অগ্নিদগ্ধ কিংবা বিধ্বস্ত হওয়া শ্রমিকের নিয়তি হতে পারে না by অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল
২৪ নভেম্বর ২০১২ তাজরিন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। এর চার মাস পরেই সাভারের রানা প্লাজার ভবন ধসে ১ হাজার ১৩৭ জনের করুণ মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল গত বছর বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি। এ দুটি ঘটনায় সারা দেশের মানুষ ও বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। অত্যন্ত হৃদয়বিদারক হল এত কিছুর পরও ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিহত শ্রমিক পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণ না পাওয়া।
জীবনের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সব মৌলিক অধিকারের প্রধান। বাংলাদেশের সংবিধানে আর্টিকেল ৩১, ৩২ ও ৩৪-এ প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতার অধিকার, জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, যা ইউনিভার্সেল হিউম্যান রাইটস ও মানবাধিকার সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাদের কারণে মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ না করলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাজরীন গার্মেন্টে কলাপসিবল গেটে তালা লাগানো অবস্থায় অগ্নিকাণ্ডের সময় শ্রমিকদের নিচে নামতে না দেয়া এবং শ্রমআইন-কারখানাআইন অমান্য করার পরও অভিযুক্ত গার্মেন্ট মালিক দেলোয়ার হোসেনকে জামিনে মুক্তি দেয়া, রানা প্লাজা ধসে জড়িত দায়ী-দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেয়া এবং বিজিএমইএ-এর পাশ কাটানো ইত্যাদি কেউ মেনে নিতে পারেনি। একইসঙ্গে সহস্রাধিক প্রাণহানির ঘটনা কেন ঘটল, কোন কোন অবহেলা (negligence),
ত্রুটি ও আইন লংঘনের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে; এগুলোর জন্য দায়ী-দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কী ঘাটতি রয়েছে-এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে আইন সংশোধন এবং বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তাজরীন ফ্যাশনের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয়েছে ৬ বা ৭ লাখ করে টাকা। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল ও মন্ত্রণালয়ের টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা আছে। বিজিএমইএ ও বায়ার আছে। কিন্তু মালিকের কোনো টাকার কথা শোনা যায়নি। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন কয়েকজন। আহতদের অনেকের চিকিৎসার খবর নেই। রানা প্লাজার ভয়ংকর ঘটনার পর বিজিএমইএ নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ক্ষতিপূরণের অর্থ অন্তত তাজরীনের চেয়ে কম হবে না, বেশিই হবে। বলেছেন, আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব তাদের। মিডিয়ার যতদিন মনোযোগ ছিল, ততদিন এসব কথা শোনা গেছে। মিডিয়া সরে যাওয়ার পর তাদের কথা আর কাজের মধ্যে ব্যাপক ফারাক পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারা কি আশা করেছেন, সময়ে সবাই ভুলে যাবে সব? দেশের আরও অঘটনে চাপা পড়ে যাবে তাদের সব কলংক?
রানা প্লাজা ধসে পড়ার সময় প্রকৃতপক্ষে কত লোক সেখানে ছিলেন, তার কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যদিও সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ভবন ধসের পর ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত ও ১ হাজার ১৩৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। জীবিত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা শ্রমিকদের সংখ্যা যোগ করলে তা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৭৫। যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে মারা যান ১৮ জন। যদিও এ সংখ্যা স্থির নয়। সে হিসাবে মৃতের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৭। এছাড়াও উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে দু’জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৯৭৬টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ২৯১টি অশনাক্ত লাশ দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে ১ হাজার ১৬৭ জন আহতের একটি তালিকা আছে। আদালতে জমা দেয়া প্রধান কারখানা পরিদর্শকের তালিকায় নিখোঁজের সংখ্যা ৩৭৯ হলেও ঢাকা জেলা প্রশাসকের তালিকায় রয়েছে ৩৭৬ জনের নাম। ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে লাশের দাবি করে রক্তের নমুনা জমা দিয়েছেন ৫৫৩ জন। সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি শুরু থেকে থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকার বা বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ তা দূর করতে পারেনি। তাই আপনজনের খোঁজ না পাওয়া কিংবা সরকারি-বেসরকারি সাহায্য থেকে অনেক পরিবারের বঞ্চিত হওয়ার আশংকা থেকেই যাচ্ছে।
ক্ষতিপূরণ কত হওয়া উচিত সেটা নিয়ে নানা হিসাব আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষারত কয়েকজন প্রবাসী শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদ্ধতি ও দেশের বিদ্যমান মজুরি কাঠামো বিশ্লেষণ করে ক্ষতিপূরণের একটি ছক দিয়েছেন। তাতে ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় সর্বনিু প্রায় ৯ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছিলেন ১৮৫৫ সালের চরম দুর্ঘটনা আইন অনুযায়ী গড়ে কম করে ধরলেও ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় ৪৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইএলওসহ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মজুরি কাঠামো বিবেচনা করে পরিবার প্রতি ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবারই অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। অনুপাত অনুযায়ী সরকার শতকরা ৯ ভাগ, বিজিএমইএ শতকরা ১৮ ভাগ, মালিক ২৮ ভাগ এবং ব্র্যান্ড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান শতকরা ৪৫ ভাগ বহন করবেন।
রানা প্লাজায় ভয়ংকর জীবননাশের পর দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু সভা-সম্মেলন হচ্ছে। অনেক রকম প্রতিশ্রুতিও শোনা যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে টাকাও উঠেছে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে এখনও বিজিএমইএ বা সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি।
মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের এ ব্যবসায় মালিকপক্ষ মুনাফা অর্জন করেই চলবে আর অন্যদিকে যাদের মেহনত ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে টিকে আছে এই শিল্প, তারা কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে, মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হয়ে থাকবে, তা হতে পারে না।
শ্রমশক্তি বা শ্রমজীবীদের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করা গার্মেন্ট শিল্পের স্বার্থেই প্রয়োজন। শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যতীত গার্মেন্ট শিল্পের অগ্রগতি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প-কারখানায় কয়েকদিন পরপর অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের ঘটনায় বিদেশী বায়ার/ক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কর্মস্থলে শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি গার্মেন্ট মালিকরা না ভেবে শুধু মুনাফা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যার কারণে ক্রেতারা বাংলাদেশের শ্রমপরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট।
অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ গার্মেন্ট ব্যবসা এবং এর উৎপাদিত পণ্য একটি গ্লোবাল চেইন বিজনেসের অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকদের আগুনে পুড়ে মরা অথবা তাদের রক্ত দিয়ে বানানো পোশাক সাধারণ ক্রেতারা ব্যবহার করে না। তাই তাদের এই প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক।
সরকার এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার বা শাস্তি দেখাতে পারেনি, যা দ্বারা শ্রমিক বা ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হতে পারে। বিজিএমইএ কয়েকটি মিটিং এবং ৩-৪ বার মিলাদ পড়ানো ছাড়া নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে উদাহরণ দেয়ার মতো তেমন কিছুই করেনি। বিজ্ঞজনরা মনে করেন, গার্মেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে।
এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে দেশের স্বার্থে, শ্রমিকের স্বার্থে এবং জাতির স্বার্থে। তবে শোষণ বা শ্রমিকের লাশের ওপর এ শিল্পের অগ্রগতি হবে না।
অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল : সভাপতি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটি
জীবনের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সব মৌলিক অধিকারের প্রধান। বাংলাদেশের সংবিধানে আর্টিকেল ৩১, ৩২ ও ৩৪-এ প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতার অধিকার, জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, যা ইউনিভার্সেল হিউম্যান রাইটস ও মানবাধিকার সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যাদের কারণে মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ না করলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাজরীন গার্মেন্টে কলাপসিবল গেটে তালা লাগানো অবস্থায় অগ্নিকাণ্ডের সময় শ্রমিকদের নিচে নামতে না দেয়া এবং শ্রমআইন-কারখানাআইন অমান্য করার পরও অভিযুক্ত গার্মেন্ট মালিক দেলোয়ার হোসেনকে জামিনে মুক্তি দেয়া, রানা প্লাজা ধসে জড়িত দায়ী-দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেয়া এবং বিজিএমইএ-এর পাশ কাটানো ইত্যাদি কেউ মেনে নিতে পারেনি। একইসঙ্গে সহস্রাধিক প্রাণহানির ঘটনা কেন ঘটল, কোন কোন অবহেলা (negligence),
ত্রুটি ও আইন লংঘনের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে; এগুলোর জন্য দায়ী-দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে কী ঘাটতি রয়েছে-এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে আইন সংশোধন এবং বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তাজরীন ফ্যাশনের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয়েছে ৬ বা ৭ লাখ করে টাকা। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল ও মন্ত্রণালয়ের টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা আছে। বিজিএমইএ ও বায়ার আছে। কিন্তু মালিকের কোনো টাকার কথা শোনা যায়নি। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন কয়েকজন। আহতদের অনেকের চিকিৎসার খবর নেই। রানা প্লাজার ভয়ংকর ঘটনার পর বিজিএমইএ নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ক্ষতিপূরণের অর্থ অন্তত তাজরীনের চেয়ে কম হবে না, বেশিই হবে। বলেছেন, আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব তাদের। মিডিয়ার যতদিন মনোযোগ ছিল, ততদিন এসব কথা শোনা গেছে। মিডিয়া সরে যাওয়ার পর তাদের কথা আর কাজের মধ্যে ব্যাপক ফারাক পরিলক্ষিত হচ্ছে। তারা কি আশা করেছেন, সময়ে সবাই ভুলে যাবে সব? দেশের আরও অঘটনে চাপা পড়ে যাবে তাদের সব কলংক?
