সুযোগকে সতর্কতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে by মোস্তাফিজুর রহমান
বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ প্রস্তাব এককথায় সোনায় সোহাগা। উভয় দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ এখানে এক বিন্দুতে মেলানোর সুযোগ পেয়েছে। বেশ কয়েকটা দিক থেকে এটা গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের নতুন অর্থনৈতিক কৌশল হলো, চীনের ওপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। এ জন্যই তারা এখন বঙ্গোপসাগর ঘিরে তাদের বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র সন্ধান করছে। বে অব বেঙ্গলে তাদের এই অর্থনৈতিক আগ্রহকে তারা বলছে ‘বিগ বি’।
বাংলাদেশও যাকে বলে ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র-অর্থনীতি, বঙ্গোপসাগর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে তেমন একটি গ্রোথ জোন সৃষ্টি করার চিন্তা করছে। অবকাঠামোকে নতুন স্তরে উন্নীত করার মাধ্যমে আরও বেশি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে এই চাহিদা। উভয় পক্ষের আগ্রহের মধ্যে সমন্বয়ের জরুরি পদক্ষেপ হিসেবেই তাই দেখা যায় জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে।
বাংলাদেশে আমাদের নিজস্ব ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারি না অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে গেলে অবকাঠামোতেই বিনিয়োগ দরকার। এর জন্য আগামী ১০ বছরে আমাদের ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ লাগবে। সেদিক থেকে জাপান যেসব প্রকল্পের কথা বলছে, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ ও আগ্রহের সঙ্গে মিল আছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থাকে আরও বিকশিত করা এবং মাতারবাড়িতে বন্দর করে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার প্রস্তাব তাই চমৎকার উদ্যোগ।
জাপান বিভিন্ন কারণে চীনের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চায়। তারা প্রতিবছর ৮৫০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মোট আমদানির ২১ ভাগ করে চীন থেকে। প্রতিবছর সেখানে তাদের সাত-আট বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হচ্ছে। সেই নির্ভরশীলতা কমানোয় জাপানের যে আগ্রহ তা মেটাতে পারে আমাদের বে অব বেঙ্গল। জাপান যেহেতু বিনিয়োগের নতুন গন্তব্য খুঁজছে, সেহেতু চীনে বিনিয়োগের একটা হিস্যা নিয়ে আসা আমাদেরও পরিকল্পনাতেও থাকা উচিত। এতে কর্মসংস্থান হবে, জ্বালানি সক্ষমতা বাড়বে এবং শিল্পায়ন ঘটবে।
জাপান রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে জিরো সিকিউরিটি দিয়ে রেখেছে। তাই এখান থেকে জাপানে পণ্য পাঠানো সহজ। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৫০টি কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে শূন্য শুল্ক সুবিধা বাংলাদেশ পায়, সেই সুবিধা ব্যবহার করেই এখান থেকে জাপানের বাজারের জন্য তৈরি পণ্য জাপানে পাঠাতে জাপানি কোম্পানিদের কোনো অসুবিধাই হবে না। এখান থেকে তারা ভারতেও পণ্য পাঠাতে পারবে।
বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। জাপানি ব্যবসায়ীরা বিজনেস ফোরামে যে কথা বলেছেন তাতে মনে হয়, বাংলাদেশের বর্ধমান অভ্যন্তরীণ বাজারকেও তারা মাথায় রেখেছে। এ কারণেই দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকেন্দ্র গড়ে তোলায় জাপান ও বাংলাদেশের স্বার্থ মিলে যায়। সুতরাং, জাপানের বিনিয়োগ প্রস্তাবের লক্ষ্যের মধ্যে থাকছে জাপানি বাজার, ভারতের বাজার এবং বাংলাদেশের বাজার।
আমরা যে বিসিআইএম (Bangladesh-China-India-Myanmar Forum for Regional Cooperation) ইকোনমিক করিডরের কথা বলছি, সেটার সুবিধাও জাপান পাবে। চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারেরও হিস্যা রয়েছে। এটা সম্ভব হবে আমাদের অবকাঠামো সুবিধা বাড়লে। তখন দক্ষিণমুখী অর্থনীতিও প্রসারিত হবে। চীন ও ভারতেরও আগ্রহ আছে বিসিআইএমে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের অনন্যতার সুবাদে আমরা ভারত, চীন ও জাপানের ত্রিভুজকে কাজে লাগাতে পারি।
