অর্থনীতি- আমাদের আবাসন খাতের বুদবুদ by ফারুক মঈনউদ্দীন
পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা, গত দশকের
মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকার গৃহায়ণ খাতের বুদ্বুদ থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা
কীভাবে বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। জনগণের ঋণ গ্রহণকে উৎসাহী করার জন্য মার্কিন
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমাতে শুরু করলে মানুষের মধ্যে ভোগ ও
বিনিয়োগের স্পৃহা বেড়ে যায়। এর প্রতিফলন ঘটে আবাসন ঋণের ক্রমবর্ধমান
চাহিদা থেকে। ব্যাংকগুলোও সুদের হার কমিয়ে আবাসন ঋণের ব্যাপক চাহিদা
সৃষ্টি করে, ফলে জনগণ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে
ঘরবাড়ি কিনতে থাকে। কিছু ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এসব ঋণ ডিসকাউন্টে কিনে নিয়ে
মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে ডিবেঞ্চার ও শেয়ারবাজারে ছেড়ে দিতে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদি হোম লোনের পোর্টফোলিও নগদ বিক্রি হয়ে যাওয়ার ফলে
ব্যাংকগুলোর হাতে নতুন ঋণ দেওয়ার জন্য আবার তহবিলের সংস্থান হয়ে যায় এবং
তারা নিত্যনতুন কায়দায় যোগ্য-অযোগ্য সব ধরনের মানুষকেই হোম লোন বিলাতে
থাকে। এর ফল ফলতে খুব বেশি দেরি হয়নি।
২০০৬ সালেই দেখা যায়, হোম লোনগুলো প্রথম কিস্তি থেকেই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। কারণ, এসব ঋণ অনুমোদনের সময় গ্রহীতার কোনো যোগ্যতা যাচাই করা হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সুদের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হার, সে কারণে মূল ঋণের মাসিক কিস্তির অঙ্ক বাড়িয়ে দিতে হয় ব্যাংকগুলোকে, অথচ দুর্বল ঋণগ্রহীতারা এই বাড়তি আকারের কিস্তির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এভাবে পরপর ঋণখেলাপের ঘটনা ঘটতে থাকলে ব্যাংকগুলো বন্ধকীকৃত বাড়ি বিক্রি করে খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে। ফলে বাড়িঘরের দরপতন ঘটতে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর দেশে দেশে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোয় পড়তে থাকে শেয়ারের দাম। কারণ, ওয়াল স্ট্রিটের বড় কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে এনে ঘর সামলানোর চেষ্টা করে। মার্কিন অর্থনীতিতে ‘সাব-প্রাইম মর্টগেজ’ নামের এই বালাইটার কারণে সৃষ্ট বিশ্বমন্দা কাটতে বহু সময় লেগেছিল।
সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশে ঠিক এ রকম ঘটনা ঘটেনি। এ দেশে এ রকম চৌকস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার নেই এবং এ রকম কোনো আর্থিক পণ্যও নেই, যার মাধ্যমে হাউজিং লোনকে নতুন মোড়কে ছোট ছোট টুকরা করে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা যায়। কিন্তু অন্য রকমভাবে হলেও এ দেশের রিয়েল এস্টেট খাতে এ রকমই একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক পুঁজিবাজারের মতোই একধরনের মূল্য বুদ্বুদ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের রিয়েল এস্টেট খাতে। এই উপসর্গের একাধিক কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথম কারণটি ভূ-সম্পত্তির প্রতি আমাদের সহজাত লোভ, মাত্র কয়েক ফুট জায়গার জন্য খুনোখুনির ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো অগণিত আবাসন কোম্পানির উদ্ভব। কোনো ধরনের যোগ্যতাবিবর্জিত এসব ভুঁইফোড় নামসর্বস্ব কোম্পানি কেবল প্রতিষ্ঠিত ডেভেলপারদের কাছে ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়ে পরবর্তী সময়ে চড়া দামে বিক্রি করে দিয়ে বাজারে সৃষ্টি করেছে কৃত্রিম মূল্যস্ফীতি। তৃতীয়ত, দেশের সম্ভাব্য সব জায়গায় জমি কিনে বা দখল করে আবাসন প্লট তৈরির নামে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করার হিড়িক। কক্সবাজার বা কুয়াকাটার মতো জায়গায় বাহারি নামের আবাসন প্রকল্পের আত্মপ্রকাশ এই দৌরাত্ম্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোর আশপাশের প্রতি ইঞ্চি খালি জায়গাই আজ ডেভেলপারদের দখলে। এমনকি আবাসন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের ফলে বিভিন্ন নগরের পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে কখনো কখনো আদালতের হস্তক্ষেপও প্রয়োজন পড়ছে। চতুর্থত, আবাসন প্রকল্প তৈরির জন্য পর্যাপ্ত উপযুক্ত জমির অভাবের বিপরীতে অতিরিক্ত চাহিদা। এবং সবশেষে আবাসন প্রকল্প এবং জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য ব্যাংকগুলোর দরাজ হাতে ঋণ বিতরণ।
