কেন্দ্রের কারণে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিতে পারছি না -সাক্ষাৎকারে মানিক সরকার by সোহরাব হাসান
মানিক সরকার
ভারতে পরিচ্ছন্নতম ও দরিদ্রতম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত মানিক সরকার
ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন ১৯৯৮ সাল থেকে। ২০১৩ সালের
বিধানসভা নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী তাঁর স্থাবর সম্পত্তি নেই।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ব্যাংকে নগদ আছে ১০ হাজার ৮০০ টাকা। পার্টির
সিদ্ধান্ত মতে, তিনি তাঁর বেতন-ভাতা দলীয় তহবিলে দান করেন, বিনিময়ে পার্টি
তার পরিবার পোষণের জন্য মাসে পাঁচ হাজার রুপি দেয়। গত সপ্তাহে তাঁর সরকারি
দপ্তরে প্রথম আলো প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন ভারতের একমাত্র বামপন্থী
মুখ্যমন্ত্রী
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো
: প্রথমে বিজেপি সরকারের আমলে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর
১০ বছর ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। আবার বিজেপি শাসন শুরু হলো।
মৌলিক কোনো পার্থক্য লক্ষ করেছেন কি?
মানিক সরকার : নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তার বয়স তিন মাসের কিছু বেশি। কাজেই এখনই সব বিষয়ে চূড়ান্ত উপসংহারে আসা সমীচীন হবে না। কিন্তু শুরুতেই লক্ষ করছি, এরা মূলত একচেটিয়া পুঁজি, দেশি-বিদেশি করপোরেট হাউস, ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। গরিব, বিশেষ করে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। কংগ্রেসের শাসনের সঙ্গে বিজেপি শাসনের মৌলিক ফারাক নেই। তবে বিজেপি শাসনের সবচেয়ে বিপদের দিকটি হলো, গত লোকসভা নির্বাচন এবং কেন্দ্রে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর সারা দেশে ৩০–৩৫টি দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্নাটক প্রভৃতি রাজ্যে এসব ঘটনা ঘটেছে। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, যাদের মধ্যে মুসলমান, শিখরাও রয়েছেন। আরও বিপজ্জনক দিক হলো, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ বা আরএসএসের প্রধান ভারত না বলে হিন্দুস্তান বলেন। তাদের দাবি, হিন্দুস্তানে বসবাসকারী সবাই হবে হিন্দু। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার অবশিষ্ট কী থাকল? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে বড় ধর্ম, ছোট ধর্ম বলে কিছু নেই। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেখানে রাষ্ট্রের কিছু বলার নেই। মূলত আরএসএসই বিজেপি সরকারকে পরিচালিত করছে।
প্রথম আলো : বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর ত্রিপুরায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শান্তি বিরাজ করলেও মোদি সরকারের এই ধর্মীয় ভাবনার প্রভাব উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে পড়ছে কি না?
মানিক সরকার : আসামকে বাদ দিলে অন্যান্য রাজ্যে তেমন পড়েনি। আসামে অভ্যন্তরীণ জটিলতা আছে। গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আরএসএসের প্রচারণা কাজ করেছে। ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ ঘটেছে। তার ফলও বিজেপি ঘরে তুলে নিয়েছে। আসামে ১৪টি আসনের সাতটিই তারা পেয়েছে। কংগ্রেসের আসন তিন।
প্রথম আলো : ত্রিপুরায় কি বিজেপির উত্থানের সম্ভাবনা আছে?
মানিক সরকার : ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে ত্রিপুরার মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে ত্রিপুরায় যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটি ধরে রাখতে আমরা সচেষ্ট থাকব।
প্রথম আলো : পশ্চিমবঙ্গেও তো বামফ্রন্ট শাসনামলে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় ছিল, সেখানে বিজেপির উত্থান ঘটেছে।
মানিক সরকার : বিজেপি তথা আরএসএস ও বজরং দলের যেসব শাখা ত্রিপুরায় আছে, তাদের কার্যক্রম ও ভাবাদর্শ সম্পর্কে এখনকার মানুষ সজাগ। এটি যদি অব্যাহত রাখা যায় তাদের ধর্মান্ধ ভাবাদর্শ প্রতিহত করা কঠিন হবে না।
প্রথম আলো : উত্তর-পূর্ব ভারত দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। মোদি সরকার একজন প্রতিমন্ত্রীকে এ অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়েছেন। এটি কি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আভাস?
মানিক সরকার : আগের সরকারেও একজন প্রতিমন্ত্রীকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেদিক থেকে এটি পরিবর্তন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া একজন মন্ত্রী আলাদা করে তো কিছু করতে পারেন না। সবটাই নির্ভর করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
প্রথম আলো : ২০১১ সালে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আপনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়িত হবে। ২০১৪ সালে এসে দেখি সেটি হয়নি। কারণ কী?
মানিক সরকার : কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিল। তিস্তার বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের কারণে আটকে আছে। বর্তমান সরকারও বলছে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অন্যদিকে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইউপিএ সরকার রাজ্যসভায় বিল পেশ করেছিল। তখন বিজেপি এর বিরোধিতা করে। আবার বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে গিয়ে দুটো সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিরোধী দলে থাকলে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁরা যে অবস্থান নেন, ক্ষমতায় গেলে তা পরিবর্তন করেন। এখন বিজেপি যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে, সেটি সদার্থকই হবে। ত্রিপুরা সরকার চায় দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হোক।
প্রথম আলো : সংসদে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বলে ইউপিএ যে অজুহাত দেখিয়েছে, এখন তো সে সুযোগ নেই। সংসদে বিজেপির যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে।
মানিক সরকার : তবে সমস্যা একটি আছে। লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন থাকলেও রাজ্যসভায় তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ। সে ক্ষেত্রে তারা উচ্চ ও নিম্নকক্ষের যৌথ অধিবেশন করে সীমান্ত বিল পাস করিয়ে নিতে পারে।
প্রথম আলো : পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষতি স্বীকার করেই এ কেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে সরবরাহ করতে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো বিদ্যুৎ পায়নি।
মানিক সরকার : কেন্দ্রীয় সরকারের নেতিবাচক ভূমিকার কারণেই সেটি হয়নি। আমরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, এই কেন্দ্র থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ পাই, তার সবটা কাজে লাগছে না। বলেছি, আমাদের অংশ থেকে বাংলাদেশকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে চাই। কিন্তু আমরা চাইলেই তো দিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। বাংলাদেশ সহায়তা না করলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হতো না। তা ছাড়া বিদ্যুৎ তো তারা মাগনা চাইছে না। পয়সা দিয়ে কিনে নেবে। তাহলে আমাদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ কেন তাদের দেব না? সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকেও আমি বিষয়টি তুলেছি, বলেছি, আমরা বিদ্যুৎ দিতে চাই কিন্তু পররাষ্ট্র ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কেন বিরোধিতা করছে? কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প দূরত্বে বিদ্যুৎ লাইন টানা সম্ভব। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা চাই দ্রুত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেওয়া হোক।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যবৈষম্যের বিষয়টি বহুলালোচিত। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ত্রিপুরায় ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল পাঠানো হয়েছে, এ জন্য শুল্ক নেওয়া হয়নি।
মানিক সরকার : এই সহায়তার জন্য আমি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আর বাণিজ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধাটি দীর্ঘদিনের। আমরা ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি, পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে হবে। তাদের সঙ্গে পণ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্র বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। শুল্ক বাধা অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন অশুল্ক বাধাগুলো তুলে নেওয়া জরুরি।
প্রথম আলো : ট্রানজিটের বিষয়টি আটকে গেল কেন?
মানিক সরকার : আমরা এখন ট্রানজিট বলছি না, ট্রান্সশিপমেন্ট (বাংলাদেশের ভেতরে বাংলাদেশের যানবাহনেই পণ্য পরিবাহিত হবে) চাইছি। এতে দুই দেশই লাভবান হবে। বাংলাদেশ তো ত্রিপুরার জানালা। আমাদের বের হওয়ার এটাই পথ। ভারতের অনেক দূর থেকে ত্রিপুরায় পণ্য আনতে হয়। সেখানে যদি বাংলাদেশ থেকে পণ্য আনলে সস্তায় পাওয়া যায়, আমরা সেটাই আনব। গুণে-মানেও ভালো।
প্রথম আলো : প্রস্তাবিত আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ কোন অবস্থায় আছে?
মানিক সরকার : আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগের জন্য জরিপ করার কথা। ভারতের অংশে জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো কাজটি শেষ হয়নি। আমরা ভারত সরকারকে বলেছি, দ্রুত টাকা ছাড় করলে আমরা জমি অধিগ্রহণের কাজটি শুরু করতে পারি। আগরতলা-কলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস নেই। এখন ঢাকায় গিয়ে একবার এবং পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও আরেকবার বাস পরিবর্তন করতে হয়। আকাশপথেও আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করা দরকার। টেলিযোগাযোগও উন্নত করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনারা বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে কি সেটি সম্ভব?
মানিক সরকার : কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কারণ সন্ত্রাসবাদীদের দৌরাত্ম্য। অন্য কোনো কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়নি। একসময় বাংলাদেশে ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি ছিল। তারা এখানে অঘটন ঘটিয়ে ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিত। সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করতেই আমরা ত্রিপুরা সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ সরকার কি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি?
মানিক সরকার : নিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সন্ত্রাসবাদীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে না। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। এ জন্য আমি বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাই। সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা পুরো বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো কাঁটাতারের বেড়ার প্রয়োজন হবে না।
প্রথম আলো : সন্ত্রাসবাদীদের দমনে শেখ হাসিনার সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা কি আপনি যথেষ্ট মনে করেন না?
মানিক সরকার : কিন্তু সমস্যাটি অনেক আগের। বাজপেয়ি সরকারের সময়েই কাঁটাতারের বেড়ার কাজ শুরু হয়েছে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। আবার ত্রিপুরার তিন দিকে বাংলাদেশ। ত্রিপুরাকে কি বাংলাদেশ দ্বারা অবরুদ্ধ মনে করেন?
মানিক সরকার : ভাবনার দিক থেকে নয়। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান তো অস্বীকার করা যাবে না।
প্রথম আলো : ফেনী নদীর পানি সমস্যার সমাধান হলো না কেন?
মানিক সরকার : তিস্তার কারণেই আটকে আছে।
প্রথম আলো : বলা হয়েছিল, উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়লে বাংলাদেশ লাভবান হবে। কিন্তু কয়েক বছর বাড়তির দিকে থাকলেও গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে।
মানিক সরকার : ওটি ছিল বাংলাদেশে ভোটের বছর। ৮৪ দিন ধর্মঘট হয়েছে। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা পণ্য পাঠাবেন কীভাবে? ব্যবসা, যানবাহন সবই বন্ধ ছিল। রুপির অবনয়নও কিছুটা গতি থামিয়ে দিয়েছে।
প্রথম আলো : ভারতে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী?
মানিক সরকার : কেবল ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবীতেই বামপন্থীর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। গত লোকসভা নির্বাচনের ফল দিয়ে বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা বা শক্তি নিরূপণ করা ভুল হবে। ভারতে নতুন সরকার এসেই যে একটার পর একটা জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে, তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রবল প্রতিবাদ বামপন্থীরাই করেছে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ও বৃহৎ জাতি ও ভূস্বামীদের স্বার্থের প্রতিভূরা যত দিন দেশ শাসন করবে, তত দিন বৃহত্তর জনগণের সমস্যা-সংকট থাকবেই। অতএব বামপন্থীদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। বামপন্থীরা আছেন, থাকবেন।
মানিক সরকার : নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, তার বয়স তিন মাসের কিছু বেশি। কাজেই এখনই সব বিষয়ে চূড়ান্ত উপসংহারে আসা সমীচীন হবে না। কিন্তু শুরুতেই লক্ষ করছি, এরা মূলত একচেটিয়া পুঁজি, দেশি-বিদেশি করপোরেট হাউস, ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। গরিব, বিশেষ করে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্যকর ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। কংগ্রেসের শাসনের সঙ্গে বিজেপি শাসনের মৌলিক ফারাক নেই। তবে বিজেপি শাসনের সবচেয়ে বিপদের দিকটি হলো, গত লোকসভা নির্বাচন এবং কেন্দ্রে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর সারা দেশে ৩০–৩৫টি দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্নাটক প্রভৃতি রাজ্যে এসব ঘটনা ঘটেছে। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, যাদের মধ্যে মুসলমান, শিখরাও রয়েছেন। আরও বিপজ্জনক দিক হলো, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ বা আরএসএসের প্রধান ভারত না বলে হিন্দুস্তান বলেন। তাদের দাবি, হিন্দুস্তানে বসবাসকারী সবাই হবে হিন্দু। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার অবশিষ্ট কী থাকল? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে বড় ধর্ম, ছোট ধর্ম বলে কিছু নেই। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেখানে রাষ্ট্রের কিছু বলার নেই। মূলত আরএসএসই বিজেপি সরকারকে পরিচালিত করছে।
প্রথম আলো : বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর ত্রিপুরায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শান্তি বিরাজ করলেও মোদি সরকারের এই ধর্মীয় ভাবনার প্রভাব উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে পড়ছে কি না?
মানিক সরকার : আসামকে বাদ দিলে অন্যান্য রাজ্যে তেমন পড়েনি। আসামে অভ্যন্তরীণ জটিলতা আছে। গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আরএসএসের প্রচারণা কাজ করেছে। ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ ঘটেছে। তার ফলও বিজেপি ঘরে তুলে নিয়েছে। আসামে ১৪টি আসনের সাতটিই তারা পেয়েছে। কংগ্রেসের আসন তিন।
প্রথম আলো : ত্রিপুরায় কি বিজেপির উত্থানের সম্ভাবনা আছে?
মানিক সরকার : ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে ত্রিপুরার মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে ত্রিপুরায় যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটি ধরে রাখতে আমরা সচেষ্ট থাকব।
প্রথম আলো : পশ্চিমবঙ্গেও তো বামফ্রন্ট শাসনামলে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় ছিল, সেখানে বিজেপির উত্থান ঘটেছে।
মানিক সরকার : বিজেপি তথা আরএসএস ও বজরং দলের যেসব শাখা ত্রিপুরায় আছে, তাদের কার্যক্রম ও ভাবাদর্শ সম্পর্কে এখনকার মানুষ সজাগ। এটি যদি অব্যাহত রাখা যায় তাদের ধর্মান্ধ ভাবাদর্শ প্রতিহত করা কঠিন হবে না।
প্রথম আলো : উত্তর-পূর্ব ভারত দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। মোদি সরকার একজন প্রতিমন্ত্রীকে এ অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়েছেন। এটি কি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আভাস?
মানিক সরকার : আগের সরকারেও একজন প্রতিমন্ত্রীকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেদিক থেকে এটি পরিবর্তন বলে মনে হয় না। তা ছাড়া একজন মন্ত্রী আলাদা করে তো কিছু করতে পারেন না। সবটাই নির্ভর করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
প্রথম আলো : ২০১১ সালে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আপনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকল বাস্তবায়িত হবে। ২০১৪ সালে এসে দেখি সেটি হয়নি। কারণ কী?
মানিক সরকার : কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিল। তিস্তার বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের কারণে আটকে আছে। বর্তমান সরকারও বলছে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অন্যদিকে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইউপিএ সরকার রাজ্যসভায় বিল পেশ করেছিল। তখন বিজেপি এর বিরোধিতা করে। আবার বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে গিয়ে দুটো সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ভারতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিরোধী দলে থাকলে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁরা যে অবস্থান নেন, ক্ষমতায় গেলে তা পরিবর্তন করেন। এখন বিজেপি যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে, সেটি সদার্থকই হবে। ত্রিপুরা সরকার চায় দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হোক।
প্রথম আলো : সংসদে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বলে ইউপিএ যে অজুহাত দেখিয়েছে, এখন তো সে সুযোগ নেই। সংসদে বিজেপির যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে।
মানিক সরকার : তবে সমস্যা একটি আছে। লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন থাকলেও রাজ্যসভায় তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ। সে ক্ষেত্রে তারা উচ্চ ও নিম্নকক্ষের যৌথ অধিবেশন করে সীমান্ত বিল পাস করিয়ে নিতে পারে।
প্রথম আলো : পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষতি স্বীকার করেই এ কেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে সরবরাহ করতে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো বিদ্যুৎ পায়নি।
মানিক সরকার : কেন্দ্রীয় সরকারের নেতিবাচক ভূমিকার কারণেই সেটি হয়নি। আমরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, এই কেন্দ্র থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ পাই, তার সবটা কাজে লাগছে না। বলেছি, আমাদের অংশ থেকে বাংলাদেশকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে চাই। কিন্তু আমরা চাইলেই তো দিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। বাংলাদেশ সহায়তা না করলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হতো না। তা ছাড়া বিদ্যুৎ তো তারা মাগনা চাইছে না। পয়সা দিয়ে কিনে নেবে। তাহলে আমাদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ কেন তাদের দেব না? সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকেও আমি বিষয়টি তুলেছি, বলেছি, আমরা বিদ্যুৎ দিতে চাই কিন্তু পররাষ্ট্র ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কেন বিরোধিতা করছে? কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলে স্বল্প সময়ে ও স্বল্প দূরত্বে বিদ্যুৎ লাইন টানা সম্ভব। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা চাই দ্রুত বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেওয়া হোক।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যবৈষম্যের বিষয়টি বহুলালোচিত। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ত্রিপুরায় ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল পাঠানো হয়েছে, এ জন্য শুল্ক নেওয়া হয়নি।
মানিক সরকার : এই সহায়তার জন্য আমি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আর বাণিজ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধাটি দীর্ঘদিনের। আমরা ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি, পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে হবে। তাদের সঙ্গে পণ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্র বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। শুল্ক বাধা অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন অশুল্ক বাধাগুলো তুলে নেওয়া জরুরি।
প্রথম আলো : ট্রানজিটের বিষয়টি আটকে গেল কেন?
মানিক সরকার : আমরা এখন ট্রানজিট বলছি না, ট্রান্সশিপমেন্ট (বাংলাদেশের ভেতরে বাংলাদেশের যানবাহনেই পণ্য পরিবাহিত হবে) চাইছি। এতে দুই দেশই লাভবান হবে। বাংলাদেশ তো ত্রিপুরার জানালা। আমাদের বের হওয়ার এটাই পথ। ভারতের অনেক দূর থেকে ত্রিপুরায় পণ্য আনতে হয়। সেখানে যদি বাংলাদেশ থেকে পণ্য আনলে সস্তায় পাওয়া যায়, আমরা সেটাই আনব। গুণে-মানেও ভালো।
প্রথম আলো : প্রস্তাবিত আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ কোন অবস্থায় আছে?
মানিক সরকার : আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগের জন্য জরিপ করার কথা। ভারতের অংশে জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো কাজটি শেষ হয়নি। আমরা ভারত সরকারকে বলেছি, দ্রুত টাকা ছাড় করলে আমরা জমি অধিগ্রহণের কাজটি শুরু করতে পারি। আগরতলা-কলকাতা সরাসরি বাস সার্ভিস নেই। এখন ঢাকায় গিয়ে একবার এবং পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও আরেকবার বাস পরিবর্তন করতে হয়। আকাশপথেও আমাদের যোগাযোগ স্থাপন করা দরকার। টেলিযোগাযোগও উন্নত করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনারা বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে কি সেটি সম্ভব?
মানিক সরকার : কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কারণ সন্ত্রাসবাদীদের দৌরাত্ম্য। অন্য কোনো কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়নি। একসময় বাংলাদেশে ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি ছিল। তারা এখানে অঘটন ঘটিয়ে ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিত। সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করতেই আমরা ত্রিপুরা সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ সরকার কি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি?
মানিক সরকার : নিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সন্ত্রাসবাদীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে না। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। এ জন্য আমি বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাই। সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা পুরো বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো কাঁটাতারের বেড়ার প্রয়োজন হবে না।
প্রথম আলো : সন্ত্রাসবাদীদের দমনে শেখ হাসিনার সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা কি আপনি যথেষ্ট মনে করেন না?
মানিক সরকার : কিন্তু সমস্যাটি অনেক আগের। বাজপেয়ি সরকারের সময়েই কাঁটাতারের বেড়ার কাজ শুরু হয়েছে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। আবার ত্রিপুরার তিন দিকে বাংলাদেশ। ত্রিপুরাকে কি বাংলাদেশ দ্বারা অবরুদ্ধ মনে করেন?
মানিক সরকার : ভাবনার দিক থেকে নয়। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান তো অস্বীকার করা যাবে না।
প্রথম আলো : ফেনী নদীর পানি সমস্যার সমাধান হলো না কেন?
মানিক সরকার : তিস্তার কারণেই আটকে আছে।
প্রথম আলো : বলা হয়েছিল, উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়লে বাংলাদেশ লাভবান হবে। কিন্তু কয়েক বছর বাড়তির দিকে থাকলেও গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে।
মানিক সরকার : ওটি ছিল বাংলাদেশে ভোটের বছর। ৮৪ দিন ধর্মঘট হয়েছে। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা পণ্য পাঠাবেন কীভাবে? ব্যবসা, যানবাহন সবই বন্ধ ছিল। রুপির অবনয়নও কিছুটা গতি থামিয়ে দিয়েছে।
প্রথম আলো : ভারতে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী?
মানিক সরকার : কেবল ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবীতেই বামপন্থীর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। গত লোকসভা নির্বাচনের ফল দিয়ে বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা বা শক্তি নিরূপণ করা ভুল হবে। ভারতে নতুন সরকার এসেই যে একটার পর একটা জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে, তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রবল প্রতিবাদ বামপন্থীরাই করেছে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ও বৃহৎ জাতি ও ভূস্বামীদের স্বার্থের প্রতিভূরা যত দিন দেশ শাসন করবে, তত দিন বৃহত্তর জনগণের সমস্যা-সংকট থাকবেই। অতএব বামপন্থীদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। বামপন্থীরা আছেন, থাকবেন।
No comments