মেয়রদের সামনে তিন চ্যালেঞ্জ by আব্দুল কাইয়ুম
তিনজন
মেয়র হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁদের একটা আফসোস রয়ে গেল। এই মেয়র তো সেই মেয়র
নন, যাঁরা সত্যিকার অর্থে জোর গলায় দাবি করতে পারেন যে মানুষের
স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাঁরা ম্যানডেট পেয়েছেন। হয়তো
এটা তাঁদের দোষ নয়। বিএনপি মাঝপথে রণে ভঙ্গ দিয়ে এমন এক অবস্থা করল যে
ভোটের দিনের শেষ অর্ধেক প্রতিপক্ষবিহীন নির্বাচন করতে তাঁরা বাধ্য হলেন।
ফলে অনেকের কাছে সেই ভোটের আর দাম থাকল না।
এখন বিতর্ক হতে পারে যে বিএনপির আর কী উপায় ছিল। তাদের এজেন্টদের গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। অথবা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রের কাছেধারে যেতে দেয়নি ইত্যাদি। আবার আওয়ামী লীগ বলবে, বিএনপির এজেন্টরা নিজেরাই ৯০ শতাংশ কেন্দ্রে যায়নি, তাদের বের করে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে কীভাবে? এই বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু যা বোঝার, মানুষ তা যে যার মতো করে বুঝে নিয়েছে।
মানুষের এই নিস্পৃহতা দূর করাই হবে তিন মেয়রের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে হলে মেয়রদের এমন কিছু করতে হবে, যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। মানুষ যদি দেখে যে মেয়ররা উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচিত না হলেও জনজীবনের দুর্ভোগ কমাতে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন, তাদের নিত্যদিনের ঝামেলা কমাতে কাজ করছেন, তাহলে ধীরে ধীরে একটা অবস্থা তৈরি হলেও হতে পারে।
এ রকম অবস্থা বিএনপির আমলেও হয়েছিল। সাদেক হোসেন খোকা ২০০২ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ মেয়র পদে প্রার্থী দেয়নি। কারণ, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি এমন তাণ্ডব শুরু করে, নেতাদের ধরপাকড়, মারধর করে এমন বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করে যে মাথা তুলে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন ছিল। কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে মেয়র হয়েও ২০১১ সাল পর্যন্ত সাদেক হোসেন খোকা টিকে ছিলেন। নানা কারসাজি হয়তো ছিল, কিন্তু তিনি মেয়র হিসেবে টিকে ছিলেন। কিছু কাজও হয়েছিল তাঁর আমলে।
তবে এ দেশে কোনো ভালো কাজও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। এবং সমালোচনাগুলোর পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও থাকে। সাদেক হোসেন খোকার মেয়রগিরিও ভালো-মন্দ মিশিয়ে পার হয়ে গেছে। তিনি যে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে একটি নিষ্প্রাণ নির্বাচনে মেয়র হয়েছিলেন, সেটা সময়ের সঙ্গে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। তাঁর একটা কৌশল ছিল। তিনি কাজ করার সময় আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন।
এখন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়ররা আর কাকে সঙ্গে নেবেন? বিএনপি তো মাঠে নেই। মারপিট-ভয়ভীতি-মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে তাদের রাজনীতির মাঠ থেকে তাড়ানো হয়েছে। বিএনপি আপাতত শীতনিদ্রায়। সংগঠন গুছিয়ে, শক্তি সঞ্চয় করে মাঠে নামবে। এখন নগরবাসীর আস্থা অর্জন করতে হলে মেয়রদের সত্যিকার অর্থে কাজ করে দেখাতে হবে যে তাঁরা জনগণের সঙ্গে আছেন।
কাজটা খুব সহজ নয়। মেয়রদের প্রথম কাজ হবে একটা চেক লিস্ট তৈরি করা। মানুষের সমস্যাগুলোর তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেগুলো সাজাতে হবে। অফিসে চোখের সামনে সেই তালিকা টাঙানো থাকবে। তালিকার একটি কপি বাসায় টাঙিয়ে রাখলে আরও ভালো। ভোরবেলা চায়ের টেবিলে বসলেই সেই সমস্যার তালিকা চোখের সামনে ভেসে উঠবে, অফিসে গেলেও সেটা তিনি দেখবেন। বাসায় ফিরে আবার দেখবেন। প্রতিদিন কতটা কাজ তিনি করতে পারলেন, তাঁর লোকজন দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে কতটা অগ্রসর হতে পারলেন, সেটা দিন শেষে তিনি হিসাব করবেন।
যেমন, ঢাকায় যে সমস্যাটা সকাল থেকে মানুষের জান শেষ করে দেয়, সেটা হলো যানজট। আপনি যেখানেই যান, দু-তিন ঘণ্টা রাস্তা খেয়ে ফেলবে। কীভাবে এ সমস্যা দূর করা যায়? সরকারের সাহায্য দরকার। আর দরকার ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের দুই মেয়রের সমন্বিতভাবে কাজ করা। মানুষের আয় বেড়েছে, গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। কী করা যায়? সকালে গুলিস্তান থেকে গুলশান-বনানী পর্যন্ত অবর্ণনীয় যানজট। এটা চলতে থাকে রাত পর্যন্ত। কারণ, উত্তর-দক্ষিণে চলাচলের জন্য এখন কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ছাড়া উপায় নেই। কাকরাইল-মগবাজার-তেজগাঁওয়ের রাস্তাটিতে বছরের পর বছর ধরে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। মগবাজার-মৌচাক রাস্তারও একই দশা। ফলে গুলিস্তান-গুলশান পথে যাতায়াতের জন্য সব গাড়ি ফার্মগেটের রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর তো কোনো উপায় নেই। এই রাস্তায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের কত লাখ ঘণ্টা যে যানজটে আটকা পড়ে নষ্ট হয়, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
এই সমস্যার একটা সুরাহা হওয়া দরকার। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর, দুই কূলেরই সমস্যা। এখন দুই মেয়র সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ করতে পারেন যে ওই দুটি ফ্লাইওভার যেন খুব দ্রুত শেষ করার ব্যবস্থা হয়। কেন বছরের পর বছর ফ্লাইওভারের কাজ চলবে? যে কাজ এক বছরে হতে পারে, সেটা চার-পাঁচ বছরেও শেষ হওয়া তো দূরের কথা, অর্ধেকও কেন হয় না? এর রহস্য কী? কাজ চলছে ঢিমে তালে। দেখার কি কেউ নেই? সরকারের কেউ কি বলতে পারেন না, কেন কাজ হচ্ছে না? কেন মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো হচ্ছে?
যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজটিও ঝুলে থাকত, যদি সরকার তাড়া না দিত। কিন্তু সেখানেও গ্যাঞ্জাম। ওপর দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে সাঁই–সাঁই করে, আর নিচের রাস্তায় দুনিয়ার জঞ্জাল। রাস্তা ভাঙাচোরা, ইট-পাথরের ব্লক। যেখানে-সেখানে বাস-ট্রাক ফেলে রাখা হয়েছে। নিচের রাস্তা দিয়ে বাস-গাড়ি চলাচল করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অথচ আরও অনেক আগেই ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা জঞ্জালমুক্ত করে দেওয়ার কথা। সেটা যে হচ্ছে না, তার কোনো জবাবদিহি নেই।
মেয়ররা হয়তো বলবেন, এসব ফ্লাইওভার তো তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেই। মেয়রের কাজ না। হয়তো তাঁরা বলবেন, ‘নগর সরকার’ না হলে কীভাবে কী করব? ঠিক। নগর সরকার হলে তো ভালোই। কিন্তু সেটা না হলে যে নগরবাসীকে প্রতিদিন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তার দায় তো তাঁরা এড়াতে পারবেন না। তাই দুই মেয়র মিলে সরকারকে বোঝান, যেন দ্রুত ফ্লাইওভারের কাজ শেষ করা হয়।
