সারমেয় মেয়র by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার একটি ছোট পৌরসভা করমোর্যান্ট। তার সদ্যনির্বাচিত মেয়র ডিউকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়ে গেল ১৬ আগস্ট। ভোটাররা সব মানুষ হলেও যে নির্বাচিত হয়েছে, সে একটি কুকুর। ডিউকের বয়স সাত বছর।
পৌর এলাকায় নির্বাচিত মেয়র একজন আছেন। ডিউক অবৈতনিক বা সাম্মানিক মেয়র। গণতন্ত্র এখন এমন এক জিনিস, যা মানুষ থেকে কুকুর পর্যন্ত নেমে এসেছে।
করমোর্যান্ট-এর নাগরিক মিজ ট্রিসিয়া ম্যালোনি সংবাদমাধ্যম WDAY6-কে জানিয়েছেন: ডিউক বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আজ তার এই খ্যাতি ও সম্মান অবশ্য উপভোগ করার ক্ষমতা তার নেই। তার বিজয় আমরা উদ্যাপন করছি।
বিজয়ের পরে শহরের নাগরিকরা ডিউকের গলায় বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করেন। মালাগলায় তার ছবি সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হয়েছে।
অবশ্য ডিউক শুধু ফুলের মালাই পেয়েছে। সোনার তৈরি তার নির্বাচনী প্রতীক তাকে উপহার দেওয়া হয়নি। তাকে সংবর্ধনা দিতে শহরের বিদ্যালয়গুলোর ছেলেমেয়েদের রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়েও রাখা হয়নি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পাঁচ সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য চাঁদাও তোলা হয়েছে অতি সামান্য। জনপ্রতি এক ডলার।
কেন ডিউককে ‘বাই আ ল্যান্ডস্লাইড’ বা ভূমিধস ভোটে নির্বাচিত করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা নগরবাসী সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছেন। তারা বলেন, ডিউক আমাদের শহরকে পাহারা দেয় এবং ডিউক মেক্স দ্য কমিউনিটি সেফার—আমাদের নাগরিক সমাজকে নিরাপদে রাখে। তারা আরও বলেছেন, এমনকি সে এটা পর্যন্ত লক্ষ রাখে যে, কেউ যেন তার গাড়ির গতিসীমা লঙ্ঘন না করে—এনসিওরিং কারস ডু নট ব্রেক দ্য স্পিড লিমিট।
সারমেয় মেয়রের এই খবর পড়ে আমার মনে হয়েছে, অনেক দেশের মানুষ–মেয়ররাও তো এই দায়িত্বগুলো পালন করেন না। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও নন।
কোনো জনপ্রতিনিধি বা শহরের মেয়র নিজে লাঠিসোঁটা নিয়ে তার শহর বা এলাকা পাহারা দেবেন—তা আশা করে না কেউ। কিন্তু ডিউকের শহরের লোকেরা আর যে কথাটি বলেছেন, তার তাৎপর্য বিরাট। তাঁরা বলেন, ডিউক আমাদের জনপদকে নিরাপদে রাখে। বহু দেশের অনেক মানুষ-মেয়র ও জনপ্রতিনিধিরা তাদের ভোটারদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া তো দূরের কথা তারা তাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভীষিকা।
কোনো দেশের অনেক মেয়রের ছেলে একের পর এক মানুষ খুন করতে পারেন। তার বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। হলেই-বা কী? আদৌ যদি ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়—কুচ পরোয়া নেই। রাষ্ট্রপতি আছেন। তিনি ক্ষমা করবেন বা সাজা কমাবেন। জেলে বসেই ঘটা করে মেয়রের পুত্র তার চোখে-পড়া সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারেন। জেল কর্মকর্তাদের পোয়াবারো। শুধু মিষ্টিমুখ নয়, তারা সেদিন বিরিয়ানিমুখ করেন। শুধু তাই নয়, বিয়ের পরে অন্য জেলার জেলখানা থেকে নববিবাহের স্বার্থে নিজের জেলার কারাগারে জামাই–আদরে নিয়ে আসা হয়। কয়েদি মেয়রপুত্র হলে আগের জেলখানার প্রভুভক্ত জেলার বলবেন, কোনো নির্দেশনা না থাকায় তাকে আর এখানে আনার সম্ভাবনা নেই। নবদম্পতির মেলামেশায় আর কোনো বাধা নেই।
