বাংলাদেশ থেকে ভালোবাসা নিয়ে by আবদুল মান্নান
২২ ঘণ্টার এক ঝটিকা সফর শেষে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেন গত রোববার। ১৪ বছরের মধ্যে এটি কোনো জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। শেষবার ২০০০ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিরো মরি বাংলাদেশ সফর করেন। তখনো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, ২০১৪ সালেও তিনি স্বপদে বহাল আছেন।
জাপান বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন-সহযোগী দেশ। গত ৪০ বছরে বাংলাদেশকে জাপান আনুমানিক ১২ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের পর যে কয়েকটি দেশ সাহায্য নিয়ে প্রথমে এগিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে জাপান অন্যতম। ১৯৭৩ সালের ১৭ অক্টোবর এক সপ্তাহের সফরে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাপান সফর করেন। সেই সফরে একাধিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সম্মতিপত্র স্বাক্ষর হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিল যমুনা নদীর ওপর বহুমুখী সেতু নির্মাণের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই। সেই সফরের সময় বঙ্গবন্ধু টোকিওর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। স্বাক্ষর করেছিলেন তাঁদের অতিথি বইয়ে।
গত ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে তাঁকে তাঁর বাবার সেই ‘জয় বাংলা’ লেখাসংবলিত স্বাক্ষরটি দেখালে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। সেই আনন্দঘন মুহূর্তে আমার সুযোগ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকার। ২৮ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে এক জাপানি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ২০১৬-১৭ মেয়াদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত অস্থায়ী আসনটি বাংলাদেশ জাপানের সমর্থনে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে কি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কোনো সরাসরি উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে বলেন, সেটি তিনি দেশে গিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলে সেখানে তাঁকে হয়তো একটা সারপ্রাইজ দেবেন।
বাংলাদেশ এর আগে ১৯৭৯-৮০ ও ১৯৯৯-২০০০ সালে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল এবং শেষের বার নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাপান। তখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সক্ষমতা সম্পর্কে জাপান পুরোমাত্রায় ওয়াকিবহাল এবং এবারও দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে ফলাফল ভিন্ন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। বাংলাদেশ বিশ্বাস করেছে, জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদের আলংকারিক সদস্য হওয়ার চেয়ে জাপানের মতো বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তির সঙ্গে সহযোগিতার বন্ধনটাকে আরও মজবুত করা দেশের জন্য অনেক বেশি লাভজনক।
সেদিন যেতে যেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশ কি জাপানের পক্ষে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে? তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে একটু মুচকি হেসেছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যদের খুব বেশি একটা ক্ষমতা থাকে না৷ কারণ, কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটাভুটি হলে তা পাঁচটি বৃহৎ শক্তির যেকোনো একটি ভেটো দিয়ে বাতিল করে দিতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যের সংখ্যা ১০।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেছে, বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে জাইকা পদ্মা সেতু থেকে সরে গিয়েছিল আর শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বেগম জিয়া কূটনৈতিক চালে শেখ হাসিনার সঙ্গে পারবেন কেন?