মূলত ২০০৫-০৬ সাল থেকে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার ও আবাসন খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করতে থাকে। শেয়ারবাজারে উন্মত্ত বিনিয়োগের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ২০১০ সালের শেষে শেয়ারবাজারের বদ্বুদ বিস্ফোরিত হয়। শেয়ারবাজারের এমন বিপর্যয়ের আগ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর দ্বিতীয় নির্ভরশীলতা ছিল আবাসন খাতের ওপর। এ সময় (২০০৭) বাংলাদেশ ব্যাংকও নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের আবাসন চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে ৩০০ কোটি টাকা দিয়ে একটা পুনঃ অর্থায়ন তহবিল চালু করে, যা ২০০৯ সালে ৭০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছিল। এই স্কিমের অধীনে একজন গ্রহীতার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৫ লাখ টাকা ঋণসুবিধা। তবে এই ক্ষুদ্রাঙ্কের ঋণ প্রকল্প বুদ্বুদ তৈরিতে কোনো বড় ভূমিকা রাখেনি। আবাসন ব্যবসার রমরমা অবস্থা এবং এই খাতে ঋণের প্রাচুর্য ওপরে উল্লেখিত কারণগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করে আরেক বুদ্বুদ। অবশ্য আবাসন খাতে এই বিনিয়োগস্ফীতি লক্ষ্য করে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে এক সার্কুলার জারি করে জমিজমা কেনার জন্য সব ধরনের ব্যাংকঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যে গৃহায়ণ খাতে পুনঃ অর্থায়ন স্কিমের অধীনে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়ে গেছে। কেবল জমি কেনার জন্য সরাসরি ব্যাংকঋণ বন্ধ করলেও ধারণা করা যায়, এই খাতে ব্যাংকঋণের টাকার অঘোষিত ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ঋণ বন্ধ হয়নি, তা হওয়া উচিতও নয়। আজ যে বহু বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংকের তারকাখেলাপি হয়ে স্ফীত করেছে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের ঝুড়ি, তারাও বাণিজ্যিক ও শিল্পঋণের একাংশ নিয়মবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগ করেছে স্থাবর সম্পদে।
এসব প্রবণতার কারণে আবাসন খাতের ঘোষিত ঋণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান সূত্রে পত্রিকার খবরে জানা যায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাতে দেওয়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৩ হাজার ৪০০ কোটি, অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ আটকে গেছে বিভিন্ন মেয়াদে। এর মধ্যে আট হাজার ১০০ কোটি টাকা মন্দ, দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা সন্দেহজনক ও তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা নিম্নমান হিসেবে শ্রেণীকৃত। অথচ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মন্দ-শ্রেণিভুক্ত ছিল চার হাজার কোটি টাকা, পরের বছর ছিল পাঁচ হাজার কোটি। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের মাথায় মন্দশ্রেণির ঋণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
আবাসন খাতে বিতরণ করা ঋণের এই প্রবণতা ব্যাংকিং খাতে যোগ করবে সংকটের নতুন মাত্রা। কারণ, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বন্ধকীকৃত জমি বা আবাসিক ভবন নিলামে তুললেও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হবে, কারণ জমি ও নির্মাণের উচ্চমূল্য এবং ক্রেতাসাধারণের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় এসবের ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল আমেরিকার আবাসন বুদ্বুদের ক্ষেত্রে। রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ২২ হাজার তৈরি অ্যাপার্টমেন্ট অবিক্রীত পড়ে আছে। সংগঠনটির দাবি, আশির দশকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এটাই অবিক্রীত অ্যাপার্টমেন্টের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
এ দেশে কোনো একটা লাভজনক ব্যবসার ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া গেলে মানুষ হিসাব-নিকাশ না করে সেখানে হামলে পড়তে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই ব্যবসার নাভিশ্বাস ওঠে। শুধু আবাসন ব্যবসা নয়, সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার, টেলিভিশন চ্যানেল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—এ রকম আরও বহু উদাহরণ উপস্থিত করা যাবে, যেখানে নবাগতদের ধাক্কায় মূল ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম। একই প্রবণতায় মানুষের আবাসন চাহিদার সুযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ও ভুঁইফোড় মিলিয়ে সহস্রাধিক ডেভেলপার কোম্পানি ব্যাংকঋণের সাহায্যে এই খাতে যে সংকট সৃষ্টি করেছে, তার স্বাভাবিক সহজ সমাধান হতে পারত যদি একটা ভালো বাজার, ক্রেতাদের আগ্রহ ও সক্ষমতা থাকত। সেটা অনুপস্থিত বলে দেশের প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী এই সংকট উত্তরণের জন্য সরকারের কাছেই সমাধান চাওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের গোড়ায় রিহ্যাব নেতারা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে, সাধারণ মানুষ যাতে তাঁদের তৈরি অ্যাপার্টমেন্টগুলো কেনার জন্য এক অঙ্কের সুদে আবাসন ঋণ পায়, তার জন্য তিন হাজার কোটি টাকার একটা তহবিল গঠন এবং আবাসন খাতের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের জন্য কোনো ধরনের ডাউন পেমেন্টের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করার দাবি তুলেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহায়ণ খাতকে অনুৎপাদনশীল আখ্যায়িত করে এই খাতে ঋণদান নিরুৎসাহিত করেছে বলে রিহ্যাব এই খাতকে উৎপাদনশীল খাত হিসেবে ঘোষণার দাবিও তুলেছে। দাবি আদায়ের জন্য অর্থনীতির সূত্র পাল্টে দেওয়ার এ রকম আবদার একমাত্র আমাদের দেশেই সম্ভব।
এ সমস্যার একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করা উচিত। তা না হলে এই খাত ব্যাংকিং খাতের জন্য বয়ে আনবে বড় ধরনের সংকট। আর এই সমাধানের জন্য কোন পক্ষ কতখানি ছাড় বা সুবিধা দেবে, সেটাও নির্ধারণ করতে হবে। আবাসন ব্যবসায়ীদের ছাড় দিতে হবে বেশি, কারণ তারা নিজেরাই বেশি মুনাফার লোভে যত্রতত্র বিনিয়োগ করেছে মানুষের প্রকৃত চাহিদা যাচাই না করে। তা ছাড়া সব ব্যবসায় লাভ-লোকসান যেহেতু আছে, কখনো কখনো সেই লোকসানও মেনে নিতে হয়। ব্যাংকগুলোকেও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কিছুটা ছাড় দিতে হবে সুদের হারে, তবে তা কখনোই আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে নয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
২০০৬ সালেই দেখা যায়, হোম লোনগুলো প্রথম কিস্তি থেকেই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। কারণ, এসব ঋণ অনুমোদনের সময় গ্রহীতার কোনো যোগ্যতা যাচাই করা হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সুদের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হার, সে কারণে মূল ঋণের মাসিক কিস্তির অঙ্ক বাড়িয়ে দিতে হয় ব্যাংকগুলোকে, অথচ দুর্বল ঋণগ্রহীতারা এই বাড়তি আকারের কিস্তির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এভাবে পরপর ঋণখেলাপের ঘটনা ঘটতে থাকলে ব্যাংকগুলো বন্ধকীকৃত বাড়ি বিক্রি করে খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে। ফলে বাড়িঘরের দরপতন ঘটতে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর দেশে দেশে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোয় পড়তে থাকে শেয়ারের দাম। কারণ, ওয়াল স্ট্রিটের বড় কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে এনে ঘর সামলানোর চেষ্টা করে। মার্কিন অর্থনীতিতে ‘সাব-প্রাইম মর্টগেজ’ নামের এই বালাইটার কারণে সৃষ্ট বিশ্বমন্দা কাটতে বহু সময় লেগেছিল।
সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশে ঠিক এ রকম ঘটনা ঘটেনি। এ দেশে এ রকম চৌকস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার নেই এবং এ রকম কোনো আর্থিক পণ্যও নেই, যার মাধ্যমে হাউজিং লোনকে নতুন মোড়কে ছোট ছোট টুকরা করে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা যায়। কিন্তু অন্য রকমভাবে হলেও এ দেশের রিয়েল এস্টেট খাতে এ রকমই একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক পুঁজিবাজারের মতোই একধরনের মূল্য বুদ্বুদ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের রিয়েল এস্টেট খাতে। এই উপসর্গের একাধিক কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথম কারণটি ভূ-সম্পত্তির প্রতি আমাদের সহজাত লোভ, মাত্র কয়েক ফুট জায়গার জন্য খুনোখুনির ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো অগণিত আবাসন কোম্পানির উদ্ভব। কোনো ধরনের যোগ্যতাবিবর্জিত এসব ভুঁইফোড় নামসর্বস্ব কোম্পানি কেবল প্রতিষ্ঠিত ডেভেলপারদের কাছে ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়ে পরবর্তী সময়ে চড়া দামে বিক্রি করে দিয়ে বাজারে সৃষ্টি করেছে কৃত্রিম মূল্যস্ফীতি। তৃতীয়ত, দেশের সম্ভাব্য সব জায়গায় জমি কিনে বা দখল করে আবাসন প্লট তৈরির নামে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করার হিড়িক। কক্সবাজার বা কুয়াকাটার মতো জায়গায় বাহারি নামের আবাসন প্রকল্পের আত্মপ্রকাশ এই দৌরাত্ম্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোর আশপাশের প্রতি ইঞ্চি খালি জায়গাই আজ ডেভেলপারদের দখলে। এমনকি আবাসন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের ফলে বিভিন্ন নগরের পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে কখনো কখনো আদালতের হস্তক্ষেপও প্রয়োজন পড়ছে। চতুর্থত, আবাসন প্রকল্প তৈরির জন্য পর্যাপ্ত উপযুক্ত জমির অভাবের বিপরীতে অতিরিক্ত চাহিদা। এবং সবশেষে আবাসন প্রকল্প এবং জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য ব্যাংকগুলোর দরাজ হাতে ঋণ বিতরণ।
মূলত ২০০৫-০৬ সাল থেকে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার ও আবাসন খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করতে থাকে। শেয়ারবাজারে উন্মত্ত বিনিয়োগের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে ২০১০ সালের শেষে শেয়ারবাজারের বদ্বুদ বিস্ফোরিত হয়। শেয়ারবাজারের এমন বিপর্যয়ের আগ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর দ্বিতীয় নির্ভরশীলতা ছিল আবাসন খাতের ওপর। এ সময় (২০০৭) বাংলাদেশ ব্যাংকও নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের আবাসন চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে ৩০০ কোটি টাকা দিয়ে একটা পুনঃ অর্থায়ন তহবিল চালু করে, যা ২০০৯ সালে ৭০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছিল। এই স্কিমের অধীনে একজন গ্রহীতার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৫ লাখ টাকা ঋণসুবিধা। তবে এই ক্ষুদ্রাঙ্কের ঋণ প্রকল্প বুদ্বুদ তৈরিতে কোনো বড় ভূমিকা রাখেনি। আবাসন ব্যবসার রমরমা অবস্থা এবং এই খাতে ঋণের প্রাচুর্য ওপরে উল্লেখিত কারণগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করে আরেক বুদ্বুদ। অবশ্য আবাসন খাতে এই বিনিয়োগস্ফীতি লক্ষ্য করে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে এক সার্কুলার জারি করে জমিজমা কেনার জন্য সব ধরনের ব্যাংকঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ইতিমধ্যে গৃহায়ণ খাতে পুনঃ অর্থায়ন স্কিমের অধীনে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়ে গেছে। কেবল জমি কেনার জন্য সরাসরি ব্যাংকঋণ বন্ধ করলেও ধারণা করা যায়, এই খাতে ব্যাংকঋণের টাকার অঘোষিত ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ঋণ বন্ধ হয়নি, তা হওয়া উচিতও নয়। আজ যে বহু বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংকের তারকাখেলাপি হয়ে স্ফীত করেছে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের ঝুড়ি, তারাও বাণিজ্যিক ও শিল্পঋণের একাংশ নিয়মবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগ করেছে স্থাবর সম্পদে।
এসব প্রবণতার কারণে আবাসন খাতের ঘোষিত ঋণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান সূত্রে পত্রিকার খবরে জানা যায়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাতে দেওয়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৩ হাজার ৪০০ কোটি, অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ আটকে গেছে বিভিন্ন মেয়াদে। এর মধ্যে আট হাজার ১০০ কোটি টাকা মন্দ, দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা সন্দেহজনক ও তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা নিম্নমান হিসেবে শ্রেণীকৃত। অথচ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মন্দ-শ্রেণিভুক্ত ছিল চার হাজার কোটি টাকা, পরের বছর ছিল পাঁচ হাজার কোটি। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের মাথায় মন্দশ্রেণির ঋণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
আবাসন খাতে বিতরণ করা ঋণের এই প্রবণতা ব্যাংকিং খাতে যোগ করবে সংকটের নতুন মাত্রা। কারণ, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বন্ধকীকৃত জমি বা আবাসিক ভবন নিলামে তুললেও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হবে, কারণ জমি ও নির্মাণের উচ্চমূল্য এবং ক্রেতাসাধারণের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় এসবের ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল আমেরিকার আবাসন বুদ্বুদের ক্ষেত্রে। রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ২২ হাজার তৈরি অ্যাপার্টমেন্ট অবিক্রীত পড়ে আছে। সংগঠনটির দাবি, আশির দশকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এটাই অবিক্রীত অ্যাপার্টমেন্টের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
এ দেশে কোনো একটা লাভজনক ব্যবসার ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া গেলে মানুষ হিসাব-নিকাশ না করে সেখানে হামলে পড়তে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই ব্যবসার নাভিশ্বাস ওঠে। শুধু আবাসন ব্যবসা নয়, সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার, টেলিভিশন চ্যানেল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—এ রকম আরও বহু উদাহরণ উপস্থিত করা যাবে, যেখানে নবাগতদের ধাক্কায় মূল ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম। একই প্রবণতায় মানুষের আবাসন চাহিদার সুযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ও ভুঁইফোড় মিলিয়ে সহস্রাধিক ডেভেলপার কোম্পানি ব্যাংকঋণের সাহায্যে এই খাতে যে সংকট সৃষ্টি করেছে, তার স্বাভাবিক সহজ সমাধান হতে পারত যদি একটা ভালো বাজার, ক্রেতাদের আগ্রহ ও সক্ষমতা থাকত। সেটা অনুপস্থিত বলে দেশের প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী এই সংকট উত্তরণের জন্য সরকারের কাছেই সমাধান চাওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের গোড়ায় রিহ্যাব নেতারা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে, সাধারণ মানুষ যাতে তাঁদের তৈরি অ্যাপার্টমেন্টগুলো কেনার জন্য এক অঙ্কের সুদে আবাসন ঋণ পায়, তার জন্য তিন হাজার কোটি টাকার একটা তহবিল গঠন এবং আবাসন খাতের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের জন্য কোনো ধরনের ডাউন পেমেন্টের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করার দাবি তুলেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহায়ণ খাতকে অনুৎপাদনশীল আখ্যায়িত করে এই খাতে ঋণদান নিরুৎসাহিত করেছে বলে রিহ্যাব এই খাতকে উৎপাদনশীল খাত হিসেবে ঘোষণার দাবিও তুলেছে। দাবি আদায়ের জন্য অর্থনীতির সূত্র পাল্টে দেওয়ার এ রকম আবদার একমাত্র আমাদের দেশেই সম্ভব।
এ সমস্যার একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করা উচিত। তা না হলে এই খাত ব্যাংকিং খাতের জন্য বয়ে আনবে বড় ধরনের সংকট। আর এই সমাধানের জন্য কোন পক্ষ কতখানি ছাড় বা সুবিধা দেবে, সেটাও নির্ধারণ করতে হবে। আবাসন ব্যবসায়ীদের ছাড় দিতে হবে বেশি, কারণ তারা নিজেরাই বেশি মুনাফার লোভে যত্রতত্র বিনিয়োগ করেছে মানুষের প্রকৃত চাহিদা যাচাই না করে। তা ছাড়া সব ব্যবসায় লাভ-লোকসান যেহেতু আছে, কখনো কখনো সেই লোকসানও মেনে নিতে হয়। ব্যাংকগুলোকেও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কিছুটা ছাড় দিতে হবে সুদের হারে, তবে তা কখনোই আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে নয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার৷
fmainuddin@hotmail.com
No comments