নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করার চাপের নেপথ্যে
সরকারবিরোধী আন্দোলনে পাকিস্তানে উত্তেজনা এখনও বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ১১ কোর কমান্ডারের মধ্যে ৫ শীর্ষ কর্মকর্তা বেঁকে বসেন। তারা বিশ্বাস করেন, এখনই তাদের হস্তক্ষেপ করা ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করার উপযুক্ত সময়। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমন এক মন্ত্রী বলেছেন, আগস্টের শেষের দিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজধানী ইসলামাবাদ কাঁপছিল। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসভবনে প্রবেশের জন্য তৎপরতা শুরু করেছে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। সে সময়ে গ্যারিসন শহর বলে পরিচিত রাওয়ালপিন্ডিতে বৈঠকে বসেন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা। সেখানে এই উত্তেজনাকর অবস্থা নিয়ে চার ঘণ্টা গোপন বৈঠক চলে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও একবার ঝুঁকির মুখে পড়ে। কারণ, সেনাবাহিনী আর একবার ক্ষমতা দখলের বিষয়টি বিবেচনা করতে থাকে। পাকিস্তানে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ার চেয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের ঘটনা বেশি। যখন ওই গোপন বৈঠক থেকে সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে মত দেয়া হলো তখন সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ সিদ্ধান্ত নেন বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এটা যথার্থ সময় নয়। এক্ষেত্রে তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে ঘোষণা করলেন, শক্তি প্রয়োগ নয়, সঙ্কটের সমাধান করতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে। এর কিছু পরেই সেনাবাহিনী একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, তারা গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মাধ্যমে ধরে নেয়া হয় যে, সামরিক অভ্যুত্থানের হুমকি আপাতত কেটে গেছে। সেনাবাহিনীর ভিতরকার এসব তথ্য যে মন্ত্রী দিয়েছেন তিনি বলেন, সঙ্কট সমাধানের জন্য অধিক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সেনাবাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন কমপক্ষে ৫ জন জেনারেল। তারা বোঝাতে চাইছিলেন, সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ থাকা অথবা চুপ করে থাকার সময় শেষ হয়ে গেছে। মন্ত্রীর দেয়া এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সেনাবাহিনীর দু’সূত্র। সিনিয়র এক নিরাপত্তা বিষয়ক সূত্র বলেছেন, রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপে আগ্রহী নন জেনারেল রাহিল শরিফ। ফলে ট্যাংক নামছে না। সেনাবাহিনী সমঝোতায় বিশ্বাস করে। গোপন ওই বৈঠকের কথা নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনীর মিডিয়া শাখা। তবে তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, সেনাবাহিনী একটি একক প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাতে একটিই মত- তাহলো তারা গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। যদিও নওয়াজ শরিফ সেনাবাহিনীর সমর্থনে ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরির পৃথক দু’টি আন্দোলন থেকে রক্ষা পান তাহলেও তার ভাবমূর্তি হ্রাস পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে পছন্দের বিষয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি। নওয়াজ শরিফের ভাবমূর্তি হ্রাস পাওয়ার ফলে এসব নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্র সেনাবাহিনীর অধিকতর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। হোঁচট খাওয়া অর্থনীতিও ব্যাপক হারে বিদ্যুতের ঘাটতির মতো অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো ব্যাপক জনরোষের মুখে ফেলে দেবে বেসামরিক শাসনকে। আগস্টে সরকারের ভিতরের একটি সূত্র বলেছেন, নওয়াজ শরিফকে সেনাবাহিনী নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, তাকে পদত্যাগ করতে বলা হবে না। হবে না কোন সামরিক অভ্যুত্থান। কিন্তু এর বিনিময়ে সেনাবাহিনীর জন্য তাকে ছাড় দিতে হবে। নওয়াজ শরিফ তালেবানদের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছেন, প্রতিপক্ষ ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্ক সূচনা করেছেন এবং এ বছরের শেষের দিকে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার করার পর পাকিস্তানের ভূমিকা কি হবে- এসব নিয়ন্ত্রণ করছিলেন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু সেনাবাহিনীর সঙ্গে ওই বোঝাপড়ার কারণে এসব ইস্যুতে এখন তাকে কাজ করতে হবে জেনারেলদের সহায়তায়। এ মাসে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজকে সমর্থন করে। এই সমর্থন থাকায় সেনাপ্রধান সতর্ক একটি অবস্থানে রয়েছেন। গত বছর ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। ফলে সেনাবাহিনীতে এখন যে সব কমান্ডার আছেন তাদেরকে নওয়াজ শরিফ সঙ্গে পেয়েছেন তার পূর্বসূরির কাছ থেকে। এসব কমান্ডারই নওয়াজের অবস্থানকে বেশি অনিরাপদ করে তুলেছেন। ওই শীর্ষ ৫ কমান্ডার আগামী মাসে অবসরে যাচ্ছেন। এরপর নওয়াজ শরিফ ওই পদগুলোতে তার পছন্দের লোক বসাতে পারেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছেন, গণ্ডগোলটা সেখানেই। সেনাবাহিনী মনে করতে পারে নওয়াজ শরিফ যাদেরকে নিয়োগ দেবেন তারা বর্তমানদের শতভাগ সমর্থন দেবে না। এতে সেনাবাহিনী শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারবে না যে পুরো টিম সেনাপ্রধানকে সমর্থন করছেন। বর্তমানে যে সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে অথবা আরও ভয়াবহ কিছু ঘটাতে পারেন সেই সেনাপ্রধানকে কল্পনা করা কঠিন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই সূত্র বলেন, আগামী মাসেই জেনারেল রাহিল শরিফ তার কোর কমান্ডারদের মধ্যে নতুন কমপক্ষে চারজনকে পাচ্ছেন। এমনকি তার মধ্যে থাকবে তার নিজস্ব গোয়েন্দা প্রধান। এবার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যারা এবার সেনাপ্রধানকে চাপ দিচ্ছেন তাদের একজন গোয়েন্দা প্রধান জহিরুল ইসলাম। পাকিস্তান ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির নাম উল্লেখ করে একটি সূত্র বলেছেন, সেনাবাহিনী নয়, নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ দাবিতে ইমরান খানকে সমর্থন দিচ্ছে আইএসআই। তবে এমন অভিযোগের জবাবে আইএসআই’র এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, এ ঘটনার সঙ্গে আইএসআইকে জড়িত করার কথা ভিত্তিহীন। পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে ২০১৩ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন নওয়াজ শরিফ। তিনি যে এমন বিপদে পড়বেন- এমনটা খুব কম মানুষই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।
No comments