তাঁর মন্তব্যের গুরুত্ব আছে। অবশ্য বিএনপি বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহারকে সমর্থন করেনি। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, আমাদের এককালের পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, এটি একান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল। এটি একটি নজিরবিহীন মন্তব্য, কারণ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই দেশে একটি সরকার থাকে। বর্তমান সরকারকে বিএনপি স্বীকার না করতে পারে, সেটি তাদের বিষয়। তবে একজন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব যদি ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি না বোঝেন, তাহলে তা দুঃখের বিষয়।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি হলে রাতের এক টিভি টক শোয় চারদলীয় জোট সরকারের আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান মন্তব্য করেছিলেন, যে বিষয় নিয়ে মিয়ানমারও সন্তুষ্ট, সেটিতে বাংলাদেশের বিজয় কীভাবে হলো, বোঝা গেল না। উইন উইন পরিস্থিতি শুধু শমসের মবিন বোঝেন না তা নয়, অনেকেই বোঝেন না।
শিনজো আবের এই ঝটিকা সফর থেকে কী পেল বাংলাদেশ? শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক জাপান সফরের সময় শিনজো আবে ঘোষণা করেছিলেন, আগামী চার-পাঁচ বছরে জাপান বাংলাদেশকে ছয় বিলিয়ন অথবা ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা দেবে। শিনজো আবে জাপান সরকারের এই অঙ্গীকারের কথা বাংলাদেশে এসে পুনরুল্লেখ করেছেন। এরই মধ্যে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবের সঙ্গে জাপানের ২২টি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ১৫০ জন প্রতিনিধি এসেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বাংলাদেশের ৫০ জন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নিজ খরচে জাপান সফর করেছেন। উভয় সফরেরই অন্যতম উদ্দেশ্য দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা। দুদেশের মধ্যে আন্তদেশীয় বাণিজ্য সব সময় জাপানের অনুকূলে থেকেছে। গত অর্থবছর জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল মাত্র ৮৬২ মিলিয়ন ডলার আর যার বিপরীতে বাংলাদেশ জাপান থেকে আমদানি করেছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশের আগ্রহ সব সময় রপ্তানি বৃদ্ধির চেয়ে বাংলাদেশে জাপানি পঁুজি আকৃষ্ট করা, কারণ জাপানে জনসংখ্যা দ্রুত কমছে আর তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে জাপান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পণ্য উৎপাদনকারী দেশ ছিল।
বর্তমানে জাপানে এই পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আছে ঠিক, তবে তাদের বেশির ভাগ পণ্যই অন্য দেশে উৎপাদিত হয়৷ কারণ, জাপানের উৎপাদন খরচ দিয়ে সে দেশের পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করা প্রায় অসম্ভব। এখন জাপানের টয়োটা গাড়ি থেকে শুরু করে মিতসুবিসির পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি বা সংযোজন হয় চীন, ভারত, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে কারণ এসব দেশে উৎপাদন ব্যয় অনেক কম।
তবে চীন প্রতিযোগিতার একাধিক অস্ত্র হারাতে বসেছে৷ কারণ, চীনেও এখন শ্রমিকদের মজুরি ও পরিবহন ব্যয় বাড়তির দিকে৷ ফলে চীন এখন ধীরে ধীরে কম মূল্যের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য প্রস্তুত বন্ধ করে দিচ্ছে। চীন তাদের দেশের নাগরিকদের জন্য পোশাক বাংলাদেশ থেকেও আমদানি করছে।
জাপানের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি তাদের উৎপাদনব্যবস্থা বা ম্যানুফ্যাকচারিং, যা আর নিজ দেশে সম্ভব হচ্ছে না। একটি সময় আসবে, যখন চীন থেকেও তারা তাদের কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলবে এবং পুঁজি নিয়ে অন্য কোনো গন্তব্যস্থল খঁুজবে। বিশ্বায়নের যুগে পঁুজির কোনো দেশ বা জাতীয়তা নেই। এই যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে আমরা এত গর্ব করি দেখা যাবে, আগামী দুই দশক পর এই খাতের আর বৃদ্ধি হচ্ছে না কারণ এই শিল্পে যারা পঁুজি বিনিয়োগ করে, তারা তাদের কলকারখানা বন্ধ করে অন্যত্র, হতে পারে তা মিয়ানমার বা কম্বোডিয়ায় হিজরত করেছে।
এমনটি ঘটেছিল মঙ্গোলিয়ায়। ২০০৪ সালে যখন বস্ত্র খাত থেকে কোটাপদ্ধতি উঠে গেল, তখন মঙ্গোলিয়ার ২০টি তৈরি পোশাক কারখানা রাতারাতি বন্ধ করে দিয়ে পঁুজি বিনিয়োগকারীরা চীনে চলে গিয়েছেন। বেকার হয়েছিলেন ২০ হাজার শ্রমিক। ধরে নিতে হবে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রমরমা অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। আমাদের নিজেদের পঁুজি খুবই সীমিত। সুতরাং বাংলাদেশের প্রয়োজন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে পঁুজি বিনিয়োগ, যা এখন খুবই নগণ্য৷ কারণ, এই খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করলে তা তুলে আনতে সেবা খাতের চেয়ে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে যেটুকু বিদেশি পুঁজি আসছে, তার সিংহভাগই সেবা খাতে। এই খাত কর্মসংস্থান করে যৎসামান্য। যেমন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টেলিকম কোম্পানি মাত্র চার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। কিন্তু একটি গাড়ি সংযোজন কারখানা, বস্ত্রকল, পেট্রোকেমিক্যাল, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানা অথবা ইস্পাত কারখানা অনেক বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করে, যা ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে প্রয়োজন এবং যা জাপানের পক্ষে এই দেশে করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি৷ কারণ, আমাদের সক্ষমতার অভাব।
কথায় কথায় আমরা বলি, আমাদের সস্তা শ্রম আছে। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের উৎপাদনশীলতা এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন। বলি আমাদের আছে বন্দর। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নিয়মিত যে ভানুমতীর খেল হয়, তা দেখে কেন ভিনদেশের কেউ এ দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতে আসবে? গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক কলকারখানা চালুর অপেক্ষায় আছে। চট্টগ্রামে গেলে মনে হয়, এই শহরে বাংলাদেশ সরকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই শহরে সরকারের ভেতর সরকার, তার ভেতরে আরও অনেক সরকার। কে যে আসল সরকার, তা বোঝা মুশকিল।
শুধু জাপান নয়, বাংলাদেশে আরও অনেক দেশীয় পুঁজি আসবে৷ তবে তার জন্য চাই সক্ষমতা বৃদ্ধি। শুধু সস্তা শ্রম আর বন্দরের কথা বললে হবে না। প্রয়োজন সুশাসন, দুর্নীতি বন্ধ করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা, দক্ষ জনশক্তি আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ২০১৩ সালে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনটি হলে জাপান নয়, ভুটানও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে বুঝেছি, কেন অনেকে বলেন, তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করা দুরূহ। এমন কথা যদি তাঁর সরকারের অারও ১০-২০ জন সম্পর্কে বলা যেত, তাহলে বাংলাদেশ যেতে পারত অনেক দূর। শুধু জাপান নয়, সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক।
আবদুল মান্নান: গবেষক ও বিশ্লেষক, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
জাপান বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন-সহযোগী দেশ। গত ৪০ বছরে বাংলাদেশকে জাপান আনুমানিক ১২ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের পর যে কয়েকটি দেশ সাহায্য নিয়ে প্রথমে এগিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে জাপান অন্যতম। ১৯৭৩ সালের ১৭ অক্টোবর এক সপ্তাহের সফরে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাপান সফর করেন। সেই সফরে একাধিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সম্মতিপত্র স্বাক্ষর হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিল যমুনা নদীর ওপর বহুমুখী সেতু নির্মাণের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই। সেই সফরের সময় বঙ্গবন্ধু টোকিওর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। স্বাক্ষর করেছিলেন তাঁদের অতিথি বইয়ে।
গত ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে তাঁকে তাঁর বাবার সেই ‘জয় বাংলা’ লেখাসংবলিত স্বাক্ষরটি দেখালে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। সেই আনন্দঘন মুহূর্তে আমার সুযোগ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকার। ২৮ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে এক জাপানি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ২০১৬-১৭ মেয়াদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত অস্থায়ী আসনটি বাংলাদেশ জাপানের সমর্থনে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে কি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কোনো সরাসরি উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে বলেন, সেটি তিনি দেশে গিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলে সেখানে তাঁকে হয়তো একটা সারপ্রাইজ দেবেন।
বাংলাদেশ এর আগে ১৯৭৯-৮০ ও ১৯৯৯-২০০০ সালে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল এবং শেষের বার নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাপান। তখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সক্ষমতা সম্পর্কে জাপান পুরোমাত্রায় ওয়াকিবহাল এবং এবারও দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে ফলাফল ভিন্ন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। বাংলাদেশ বিশ্বাস করেছে, জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদের আলংকারিক সদস্য হওয়ার চেয়ে জাপানের মতো বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তির সঙ্গে সহযোগিতার বন্ধনটাকে আরও মজবুত করা দেশের জন্য অনেক বেশি লাভজনক।
সেদিন যেতে যেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশ কি জাপানের পক্ষে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবে? তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে একটু মুচকি হেসেছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যদের খুব বেশি একটা ক্ষমতা থাকে না৷ কারণ, কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটাভুটি হলে তা পাঁচটি বৃহৎ শক্তির যেকোনো একটি ভেটো দিয়ে বাতিল করে দিতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যের সংখ্যা ১০।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেছে, বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে জাইকা পদ্মা সেতু থেকে সরে গিয়েছিল আর শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বেগম জিয়া কূটনৈতিক চালে শেখ হাসিনার সঙ্গে পারবেন কেন?
তাঁর মন্তব্যের গুরুত্ব আছে। অবশ্য বিএনপি বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহারকে সমর্থন করেনি। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, আমাদের এককালের পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, এটি একান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল। এটি একটি নজিরবিহীন মন্তব্য, কারণ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই দেশে একটি সরকার থাকে। বর্তমান সরকারকে বিএনপি স্বীকার না করতে পারে, সেটি তাদের বিষয়। তবে একজন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব যদি ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি না বোঝেন, তাহলে তা দুঃখের বিষয়।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তি হলে রাতের এক টিভি টক শোয় চারদলীয় জোট সরকারের আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান মন্তব্য করেছিলেন, যে বিষয় নিয়ে মিয়ানমারও সন্তুষ্ট, সেটিতে বাংলাদেশের বিজয় কীভাবে হলো, বোঝা গেল না। উইন উইন পরিস্থিতি শুধু শমসের মবিন বোঝেন না তা নয়, অনেকেই বোঝেন না।
শিনজো আবের এই ঝটিকা সফর থেকে কী পেল বাংলাদেশ? শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক জাপান সফরের সময় শিনজো আবে ঘোষণা করেছিলেন, আগামী চার-পাঁচ বছরে জাপান বাংলাদেশকে ছয় বিলিয়ন অথবা ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা দেবে। শিনজো আবে জাপান সরকারের এই অঙ্গীকারের কথা বাংলাদেশে এসে পুনরুল্লেখ করেছেন। এরই মধ্যে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবের সঙ্গে জাপানের ২২টি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ১৫০ জন প্রতিনিধি এসেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বাংলাদেশের ৫০ জন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নিজ খরচে জাপান সফর করেছেন। উভয় সফরেরই অন্যতম উদ্দেশ্য দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা। দুদেশের মধ্যে আন্তদেশীয় বাণিজ্য সব সময় জাপানের অনুকূলে থেকেছে। গত অর্থবছর জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল মাত্র ৮৬২ মিলিয়ন ডলার আর যার বিপরীতে বাংলাদেশ জাপান থেকে আমদানি করেছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশের আগ্রহ সব সময় রপ্তানি বৃদ্ধির চেয়ে বাংলাদেশে জাপানি পঁুজি আকৃষ্ট করা, কারণ জাপানে জনসংখ্যা দ্রুত কমছে আর তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে জাপান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পণ্য উৎপাদনকারী দেশ ছিল।
বর্তমানে জাপানে এই পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আছে ঠিক, তবে তাদের বেশির ভাগ পণ্যই অন্য দেশে উৎপাদিত হয়৷ কারণ, জাপানের উৎপাদন খরচ দিয়ে সে দেশের পণ্য অন্য দেশে রপ্তানি করা প্রায় অসম্ভব। এখন জাপানের টয়োটা গাড়ি থেকে শুরু করে মিতসুবিসির পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি বা সংযোজন হয় চীন, ভারত, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে কারণ এসব দেশে উৎপাদন ব্যয় অনেক কম।
তবে চীন প্রতিযোগিতার একাধিক অস্ত্র হারাতে বসেছে৷ কারণ, চীনেও এখন শ্রমিকদের মজুরি ও পরিবহন ব্যয় বাড়তির দিকে৷ ফলে চীন এখন ধীরে ধীরে কম মূল্যের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য প্রস্তুত বন্ধ করে দিচ্ছে। চীন তাদের দেশের নাগরিকদের জন্য পোশাক বাংলাদেশ থেকেও আমদানি করছে।
জাপানের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি তাদের উৎপাদনব্যবস্থা বা ম্যানুফ্যাকচারিং, যা আর নিজ দেশে সম্ভব হচ্ছে না। একটি সময় আসবে, যখন চীন থেকেও তারা তাদের কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলবে এবং পুঁজি নিয়ে অন্য কোনো গন্তব্যস্থল খঁুজবে। বিশ্বায়নের যুগে পঁুজির কোনো দেশ বা জাতীয়তা নেই। এই যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে আমরা এত গর্ব করি দেখা যাবে, আগামী দুই দশক পর এই খাতের আর বৃদ্ধি হচ্ছে না কারণ এই শিল্পে যারা পঁুজি বিনিয়োগ করে, তারা তাদের কলকারখানা বন্ধ করে অন্যত্র, হতে পারে তা মিয়ানমার বা কম্বোডিয়ায় হিজরত করেছে।
এমনটি ঘটেছিল মঙ্গোলিয়ায়। ২০০৪ সালে যখন বস্ত্র খাত থেকে কোটাপদ্ধতি উঠে গেল, তখন মঙ্গোলিয়ার ২০টি তৈরি পোশাক কারখানা রাতারাতি বন্ধ করে দিয়ে পঁুজি বিনিয়োগকারীরা চীনে চলে গিয়েছেন। বেকার হয়েছিলেন ২০ হাজার শ্রমিক। ধরে নিতে হবে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রমরমা অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। আমাদের নিজেদের পঁুজি খুবই সীমিত। সুতরাং বাংলাদেশের প্রয়োজন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে পঁুজি বিনিয়োগ, যা এখন খুবই নগণ্য৷ কারণ, এই খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করলে তা তুলে আনতে সেবা খাতের চেয়ে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে যেটুকু বিদেশি পুঁজি আসছে, তার সিংহভাগই সেবা খাতে। এই খাত কর্মসংস্থান করে যৎসামান্য। যেমন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টেলিকম কোম্পানি মাত্র চার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। কিন্তু একটি গাড়ি সংযোজন কারখানা, বস্ত্রকল, পেট্রোকেমিক্যাল, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানা অথবা ইস্পাত কারখানা অনেক বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করে, যা ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে প্রয়োজন এবং যা জাপানের পক্ষে এই দেশে করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি৷ কারণ, আমাদের সক্ষমতার অভাব।
কথায় কথায় আমরা বলি, আমাদের সস্তা শ্রম আছে। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের উৎপাদনশীলতা এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন। বলি আমাদের আছে বন্দর। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নিয়মিত যে ভানুমতীর খেল হয়, তা দেখে কেন ভিনদেশের কেউ এ দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতে আসবে? গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক কলকারখানা চালুর অপেক্ষায় আছে। চট্টগ্রামে গেলে মনে হয়, এই শহরে বাংলাদেশ সরকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই শহরে সরকারের ভেতর সরকার, তার ভেতরে আরও অনেক সরকার। কে যে আসল সরকার, তা বোঝা মুশকিল।
শুধু জাপান নয়, বাংলাদেশে আরও অনেক দেশীয় পুঁজি আসবে৷ তবে তার জন্য চাই সক্ষমতা বৃদ্ধি। শুধু সস্তা শ্রম আর বন্দরের কথা বললে হবে না। প্রয়োজন সুশাসন, দুর্নীতি বন্ধ করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা, দক্ষ জনশক্তি আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ২০১৩ সালে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনটি হলে জাপান নয়, ভুটানও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে বুঝেছি, কেন অনেকে বলেন, তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করা দুরূহ। এমন কথা যদি তাঁর সরকারের অারও ১০-২০ জন সম্পর্কে বলা যেত, তাহলে বাংলাদেশ যেতে পারত অনেক দূর। শুধু জাপান নয়, সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক।
আবদুল মান্নান: গবেষক ও বিশ্লেষক, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments