ইসমতকে পেটালেন, ঝর্ণা বেগমকে ভুলে গেলেন! by আলী ইমাম মজুমদার
আহত পুলিশকে উদ্ধার করেন ঝর্ণা বেগম, ইসমতকে গলা চেপে ধরেন পুলিশ সদস্য |
১০
মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত শতাধিক ছাত্রছাত্রীর
একটি মিছিল যাচ্ছিল ডিএমপি সদর দপ্তর অভিমুখে। উদ্দেশ্য, গত পয়লা বৈশাখে
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নারী লাঞ্ছনাকারীদের চিহ্নিত করতে পুলিশি ব্যর্থতার
প্রতিবাদ। মিন্টো রোডে আটকে দেওয়া হয় মিছিলকারীদের। তারা সেখানে অবস্থান
নিলে একপর্যায়ে রণসাজে সজ্জিত পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। লাঠিপেটায় আহত
হয় ১৫-২০ জন ছাত্রছাত্রী। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলকারীরা।
এ রকম সাদামাটাই যদি ঘটনাটি হতো, তাহলে তেমন কথা ছিল না। সময়ে সময়ে ছত্রভঙ্গ করতে মিছিলে বাধা দিতে হয় পুলিশকে। তবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর তারা যেভাবে হামলাটি চালিয়েছিল, তা বিস্ময়কর ও অভাবিত। লাঠিপেটা করেছে, হেলমেট দিয়ে করেছে আঘাত, মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে মারধর করেছে। মাটিতে পড়ে যাওয়া ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিসহ আরও কয়েকজন ছাত্রের পিঠে পড়েছে পদাঘাত। হামলায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইসমত জাহান নামের একজন ছাত্রীকে চুলের মুঠি ধরে বের করে এনে করেছে লাঠিপেটা। ঘটনাটি বিস্ময়ের এ জন্য যে মিছিলটি ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ আর কলেবরে খুবই ছোট। তারা যদি রাস্তা অবরোধ করেও রাখে, সেটা ভেঙে দিতে এ মাত্রায় শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল, এমনটা মনে করার কোনো সংগত কারণ নেই। ঘেরাও-অবরোধ হিংস্র হয়ে উঠলে আর সরকারি স্থাপনা, জনজীবন, বিশেষ করে কর্তব্যরত পুলিশ বিপন্ন হলে গুলিও চালানো যায়। মিছিলকারীদের বেআইনি জনতা বলে চিহ্নিত করলেও তাদের সংখ্যা ও আচরণ বিবেচনায় শক্তি প্রয়োগে গ্রহণযোগ্য মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিগুলোতে পুলিশকে যে রূপে দেখা গেল, তা অভাবিতও বটে।
ঝর্ণা বেগম ব্যাপক ঝুঁকির মুখে তাঁর নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সেটার মূল্যায়ন বৈষয়িকভাবে করা যায় না। তবে নৈতিক দিকটি শিক্ষণীয় সবার কাছে। পুলিশ সদস্যরা এ দেশেরই সন্তান। তাঁরা বিপন্ন হলে এরূপ সহায়তা করাই সংগত ছাত্র ইউনিয়ন নামক সংগঠনটি হালে তেমন জোরদার নয়। তাদের কর্মসূচিও এখন তাই সীমিত থাকে আকৃতি ও প্রকৃতিতে। তাদের নেতা-কর্মীদের আচরণ অনেকটা পরিশীলিত। তারপরও যে উদ্দেশ্যে আলোচ্য ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে মিছিল নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছিল, তা খুবই যুক্তিসংগত বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়। পয়লা বৈশাখের বিকেলে নববর্ষ অনুষ্ঠানে নারী লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা বিরাজ করছে সব বিবেকবান মানুষের মধ্যে। সবাই আশা করেন পুলিশ তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনবে। কিন্তু এক মাস চলে গেলেও কোনো সাফল্য দেখা যাচ্ছে না তদন্তে। এতে নাগরিক সমাজ উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। প্রতিবাদও সংগত। এ অপরাধীদের শনাক্ত ও শাস্তি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সহায়ক হবে, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায়। আর উল্টোটা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে করবে আরও জোরদার। দ্বিগুণ উৎসাহে সময়-সুযোগে এরূপ ঘটবে। এ কথা সত্যি যে সব অপরাধ তাৎক্ষণিক বা অতি দ্রুত উদ্ঘাটিত হয় না। সেসব ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের প্রতি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা সংবেদনশীল থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করে কোনো দপ্তর ঘেরাও করা কোনো অভিনব বা সব ক্ষেত্রেই আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ঘটনা নয়। আর এখানে মিছিলকারীদের সংখ্যা ও তাদের আচরণঘটিত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিলে মোটেই নয়। এরূপ কত ঘটনায় ডিসি, এসপিদের অফিস ঘেরাও হয়। আর তার সুন্দর পরিণতিও ঘটে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মিন্টো রোডে ক্ষুব্ধ ছেলেমেয়েদের প্রতি পুলিশের এতটা অসহিষ্ণু হওয়ার কারণটি দুর্বোধ্য। বলা হচ্ছে, তারা মিনিট বিশেক রাস্তা আটকে রেখে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছিল। এরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি অসংগত, এটা কেউ অস্বীকার করবে না। তবে কত আনন্দ মিছিল কিংবা ‘সরকারি প্রয়োজনে’ ঢাকার কোনো না কোনো রাস্তা প্রায়ই আটকে থাকে দীর্ঘ সময়। অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয় যাত্রীরা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে এত দ্রুত পুলিশি তৎপরতার নৈতিক দিকটি খুঁজে পাওয়া যায় না।
ঘটনার পরপর একজন নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তবে ডিএমপি সদর দপ্তরে সেদিনকার নিরাপত্তার দায়িত্বে কোন কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিলেন, কার সিদ্ধান্তে এমনটি ঘটল, তা তলিয়ে দেখা দরকার। পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ কেউ বলছেন মিছিলকারীদের ওপর হামলা করা হয়নি, সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বক্তব্যটি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো। টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের কল্যাণে সে ‘সরিয়ে দেওয়ার’ চিত্রের সঙ্গে দেশবাসী পরিচিত হয়েছে পুরোপুরি। ঘটনাটি পুলিশের ভাবমূর্তিকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। এটা উপেক্ষা করার নয়। দায়ী ব্যক্তিদের দায় ভোগ করা সংগত। ঠিক তেমনি পয়লা বৈশাখের বেদনাদায়ক ঘটনাও সঠিক তদন্তে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো আবশ্যক। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, সে ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য পুলিশের তিনজন সদস্যকে তাঁদের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি চিহ্নিত করেছে। কারও বিরুদ্ধেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই জানা যায়।
পুলিশের ক্ষমতার উৎস আইন। আইন পুলিশকে জনজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব দিয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই আবশ্যক হয় জনগণের সহযোগিতা। জনগণের একটি বড় অংশের সহযোগিতা ছাড়া তাদের সফল হওয়ার কথা নয়। সে সহযোগিতা নৈতিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে বৈষয়িকও হতে পারে। কিছুদিন আগেও পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে। কিছু ক্ষেত্রে জনগণই পুলিশকে সহায়তা করে তাদের আইনের আওতায় আনতে।
আর ২০১৩ সালে পুলিশের সামনে ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। সে সময়ে হঠাৎ শুরু হওয়া হিংসাত্মক আক্রমণের মুখে পুলিশ ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটা অপ্রস্তুতই ছিল। তখন ঢাকা মহানগরেও এসব হামলাকারীর ঝটিকা আক্রমণে পুলিশের বেশ কিছু সদস্য আহত হন। তাঁদের অনেক গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া বা ভেঙে ফেলা হয়। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এ ধরনের হামলা ছিল অনেক বেশি আগ্রাসী। কোথাও পিটিয়েও পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। তখন জনগণের বিশাল অংশ নৈতিকভাবে পুলিশের ওপর হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ লিখে, টিভি টক শোতে, তাঁদের অনেকে সে অবস্থান জানান দেন। এটা সবাই বলতে থাকেন, পুলিশ এ ধরনের হামলায় নিজেদের রক্ষা করতে সফল না হলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জানমালের নিরাপত্তা বিধান করবে কীভাবে? পরামর্শ আসে পুলিশকে ঘুরে দাঁড়ানোর। সেটা তারা অনেকটা করতেও পেরেছে। এ-জাতীয় হামলায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষ, এমন নজিরও রয়েছে। একটি ঘটনা তো পুলিশ মহলসহ সারা দেশেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। সেটা ঘটে ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরে। হরতাল চলাকালে রাজশাহীর শালবাগান এলাকায় বোয়ালিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল অতর্কিত হামলার মুখোমুখি হয়। এসআই জাহাঙ্গীর গুরুতর আহত হয়ে রাজপথে পড়ে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে টহলদানকারী অবশিষ্ট সদস্যরা হয়তো বা টিকে উঠতে না পেরে পালিয়ে যান তাঁকে ফেলে। নিকটবর্তী কোনো টহল দলও এগিয়ে এল না। এগিয়ে এলেন বিউটি পারলারকর্মী ঝর্ণা বেগম। তিনি দ্রুত সে মুমূর্ষু এসআইকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। প্রাণে বেঁচে সুস্থ হন সেই এসআই। পুলিশ সদর দপ্তর ঝর্ণা বেগমকে আন্তরিক সংবর্ধনা দেয়। উদ্যোগ নেওয়া হয় তাঁর জন্য একটি স্থায়ী চাকরির।
ঝর্ণা বেগম ব্যাপক ঝুঁকির মুখে তাঁর নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সেটার মূল্যায়ন বৈষয়িকভাবে করা যায় না। তবে নৈতিক দিকটি শিক্ষণীয় সবার কাছে। পুলিশ সদস্যরা এ দেশেরই সন্তান। তাঁরা বিপন্ন হলে এরূপ সহায়তা করাই সংগত। তেমনি এ দেশের জনগণেরও প্রত্যাশা থাকে, তাঁরা সদাচারী ও ন্যায়নিষ্ঠ হবেন। অনেকেই তেমন আছেনও বটে। বিপন্নের সহায়তায় দ্রুত হাত বাড়ান। তবে ব্যতিক্রমও কম নয়। আর সেটাই তো দেখা গেল নববর্ষের অপ্রীতিকর ঘটনা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অসামর্থ্য এবং প্রতিবাদকারী সামান্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ওপর হামলার ধরন থেকে। ঝর্ণা বেগম নামটি কিন্তু প্রতীকী হয়ে আছে। ইসমত জাহানদের অপ্রয়োজনীয় লাঠিপেটা আর চুল ধরে টানাহেঁচড়ার সময় সে প্রতীকী চিত্র মনে রাখাই তো স্বাভাবিক ছিল। অন্তত তা প্রত্যাশিত ছিল এ অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তার কাছে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
এ রকম সাদামাটাই যদি ঘটনাটি হতো, তাহলে তেমন কথা ছিল না। সময়ে সময়ে ছত্রভঙ্গ করতে মিছিলে বাধা দিতে হয় পুলিশকে। তবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর তারা যেভাবে হামলাটি চালিয়েছিল, তা বিস্ময়কর ও অভাবিত। লাঠিপেটা করেছে, হেলমেট দিয়ে করেছে আঘাত, মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে মারধর করেছে। মাটিতে পড়ে যাওয়া ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিসহ আরও কয়েকজন ছাত্রের পিঠে পড়েছে পদাঘাত। হামলায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইসমত জাহান নামের একজন ছাত্রীকে চুলের মুঠি ধরে বের করে এনে করেছে লাঠিপেটা। ঘটনাটি বিস্ময়ের এ জন্য যে মিছিলটি ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ আর কলেবরে খুবই ছোট। তারা যদি রাস্তা অবরোধ করেও রাখে, সেটা ভেঙে দিতে এ মাত্রায় শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল, এমনটা মনে করার কোনো সংগত কারণ নেই। ঘেরাও-অবরোধ হিংস্র হয়ে উঠলে আর সরকারি স্থাপনা, জনজীবন, বিশেষ করে কর্তব্যরত পুলিশ বিপন্ন হলে গুলিও চালানো যায়। মিছিলকারীদের বেআইনি জনতা বলে চিহ্নিত করলেও তাদের সংখ্যা ও আচরণ বিবেচনায় শক্তি প্রয়োগে গ্রহণযোগ্য মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিগুলোতে পুলিশকে যে রূপে দেখা গেল, তা অভাবিতও বটে।
ঝর্ণা বেগম ব্যাপক ঝুঁকির মুখে তাঁর নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সেটার মূল্যায়ন বৈষয়িকভাবে করা যায় না। তবে নৈতিক দিকটি শিক্ষণীয় সবার কাছে। পুলিশ সদস্যরা এ দেশেরই সন্তান। তাঁরা বিপন্ন হলে এরূপ সহায়তা করাই সংগত ছাত্র ইউনিয়ন নামক সংগঠনটি হালে তেমন জোরদার নয়। তাদের কর্মসূচিও এখন তাই সীমিত থাকে আকৃতি ও প্রকৃতিতে। তাদের নেতা-কর্মীদের আচরণ অনেকটা পরিশীলিত। তারপরও যে উদ্দেশ্যে আলোচ্য ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে মিছিল নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছিল, তা খুবই যুক্তিসংগত বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়। পয়লা বৈশাখের বিকেলে নববর্ষ অনুষ্ঠানে নারী লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা বিরাজ করছে সব বিবেকবান মানুষের মধ্যে। সবাই আশা করেন পুলিশ তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনবে। কিন্তু এক মাস চলে গেলেও কোনো সাফল্য দেখা যাচ্ছে না তদন্তে। এতে নাগরিক সমাজ উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। প্রতিবাদও সংগত। এ অপরাধীদের শনাক্ত ও শাস্তি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সহায়ক হবে, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায়। আর উল্টোটা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে করবে আরও জোরদার। দ্বিগুণ উৎসাহে সময়-সুযোগে এরূপ ঘটবে। এ কথা সত্যি যে সব অপরাধ তাৎক্ষণিক বা অতি দ্রুত উদ্ঘাটিত হয় না। সেসব ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের প্রতি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা সংবেদনশীল থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করে কোনো দপ্তর ঘেরাও করা কোনো অভিনব বা সব ক্ষেত্রেই আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ঘটনা নয়। আর এখানে মিছিলকারীদের সংখ্যা ও তাদের আচরণঘটিত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিলে মোটেই নয়। এরূপ কত ঘটনায় ডিসি, এসপিদের অফিস ঘেরাও হয়। আর তার সুন্দর পরিণতিও ঘটে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মিন্টো রোডে ক্ষুব্ধ ছেলেমেয়েদের প্রতি পুলিশের এতটা অসহিষ্ণু হওয়ার কারণটি দুর্বোধ্য। বলা হচ্ছে, তারা মিনিট বিশেক রাস্তা আটকে রেখে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছিল। এরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি অসংগত, এটা কেউ অস্বীকার করবে না। তবে কত আনন্দ মিছিল কিংবা ‘সরকারি প্রয়োজনে’ ঢাকার কোনো না কোনো রাস্তা প্রায়ই আটকে থাকে দীর্ঘ সময়। অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয় যাত্রীরা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে এত দ্রুত পুলিশি তৎপরতার নৈতিক দিকটি খুঁজে পাওয়া যায় না।
ঘটনার পরপর একজন নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তবে ডিএমপি সদর দপ্তরে সেদিনকার নিরাপত্তার দায়িত্বে কোন কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিলেন, কার সিদ্ধান্তে এমনটি ঘটল, তা তলিয়ে দেখা দরকার। পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ কেউ বলছেন মিছিলকারীদের ওপর হামলা করা হয়নি, সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বক্তব্যটি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো। টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের কল্যাণে সে ‘সরিয়ে দেওয়ার’ চিত্রের সঙ্গে দেশবাসী পরিচিত হয়েছে পুরোপুরি। ঘটনাটি পুলিশের ভাবমূর্তিকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। এটা উপেক্ষা করার নয়। দায়ী ব্যক্তিদের দায় ভোগ করা সংগত। ঠিক তেমনি পয়লা বৈশাখের বেদনাদায়ক ঘটনাও সঠিক তদন্তে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো আবশ্যক। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, সে ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য পুলিশের তিনজন সদস্যকে তাঁদের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি চিহ্নিত করেছে। কারও বিরুদ্ধেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই জানা যায়।
পুলিশের ক্ষমতার উৎস আইন। আইন পুলিশকে জনজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব দিয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই আবশ্যক হয় জনগণের সহযোগিতা। জনগণের একটি বড় অংশের সহযোগিতা ছাড়া তাদের সফল হওয়ার কথা নয়। সে সহযোগিতা নৈতিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে বৈষয়িকও হতে পারে। কিছুদিন আগেও পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে। কিছু ক্ষেত্রে জনগণই পুলিশকে সহায়তা করে তাদের আইনের আওতায় আনতে।
আর ২০১৩ সালে পুলিশের সামনে ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। সে সময়ে হঠাৎ শুরু হওয়া হিংসাত্মক আক্রমণের মুখে পুলিশ ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটা অপ্রস্তুতই ছিল। তখন ঢাকা মহানগরেও এসব হামলাকারীর ঝটিকা আক্রমণে পুলিশের বেশ কিছু সদস্য আহত হন। তাঁদের অনেক গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া বা ভেঙে ফেলা হয়। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এ ধরনের হামলা ছিল অনেক বেশি আগ্রাসী। কোথাও পিটিয়েও পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। তখন জনগণের বিশাল অংশ নৈতিকভাবে পুলিশের ওপর হামলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ লিখে, টিভি টক শোতে, তাঁদের অনেকে সে অবস্থান জানান দেন। এটা সবাই বলতে থাকেন, পুলিশ এ ধরনের হামলায় নিজেদের রক্ষা করতে সফল না হলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জানমালের নিরাপত্তা বিধান করবে কীভাবে? পরামর্শ আসে পুলিশকে ঘুরে দাঁড়ানোর। সেটা তারা অনেকটা করতেও পেরেছে। এ-জাতীয় হামলায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষ, এমন নজিরও রয়েছে। একটি ঘটনা তো পুলিশ মহলসহ সারা দেশেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। সেটা ঘটে ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরে। হরতাল চলাকালে রাজশাহীর শালবাগান এলাকায় বোয়ালিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল অতর্কিত হামলার মুখোমুখি হয়। এসআই জাহাঙ্গীর গুরুতর আহত হয়ে রাজপথে পড়ে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে টহলদানকারী অবশিষ্ট সদস্যরা হয়তো বা টিকে উঠতে না পেরে পালিয়ে যান তাঁকে ফেলে। নিকটবর্তী কোনো টহল দলও এগিয়ে এল না। এগিয়ে এলেন বিউটি পারলারকর্মী ঝর্ণা বেগম। তিনি দ্রুত সে মুমূর্ষু এসআইকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। প্রাণে বেঁচে সুস্থ হন সেই এসআই। পুলিশ সদর দপ্তর ঝর্ণা বেগমকে আন্তরিক সংবর্ধনা দেয়। উদ্যোগ নেওয়া হয় তাঁর জন্য একটি স্থায়ী চাকরির।
ঝর্ণা বেগম ব্যাপক ঝুঁকির মুখে তাঁর নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সেটার মূল্যায়ন বৈষয়িকভাবে করা যায় না। তবে নৈতিক দিকটি শিক্ষণীয় সবার কাছে। পুলিশ সদস্যরা এ দেশেরই সন্তান। তাঁরা বিপন্ন হলে এরূপ সহায়তা করাই সংগত। তেমনি এ দেশের জনগণেরও প্রত্যাশা থাকে, তাঁরা সদাচারী ও ন্যায়নিষ্ঠ হবেন। অনেকেই তেমন আছেনও বটে। বিপন্নের সহায়তায় দ্রুত হাত বাড়ান। তবে ব্যতিক্রমও কম নয়। আর সেটাই তো দেখা গেল নববর্ষের অপ্রীতিকর ঘটনা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অসামর্থ্য এবং প্রতিবাদকারী সামান্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর ওপর হামলার ধরন থেকে। ঝর্ণা বেগম নামটি কিন্তু প্রতীকী হয়ে আছে। ইসমত জাহানদের অপ্রয়োজনীয় লাঠিপেটা আর চুল ধরে টানাহেঁচড়ার সময় সে প্রতীকী চিত্র মনে রাখাই তো স্বাভাবিক ছিল। অন্তত তা প্রত্যাশিত ছিল এ অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তার কাছে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments