প্রশিক্ষণের ২০ কোটি টাকা কর্মকর্তাদের পকেটে by শিশির মোড়ল
স্বাস্থ্য
খাতের টাকা লোপাট হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার নামে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে
কাগজে-কলমে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশ নিয়েছেন ১৭ লাখ ২৫ হাজার
৮১৮ জন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাস্তবে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক কম।
কাল্পনিক প্রশিক্ষণ, বানোয়াট প্রশিক্ষণার্থীর তালিকা ও ভুয়া বিল ভাউচার
তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন কর্মকর্তারা।
সরকারি নিরীক্ষায় দেখা গেছে, গত অর্থবছরে প্রশিক্ষণ খাত থেকে ২০ কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ না দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের টাকা লোপাট করছেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। অন্তত তিন বছর ধরে একই পন্থায় দুর্নীতি করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিংহভাগ কাজ ৩২টি কার্যকর পরিকল্পনা বা অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে দাতাদের অর্থসহায়তা আছে। মহাহিসাব নিরীক্ষা অধিদপ্তরের ফরেন এইডেড প্রোজেক্ট অডিট ডাইরেক্টরেট (ফাপাদ) ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০টি ওপির হিসাব নিরীক্ষা করেছে। তাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। নিরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সবগুলো ওপি নিরীক্ষা করলে প্রশিক্ষণে শতকোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ হচ্ছে না। দুর্নীতি রপ্ত করতেই প্রশিক্ষণ হচ্ছে।’
টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি স্বাস্থ্যসচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ১১ মে মন্ত্রণালয়ে নিজ কক্ষে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়ে অবগত আছি। অনিয়ম দূর করার চেষ্টা করছি।’
অনিয়মের ধরন: ফাপাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন কর্মকর্তা একই দিনে দুই জেলায় উপস্থিত থেকে কর্মশালা পরিচালনা করেছেন। এভাবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা শতাধিক কর্মশালা থেকে সম্মানী নিয়েছেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর নিজস্ব অফিস আছে জেলা পর্যায়ে। সেখানে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে জেলা সিভিল সার্জন অফিসে নগদ টাকা পাঠানো হয়েছে, যা বড় ধরনের অনিয়ম। তিন দিনের অন্তত ৪০টি কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, প্রশিক্ষণার্থীদের আমন্ত্রণপত্র কিছুই খুঁজে পায়নি নিরীক্ষক দল।
এই অনিয়মের সময় আব্দুল ওয়াহিদ আকন্দ ও নাসির উদ্দিন লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। এঁরা কেউই অনিয়মের কথা অস্বীকার করেননি। তবে একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। আব্দুল ওয়াহিদ আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি লাইন ডিরেক্টর থাকাকালে অনিয়ম হয়নি। আমি কিছু দিন ছিলাম না, তখন হয়ে থাকতে পারে।’ আবার তিন মাস লাইন ডিরেক্টরের পদে থাকা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি প্রশিক্ষণের কোনো বিল চূড়ান্তভাবে পরিশোধ করিনি। অনিয়ম কিছু হয়ে থাকলে আমার আগে যিনি ছিলেন তাঁর (আকন্দ) সময়ে হয়েছে।’
দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশি দেখিয়ে টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন কর্মকর্তারা। ইন-সার্ভিস (পেশায় থাকাকালীন) প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বাস্তবে ২ হাজার ৬৫৬ জন প্রশিক্ষণ পান। অথচ কাগজে-কলমে ৩ হাজার ৯২১ জন দেখানো হয়েছে। ১ হাজার ২৬৫ জনকে প্রশিক্ষণ না দিয়েই তাঁদের নামে খরচ দেখানো হয়েছে।
কাগজপত্রে দেখা গেছে, রাজধানীর পান্থপথের একটি প্রতিষ্ঠানে ৩৬০ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ইংরেজি, আরবি ও কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক হিসেবে তিন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন একই ব্যক্তি। নিরীক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, ওই প্রতিষ্ঠানটির আকার এতই ছোট যে সেখানে মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। আর এক ব্যক্তি কী করে তিনটি বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এই সময় লাইন ডিরেক্টর ছিলেন সুভাস কুমার সাহা। যোগাযোগ করা হলে অবসরে যাওয়া এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চাকরিতে থাকার সময় এসব অভিযোগ শুনিনি।’
সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (এনসিডি) কর্মসূচিতে। দরপত্র ছাড়াই কোটি টাকার বেশি মূল্যের প্রশিক্ষণ সামগ্রী কেনা হয়েছে। সবগুলো ভাউচার ১৪ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৬২ হাজার ৪২৮ জনকে, কিন্তু খরচ দেখানো হয়েছে ৬৮ হাজার প্রশিক্ষণার্থীর। একই প্রশিক্ষণের বিপরীতে একাধিকবার খরচ দেখানো হয়েছে। সব জেলাতেই হোটেল ভাড়া ১৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, ওই অর্থবছরে তিনজন লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন। এঁদের দুজনকে ওএসডি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় অন্যজনকে প্রথমে ওএসডি করে এবং পরে দাতাদের অর্থসহায়তা নেই এমন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক করেছে।
বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে: বিদেশে প্রশিক্ষণের নামেও অনিয়ম হয়েছে। ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ কর্মসূচি থেকে মালয়েশিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। মালয়েশিয়ার হাসপাতালে প্রশিক্ষণের টাকা পাঠানো হয়নি। টাকা দেওয়া হয়েছে একটি দালাল প্রতিষ্ঠানকে।
অন্যদিকে একাধিক প্রশিক্ষণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন কর্মকর্তারা গেছেন, যাঁদের সঙ্গে স্বাস্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। নিরীক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রশিক্ষণ গ্রহণের উপযুক্ত না হলেও এঁদের সম্মানী, বিমান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এঁদের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফিও দেওয়া হয়েছে।
দিনে ৪,৭২৮ জনকে প্রশিক্ষণ: গত অর্থবছর শেষে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচির মধ্যবর্তী মূল্যায়ন করেছে। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ লাখ ২৫ হাজার ৮১৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ দিনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৪ হাজার ৭২৮ জন। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন বাদ দিলে দৈনিক ৮ হাজারের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বাস্তবে কিছু কর্মকর্তা প্রশিক্ষণকে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পন্থা হিসেবে ব্যবহার করছেন।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যে বাস্তবে সম্ভব নয়, এটা দাতাদেরও বুঝতে হবে। দাতারা কী করে বাজেট অনুমোদন করে? দুর্নীতির দায় তাদেরও নিতে হবে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান: ফাপাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধূমপান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে চিকিৎসকদের জন্য ১৪৫টি কর্মশালার আয়োজন করে অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (এনসিডি) কর্তৃপক্ষ। এতে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৩১ হাজার ৬১৮ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ না দিয়েই ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। যাচাইয়ের জন্য নিরীক্ষকদের সদস্যরা নোয়াখালী সফর করেন। তাঁরা জানতে পারেন, নোয়াখালীতে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি।
সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলার প্রশিক্ষণ-সম্পর্কিত কাগজপত্র প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা যায়, লালমনিরহাটের বড় বাড়ির হাড়াটি কমিউনিটি সেন্টারে ২৪ থেকে ২৬ মে তিন দিনের কর্মশালা হয়। কর্মশালার জন্য শহরের আর এন ইসলাম মার্কেটের মিয়াজী বই ঘর থেকে খাতা, পেনসিল, কলম, প্যাড, ফাইল; আহমেদ অ্যান্ড সন্স থেকে ব্যাগ; হাবিব প্রিন্টার্স থেকে ব্যানার, কেরামত ফটোকপিয়ার থেকে ফটোকপি, হাবিব ডেকোরেটরস থেকে সাউন্ড সিস্টেম, আউয়াল মিষ্টি ঘর থেকে শিঙাড়া, সন্দেশ, লাড্ডু; শাওন কম্পিউটারস থেকে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল এবং তাপস সিডি থেকে সিডি কেনা হয়েছে। আর এন ইসলাম মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এসব দোকানের অস্তিত্বই নেই। হাড়াটি কমিউনিটি সেন্টার নামে কমিউনিটি সেন্টারও নেই।
লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, ওই সময় তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে লালমনিরহাটে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি।
কাগজপত্রে দেখা যায়, একই তারিখে প্রশিক্ষণ কর্মশালা হয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ে। শহরের গোড়িয়া সড়কে মানবকল্যাণ সংস্থা নামের একটি এনজিওর মিলনায়তন ব্যবহারের বিল জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান ঠাকুরগাঁও শহরে নেই।
শহরের সমবায় মার্কেটের সেলিম স্টেশনারিকে খাতা, কলম, ফাইলের দাম, আরমান লেদার শপকে ব্যাগের দাম, মাসুম ব্যানারকে ব্যানারের দাম, মামুন ফটোস্ট্যাটকে ফটোকপির, নবরূপা সাউন্ড সিস্টেম থেকে শব্দযন্ত্র ভাড়া, মোহনা কনফেকশনারিকে নাশতা, প্রান্তিক এন্টারপ্রাইজ থেকে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল বাঁধাই এবং প্রিয়া কম্পিউটার্সকে সিডি রাইট করার দাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঠাকুরগাঁও শহরে এসব দোকান খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, এই সময় ঠাকুরগাঁওয়ে কোনো প্রশিক্ষণই হয়নি।
প্রশিক্ষণার্থীর তালিকায় সবাই চিকিৎসক। অথচ কোনো চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁদের কেউ কেউ ২০ বা ১২ বছর আগে এই দুই জেলায় কাজ করতেন বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে।
২০১২ সাল থেকে প্রথম আলো স্বাস্থ্য খাতে প্রশিক্ষণে অনিয়ম অনুসন্ধান করছে। ওই বছরের ১১ জুন বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিন দিনের পুষ্টি প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, তিন দিনের কর্মশালা শেষ হয় দুই ঘণ্টায়। ঢাকা থেকে যাওয়া কর্মকর্তা ব্যাগ, খাতা, কলম ও প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল নিয়ে যাননি। এমনকি প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানীও দিয়ে আসেননি। এ নিয়ে প্রথম আলোতে ২ অক্টোবর ২০১২ প্রতিবেদন ছাপা হয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে কয়েকটি ওপির হিসাব নিরীক্ষা করেছিল ফাপাদ। সেই নিরীক্ষায় দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ একাধিক পরিচালক ও কর্মসূচি ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ নিয়েও ২০১৩ সালের ৮, ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে এই দুর্নীতি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর এটা হচ্ছে বেশ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার যোগসাজশে। যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাঁদের শাস্তি না দিলে এই দুর্নীতি বন্ধ হবে না।
সরকারি নিরীক্ষায় দেখা গেছে, গত অর্থবছরে প্রশিক্ষণ খাত থেকে ২০ কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ না দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের টাকা লোপাট করছেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। অন্তত তিন বছর ধরে একই পন্থায় দুর্নীতি করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিংহভাগ কাজ ৩২টি কার্যকর পরিকল্পনা বা অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে দাতাদের অর্থসহায়তা আছে। মহাহিসাব নিরীক্ষা অধিদপ্তরের ফরেন এইডেড প্রোজেক্ট অডিট ডাইরেক্টরেট (ফাপাদ) ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০টি ওপির হিসাব নিরীক্ষা করেছে। তাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। নিরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সবগুলো ওপি নিরীক্ষা করলে প্রশিক্ষণে শতকোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ হচ্ছে না। দুর্নীতি রপ্ত করতেই প্রশিক্ষণ হচ্ছে।’
টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি স্বাস্থ্যসচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ১১ মে মন্ত্রণালয়ে নিজ কক্ষে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়ে অবগত আছি। অনিয়ম দূর করার চেষ্টা করছি।’
অনিয়মের ধরন: ফাপাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন কর্মকর্তা একই দিনে দুই জেলায় উপস্থিত থেকে কর্মশালা পরিচালনা করেছেন। এভাবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা শতাধিক কর্মশালা থেকে সম্মানী নিয়েছেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর নিজস্ব অফিস আছে জেলা পর্যায়ে। সেখানে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে জেলা সিভিল সার্জন অফিসে নগদ টাকা পাঠানো হয়েছে, যা বড় ধরনের অনিয়ম। তিন দিনের অন্তত ৪০টি কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, প্রশিক্ষণার্থীদের আমন্ত্রণপত্র কিছুই খুঁজে পায়নি নিরীক্ষক দল।
এই অনিয়মের সময় আব্দুল ওয়াহিদ আকন্দ ও নাসির উদ্দিন লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। এঁরা কেউই অনিয়মের কথা অস্বীকার করেননি। তবে একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। আব্দুল ওয়াহিদ আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি লাইন ডিরেক্টর থাকাকালে অনিয়ম হয়নি। আমি কিছু দিন ছিলাম না, তখন হয়ে থাকতে পারে।’ আবার তিন মাস লাইন ডিরেক্টরের পদে থাকা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি প্রশিক্ষণের কোনো বিল চূড়ান্তভাবে পরিশোধ করিনি। অনিয়ম কিছু হয়ে থাকলে আমার আগে যিনি ছিলেন তাঁর (আকন্দ) সময়ে হয়েছে।’
দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশি দেখিয়ে টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন কর্মকর্তারা। ইন-সার্ভিস (পেশায় থাকাকালীন) প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বাস্তবে ২ হাজার ৬৫৬ জন প্রশিক্ষণ পান। অথচ কাগজে-কলমে ৩ হাজার ৯২১ জন দেখানো হয়েছে। ১ হাজার ২৬৫ জনকে প্রশিক্ষণ না দিয়েই তাঁদের নামে খরচ দেখানো হয়েছে।
কাগজপত্রে দেখা গেছে, রাজধানীর পান্থপথের একটি প্রতিষ্ঠানে ৩৬০ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ইংরেজি, আরবি ও কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক হিসেবে তিন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন একই ব্যক্তি। নিরীক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, ওই প্রতিষ্ঠানটির আকার এতই ছোট যে সেখানে মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। আর এক ব্যক্তি কী করে তিনটি বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এই সময় লাইন ডিরেক্টর ছিলেন সুভাস কুমার সাহা। যোগাযোগ করা হলে অবসরে যাওয়া এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চাকরিতে থাকার সময় এসব অভিযোগ শুনিনি।’
সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (এনসিডি) কর্মসূচিতে। দরপত্র ছাড়াই কোটি টাকার বেশি মূল্যের প্রশিক্ষণ সামগ্রী কেনা হয়েছে। সবগুলো ভাউচার ১৪ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৬২ হাজার ৪২৮ জনকে, কিন্তু খরচ দেখানো হয়েছে ৬৮ হাজার প্রশিক্ষণার্থীর। একই প্রশিক্ষণের বিপরীতে একাধিকবার খরচ দেখানো হয়েছে। সব জেলাতেই হোটেল ভাড়া ১৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, ওই অর্থবছরে তিনজন লাইন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন। এঁদের দুজনকে ওএসডি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় অন্যজনকে প্রথমে ওএসডি করে এবং পরে দাতাদের অর্থসহায়তা নেই এমন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক করেছে।
বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে: বিদেশে প্রশিক্ষণের নামেও অনিয়ম হয়েছে। ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ কর্মসূচি থেকে মালয়েশিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় সরকারি কর্মকর্তাদের। মালয়েশিয়ার হাসপাতালে প্রশিক্ষণের টাকা পাঠানো হয়নি। টাকা দেওয়া হয়েছে একটি দালাল প্রতিষ্ঠানকে।
অন্যদিকে একাধিক প্রশিক্ষণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন কর্মকর্তারা গেছেন, যাঁদের সঙ্গে স্বাস্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। নিরীক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রশিক্ষণ গ্রহণের উপযুক্ত না হলেও এঁদের সম্মানী, বিমান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এঁদের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফিও দেওয়া হয়েছে।
দিনে ৪,৭২৮ জনকে প্রশিক্ষণ: গত অর্থবছর শেষে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচির মধ্যবর্তী মূল্যায়ন করেছে। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ লাখ ২৫ হাজার ৮১৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ দিনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৪ হাজার ৭২৮ জন। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন বাদ দিলে দৈনিক ৮ হাজারের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বাস্তবে কিছু কর্মকর্তা প্রশিক্ষণকে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পন্থা হিসেবে ব্যবহার করছেন।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যে বাস্তবে সম্ভব নয়, এটা দাতাদেরও বুঝতে হবে। দাতারা কী করে বাজেট অনুমোদন করে? দুর্নীতির দায় তাদেরও নিতে হবে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান: ফাপাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধূমপান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে চিকিৎসকদের জন্য ১৪৫টি কর্মশালার আয়োজন করে অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (এনসিডি) কর্তৃপক্ষ। এতে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৩১ হাজার ৬১৮ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ না দিয়েই ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। যাচাইয়ের জন্য নিরীক্ষকদের সদস্যরা নোয়াখালী সফর করেন। তাঁরা জানতে পারেন, নোয়াখালীতে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি।
সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলার প্রশিক্ষণ-সম্পর্কিত কাগজপত্র প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা যায়, লালমনিরহাটের বড় বাড়ির হাড়াটি কমিউনিটি সেন্টারে ২৪ থেকে ২৬ মে তিন দিনের কর্মশালা হয়। কর্মশালার জন্য শহরের আর এন ইসলাম মার্কেটের মিয়াজী বই ঘর থেকে খাতা, পেনসিল, কলম, প্যাড, ফাইল; আহমেদ অ্যান্ড সন্স থেকে ব্যাগ; হাবিব প্রিন্টার্স থেকে ব্যানার, কেরামত ফটোকপিয়ার থেকে ফটোকপি, হাবিব ডেকোরেটরস থেকে সাউন্ড সিস্টেম, আউয়াল মিষ্টি ঘর থেকে শিঙাড়া, সন্দেশ, লাড্ডু; শাওন কম্পিউটারস থেকে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল এবং তাপস সিডি থেকে সিডি কেনা হয়েছে। আর এন ইসলাম মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, এসব দোকানের অস্তিত্বই নেই। হাড়াটি কমিউনিটি সেন্টার নামে কমিউনিটি সেন্টারও নেই।
লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, ওই সময় তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে লালমনিরহাটে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি।
কাগজপত্রে দেখা যায়, একই তারিখে প্রশিক্ষণ কর্মশালা হয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ে। শহরের গোড়িয়া সড়কে মানবকল্যাণ সংস্থা নামের একটি এনজিওর মিলনায়তন ব্যবহারের বিল জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান ঠাকুরগাঁও শহরে নেই।
শহরের সমবায় মার্কেটের সেলিম স্টেশনারিকে খাতা, কলম, ফাইলের দাম, আরমান লেদার শপকে ব্যাগের দাম, মাসুম ব্যানারকে ব্যানারের দাম, মামুন ফটোস্ট্যাটকে ফটোকপির, নবরূপা সাউন্ড সিস্টেম থেকে শব্দযন্ত্র ভাড়া, মোহনা কনফেকশনারিকে নাশতা, প্রান্তিক এন্টারপ্রাইজ থেকে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল বাঁধাই এবং প্রিয়া কম্পিউটার্সকে সিডি রাইট করার দাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঠাকুরগাঁও শহরে এসব দোকান খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, এই সময় ঠাকুরগাঁওয়ে কোনো প্রশিক্ষণই হয়নি।
প্রশিক্ষণার্থীর তালিকায় সবাই চিকিৎসক। অথচ কোনো চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁদের কেউ কেউ ২০ বা ১২ বছর আগে এই দুই জেলায় কাজ করতেন বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে।
২০১২ সাল থেকে প্রথম আলো স্বাস্থ্য খাতে প্রশিক্ষণে অনিয়ম অনুসন্ধান করছে। ওই বছরের ১১ জুন বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিন দিনের পুষ্টি প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, তিন দিনের কর্মশালা শেষ হয় দুই ঘণ্টায়। ঢাকা থেকে যাওয়া কর্মকর্তা ব্যাগ, খাতা, কলম ও প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল নিয়ে যাননি। এমনকি প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানীও দিয়ে আসেননি। এ নিয়ে প্রথম আলোতে ২ অক্টোবর ২০১২ প্রতিবেদন ছাপা হয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে কয়েকটি ওপির হিসাব নিরীক্ষা করেছিল ফাপাদ। সেই নিরীক্ষায় দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ একাধিক পরিচালক ও কর্মসূচি ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ নিয়েও ২০১৩ সালের ৮, ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে এই দুর্নীতি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর এটা হচ্ছে বেশ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার যোগসাজশে। যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাঁদের শাস্তি না দিলে এই দুর্নীতি বন্ধ হবে না।
No comments