দুনিয়াতে এমন দেশও আছে যার রাজধানী নগরীরই কোনো মেয়র নেই। নির্বাচন দিলে সরকারি দলের প্রার্থীর ভরাডুবি হবে, সে জন্য দয়াময় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকেই শিকেয় তুলে রাখে। দুই মিনিটে মহানগরকে কেটে দুই টুকরা করা হয়। তারপর সিটি ফাদার নির্বাচন তো দূরের কথা, সিটিরই বাপ-মা নেই। একেবারে এতিম। মেয়রহীন। পৃথিবীতে এমন পৌর এলাকাও আছে যেখানে অভিযোগ রয়েছে, স্বনির্বাচিত অথবা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত ঘোষিত জনপ্রতিনিধির লোকজন পুলিশের উপস্থিতিতে এক পরিবারের নয়জনকে ঘরে তালা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারে। নগর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ একজন অপরাধীর একটি লোম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, দৈবক্রমে তার ওপরে উঠে যায় একটি বাস। তিনি চলে যান এমন জায়গায়, যেখানে মামলা- মোকদ্দমা, সাক্ষী-সাবুদ, আসামি-হাকিম কিছুই নেই।
যেসব দেশে মানুষের গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে একটি কর্তব্যপরায়ণ কুকুরকে ‘মেয়র’ নির্বাচিত করা হয় প্রতীকী কারণে। কুকুরটি কোনো অপরাধীকে তার শহরে ঢুকতে দেয় না। তাড়া করে। শহরের সড়কে কাউকে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে দেয় না। ঘেউ ঘেউ করে তার পেছনে ছোটে। শহরবাসীকে নিরাপদে রাখে এবং শান্তিতে ঘুমাতে দেয়।
কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে একটি কুকুরও পায় মেয়রের মর্যাদা। অন্যদিকে অসততা, দণ্ডনীয় অপরাধ, কর্তব্যে অবহেলা, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনার কারণে মানুষ নেমে যায় পশুর পর্যায়ে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
পৌর এলাকায় নির্বাচিত মেয়র একজন আছেন। ডিউক অবৈতনিক বা সাম্মানিক মেয়র। গণতন্ত্র এখন এমন এক জিনিস, যা মানুষ থেকে কুকুর পর্যন্ত নেমে এসেছে।
করমোর্যান্ট-এর নাগরিক মিজ ট্রিসিয়া ম্যালোনি সংবাদমাধ্যম WDAY6-কে জানিয়েছেন: ডিউক বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আজ তার এই খ্যাতি ও সম্মান অবশ্য উপভোগ করার ক্ষমতা তার নেই। তার বিজয় আমরা উদ্যাপন করছি।
বিজয়ের পরে শহরের নাগরিকরা ডিউকের গলায় বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করেন। মালাগলায় তার ছবি সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হয়েছে।
অবশ্য ডিউক শুধু ফুলের মালাই পেয়েছে। সোনার তৈরি তার নির্বাচনী প্রতীক তাকে উপহার দেওয়া হয়নি। তাকে সংবর্ধনা দিতে শহরের বিদ্যালয়গুলোর ছেলেমেয়েদের রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়েও রাখা হয়নি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পাঁচ সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য চাঁদাও তোলা হয়েছে অতি সামান্য। জনপ্রতি এক ডলার।
কেন ডিউককে ‘বাই আ ল্যান্ডস্লাইড’ বা ভূমিধস ভোটে নির্বাচিত করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা নগরবাসী সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছেন। তারা বলেন, ডিউক আমাদের শহরকে পাহারা দেয় এবং ডিউক মেক্স দ্য কমিউনিটি সেফার—আমাদের নাগরিক সমাজকে নিরাপদে রাখে। তারা আরও বলেছেন, এমনকি সে এটা পর্যন্ত লক্ষ রাখে যে, কেউ যেন তার গাড়ির গতিসীমা লঙ্ঘন না করে—এনসিওরিং কারস ডু নট ব্রেক দ্য স্পিড লিমিট।
