কোন পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটায় by আলী রীয়াজ
একটি
দেশে কেন জঙ্গিবাদ বা সহিংস উগ্রপন্থা বিস্তার লাভ করে, কেন এ ধরনের আদর্শ
মানুষকে আকর্ষণ করে, কারা জঙ্গিবাদের প্রতি আকর্ষিত হয়? কয়েক দশক ধরেই
সমাজবিজ্ঞানী, নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকেরা এই
প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। প্রকৃতপক্ষে এই প্রশ্নগুলো বেশ
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গত শতকের ষাটের দশকে, যখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের
প্রতি মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয় এবং বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র
বিপ্লবের পথে সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু তার আগেও জাতীয়তাবাদী
আন্দোলনের অংশ হিসেবে সহিংসতার ব্যবহারকে (যেমন: আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি,
বাস্ক গেরিলাদের সংগঠন) বোঝার জন্যও একই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
সত্তরের দশকে ইতালির রেড ব্রিগেড, জার্মানির বাদের-মেইনহফ, জাপানে রেড
আর্মিকে যাঁরা অনুসরণ করেছেন, সেসব গবেষকও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন।
ফলে এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে কখনোই ঘাটতি ছিল না।
এই প্রশ্নগুলো নতুন করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর; আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদার আবির্ভাব, আফগানিস্তানে তালেবানের গ্রহণযোগ্যতা এই প্রশ্নগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করে দেয়। এই পর্যায়ে রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে ধর্মের প্রশ্ন। কেউ কেউ এই প্রশ্নও তোলেন যে রাজনৈতিক আদর্শ ও ধর্মের মধ্যে কোনো বিভাজন টানা উচিত হবে কি না।
রাজনৈতিক ইসলামের মধ্য থেকে একটি ধারা আগেও সহিংসতাকে তাদের কৌশল হিসেবেই শুধু বেছে নিয়েছিল তা নয়, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় একেই একমাত্র পথ বলেও বিবেচনা করে সে পথেই অগ্রসর হয়েছে। তালেবান সেই ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। ২০০১ সালের ঘটনাবলির কারণে তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষিত হয়। এই ধারার লক্ষ্য সীমিত বলেই বিবেচিত হওয়া দরকার, কেননা নিজস্ব রাষ্ট্রের মধ্যেই তারা তাদের আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং চেয়েছে। অন্যপক্ষে, আমরা দেখতে পাই ইসলামের রাজনৈতিক দিককে আশ্রয় করে আরও সংগঠনের আবির্ভাব বা পুনরুত্থান ঘটে, যাদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রসীমাকে অস্বীকার করে তাদের ভাষায় ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা। একই সঙ্গে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক কাঠামোকে তারা চ্যালেঞ্জ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। কৌশল ও কর্মপদ্ধতি তাদের জন্য গৌণ বিষয়। হিযবুত তাহ্রীর সেই ধারার প্রতিনিধি।
এই ঘটনাপ্রবাহ ইসলামপন্থী রাজনীতির মধ্যে যেমন বিভিন্ন ধারার জন্ম দেয়, তেমনি এসব ধারার আবেদন বোঝার তাগিদ তৈরি হয়। অবশ্যই এই ঘটনাপ্রবাহ নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়নি। চলমান আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি, অর্থনীতির বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির উৎকর্ষ—সবই তাকে প্রভাবিত করেছে। ২০১০ সাল নাগাদ আমরা দেখতে পাই যে আরও একধরনের সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত অঞ্চলগুলোয় তাদের নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের রাষ্ট্র, যাকে তারা ‘খেলাফত’ বলে বর্ণনা করে, প্রতিষ্ঠা করে এবং সারা পৃথিবীর মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার হয়ে ওঠে। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম ও ইরাকে ইসলামি রাষ্ট্র এর উদাহরণ।
এই ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি ২০০১ সাল থেকে ইসলামপন্থী সহিংস চরমপন্থী সংগঠনগুলো নিয়ে গবেষণার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এসব গবেষণার ফলাফলের দিকে দৃকপাত না করে অনেক বিশ্লেষক, রাজনীতিবিদ সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের কারণ হিসেবে তাঁদের ধারণাকে প্রকৃত কারণ বলে বর্ণনা করতে শুরু করেন। এই প্রবণতার সবচেয়ে বড় দিক হলো এই যে তাঁরা ধরে নিলেন যে দারিদ্র্যই হচ্ছে সহিংস চরমপন্থার কারণ এবং সুযোগবঞ্চিত মানুষেরা জঙ্গি সংগঠনের আদর্শের প্রতি আকর্ষিত হয়। তালেবান নেতৃত্ব, পাকিস্তানের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাংগঠনিক কাঠামো ও আফগান যুদ্ধে পাকিস্তানি কয়েকটি মাদ্রাসার ভূমিকার ওপরে নির্ভর করে অনেকে মাদ্রাসাকেই ইসলামপন্থী সহিংস চরমপন্থার উৎস বলে প্রচার করতে থাকে। এসব ধারণা শিগগিরই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে শুরু করে; কেননা দেখা যায় যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের অধিকাংশ নেতা কিংবা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত নয়।