জাপানের এই আগ্রহ বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন–সহযোগীদের থেকে চরিত্রগতভাবে অনেক উদার। অতীতের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশকে দেওয়া জাপানের ঋণগুলো হয় সফট লোন। এ ক্ষেত্রে তারা কঠিন শর্তাবলি আরোপ করে না। এর একটা উদাহরণ হলো তাদের দেওয়া ডেট ক্যানসেলেশন ফান্ড। তাদের কাছে অপরিশোধিত ঋণ আছে, তা অনুদান হিসাবে করে দেওয়ায় এবং জাপানকে ঋণের সুদ বাবদ দেয় অর্থ আবার ফিরে পাওয়ার এই ব্যবস্থা উদারতার একটা নজির।
২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই তহবিল থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১৬০ মিলিয়ন ডলার করে পাবে। ১৪ বছরে এর মোট পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এর শর্ত হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এই অর্থ ব্যবহার করা। ২০১৪-১৫ সালের চলমান এডিপিতে ৩১টি প্রকল্প আছে, যা ওই তহবিল দিয়ে বাস্তবায়ন করব। সুতরাং, বাংলাদেশে উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে জাপানের ভূমিকাও পরীক্ষিত। এ দিকটাও বিবেচনা করি, তাহলে জাপানের উদ্দেশ্যের মধ্যে স্বচ্ছতা আছে। সব মিলিয়ে তাই এটা একটা বড় সুযোগ।
বছরে তিন হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে জাপান। এর ৮০ শতাংশই আসে চীন থেকে। এ ক্ষেত্রে সদ্যবিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৫৭ কোটি ডলার, অর্থাৎ দেড় শতাংশের মতো। আগের অর্থবছরে তা ছিল ৪৭ কোটি ডলার। পণ্যের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হলে জাপানের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সম্ভাবনার পুরোটাই কাজে লাগানো সম্ভব।
জাপান বাংলাদেশের তৈরি পোশাকেও শূন্য শুল্ক সুবিধা আছে। এখন চীন থেকে তারা নিচ্ছে অথচ এ ক্ষেত্রেও আমাদের শক্তিমত্তা আছে। গত পাঁচ বছরে জাপানে পোশাক রপ্তানি ১০ গুণ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রেও চীনের পরিপূরক বা বিকল্প হিসেবে আমরা তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়াতে পারি। যেহেতু জাপানিরা খুবই মানসম্পন্ন পণ্য চায়, সে ক্ষেত্রে চীন থেকে সরে এসে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব করে জাপানিদের চাহিদামতো পোশাক তৈরি করে পাঠানোর সুযোগ আছে। তাহলে আমরা আরও বড় আকারে তাদের বাজারে প্রবেশ করতে পারব। এই বাজারে ঢোকার জন্যও আমাদের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) দরকার।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে আস্থার সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখাই এখন বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ। এখন তো পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হলো, পরে উভয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে দ্বিপক্ষীয় কথাবার্তা হবে। সেসব আলোচনা, যা আসলে সহযোগিতা বাস্তবায়নের প্রায়োগিক দিকগুলো মেলে ধরবে, তাতে যদি আমরা দক্ষতা দেখাতে না পারি, যদি আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকে, তাহলে জাপানের আগ্রহ কমতে পারে। জাপানের সামনে চীনের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের পাশাপাশি কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামও আছে। তাই আমরা যদি হেলাফেলা করি, তাহলে সুযোগটা হাতছাড়া হতে পারে। তারা বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত দেখতে আগ্রহী। বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা, নীতি-ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং তাদের বিনিয়োগকারীরা যাতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস পান, তাহলে আস্থার সম্পর্কটা তৈরি হবে।
অতীতে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক বড় বড় বিনিয়োগে সমস্যা হয়েছে; বিনিয়োগ ফিরে গেছে। জাপানিরা এসবের ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর। সুশাসন ও দুর্নীতির প্রশ্নে তারা অত্যন্ত কঠোর। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতির কারণে, অর্থনীতির দৃষ্টিকোণের বাইরের বিবেচনা থেকে প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনা করে কিছু করতে গেলে জাপানিরা নিরুৎসাহ হবে। এ বিষয়ে সতর্ক থেকে যৌথতাকে সমন্বিত গতিশক্তিতে পরিণত করার মধ্যেই রয়েছে সাফল্যের চাবি।
বাংলাদেশকে এখন বহু দিকেই হাত বাড়াতে হবে। জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ালাম মানে কিন্তু ভারত ও চীন থেকে দূরে আসা নয়। সবকিছুকেই মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ করে দেখতে হবে। তাহলেই যেখানে যা সম্ভব তা বাস্তব সুযোগ হিসেবে সামনে আসবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
বাংলাদেশও যাকে বলে ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র-অর্থনীতি, বঙ্গোপসাগর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে তেমন একটি গ্রোথ জোন সৃষ্টি করার চিন্তা করছে। অবকাঠামোকে নতুন স্তরে উন্নীত করার মাধ্যমে আরও বেশি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে এই চাহিদা। উভয় পক্ষের আগ্রহের মধ্যে সমন্বয়ের জরুরি পদক্ষেপ হিসেবেই তাই দেখা যায় জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে।
বাংলাদেশে আমাদের নিজস্ব ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারি না অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে গেলে অবকাঠামোতেই বিনিয়োগ দরকার। এর জন্য আগামী ১০ বছরে আমাদের ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ লাগবে। সেদিক থেকে জাপান যেসব প্রকল্পের কথা বলছে, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ ও আগ্রহের সঙ্গে মিল আছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থাকে আরও বিকশিত করা এবং মাতারবাড়িতে বন্দর করে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার প্রস্তাব তাই চমৎকার উদ্যোগ।
জাপান বিভিন্ন কারণে চীনের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চায়। তারা প্রতিবছর ৮৫০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মোট আমদানির ২১ ভাগ করে চীন থেকে। প্রতিবছর সেখানে তাদের সাত-আট বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হচ্ছে। সেই নির্ভরশীলতা কমানোয় জাপানের যে আগ্রহ তা মেটাতে পারে আমাদের বে অব বেঙ্গল। জাপান যেহেতু বিনিয়োগের নতুন গন্তব্য খুঁজছে, সেহেতু চীনে বিনিয়োগের একটা হিস্যা নিয়ে আসা আমাদেরও পরিকল্পনাতেও থাকা উচিত। এতে কর্মসংস্থান হবে, জ্বালানি সক্ষমতা বাড়বে এবং শিল্পায়ন ঘটবে।
জাপান রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে জিরো সিকিউরিটি দিয়ে রেখেছে। তাই এখান থেকে জাপানে পণ্য পাঠানো সহজ। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৫০টি কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে শূন্য শুল্ক সুবিধা বাংলাদেশ পায়, সেই সুবিধা ব্যবহার করেই এখান থেকে জাপানের বাজারের জন্য তৈরি পণ্য জাপানে পাঠাতে জাপানি কোম্পানিদের কোনো অসুবিধাই হবে না। এখান থেকে তারা ভারতেও পণ্য পাঠাতে পারবে।
বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। জাপানি ব্যবসায়ীরা বিজনেস ফোরামে যে কথা বলেছেন তাতে মনে হয়, বাংলাদেশের বর্ধমান অভ্যন্তরীণ বাজারকেও তারা মাথায় রেখেছে। এ কারণেই দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পকেন্দ্র গড়ে তোলায় জাপান ও বাংলাদেশের স্বার্থ মিলে যায়। সুতরাং, জাপানের বিনিয়োগ প্রস্তাবের লক্ষ্যের মধ্যে থাকছে জাপানি বাজার, ভারতের বাজার এবং বাংলাদেশের বাজার।
আমরা যে বিসিআইএম (Bangladesh-China-India-Myanmar Forum for Regional Cooperation) ইকোনমিক করিডরের কথা বলছি, সেটার সুবিধাও জাপান পাবে। চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারেরও হিস্যা রয়েছে। এটা সম্ভব হবে আমাদের অবকাঠামো সুবিধা বাড়লে। তখন দক্ষিণমুখী অর্থনীতিও প্রসারিত হবে। চীন ও ভারতেরও আগ্রহ আছে বিসিআইএমে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের অনন্যতার সুবাদে আমরা ভারত, চীন ও জাপানের ত্রিভুজকে কাজে লাগাতে পারি।
জাপানের এই আগ্রহ বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন–সহযোগীদের থেকে চরিত্রগতভাবে অনেক উদার। অতীতের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশকে দেওয়া জাপানের ঋণগুলো হয় সফট লোন। এ ক্ষেত্রে তারা কঠিন শর্তাবলি আরোপ করে না। এর একটা উদাহরণ হলো তাদের দেওয়া ডেট ক্যানসেলেশন ফান্ড। তাদের কাছে অপরিশোধিত ঋণ আছে, তা অনুদান হিসাবে করে দেওয়ায় এবং জাপানকে ঋণের সুদ বাবদ দেয় অর্থ আবার ফিরে পাওয়ার এই ব্যবস্থা উদারতার একটা নজির।
২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই তহবিল থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১৬০ মিলিয়ন ডলার করে পাবে। ১৪ বছরে এর মোট পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এর শর্ত হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এই অর্থ ব্যবহার করা। ২০১৪-১৫ সালের চলমান এডিপিতে ৩১টি প্রকল্প আছে, যা ওই তহবিল দিয়ে বাস্তবায়ন করব। সুতরাং, বাংলাদেশে উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে জাপানের ভূমিকাও পরীক্ষিত। এ দিকটাও বিবেচনা করি, তাহলে জাপানের উদ্দেশ্যের মধ্যে স্বচ্ছতা আছে। সব মিলিয়ে তাই এটা একটা বড় সুযোগ।
বছরে তিন হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে জাপান। এর ৮০ শতাংশই আসে চীন থেকে। এ ক্ষেত্রে সদ্যবিদায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৫৭ কোটি ডলার, অর্থাৎ দেড় শতাংশের মতো। আগের অর্থবছরে তা ছিল ৪৭ কোটি ডলার। পণ্যের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হলে জাপানের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সম্ভাবনার পুরোটাই কাজে লাগানো সম্ভব।
জাপান বাংলাদেশের তৈরি পোশাকেও শূন্য শুল্ক সুবিধা আছে। এখন চীন থেকে তারা নিচ্ছে অথচ এ ক্ষেত্রেও আমাদের শক্তিমত্তা আছে। গত পাঁচ বছরে জাপানে পোশাক রপ্তানি ১০ গুণ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রেও চীনের পরিপূরক বা বিকল্প হিসেবে আমরা তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়াতে পারি। যেহেতু জাপানিরা খুবই মানসম্পন্ন পণ্য চায়, সে ক্ষেত্রে চীন থেকে সরে এসে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব করে জাপানিদের চাহিদামতো পোশাক তৈরি করে পাঠানোর সুযোগ আছে। তাহলে আমরা আরও বড় আকারে তাদের বাজারে প্রবেশ করতে পারব। এই বাজারে ঢোকার জন্যও আমাদের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) দরকার।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে আস্থার সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখাই এখন বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ। এখন তো পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হলো, পরে উভয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে দ্বিপক্ষীয় কথাবার্তা হবে। সেসব আলোচনা, যা আসলে সহযোগিতা বাস্তবায়নের প্রায়োগিক দিকগুলো মেলে ধরবে, তাতে যদি আমরা দক্ষতা দেখাতে না পারি, যদি আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকে, তাহলে জাপানের আগ্রহ কমতে পারে। জাপানের সামনে চীনের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের পাশাপাশি কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামও আছে। তাই আমরা যদি হেলাফেলা করি, তাহলে সুযোগটা হাতছাড়া হতে পারে। তারা বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত দেখতে আগ্রহী। বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা, নীতি-ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং তাদের বিনিয়োগকারীরা যাতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস পান, তাহলে আস্থার সম্পর্কটা তৈরি হবে।
অতীতে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক বড় বড় বিনিয়োগে সমস্যা হয়েছে; বিনিয়োগ ফিরে গেছে। জাপানিরা এসবের ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর। সুশাসন ও দুর্নীতির প্রশ্নে তারা অত্যন্ত কঠোর। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতির কারণে, অর্থনীতির দৃষ্টিকোণের বাইরের বিবেচনা থেকে প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনা করে কিছু করতে গেলে জাপানিরা নিরুৎসাহ হবে। এ বিষয়ে সতর্ক থেকে যৌথতাকে সমন্বিত গতিশক্তিতে পরিণত করার মধ্যেই রয়েছে সাফল্যের চাবি।
বাংলাদেশকে এখন বহু দিকেই হাত বাড়াতে হবে। জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ালাম মানে কিন্তু ভারত ও চীন থেকে দূরে আসা নয়। সবকিছুকেই মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ করে দেখতে হবে। তাহলেই যেখানে যা সম্ভব তা বাস্তব সুযোগ হিসেবে সামনে আসবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
No comments