মেয়ররা তো পরিষ্কার ঢাকার জন্য ঝাড়ু হাতে রাজপথে নেমেছেন। ভালো কাজ। এ রকম একদিন সকাল থেকে দু-এক ঘণ্টা তেজগাঁও-মগবাজার-মৌচাক রাস্তাজুড়ে অবস্থান করেন না দুই মেয়র, তাঁদের সমর্থকদের নিয়ে। ডাক দেন ভুক্তভোগী নাগরিকদের। কোনো হই–হাঙ্গামা নয়, কোনো ভাঙচুর নয়। শান্তিপূর্ণ অবস্থান। ন্যায্য দাবি। ছয় মাসের মধ্যে ফ্লাইওভারের কাজ শেষ করতে হবে।
তারপর ক্ষণ গণনা শুরু করুন। নগর ভবনে একটা বড় ইলেকট্রনিক ঘড়ি লাগিয়ে দেন। সেখানে প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে, ফ্লাইওভার শেষ করতে আর মাত্র ১৮২ দিন বাকি, পরদিন দেখা যাবে, আর মাত্র ১৮১ দিন বাকি! নগরবাসী দেখুক, কাজ কত দূর হচ্ছে।
ইতিমধ্যে মেয়ররা সরকারকে অনুরোধ করতে পারেন, যেন সরকারি অফিসগুলো সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত করা হয়। তাহলে যানজট কিছুটা কমানো যাবে। শুক্র-শনি ছুটি যথারীতি থাকবে। আগে তো সকালে অফিস হতো।
সরকার উঠেপড়ে লাগায় বিদ্যুৎ সমস্যা প্রায় মিটিয়ে ফেলা গেছে। এ রকম জানপ্রাণ চেষ্টা করলে যানজটও কমিয়ে আনা যাবে। তাহলে কত লোকের যে কত সময় বেঁচে যাবে, তা বুঝিয়ে বলা লাগে না। এটা যেন হয়, সে জন্য ঢাকার দুই মেয়র একযোগে কাজ করুন। যদি তাঁরা সফল হন, তাহলে মেয়রদের প্রতি মানুষের নিস্পৃহ ভাব অনেকটাই কেটে যাবে। নির্জীব নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়রও যে খুব তেজি মেয়র হতে পারেন, তা তাঁরা প্রমাণ করতে পারবেন।
এর সঙ্গে আরও দুটি চ্যালেঞ্জ তাঁদের মোকাবিলা করতেই হবে। একটি হলো টেন্ডারবাজি-দলবাজি বন্ধ, অপরটি হলো জলাবদ্ধতার অবসান। এ দুটি বিষয়ে আগামী দিনে লিখব।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail. com
এখন বিতর্ক হতে পারে যে বিএনপির আর কী উপায় ছিল। তাদের এজেন্টদের গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। অথবা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রের কাছেধারে যেতে দেয়নি ইত্যাদি। আবার আওয়ামী লীগ বলবে, বিএনপির এজেন্টরা নিজেরাই ৯০ শতাংশ কেন্দ্রে যায়নি, তাদের বের করে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে কীভাবে? এই বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু যা বোঝার, মানুষ তা যে যার মতো করে বুঝে নিয়েছে।
মানুষের এই নিস্পৃহতা দূর করাই হবে তিন মেয়রের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে হলে মেয়রদের এমন কিছু করতে হবে, যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। মানুষ যদি দেখে যে মেয়ররা উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচিত না হলেও জনজীবনের দুর্ভোগ কমাতে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন, তাদের নিত্যদিনের ঝামেলা কমাতে কাজ করছেন, তাহলে ধীরে ধীরে একটা অবস্থা তৈরি হলেও হতে পারে।
এ রকম অবস্থা বিএনপির আমলেও হয়েছিল। সাদেক হোসেন খোকা ২০০২ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ মেয়র পদে প্রার্থী দেয়নি। কারণ, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি এমন তাণ্ডব শুরু করে, নেতাদের ধরপাকড়, মারধর করে এমন বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করে যে মাথা তুলে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন ছিল। কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে মেয়র হয়েও ২০১১ সাল পর্যন্ত সাদেক হোসেন খোকা টিকে ছিলেন। নানা কারসাজি হয়তো ছিল, কিন্তু তিনি মেয়র হিসেবে টিকে ছিলেন। কিছু কাজও হয়েছিল তাঁর আমলে।
তবে এ দেশে কোনো ভালো কাজও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। এবং সমালোচনাগুলোর পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও থাকে। সাদেক হোসেন খোকার মেয়রগিরিও ভালো-মন্দ মিশিয়ে পার হয়ে গেছে। তিনি যে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে একটি নিষ্প্রাণ নির্বাচনে মেয়র হয়েছিলেন, সেটা সময়ের সঙ্গে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। তাঁর একটা কৌশল ছিল। তিনি কাজ করার সময় আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও সঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করেছেন।
এখন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়ররা আর কাকে সঙ্গে নেবেন? বিএনপি তো মাঠে নেই। মারপিট-ভয়ভীতি-মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে তাদের রাজনীতির মাঠ থেকে তাড়ানো হয়েছে। বিএনপি আপাতত শীতনিদ্রায়। সংগঠন গুছিয়ে, শক্তি সঞ্চয় করে মাঠে নামবে। এখন নগরবাসীর আস্থা অর্জন করতে হলে মেয়রদের সত্যিকার অর্থে কাজ করে দেখাতে হবে যে তাঁরা জনগণের সঙ্গে আছেন।
কাজটা খুব সহজ নয়। মেয়রদের প্রথম কাজ হবে একটা চেক লিস্ট তৈরি করা। মানুষের সমস্যাগুলোর তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেগুলো সাজাতে হবে। অফিসে চোখের সামনে সেই তালিকা টাঙানো থাকবে। তালিকার একটি কপি বাসায় টাঙিয়ে রাখলে আরও ভালো। ভোরবেলা চায়ের টেবিলে বসলেই সেই সমস্যার তালিকা চোখের সামনে ভেসে উঠবে, অফিসে গেলেও সেটা তিনি দেখবেন। বাসায় ফিরে আবার দেখবেন। প্রতিদিন কতটা কাজ তিনি করতে পারলেন, তাঁর লোকজন দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে কতটা অগ্রসর হতে পারলেন, সেটা দিন শেষে তিনি হিসাব করবেন।
যেমন, ঢাকায় যে সমস্যাটা সকাল থেকে মানুষের জান শেষ করে দেয়, সেটা হলো যানজট। আপনি যেখানেই যান, দু-তিন ঘণ্টা রাস্তা খেয়ে ফেলবে। কীভাবে এ সমস্যা দূর করা যায়? সরকারের সাহায্য দরকার। আর দরকার ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের দুই মেয়রের সমন্বিতভাবে কাজ করা। মানুষের আয় বেড়েছে, গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। কী করা যায়? সকালে গুলিস্তান থেকে গুলশান-বনানী পর্যন্ত অবর্ণনীয় যানজট। এটা চলতে থাকে রাত পর্যন্ত। কারণ, উত্তর-দক্ষিণে চলাচলের জন্য এখন কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ছাড়া উপায় নেই। কাকরাইল-মগবাজার-তেজগাঁওয়ের রাস্তাটিতে বছরের পর বছর ধরে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। মগবাজার-মৌচাক রাস্তারও একই দশা। ফলে গুলিস্তান-গুলশান পথে যাতায়াতের জন্য সব গাড়ি ফার্মগেটের রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর তো কোনো উপায় নেই। এই রাস্তায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের কত লাখ ঘণ্টা যে যানজটে আটকা পড়ে নষ্ট হয়, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
এই সমস্যার একটা সুরাহা হওয়া দরকার। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর, দুই কূলেরই সমস্যা। এখন দুই মেয়র সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ করতে পারেন যে ওই দুটি ফ্লাইওভার যেন খুব দ্রুত শেষ করার ব্যবস্থা হয়। কেন বছরের পর বছর ফ্লাইওভারের কাজ চলবে? যে কাজ এক বছরে হতে পারে, সেটা চার-পাঁচ বছরেও শেষ হওয়া তো দূরের কথা, অর্ধেকও কেন হয় না? এর রহস্য কী? কাজ চলছে ঢিমে তালে। দেখার কি কেউ নেই? সরকারের কেউ কি বলতে পারেন না, কেন কাজ হচ্ছে না? কেন মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো হচ্ছে?
যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজটিও ঝুলে থাকত, যদি সরকার তাড়া না দিত। কিন্তু সেখানেও গ্যাঞ্জাম। ওপর দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে সাঁই–সাঁই করে, আর নিচের রাস্তায় দুনিয়ার জঞ্জাল। রাস্তা ভাঙাচোরা, ইট-পাথরের ব্লক। যেখানে-সেখানে বাস-ট্রাক ফেলে রাখা হয়েছে। নিচের রাস্তা দিয়ে বাস-গাড়ি চলাচল করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অথচ আরও অনেক আগেই ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা জঞ্জালমুক্ত করে দেওয়ার কথা। সেটা যে হচ্ছে না, তার কোনো জবাবদিহি নেই।
মেয়ররা হয়তো বলবেন, এসব ফ্লাইওভার তো তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেই। মেয়রের কাজ না। হয়তো তাঁরা বলবেন, ‘নগর সরকার’ না হলে কীভাবে কী করব? ঠিক। নগর সরকার হলে তো ভালোই। কিন্তু সেটা না হলে যে নগরবাসীকে প্রতিদিন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তার দায় তো তাঁরা এড়াতে পারবেন না। তাই দুই মেয়র মিলে সরকারকে বোঝান, যেন দ্রুত ফ্লাইওভারের কাজ শেষ করা হয়।
মেয়ররা তো পরিষ্কার ঢাকার জন্য ঝাড়ু হাতে রাজপথে নেমেছেন। ভালো কাজ। এ রকম একদিন সকাল থেকে দু-এক ঘণ্টা তেজগাঁও-মগবাজার-মৌচাক রাস্তাজুড়ে অবস্থান করেন না দুই মেয়র, তাঁদের সমর্থকদের নিয়ে। ডাক দেন ভুক্তভোগী নাগরিকদের। কোনো হই–হাঙ্গামা নয়, কোনো ভাঙচুর নয়। শান্তিপূর্ণ অবস্থান। ন্যায্য দাবি। ছয় মাসের মধ্যে ফ্লাইওভারের কাজ শেষ করতে হবে।
তারপর ক্ষণ গণনা শুরু করুন। নগর ভবনে একটা বড় ইলেকট্রনিক ঘড়ি লাগিয়ে দেন। সেখানে প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে, ফ্লাইওভার শেষ করতে আর মাত্র ১৮২ দিন বাকি, পরদিন দেখা যাবে, আর মাত্র ১৮১ দিন বাকি! নগরবাসী দেখুক, কাজ কত দূর হচ্ছে।
ইতিমধ্যে মেয়ররা সরকারকে অনুরোধ করতে পারেন, যেন সরকারি অফিসগুলো সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত করা হয়। তাহলে যানজট কিছুটা কমানো যাবে। শুক্র-শনি ছুটি যথারীতি থাকবে। আগে তো সকালে অফিস হতো।
সরকার উঠেপড়ে লাগায় বিদ্যুৎ সমস্যা প্রায় মিটিয়ে ফেলা গেছে। এ রকম জানপ্রাণ চেষ্টা করলে যানজটও কমিয়ে আনা যাবে। তাহলে কত লোকের যে কত সময় বেঁচে যাবে, তা বুঝিয়ে বলা লাগে না। এটা যেন হয়, সে জন্য ঢাকার দুই মেয়র একযোগে কাজ করুন। যদি তাঁরা সফল হন, তাহলে মেয়রদের প্রতি মানুষের নিস্পৃহ ভাব অনেকটাই কেটে যাবে। নির্জীব নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়রও যে খুব তেজি মেয়র হতে পারেন, তা তাঁরা প্রমাণ করতে পারবেন।
এর সঙ্গে আরও দুটি চ্যালেঞ্জ তাঁদের মোকাবিলা করতেই হবে। একটি হলো টেন্ডারবাজি-দলবাজি বন্ধ, অপরটি হলো জলাবদ্ধতার অবসান। এ দুটি বিষয়ে আগামী দিনে লিখব।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail. com
No comments