযুক্তির বিপুল প্রসারে, বিশেষভাবে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের কল্যাণে দুর্গাপূজা বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে। দুর্গা ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের পুজো সাকার বিধায় সায়ন্তনে আলোক বিভায়, পুষ্পরাজির শোভায়, ধূপ-ধুনোয়, আরতির তুমুল নৃত্য-গানে, ঢোল-বাদ্য-ঘণ্টায় অতীব জমকালো, মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সঙ্গে থাকে পুরোহিতের বিশেষ পূতপবিত্র সজ্জা ও মুখাভাব, মন্ত্র ও ত্রোস্তের মধুর গম্ভীর সামধ্বনি। উচ্চবিত্ত বাঙালি হিন্দুর দুর্গাপূজা সব সময় জৌলুশপূর্ণ ও মহার্ঘ। নিম্নবিত্তদের পূজায় অত জৌলুশ থাকে না থাকলেও ভক্তি, প্রীতি ও আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি থাকে না। সাঁওতাল ও অন্য আদিবাসীদের পূজা সাদামাটা, মূর্তি ঝলমলে নয়, কিন্তু গভীর ভাবব্যঞ্জক। বঙ্গভূমিতে অনার্য আদিবাসীরাই দুর্গাপূজার পথিকৃৎ।
No comments