সারমেয় মেয়রের এই খবর পড়ে আমার মনে হয়েছে, অনেক দেশের মানুষ–মেয়ররাও তো এই দায়িত্বগুলো পালন করেন না। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও নন।
কোনো জনপ্রতিনিধি বা শহরের মেয়র নিজে লাঠিসোঁটা নিয়ে তার শহর বা এলাকা পাহারা দেবেন—তা আশা করে না কেউ। কিন্তু ডিউকের শহরের লোকেরা আর যে কথাটি বলেছেন, তার তাৎপর্য বিরাট। তাঁরা বলেন, ডিউক আমাদের জনপদকে নিরাপদে রাখে। বহু দেশের অনেক মানুষ-মেয়র ও জনপ্রতিনিধিরা তাদের ভোটারদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া তো দূরের কথা তারা তাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভীষিকা।
কোনো দেশের অনেক মেয়রের ছেলে একের পর এক মানুষ খুন করতে পারেন। তার বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। হলেই-বা কী? আদৌ যদি ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়—কুচ পরোয়া নেই। রাষ্ট্রপতি আছেন। তিনি ক্ষমা করবেন বা সাজা কমাবেন। জেলে বসেই ঘটা করে মেয়রের পুত্র তার চোখে-পড়া সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারেন। জেল কর্মকর্তাদের পোয়াবারো। শুধু মিষ্টিমুখ নয়, তারা সেদিন বিরিয়ানিমুখ করেন। শুধু তাই নয়, বিয়ের পরে অন্য জেলার জেলখানা থেকে নববিবাহের স্বার্থে নিজের জেলার কারাগারে জামাই–আদরে নিয়ে আসা হয়। কয়েদি মেয়রপুত্র হলে আগের জেলখানার প্রভুভক্ত জেলার বলবেন, কোনো নির্দেশনা না থাকায় তাকে আর এখানে আনার সম্ভাবনা নেই। নবদম্পতির মেলামেশায় আর কোনো বাধা নেই।
দুনিয়াতে এমন দেশও আছে যার রাজধানী নগরীরই কোনো মেয়র নেই। নির্বাচন দিলে সরকারি দলের প্রার্থীর ভরাডুবি হবে, সে জন্য দয়াময় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকেই শিকেয় তুলে রাখে। দুই মিনিটে মহানগরকে কেটে দুই টুকরা করা হয়। তারপর সিটি ফাদার নির্বাচন তো দূরের কথা, সিটিরই বাপ-মা নেই। একেবারে এতিম। মেয়রহীন। পৃথিবীতে এমন পৌর এলাকাও আছে যেখানে অভিযোগ রয়েছে, স্বনির্বাচিত অথবা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত ঘোষিত জনপ্রতিনিধির লোকজন পুলিশের উপস্থিতিতে এক পরিবারের নয়জনকে ঘরে তালা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারে। নগর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ একজন অপরাধীর একটি লোম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, দৈবক্রমে তার ওপরে উঠে যায় একটি বাস। তিনি চলে যান এমন জায়গায়, যেখানে মামলা- মোকদ্দমা, সাক্ষী-সাবুদ, আসামি-হাকিম কিছুই নেই।
যেসব দেশে মানুষের গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে একটি কর্তব্যপরায়ণ কুকুরকে ‘মেয়র’ নির্বাচিত করা হয় প্রতীকী কারণে। কুকুরটি কোনো অপরাধীকে তার শহরে ঢুকতে দেয় না। তাড়া করে। শহরের সড়কে কাউকে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে দেয় না। ঘেউ ঘেউ করে তার পেছনে ছোটে। শহরবাসীকে নিরাপদে রাখে এবং শান্তিতে ঘুমাতে দেয়।
কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে একটি কুকুরও পায় মেয়রের মর্যাদা। অন্যদিকে অসততা, দণ্ডনীয় অপরাধ, কর্তব্যে অবহেলা, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনার কারণে মানুষ নেমে যায় পশুর পর্যায়ে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments