শিশুনিগ্রহ- যে মায়েরা সাহসে বড় by ফারুক ওয়াসিফ

যখন প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়, তখন সমাজ দাঁড়িয়ে পড়ে এভাবেই
মানুষের আবেগ অদ্ভুত, কখন কোথায় তার বিস্ফোরণ হবে, কেউ বলতে পারে না। রাষ্ট্র-প্রশাসন বলতে পারে না, আবেগের জোরে কেন মানুষ রুখে দাঁড়ায়। ওদের বোধ হয় মন থাকতে নেই। তাই নির্যাতিতের কান্না তাদের কমই স্পর্শ করে। মায়েদের ক্ষোভ কতটা জ্বালাময় হতে পারে তা এখন টের পাচ্ছে মোহাম্মদপুরের প্রিপারেটরি গার্লস স্কুলের (সংক্ষেপে এমপিএস) অধ্যক্ষ মহোদয়। মায়ের হৃদয় যে বাঘিনীর হৃদয়, সেই সত্যটা রাষ্ট্রযন্ত্রের জানা থাকা ভালো। প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রীকে মুখ চেপে ধরে নিয়ে গিয়েছিল মোহাম্মদপুরের প্রিপারেটরি গার্লস স্কুলের এক পাষণ্ড কর্মচারী। এই নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ চলছে ৫ মের পর থেকে। অভিযোগ উঠেছে আরও দুটি ছাত্রীকে নিপীড়ন করার বিষয়েও। কিন্তু তদন্তে চলছে গড়িমসি। অভিভাবকদের চাপে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো বটে, কিন্তু তার প্রতিবেদন আর জমা পড়ে না। দফায় দফায় তাঁরা সময় বাড়ান। এসব দেখে-শুনে অভিভাবকদের চাপা ক্ষোভ শনিবার দুপুরে শতজলঝরনার মতো ফেটে পড়ল।
শত শত অভিভাবক আর ছাত্রী প্রথমে সকালে স্কুলের সামনে জড়ো হয়ে মানববন্ধন করলেন। এদিনই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অভিভাবককদের জানানোর কথা। কিন্তু তার কোনো হদিস না পেয়ে তাঁরা ঢুকে পড়লেন স্কুলের মাঠে। এরপর ঘটনার নিয়মে ঘটনা ঘটতে থাকল। শত শত নারী, যাঁদের অধিকাংশই মা, প্রথমে মিথ্যাচারের অভিযোগে রেক্টরের কক্ষের দরজার কাচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না। এরপর তাঁরা ঘিরে ধরলেন অধ্যক্ষকে। স্কুলটির প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীরা হাতে হাত বেঁধে ব্যূহ রচনা করে তাঁকে আটকালেন। কোনোভাবে পার পেয়ে তিনি আশ্রয় নিলেন একটি কক্ষে। বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিল বাইরে, বিচার ছাড়া তাঁরা কাউকে ছাড়বেন না।
চারদিকে ভবনের মাঝখানে মাঠ। তার একদিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাপসিবল গেট। প্রশ্ন উঠবে, মেয়েদের স্কুলের মধ্যে অন্য একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা থাকবে কেন? স্কুলের ভেতরই ক্যানটিন, সেটা চালান পুরুষ কর্মীরা। মেয়েদের বাথরুমের ছিটকিনি ঠিক নেই, পুরুষ পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের অবাধ যাতায়াত সেখানে। ছাত্রী ও মায়েদের অভিযোগের পাহাড়ের চূড়ায় ছিল একটি কথা। ফারুক আহমেদ নামের এক অভিভাবক জানান, ‘আমরা যখন কোনো অভিযোগ নিয়ে যাই, তখন বলে মেয়েরাই খারাপ।’ পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ ফজলুর রহমান বলে উঠলেন, ‘এটা কোনো শিক্ষক বলতে পারেন তাঁর ছাত্রীদের সম্পর্কে? যদি খারাপই হয়, তাহলে আপনারা ভালো করবেন। সব জায়গায় ওদের দালাল, কথা বলতে গেলে থানার লোক দিয়ে ভয় দেখায়।’ মানুষটার নাতনি এখানে পড়ে। শনিবারের বিক্ষোভের মানুষ ছিলেন তিনিও।
