‘রাজনৈতিক থমথমে পরিস্থিতি বড় ঝড়ের পূর্বাভাস’ -মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম by কাজী সুমন
লুটপাটের ভাগ-বাটোয়ারার জন্য দুই জোট
অহেতুক বিতর্কিত বিষয় সামনে আনছে। আসল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে
ঘোরানোর চেষ্টা করছে তারা। রাজনৈতিক এই থমথমে পরিস্থিতি আসন্ন বড় ঝড়ের
পূর্বাভাস বলে মন্তব্য করেছেন কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি)
সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, দেশের
ভেতরে সঙ্কট অব্যাহত আছে। সেই সঙ্কট হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক
এবং নৈতিক। সঙ্কটগুলো হ্রাস না পেয়ে ক্রমাগত গভীর হচ্ছে। দেশের এই থমথমে
ভাবটা আসন্ন একটা বড় ঝড়ের পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, মানুষের মনে
রাজনীতি নিয়ে সংশয় এখনও দূর হয়নি। নানা সঙ্কটের আবর্তে দেশ নিমজ্জিত।
দেশের অবস্থা হলো- সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথায়। দু-একটি জায়গায় মলম
লাগিয়ে ব্যথা নিরসনের চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সমাজ-দেহে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি
হয়ে সেটা দেশবাসীর জন্য অসহনীয় যন্ত্রণার। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা
পরস্পরকে খুনি হিসেবে আখ্যায়িত করার ব্যাপারে সিপিবি সভাপতি বলেন, এই দুটি
দল রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক দিয়ে একই গোত্রভুক্ত। তারা রাজনীতির আদর্শ এবং
নীতিকে নিচে ঠেলে দিয়ে যেনতেন উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। তাদের ক্ষমতায়
যাওয়ার উদ্দেশ্য হলো- দেশকে লুটপাটের ধারায় নিমজ্জিত করে তার বড় ভাগীদার
হওয়া। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব হলো লুটপাটের
ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল
কারণও একই। তিনি বলেন, দু’দলের নেতারা কিছু বিতর্কিত বিষয় সামনে এনে জনগণের
দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করছেন। সেজন্য ইতিহাসের নানা বিষয় নিয়ে
অহেতুক বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছেন। একপক্ষ আরেকপক্ষকে বিতর্কে উস্কে দিচ্ছে।
তারা দেশের মৌলিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি কি হবে সেই বিষয়ে বিতর্ক করেন
না। সেলিম বলেন, বিএনপি এখনও ইতিহাসের মিথ্যাচার করে চলেছে । স্বাধীনতা ও
এর পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা দেশের জনগণকে ভুল ব্যাখ্যা
দিচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ইতিহাসকে পরিশুদ্ধ করার নামে যা করছে
তাও সঠিক করেনি। সেখানে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রকাশ
হচ্ছে। ইতিহাসে কোন সত্যকে অতিরঞ্জিত করে লাভ হবে না। জাতীয় সম্প্রচার
নীতিমালা সম্পর্কে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সংবিধানে রয়েছে, একটা সরকার
প্রতিষ্ঠিত হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু সরকার সেটি
না করে কোন পয়েন্ট দিয়ে খর্ব করা যায় সে চেষ্টা করছে। এর কারণ হলো- ক্ষমতায়
টিকে থাকার জন্য সরকারের সমালোচনা যাতে কম হয় সে চেষ্টা করছে তারা। এছাড়া
সম্প্রচার নীতিমালা কার্যকর করার জন্য যে কমিশন গঠন করা প্রয়োজন সেটা না
করে যখন আগে নীতিমালা করা হয় তখনই মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। গণতন্ত্রকে
অগ্রসর না করে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে সরকার। এই গোটা ব্যাপারটা নিয়েই
মানুষের মনে ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে। বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের কাছে
ফিরিয়ে নেয়ার সরকারের চেষ্টা সম্পর্কে সেলিম বলেন, সরকার বলছে, ’৭২ সালের
সংবিধানে ছিল, তাই এটাকে আমরা ফিরিয়ে আনতে চাই। কিন্তু সরকারের কাছে আমি
প্রশ্ন করতে চাই- ’৭২ সালের সংবিধানে তো আরও অনেক বিষয় ছিল- সেগুলো আপনারা
ফিরিয়ে আনছেন না কেন। ৩৮নং অনুচ্ছেদে ছিল- ‘ধর্মের নাম ব্যবহার কোন
রাজনৈতিক দল করা যাবে না।’ সেটা কেন হুবহু ফেরত আনছে না। তিনি বলেন, বিচার
বিভাগের ক্ষেত্রে অভিশংসনের কথা বলছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচারক নিয়োগের
দায়িত্বটা সর্বত্রভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকবে- এই ব্যাপারে ’৭২ সালের
যে বিধান সেটা নিয়ে সরকার কথা বলছে না। তাই গোটা ব্যাপারে সরকারের উদ্দেশ্য
নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। আরও গুরুতর মৌলিক একটা তর্ক হাজির করেছে
সরকার। সেটা হলো- বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ। রাষ্ট্রের এই
তিনটা স্তম্ভ কার চেয়ে কে কর্তৃত্ববান, কার কাছে কে জবাবদিহি করবে- এ
ব্যাপারে একটা বিতর্ক সুপ্ত হয়ে আছে। সংবিধানে বলা আছে, জনগণ সব ক্ষমতার
অধিকারী। কিন্তু জনগণের সার্বভৌমত্ব কি কারও কাছে হস্তান্তর করা যায়।
সুতরাং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তার কাছে এর ক্ষমতা দেয়া উচিত
বলে আমি মনে করি। সরকারের কালা-কানুনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি
দেয়ার কথা জানিয়ে সিপিবি সভাপতি বলেন, এই ইস্যুগুলো বিরুদ্ধে রাজপথে
আন্দোলন করবে সিপিবি। এর পাশাপাশি গণতান্ত্রিক অধিকার সাধারণ মানুষের মৌলিক
অধিকার নিয়ে আরও জোরালো কর্মসূচি পালন করা হবে। বিরোধী জোটের সঙ্গে সিপিবি
একত্রে যুগপৎ আন্দোলন করবে কিনা এ ব্যাপারে সেলিম বলেন, বিএনপি সরকারের
বিরোধিতা করে দক্ষিণপন্থি অবস্থান থেকে। আর আমরা বিরোধিতা করি বামপন্থি
অবস্থান থেকে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিএনপির
মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই দু’দলের নীতি একই। তিনি বলেন, বিএনপি হলো দুই
নম্বর বিরোধী দল। তারা গদির বিরোধিতা করে। নীতির বিরোধিতা করে না। আর
প্রকৃত বিরোধী দল হলো সিপিবি। আমরা গদিরও বিরোধিতা করি নীতিরও বিরোধিতা
করি। আমরা আমাদের বামপন্থি অবস্থান থেকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার
করবো। রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে শিগগিরই সংলাপের কোন সম্ভাবনা দেখছেন কিনা-
এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’পক্ষই দেখবে কোনটা
করলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়াটা নিশ্চিত হয়। সেখানে কোন নীতিগত অবস্থান তারা
অনুসরণ করবে বলে আমার মনে হয় না। তবে সরকার ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে
বলেছিল- নিয়ম রক্ষার জন্য এই নির্বাচন করা হচ্ছে। ১০ম নয়, একাদশ সংসদ নিয়ে
আলোচনা করবো। তখন একটা স্বাভাবিক নির্বাচন হবে। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হওয়ার পর সেই কথা থেকে দূরে সরে গেছে। তাই শিগগিরই উভয় জোটের মধ্যে সংলাপের
কোন সম্ভাবনা নেই বলে মনে হচ্ছে।
No comments