রানা প্লাজা ধসে পড়ার সময় প্রকৃতপক্ষে কত লোক সেখানে ছিলেন, তার কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যদিও সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ভবন ধসের পর ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত ও ১ হাজার ১৩৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। জীবিত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা শ্রমিকদের সংখ্যা যোগ করলে তা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৭৫। যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে মারা যান ১৮ জন। যদিও এ সংখ্যা স্থির নয়। সে হিসাবে মৃতের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৭। এছাড়াও উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে দু’জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৯৭৬টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ২৯১টি অশনাক্ত লাশ দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে ১ হাজার ১৬৭ জন আহতের একটি তালিকা আছে। আদালতে জমা দেয়া প্রধান কারখানা পরিদর্শকের তালিকায় নিখোঁজের সংখ্যা ৩৭৯ হলেও ঢাকা জেলা প্রশাসকের তালিকায় রয়েছে ৩৭৬ জনের নাম। ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে লাশের দাবি করে রক্তের নমুনা জমা দিয়েছেন ৫৫৩ জন। সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি শুরু থেকে থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকার বা বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ তা দূর করতে পারেনি। তাই আপনজনের খোঁজ না পাওয়া কিংবা সরকারি-বেসরকারি সাহায্য থেকে অনেক পরিবারের বঞ্চিত হওয়ার আশংকা থেকেই যাচ্ছে।
ক্ষতিপূরণ কত হওয়া উচিত সেটা নিয়ে নানা হিসাব আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষারত কয়েকজন প্রবাসী শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদ্ধতি ও দেশের বিদ্যমান মজুরি কাঠামো বিশ্লেষণ করে ক্ষতিপূরণের একটি ছক দিয়েছেন। তাতে ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় সর্বনিু প্রায় ৯ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছিলেন ১৮৫৫ সালের চরম দুর্ঘটনা আইন অনুযায়ী গড়ে কম করে ধরলেও ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় ৪৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইএলওসহ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মজুরি কাঠামো বিবেচনা করে পরিবার প্রতি ক্ষতিপূরণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবারই অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। অনুপাত অনুযায়ী সরকার শতকরা ৯ ভাগ, বিজিএমইএ শতকরা ১৮ ভাগ, মালিক ২৮ ভাগ এবং ব্র্যান্ড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান শতকরা ৪৫ ভাগ বহন করবেন।
রানা প্লাজায় ভয়ংকর জীবননাশের পর দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু সভা-সম্মেলন হচ্ছে। অনেক রকম প্রতিশ্রুতিও শোনা যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে টাকাও উঠেছে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে এখনও বিজিএমইএ বা সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি।
মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের এ ব্যবসায় মালিকপক্ষ মুনাফা অর্জন করেই চলবে আর অন্যদিকে যাদের মেহনত ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে টিকে আছে এই শিল্প, তারা কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে, মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হয়ে থাকবে, তা হতে পারে না।
শ্রমশক্তি বা শ্রমজীবীদের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করা গার্মেন্ট শিল্পের স্বার্থেই প্রয়োজন। শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যতীত গার্মেন্ট শিল্পের অগ্রগতি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প-কারখানায় কয়েকদিন পরপর অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের ঘটনায় বিদেশী বায়ার/ক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কর্মস্থলে শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি গার্মেন্ট মালিকরা না ভেবে শুধু মুনাফা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যার কারণে ক্রেতারা বাংলাদেশের শ্রমপরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট।
অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ গার্মেন্ট ব্যবসা এবং এর উৎপাদিত পণ্য একটি গ্লোবাল চেইন বিজনেসের অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকদের আগুনে পুড়ে মরা অথবা তাদের রক্ত দিয়ে বানানো পোশাক সাধারণ ক্রেতারা ব্যবহার করে না। তাই তাদের এই প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক।
সরকার এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার বা শাস্তি দেখাতে পারেনি, যা দ্বারা শ্রমিক বা ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হতে পারে। বিজিএমইএ কয়েকটি মিটিং এবং ৩-৪ বার মিলাদ পড়ানো ছাড়া নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে উদাহরণ দেয়ার মতো তেমন কিছুই করেনি। বিজ্ঞজনরা মনে করেন, গার্মেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে।
এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে দেশের স্বার্থে, শ্রমিকের স্বার্থে এবং জাতির স্বার্থে। তবে শোষণ বা শ্রমিকের লাশের ওপর এ শিল্পের অগ্রগতি হবে না।
অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল : সভাপতি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটি
No comments