অভিভাবক ও ছাত্রীদের অভিযোগ অনেক, কর্তৃপক্ষের অস্বীকৃতিও অনেক। তবে গোপাল দাস নামের এক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী মুখ চেপে পাশের নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে এখন আর সন্দেহ নেই। স্কুলের প্রশাসনের বিরুদ্ধে যখন অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ, তখন তাদের দিয়ে কীভাবে নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব? এসব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ তৃতীয় কোনো আস্থাভাজন ব্যক্তিকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। ঠিক যেমনটা করা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের সময়। শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধূরীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয় এবং তাঁর কাছে গোপনে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। এই ঘটনাতে সেটাই করা উচিত।
অবরুদ্ধ হওয়ার আগেই কথা হলো অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘গোপাল দাস তো এখন ভারতে। সে এখন ছুটিতে আছে।’ জিজ্ঞাসা করলাম, অভিযোগ ওঠার পরে কেন তাকে ছুটি নিয়ে পালাতে দেওয়া হলো? তাকে তো এখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাওয়া যাবে না। তিনি বললেন, ‘আগেই সে ছুটি নিয়েছে।’ তিনিই জানান, ‘ছুটি নিয়েছে ১১ মে।’ ঘটনার তারিখ ৫ মে, এটা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে শোরগোল ওঠে ৭ তারিখে। তার মানে তিনি ছুটি দিয়েছেন সজ্ঞানে। শুধু এই একটা কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযুক্তকে রক্ষার চেষ্টার অভিযোগ উঠতে পারে।
দুপুর ১২টার দিকে স্কুলের সামনে সাদা পোশাক পরা একদল মেয়ে জটলা করে কথা বলছিল। তারা জানাল, মেয়েরা যাতে আন্দোলন না করে সে জন্য ক্লাসে ক্লাসে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কাউকে আন্দোলনে দেখা গেলে তাকে ‘বড় মিস’ স্কুল থেকে বের করে দেবেন। তৃতীয় শ্রেণির দুটি ছাত্রীর মুখে এমন অভিযোগ শুনে মনটা বিষিয়ে উঠল। শিশুদের কেন এভাবে হুমকি দেওয়া হবে? অভিভাবকদের মুখে মুখে ঘুরছে রেক্টর জিন্নাতুন্নেসার একটি উক্তি। তিনি নাকি বলেছিলেন ‘মধু থাকলে মৌমাছি আসবেই!!!’ তাহলে ছয় বছরের শিশুরা যাঁর চোখে ‘মধু’, তাঁর সঙ্গে আগ্রাসী পুরুষ মনের আর কী পার্থক্য থাকল? এ কারণেই অভিভাবকেরা দাবি তুলেছেন, অধ্যক্ষ ও রেক্টরকে অব্যাহতি দিতে হবে। অভিযুক্ত গোপাল দাসকে গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করতে হবে। স্কুলের প্রাঙ্গণে কোনো পুরুষ কর্মচারী রাখা যাবে না।
এ ঘটনায় উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়েছে, আদালত তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছেন। অধ্যক্ষ মহোদয়কে মনে করিয়ে দিলাম, ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ বিধিমালা প্রণয়ন এবং নিপীড়নবিরোধী অভিযোগ সেল গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তো, আপনার প্রতিষ্ঠানে কি এ ধরনের কোনো কমিটি আছে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কমিটি তো আছে।’ সেই কমিটিতে কারা কারা আছেন? তিনি ‘আছে আছে’ বলে উপস্থিত শিক্ষকদের মুখের দিকে তাকালেন। সম্ভবত, এমন কথা তাঁরাও প্রথম শুনছেন। নাম বলতে পারলেন না কেউই। অধ্যক্ষ হিসেবে নিজের তৈরি করা কমিটির কারও নামই যখন বলতে পারছেন না, তার মানে এ ধরনের কোনো কমিটি নেই বা থাকলেও তার কোনো কাজ নেই। তাঁর জবাব: ‘কমিটির কাজ নেই, কারণ এখানে কোনো দিন কোনো অঘটন ঘটেনি।’ বাহ! হতবাক ও নির্বাক হয়ে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে তখন তুমুল হট্টগোল। হ্যান্ডমাইক ফেলে এখন মাইকে কথা বলছেন নারীরা। স্কুলের মাঠে, বারান্দায় চার থেকে পাঁচ শ অভিভাবক। বেলা দুইটার পর এলেন স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ম. তামিম। তিনি একপর্যায়ে অভিভাবকদের কথা মেনে নিলেন এবং দায়ীদের শাস্তির অঙ্গীকার, অভিভাবক বা ছাত্রীদের হয়রানি না করার আশ্বাস এবং বিচারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন। উত্তপ্ত রোদের মধ্যে ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের শান্ত করায় এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তবে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। অনেক সময় আন্দোলনের মুখে ‘বহিষ্কার’ ‘অব্যাহতি’ ইত্যাদি করা হলেও, আইনের বিচারটি আর হয় না। সেদিকে নজর রাখা প্রয়োজন।
যে প্রশ্নটি করা দরকার: অভিযোগ আসামাত্রই যদি বিচার হতো তাহলে প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থাহীনতা আসত না। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে কাণ্ডজ্ঞান সম্ভবত লোপ পায়। তাই একটি অন্যায় ঢাকতে আরও আরও অন্যায় চলতে থাকে।
এরই মধ্যে ঢুকে পড়লেন একদল তরুণ। তাঁরা আন্দোলনের মধ্যে বহিরাগত খুঁজছেন! সেই চিরাচরিত কৌশল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্য যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বলেছিলেন, ‘বহিরাগত গার্মেন্টসের মেয়েরা আন্দোলন করছে।’ যেন গার্মেন্টসের মেয়েমাত্রই খারাপ, ‘তাদের কথায় কান দেওয়ার দরকার নেই।’ এভাবে নিজের ছাত্রীদের বিরুদ্ধে তিনি যে বাচনিক সন্ত্রাস চালিয়েছিলেন, মোহাম্মদপুরের এমপিএসেও সেটাই দেখা গেল।
শিক্ষকদের কেউ কেউ বলতে চাইলেন, ‘ছোট একটি ঘটনাকে অনেক বড় করা হচ্ছে।’ আমাদের পুলিশ–প্রধান নববর্ষে যৌন নির্যাতনকারী ছেলেদের কাজকে ‘দুষ্টামি’ বলে হালকা করতে চেয়েছিলেন। যাঁরা নিষ্পাপ শিশুর সঙ্গে অন্যায় আচরণকে ছোট ঘটনা বলে মনে করেন, তাঁদের টনক নড়াতে বড় আকারের একটা প্রতিবাদের দরকার ছিল। সাম্প্রতিক সময়ের অনেক যৌন নিপীড়নের ঘটনায় যা ঘটেনি, মোহাম্মদপুরে সেটাই ঘটল। ভুক্তভোগীরা প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসে প্রতিরোধের দায়িত্ব নিজ হাতে নিলেন। এই মায়েদের, এই মেয়েদের অভিবাদন।
পরিবার ও সন্তানের জন্য মানুষ কী না করে। সেই সন্তানটি যখন এমন অনিরাপদ দশায় পড়ে, তখন পরিবার রুখে দাঁড়াবেই। যখন প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়, তখন সমাজ দাঁড়িয়ে পড়ে। এবং তারা বারেবারেই দেখতে পায়, আসলেই জনগণের জনগণ ছাড়া আর কেউ নেই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.