দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আওয়ামী লীগে উদ্বেগ
দলীয় কোন্দল-আর দ্বন্দ্বে উদ্বিগ্ন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে দলটি। বিরোধী জোটের সম্ভাব্য আন্দোলনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল সাংগঠনিক কর্মসূচি নিয়ে তৃণমূলে দল গোছানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে নেতাদের। সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় দলের নেতাকর্মীরাই দলের বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা কারণে নিজ দলের নেতাকর্মীরাই একে অপরের সঙ্গে বিরোধে জড়াচ্ছে। ঘটছে সংঘাত-সহিংসতা। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি জেলায় দলীয় কোন্দলে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। এছাড়া দলের সম্মেলন ও কাউন্সিল প্রক্রিয়া চলার সময় সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন বিভক্ত গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনা দলের জন্য বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের নেতারা। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদা ও লুটপাটের ভাগ-বাটোয়ারা এবং দলীয় পদ কব্জা করা নিয়ে সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে বেশি। এবিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন এগুলো ঘটেই থাকে। কারণ ক্ষমতার ভাগ সবাই চায়। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোকে আমরা ভালভাবে নিচ্ছি না। এজন্য নেত্রীর নির্দেশে এ সব গ-গোল কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ থেকে হয়তো ফায়দা নিতে চাইবে এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের বক্তব্য আমরা রাজনৈতিকভাবেই নিচ্ছি। এ পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যাতে ফায়দা নিতে না পারে এ বিষয়েও আমরা সতর্ক আছি। কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ দল। সম্মেলনের মাধ্যমে তৃণমূলকে আমরা ভবিষ্যতের জন্য আরও সংগঠিত করছি। তাই আর যাতে এ ধরনের কোন ঘটনা না ঘটে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, যা ঘটছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত এবং তা কাম্য নয়। তবে ঘটনার পর ‘আওয়ামী লীগের খুনোখুনি’ বলে যে ভাবে সরল করে দেখা হয়, এটির সঙ্গে আমি একমত নই। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে আক্রমণকারী ও প্রতিরক্ষাকারী নিজেকে রক্ষা করে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের জন্য দলের নাম ব্যবহার করে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যই এমন যে সবাই রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে স্থানীয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও রাজনৈতিক রঙ ছড়ানোর চেষ্টায় থাকে। লেনিন বলেন, যা ঘটছে সে বিষয়গুলো আমরা হালকাভাবে নিচ্ছি না। এটি কোন সুস্থ রাজনীতি নয়। খোঁজ নিয়ে নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে নিহত হয়েছেন ২৪ জন। গত ৬ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের ৪৬ জনেরও বেশি খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১০, যুবলীগের ১৫, ছাত্রলীগের ৬, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের ৭, শ্রমিক লীগের ২ এবং বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের একজন মারা যান। গত ছয় বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে অন্তত ৪৩২টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে অন্তত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ জন দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থক। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দেড় হাজারেরও বেশি। অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক-পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা ঘটনায় প্রায়ই আলোচনায় আসছে সরকারি দল ও সহযোগী সংগঠনের নাম। গত ছয় বছরে ছাত্রলীগের সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে অধর্শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়েছে দফায় দফায়। একাধিকবার বন্ধের ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চারবার এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় তিনবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সংগঠনের কর্মী ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সুমন দাস মারা যান। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার এ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও ক্লাস পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। দলের উপদেষ্টা পরিষদের প্রবীণ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, এই মুহূর্তে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ছাত্রলীগ এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে গেছে। তাদের কাজের খেসারত আওয়ামী লীগকে দিতে হচ্ছে। দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
No comments