পরবর্তী কয়েক বছরে গবেষকেরা তাঁদের অতীত গবেষণা, সংগৃহীত তথ্য ইত্যাদির আলোকে কিছু সাধারণ উপসংহারে উপনীত হন। যাতে ধারণা দেওয়া হয় যে সন্ত্রাসবাদের কিছু ভিত্তিগত (ইংরেজিতে আন্ডারলায়িং), অন্যভাবে বললে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল কারণ রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে আরও সুনির্দিষ্ট, বাস্তবতানির্ভর ও তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাকাজের পরে দেখা যাচ্ছে যে এই ধরনের মূল কারণ চিহ্নিত করার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন একই রকমের আর্থসামাজিক অবস্থা সবাইকে সন্ত্রাসী করে তুলছে না। তা ছাড়া যারা এই ধরনের সন্ত্রাসী কাজে যুক্ত হয়, তারা কেবল পরিস্থিতির চাপে যোগ দেয় না, ক্ষেত্রবিশেষে কিছুর আকর্ষণে যুক্ত হয়। সেটা বিশেষ করে কোনো নেতার আকর্ষণ হতে পারে, হতে পারে যে এই ধরনের সংগঠন তাকে এমন কিছু দিতে পারে, যা তাকে সমাজের অন্য কোনো সংস্থা, পরিবার বা বন্ধু দিতে পারছে না। তা ছাড়া মানুষ স্বেচ্ছায় অনেক কিছু করে, কেবল পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করে না। সন্ত্রাসের মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টার একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে যে, ধরে নেওয়া হয় যে সম্ভাব্য সন্ত্রাসীরা কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দিয়ে প্রভাবিত হয়।
এসব দুর্বলতার প্রেক্ষাপটে গবেষকেরা গত কয়েক দশকে বিভিন্ন দেশে যেখানে জঙ্গিবাদ প্রসারিত হয়েছে, যেসব ব্যক্তি জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয়েছে, যেসব জঙ্গি সংগঠন শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছে, তাদের ওপর গবেষণা করে এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে জঙ্গি হয়ে ওঠা এবং জঙ্গিবাদের প্রসারের ক্ষেত্রে কতিপয় বিষয় চালকের ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ এই বিষয়গুলো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দেয়, সমাজে জঙ্গিবাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে এবং সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে। এই ড্রাইভার বা চালিকাগুলোকে ভাগ করা হয়েছে চারটি ভাগে: অভ্যন্তরীণ সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈশ্বিক।
অভ্যন্তরীণ চালকের মধ্যে রয়েছে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতা বা প্রান্তিকতা অনুভব করা, সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়া, হতাশার বোধ, অন্যদের তুলনায় বঞ্চিত অনুভব করা। রাজনৈতিক চালকগুলোর মধ্যে আছে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, সরকারের কঠোর নিপীড়ন ও সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা, স্থানীয়ভাবে অব্যাহত সংঘাত, সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এলাকা তৈরি হওয়া। সাংস্কৃতিক চালকের মধ্যে আছে এই ধারণা বিরাজ করা বা তৈরি হওয়া যে ইসলাম আক্রমণের বা বিপদের মুখোমুখি, নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হুমকির মুখে এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজের ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ বা সমাজে অন্যদের ওপরে নিজের ইসলামি সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়া।
বৈশ্বিক চালকের মধ্যে আছে নিজেদের ভিকটিম বলে মনে করা। একার্থে এটি সাংস্কৃতিক চালকের সঙ্গে যুক্ত। ইসলাম বিপদের মুখে—এই ধারণার সঙ্গে যখন যুক্ত হয় যে মুসলিম জনগোষ্ঠী অন্যত্র অন্যায় ও বৈষম্যের শিকার, যদি এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে বিশ্বব্যবস্থা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য অন্যায্য, তাহলে তা এক শক্তিশালী চালকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক চালকের আরেকটি হচ্ছে ‘কাছের শত্রু-দূরের শত্রু’র ধারণা। যখন অভ্যন্তরীণভাবে দেশের ভেতরে নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়, যখন ‘কাছের শত্রু’কে পরাজিত করতে সক্ষম হয় না, তখন দেশের বাইরে ‘দূরের শত্রু’র বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চালানোর আগ্রহ তৈরি হয়। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রু বলে বিবেচনা করে, তার কারণগুলোর মধ্যে নিপীড়ক সরকারগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন অন্যতম বলেই তাদের দলিলপত্র, প্রচারণা ও সদস্য সংগ্রহের প্রচারণায় স্পষ্ট। এই চালকগুলো একক ও সম্মিলিতভাবে কাজ করে এবং সব জায়গায় সবগুলো না থাকলেও তার কার্যকারিতা অক্ষত থাকে বলেই দেখা গেছে।
আজ যখন বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট বা আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে সময় বোঝা দরকার কোন ধরনের পরিস্থিতিতে কোন ধরনের চালক দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের জন্য অনুকূল অবস্থার জন্ম দেয়। জঙ্গিবাদ কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে চাইলে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। (শেষ)
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
এই প্রশ্নগুলো নতুন করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর; আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদার আবির্ভাব, আফগানিস্তানে তালেবানের গ্রহণযোগ্যতা এই প্রশ্নগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করে দেয়। এই পর্যায়ে রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে ধর্মের প্রশ্ন। কেউ কেউ এই প্রশ্নও তোলেন যে রাজনৈতিক আদর্শ ও ধর্মের মধ্যে কোনো বিভাজন টানা উচিত হবে কি না।
রাজনৈতিক ইসলামের মধ্য থেকে একটি ধারা আগেও সহিংসতাকে তাদের কৌশল হিসেবেই শুধু বেছে নিয়েছিল তা নয়, তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় একেই একমাত্র পথ বলেও বিবেচনা করে সে পথেই অগ্রসর হয়েছে। তালেবান সেই ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। ২০০১ সালের ঘটনাবলির কারণে তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষিত হয়। এই ধারার লক্ষ্য সীমিত বলেই বিবেচিত হওয়া দরকার, কেননা নিজস্ব রাষ্ট্রের মধ্যেই তারা তাদের আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং চেয়েছে। অন্যপক্ষে, আমরা দেখতে পাই ইসলামের রাজনৈতিক দিককে আশ্রয় করে আরও সংগঠনের আবির্ভাব বা পুনরুত্থান ঘটে, যাদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রসীমাকে অস্বীকার করে তাদের ভাষায় ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা। একই সঙ্গে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক কাঠামোকে তারা চ্যালেঞ্জ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। কৌশল ও কর্মপদ্ধতি তাদের জন্য গৌণ বিষয়। হিযবুত তাহ্রীর সেই ধারার প্রতিনিধি।
এই ঘটনাপ্রবাহ ইসলামপন্থী রাজনীতির মধ্যে যেমন বিভিন্ন ধারার জন্ম দেয়, তেমনি এসব ধারার আবেদন বোঝার তাগিদ তৈরি হয়। অবশ্যই এই ঘটনাপ্রবাহ নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়নি। চলমান আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি, অর্থনীতির বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির উৎকর্ষ—সবই তাকে প্রভাবিত করেছে। ২০১০ সাল নাগাদ আমরা দেখতে পাই যে আরও একধরনের সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত অঞ্চলগুলোয় তাদের নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের রাষ্ট্র, যাকে তারা ‘খেলাফত’ বলে বর্ণনা করে, প্রতিষ্ঠা করে এবং সারা পৃথিবীর মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার হয়ে ওঠে। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম ও ইরাকে ইসলামি রাষ্ট্র এর উদাহরণ।
এই ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি ২০০১ সাল থেকে ইসলামপন্থী সহিংস চরমপন্থী সংগঠনগুলো নিয়ে গবেষণার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এসব গবেষণার ফলাফলের দিকে দৃকপাত না করে অনেক বিশ্লেষক, রাজনীতিবিদ সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের কারণ হিসেবে তাঁদের ধারণাকে প্রকৃত কারণ বলে বর্ণনা করতে শুরু করেন। এই প্রবণতার সবচেয়ে বড় দিক হলো এই যে তাঁরা ধরে নিলেন যে দারিদ্র্যই হচ্ছে সহিংস চরমপন্থার কারণ এবং সুযোগবঞ্চিত মানুষেরা জঙ্গি সংগঠনের আদর্শের প্রতি আকর্ষিত হয়। তালেবান নেতৃত্ব, পাকিস্তানের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাংগঠনিক কাঠামো ও আফগান যুদ্ধে পাকিস্তানি কয়েকটি মাদ্রাসার ভূমিকার ওপরে নির্ভর করে অনেকে মাদ্রাসাকেই ইসলামপন্থী সহিংস চরমপন্থার উৎস বলে প্রচার করতে থাকে। এসব ধারণা শিগগিরই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে শুরু করে; কেননা দেখা যায় যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের অধিকাংশ নেতা কিংবা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত নয়।
পরবর্তী কয়েক বছরে গবেষকেরা তাঁদের অতীত গবেষণা, সংগৃহীত তথ্য ইত্যাদির আলোকে কিছু সাধারণ উপসংহারে উপনীত হন। যাতে ধারণা দেওয়া হয় যে সন্ত্রাসবাদের কিছু ভিত্তিগত (ইংরেজিতে আন্ডারলায়িং), অন্যভাবে বললে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল কারণ রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে আরও সুনির্দিষ্ট, বাস্তবতানির্ভর ও তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণাকাজের পরে দেখা যাচ্ছে যে এই ধরনের মূল কারণ চিহ্নিত করার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন একই রকমের আর্থসামাজিক অবস্থা সবাইকে সন্ত্রাসী করে তুলছে না। তা ছাড়া যারা এই ধরনের সন্ত্রাসী কাজে যুক্ত হয়, তারা কেবল পরিস্থিতির চাপে যোগ দেয় না, ক্ষেত্রবিশেষে কিছুর আকর্ষণে যুক্ত হয়। সেটা বিশেষ করে কোনো নেতার আকর্ষণ হতে পারে, হতে পারে যে এই ধরনের সংগঠন তাকে এমন কিছু দিতে পারে, যা তাকে সমাজের অন্য কোনো সংস্থা, পরিবার বা বন্ধু দিতে পারছে না। তা ছাড়া মানুষ স্বেচ্ছায় অনেক কিছু করে, কেবল পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করে না। সন্ত্রাসের মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টার একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে যে, ধরে নেওয়া হয় যে সম্ভাব্য সন্ত্রাসীরা কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দিয়ে প্রভাবিত হয়।
এসব দুর্বলতার প্রেক্ষাপটে গবেষকেরা গত কয়েক দশকে বিভিন্ন দেশে যেখানে জঙ্গিবাদ প্রসারিত হয়েছে, যেসব ব্যক্তি জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয়েছে, যেসব জঙ্গি সংগঠন শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছে, তাদের ওপর গবেষণা করে এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে জঙ্গি হয়ে ওঠা এবং জঙ্গিবাদের প্রসারের ক্ষেত্রে কতিপয় বিষয় চালকের ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ এই বিষয়গুলো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দেয়, সমাজে জঙ্গিবাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে এবং সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে। এই ড্রাইভার বা চালিকাগুলোকে ভাগ করা হয়েছে চারটি ভাগে: অভ্যন্তরীণ সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈশ্বিক।
অভ্যন্তরীণ চালকের মধ্যে রয়েছে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতা বা প্রান্তিকতা অনুভব করা, সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়া, হতাশার বোধ, অন্যদের তুলনায় বঞ্চিত অনুভব করা। রাজনৈতিক চালকগুলোর মধ্যে আছে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, সরকারের কঠোর নিপীড়ন ও সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা, স্থানীয়ভাবে অব্যাহত সংঘাত, সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এলাকা তৈরি হওয়া। সাংস্কৃতিক চালকের মধ্যে আছে এই ধারণা বিরাজ করা বা তৈরি হওয়া যে ইসলাম আক্রমণের বা বিপদের মুখোমুখি, নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হুমকির মুখে এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজের ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ বা সমাজে অন্যদের ওপরে নিজের ইসলামি সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়া।
বৈশ্বিক চালকের মধ্যে আছে নিজেদের ভিকটিম বলে মনে করা। একার্থে এটি সাংস্কৃতিক চালকের সঙ্গে যুক্ত। ইসলাম বিপদের মুখে—এই ধারণার সঙ্গে যখন যুক্ত হয় যে মুসলিম জনগোষ্ঠী অন্যত্র অন্যায় ও বৈষম্যের শিকার, যদি এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে বিশ্বব্যবস্থা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য অন্যায্য, তাহলে তা এক শক্তিশালী চালকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক চালকের আরেকটি হচ্ছে ‘কাছের শত্রু-দূরের শত্রু’র ধারণা। যখন অভ্যন্তরীণভাবে দেশের ভেতরে নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়, যখন ‘কাছের শত্রু’কে পরাজিত করতে সক্ষম হয় না, তখন দেশের বাইরে ‘দূরের শত্রু’র বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চালানোর আগ্রহ তৈরি হয়। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রু বলে বিবেচনা করে, তার কারণগুলোর মধ্যে নিপীড়ক সরকারগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন অন্যতম বলেই তাদের দলিলপত্র, প্রচারণা ও সদস্য সংগ্রহের প্রচারণায় স্পষ্ট। এই চালকগুলো একক ও সম্মিলিতভাবে কাজ করে এবং সব জায়গায় সবগুলো না থাকলেও তার কার্যকারিতা অক্ষত থাকে বলেই দেখা গেছে।
আজ যখন বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট বা আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে সময় বোঝা দরকার কোন ধরনের পরিস্থিতিতে কোন ধরনের চালক দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের জন্য অনুকূল অবস্থার জন্ম দেয়। জঙ্গিবাদ কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে চাইলে এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। (শেষ)
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments