এই ভূখণ্ডে জঙ্গিবাদের বিপদ কতটা বাস্তব? by মশিউল আলম
আল-কায়েদার কোনো অডিও বা ভিডিওবার্তা প্রচারিত হলে এত দিন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর সরকার ও সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু এবার একটা বড় ব্যতিক্রম লক্ষ করা গেল। আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরির একটি ভিডিওবার্তা ইন্টারনেটে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠল ভারতের সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং তাঁর মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসলেন; দেশটির গোয়েন্দাপ্রধানকে নির্দেশ দেওয়া হলো, যত দ্রুত সম্ভব আল-কায়েদার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করতে এবং ভারতের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হলো।
ভারত সরকারের এত বিচলিত হওয়ার কারণ কী? কেন এত চাঞ্চল্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে? দৃশ্যমান কারণ, আল-কায়েদা ভারত উপমহাদেশে এই প্রথম শাখা বিস্তারের ঘোষণা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আল-কায়েদার তৎপরতা এতকাল সীমাবদ্ধ ছিল আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে। এবার তার নজর পড়েছে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতি। ভিডিওবার্তায় বলা হয়েছে, এই অঞ্চলজুড়ে সীমান্তবিহীন একটা ইসলামি খেলাফত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আল-কায়েদার ভারত উপমহাদেশীয় শাখা খোলার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।
জাওয়াহিরির বক্তব্য অনুযায়ী আল-কায়েদার শ্যেন দৃষ্টির আওতায় বাংলাদেশও আছে, যে দেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলমান এবং যেখানে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা অনেক ছোট ছোট জঙ্গিগোষ্ঠী আছে, যাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদিন ও পরবর্তীকালে তালেবানের সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। আফগানিস্তানে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে জিহাদের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে এমন কিছু জঙ্গির কথা জানা যায়; তাদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে, এমন খবরও অতীতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকে জাওয়াহিরির ওই ভিডিওবার্তার সত্যতা নিয়ে প্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এ বিষয়টি আমাদের সরকারের কাছে প্রথমে ততটা গুরুত্ব পায়নি, যতটা পেয়েছে ভারত সরকারের কাছে। পরে অবশ্য র্যাবের জঙ্গিবিরোধী সেলগুলোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার মামলার আসামি এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সুবাদে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও নজরদারি শুরু হয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। অর্থাৎ জাওয়াহিরির ভিডিওবার্তা বাংলাদেশের সরকারের হাতে ধর্মভিত্তিক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও কোণঠাসা করার সুযোগ এনে দিল। ভারতেও বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক ফায়দা তোলার সুযোগ হবে, আরও জোশ বাড়বে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীদের, এবং মুসলমান মৌলবাদীদেরও কম সুবিধা হবে না—এ রকম কথাও বলাবলি হচ্ছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় রুচির জোশি লিখেছেন, জাওয়াহিরির ঘোষণার পর ভারতে হিন্দু ও মুসলমান মৌলবাদীরা একসঙ্গে ট্যাঙ্গো নাচ নাচতে শুরু করেছে, কারণ ধর্মীয় ঘৃণা ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটায় এবার উভয় পক্ষেরই বিরাট সুবিধা হবে।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, আল-কায়েদার পক্ষ থেকে জাওয়াহিরির এই ভিডিওবার্তা প্রচারের তাৎপর্য কী? ঠিক এই মুহূর্তে কেন এটা প্রচার করা হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা চলছে। ভিডিওবার্তাটি ভুয়া হতে পারে, মতলববাজ কোনো রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তৈরিও হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের দাবির সমর্থনে সাক্ষ্য–প্রমাণের খবর পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভবত এটা আয়মান আল জাওয়াহিরির কণ্ঠে উচ্চারিত আল-কায়েদারই বক্তব্য এবং এই বক্তব্য একটি প্রতিক্রিয়া। ইরাক ও সিরিয়ার বিরাট অঞ্চলজুড়ে ‘ইসলামি খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করে প্রবল দাপটের সঙ্গে ইরাকি ও সিরীয় সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের যে সুন্নি জঙ্গি সংগঠন, সারা মুসলিম বিশ্বে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমেই বেড়ে ওঠার দৃশ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে আল-কায়েদার পক্ষ থেকে জাওয়াহিরির এই ভিডিওবার্তা প্রচার করা হয়েছে।
আমেরিকানদের হাতে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার বেশ আগে থেকেই আল-কায়েদার তৎপরতা হ্রাস পেতে শুরু করে। বিশেষত, আফগানিস্তানে ও পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আমেরিকানরা ড্রোন হামলা শুরু করার পর থেকে আল-কায়েদার যোদ্ধাদের পক্ষে সক্রিয় থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁদের বড় নেতাদের অনেকেই ড্রোন হামলায় মারা যান এবং অন্য যোদ্ধাদের চলাফেরা সংকুচিত হতে থাকে। এমনকি তাঁদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও আর আগের মতো থাকে না। বিশেষত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটার ব্যবহার তাঁদের জন্য ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আমেরিকান ড্রোন হামলায় নিহত তালেবান যোদ্ধাদের অধিকাংশই মারা গেছেন মোবাইল ফোন ব্যবহার করার কারণে। যন্ত্র ব্যবহারের এই বিপদ তাঁদের বাধ্য করে চিঠি-চিরকুট লেখা ও মানুষের হাতে হাতে সেগুলো আদান-প্রদানের যুগে ফিরে যেতে। ওসামা বিন লাদেনও মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপেন বাধ্য হন। আল-কায়েদার অল্প কয়েকজন নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যেটুকু ছিল, তার মাধ্যম ছিলেন তাঁর অতি বিশ্বস্ত দুই সহোদর বার্তাবাহক, যাঁরা তাঁর সঙ্গে সপরিবারে বাস করতেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের একটি বাড়িতে, যেখানে আমেরিকান বিশেষ বাহিনী অভিযান চালিয়ে লাদেন ও তাঁর ওই দুই বার্তাবাহককে হত্যা করে।
চলাফেরায় বাধা, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগহীনতা ইত্যাদির পাশাপাশি ড্রোন হামলার সার্বক্ষণিক হুমকি—এসবের মারাত্মক প্রভাব পড়ে আল-কায়েদার অর্থায়নেও। গোষ্ঠীটি দরিদ্র হতে থাকে এবং নতুন কর্মী সংগ্রহ প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। আর বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর তালেবান যোদ্ধাদের মনোবল ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে এবং অবশেষে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যখন জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষকেরা বলতে শুরু করেন যে আল-কায়েদা এখন যতটা না একটা সংগঠন, তার চেয়ে বেশি একটা ভাবাদর্শের আকারে টিকে আছে। আয়মান আল জাওয়াহিরিও আমেরিকান ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার ভয়ে পালিয়ে থাকা এক গুহাবাসী নেতা, আল-কায়েদাকে সংগঠিত রাখা যাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
আল-কায়েদার এই দুর্দশার বিপরীতে ইরাক-সিরিয়ায় দাপটের সঙ্গে যুদ্ধরত আইএস (বা আইসিস) সারা বিশ্বের জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মুসলমান তরুণ-যুবকের কাছে ভীষণ এক প্রলুব্ধকর সংগঠনের নাম। আইএসের নেতা আবু বকর আল বাগদাদি তাদের কাছে ওসামা বিন লাদেনের চেয়েও আকর্ষণীয় এক নেতা, নৃশংসতায় যার জুড়ি মেলা ভার। সে কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৮১টি দেশ থেকে মুসলমান তরুণ-যুবকেরা ছুটে গেছেন ইরাক ও সিরিয়ায়, যোগ দিয়েছে খলিফা আবু বকর আল বাগদাদির নিশানতলে। দেশগুলোর তালিকায় আমেরিকা ও ব্রিটেনও আছে। এই দুটি দেশ, বিশেষত আমেরিকায় মানুষ আইএসকে নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এ কারণে যে, তাদের অনেক যুবক নাগরিক ইসলামি খিলাফত কায়েম করতে ইরাক-সিরিয়া গিয়ে আইএসের যোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। তারা যখন স্বদেশে ফিরবে, মনের মধ্যে জঙ্গিবাদ নিয়েই ফিরবে এবং ওই ভাবাদর্শ আমেরিকা ও ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যাবে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুদ্ধ ঢুকে পড়বে খোদ আমেরিকান বা ব্রিটিশ ভূখণ্ডে।
ভারত উপমহাদেশে আল-কায়েদার বিস্তারের বিপদ যদি এখন আর বাস্তবসম্মত নাও হয়, তবু ভারত সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। কারণটা আইএসকে ঘিরে। ভারতীয় গোয়েন্দারা খবর পেয়েছেন, ভারত থেকেও কিছু মুসলমান যুবক সিরিয়া-ইরাকে গিয়ে আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আর আল-কায়েদার এই নতুন ঘোষণার আগেই আইএস দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের পেশোয়ারসহ সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় ও আফগানিস্তানে আইএসের প্রচারপত্র বিলি করা শুরু হয়েছে; তাদের লিফলেট পাওয়া গেছে ভারতীয় কাশ্মীরেও। আর পাকিস্তানি তালেবানের একটা খুব সক্রিয় গ্রুপ জামাআতুল আহরার আইএসের যোদ্ধাদের ‘ভাই’ বলে ঘোষণা করেছে এবং তারা আইএসের নেতা আবু বকর আল বাগদাদির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। যদিও পাকিস্তানি তালেবান আল-কায়েদার সঙ্গেও সংহতি প্রকাশ করে, তবু আল-কায়েদার তুলনায় আইএসের আকর্ষণ এখন অনেক গুণ বেশি। আইএস সিরিয়া-ইরাকের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে নিজেদের রাষ্ট্র বা খিলাফত কায়েম করেছে এবং ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী তা পরিচালনা করছে। আইএস বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ধনী জঙ্গি সংগঠন, যার নগদ সম্পদের পরিমাণ ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। তারা যেসব তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তা থেকে তাদের দৈনিক আয় ৩০ লাখ ডলার। এ ছাড়া সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েতের ধনাঢ্য সুন্নিরা তাদের নিয়মিত বিরাট অঙ্কের চাঁদা দেয়। সব মিলিয়ে আইএসের যে রমরমা অবস্থা, তার ফলে বিশ্বের জঙ্গিবাদী মহলে এই সংগঠনটি আল-কায়েদার সেরা বিকল্পরূপে হাজির হয়েছে।
সুতরাং আল-কায়েদা না হোক, আইএসের মাধ্যমে ইসলামি জঙ্গিবাদ ভারত উপমহাদেশে, এমনকি বাংলাদেশেও মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে বাংলাদেশে তারা হয়তো সুবিধা করতে পারবে না, কারণ এ দেশে ধর্মের নামে সহিংস তৎপরতার পক্ষে সামাজিক সমর্থন নেই, যা আছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন দুষ্কৃতকারীদের মতো আচরণ করেও তারা যে সমাজের শান্তি যথেষ্ট মাত্রায় বিঘ্নিত করতে পারে, তার কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি ও বাংলা ভাইয়ের জাগ্রত মুসলিম জনতার দৌরাত্ম্যের সময়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
ভারত সরকারের এত বিচলিত হওয়ার কারণ কী? কেন এত চাঞ্চল্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে? দৃশ্যমান কারণ, আল-কায়েদা ভারত উপমহাদেশে এই প্রথম শাখা বিস্তারের ঘোষণা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আল-কায়েদার তৎপরতা এতকাল সীমাবদ্ধ ছিল আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে। এবার তার নজর পড়েছে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতি। ভিডিওবার্তায় বলা হয়েছে, এই অঞ্চলজুড়ে সীমান্তবিহীন একটা ইসলামি খেলাফত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আল-কায়েদার ভারত উপমহাদেশীয় শাখা খোলার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।
জাওয়াহিরির বক্তব্য অনুযায়ী আল-কায়েদার শ্যেন দৃষ্টির আওতায় বাংলাদেশও আছে, যে দেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলমান এবং যেখানে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা অনেক ছোট ছোট জঙ্গিগোষ্ঠী আছে, যাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদিন ও পরবর্তীকালে তালেবানের সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। আফগানিস্তানে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে জিহাদের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে এমন কিছু জঙ্গির কথা জানা যায়; তাদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে, এমন খবরও অতীতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকে জাওয়াহিরির ওই ভিডিওবার্তার সত্যতা নিয়ে প্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এ বিষয়টি আমাদের সরকারের কাছে প্রথমে ততটা গুরুত্ব পায়নি, যতটা পেয়েছে ভারত সরকারের কাছে। পরে অবশ্য র্যাবের জঙ্গিবিরোধী সেলগুলোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার মামলার আসামি এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সুবাদে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও নজরদারি শুরু হয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। অর্থাৎ জাওয়াহিরির ভিডিওবার্তা বাংলাদেশের সরকারের হাতে ধর্মভিত্তিক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও কোণঠাসা করার সুযোগ এনে দিল। ভারতেও বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক ফায়দা তোলার সুযোগ হবে, আরও জোশ বাড়বে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীদের, এবং মুসলমান মৌলবাদীদেরও কম সুবিধা হবে না—এ রকম কথাও বলাবলি হচ্ছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় রুচির জোশি লিখেছেন, জাওয়াহিরির ঘোষণার পর ভারতে হিন্দু ও মুসলমান মৌলবাদীরা একসঙ্গে ট্যাঙ্গো নাচ নাচতে শুরু করেছে, কারণ ধর্মীয় ঘৃণা ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটায় এবার উভয় পক্ষেরই বিরাট সুবিধা হবে।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, আল-কায়েদার পক্ষ থেকে জাওয়াহিরির এই ভিডিওবার্তা প্রচারের তাৎপর্য কী? ঠিক এই মুহূর্তে কেন এটা প্রচার করা হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা চলছে। ভিডিওবার্তাটি ভুয়া হতে পারে, মতলববাজ কোনো রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তৈরিও হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের দাবির সমর্থনে সাক্ষ্য–প্রমাণের খবর পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভবত এটা আয়মান আল জাওয়াহিরির কণ্ঠে উচ্চারিত আল-কায়েদারই বক্তব্য এবং এই বক্তব্য একটি প্রতিক্রিয়া। ইরাক ও সিরিয়ার বিরাট অঞ্চলজুড়ে ‘ইসলামি খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করে প্রবল দাপটের সঙ্গে ইরাকি ও সিরীয় সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের যে সুন্নি জঙ্গি সংগঠন, সারা মুসলিম বিশ্বে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমেই বেড়ে ওঠার দৃশ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে আল-কায়েদার পক্ষ থেকে জাওয়াহিরির এই ভিডিওবার্তা প্রচার করা হয়েছে।
আমেরিকানদের হাতে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার বেশ আগে থেকেই আল-কায়েদার তৎপরতা হ্রাস পেতে শুরু করে। বিশেষত, আফগানিস্তানে ও পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আমেরিকানরা ড্রোন হামলা শুরু করার পর থেকে আল-কায়েদার যোদ্ধাদের পক্ষে সক্রিয় থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁদের বড় নেতাদের অনেকেই ড্রোন হামলায় মারা যান এবং অন্য যোদ্ধাদের চলাফেরা সংকুচিত হতে থাকে। এমনকি তাঁদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও আর আগের মতো থাকে না। বিশেষত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটার ব্যবহার তাঁদের জন্য ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আমেরিকান ড্রোন হামলায় নিহত তালেবান যোদ্ধাদের অধিকাংশই মারা গেছেন মোবাইল ফোন ব্যবহার করার কারণে। যন্ত্র ব্যবহারের এই বিপদ তাঁদের বাধ্য করে চিঠি-চিরকুট লেখা ও মানুষের হাতে হাতে সেগুলো আদান-প্রদানের যুগে ফিরে যেতে। ওসামা বিন লাদেনও মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপেন বাধ্য হন। আল-কায়েদার অল্প কয়েকজন নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যেটুকু ছিল, তার মাধ্যম ছিলেন তাঁর অতি বিশ্বস্ত দুই সহোদর বার্তাবাহক, যাঁরা তাঁর সঙ্গে সপরিবারে বাস করতেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের একটি বাড়িতে, যেখানে আমেরিকান বিশেষ বাহিনী অভিযান চালিয়ে লাদেন ও তাঁর ওই দুই বার্তাবাহককে হত্যা করে।
চলাফেরায় বাধা, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগহীনতা ইত্যাদির পাশাপাশি ড্রোন হামলার সার্বক্ষণিক হুমকি—এসবের মারাত্মক প্রভাব পড়ে আল-কায়েদার অর্থায়নেও। গোষ্ঠীটি দরিদ্র হতে থাকে এবং নতুন কর্মী সংগ্রহ প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। আর বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর তালেবান যোদ্ধাদের মনোবল ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে এবং অবশেষে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যখন জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষকেরা বলতে শুরু করেন যে আল-কায়েদা এখন যতটা না একটা সংগঠন, তার চেয়ে বেশি একটা ভাবাদর্শের আকারে টিকে আছে। আয়মান আল জাওয়াহিরিও আমেরিকান ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার ভয়ে পালিয়ে থাকা এক গুহাবাসী নেতা, আল-কায়েদাকে সংগঠিত রাখা যাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
আল-কায়েদার এই দুর্দশার বিপরীতে ইরাক-সিরিয়ায় দাপটের সঙ্গে যুদ্ধরত আইএস (বা আইসিস) সারা বিশ্বের জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মুসলমান তরুণ-যুবকের কাছে ভীষণ এক প্রলুব্ধকর সংগঠনের নাম। আইএসের নেতা আবু বকর আল বাগদাদি তাদের কাছে ওসামা বিন লাদেনের চেয়েও আকর্ষণীয় এক নেতা, নৃশংসতায় যার জুড়ি মেলা ভার। সে কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৮১টি দেশ থেকে মুসলমান তরুণ-যুবকেরা ছুটে গেছেন ইরাক ও সিরিয়ায়, যোগ দিয়েছে খলিফা আবু বকর আল বাগদাদির নিশানতলে। দেশগুলোর তালিকায় আমেরিকা ও ব্রিটেনও আছে। এই দুটি দেশ, বিশেষত আমেরিকায় মানুষ আইএসকে নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এ কারণে যে, তাদের অনেক যুবক নাগরিক ইসলামি খিলাফত কায়েম করতে ইরাক-সিরিয়া গিয়ে আইএসের যোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। তারা যখন স্বদেশে ফিরবে, মনের মধ্যে জঙ্গিবাদ নিয়েই ফিরবে এবং ওই ভাবাদর্শ আমেরিকা ও ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যাবে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুদ্ধ ঢুকে পড়বে খোদ আমেরিকান বা ব্রিটিশ ভূখণ্ডে।
ভারত উপমহাদেশে আল-কায়েদার বিস্তারের বিপদ যদি এখন আর বাস্তবসম্মত নাও হয়, তবু ভারত সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। কারণটা আইএসকে ঘিরে। ভারতীয় গোয়েন্দারা খবর পেয়েছেন, ভারত থেকেও কিছু মুসলমান যুবক সিরিয়া-ইরাকে গিয়ে আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আর আল-কায়েদার এই নতুন ঘোষণার আগেই আইএস দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের পেশোয়ারসহ সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় ও আফগানিস্তানে আইএসের প্রচারপত্র বিলি করা শুরু হয়েছে; তাদের লিফলেট পাওয়া গেছে ভারতীয় কাশ্মীরেও। আর পাকিস্তানি তালেবানের একটা খুব সক্রিয় গ্রুপ জামাআতুল আহরার আইএসের যোদ্ধাদের ‘ভাই’ বলে ঘোষণা করেছে এবং তারা আইএসের নেতা আবু বকর আল বাগদাদির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। যদিও পাকিস্তানি তালেবান আল-কায়েদার সঙ্গেও সংহতি প্রকাশ করে, তবু আল-কায়েদার তুলনায় আইএসের আকর্ষণ এখন অনেক গুণ বেশি। আইএস সিরিয়া-ইরাকের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে নিজেদের রাষ্ট্র বা খিলাফত কায়েম করেছে এবং ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী তা পরিচালনা করছে। আইএস বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ধনী জঙ্গি সংগঠন, যার নগদ সম্পদের পরিমাণ ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। তারা যেসব তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তা থেকে তাদের দৈনিক আয় ৩০ লাখ ডলার। এ ছাড়া সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েতের ধনাঢ্য সুন্নিরা তাদের নিয়মিত বিরাট অঙ্কের চাঁদা দেয়। সব মিলিয়ে আইএসের যে রমরমা অবস্থা, তার ফলে বিশ্বের জঙ্গিবাদী মহলে এই সংগঠনটি আল-কায়েদার সেরা বিকল্পরূপে হাজির হয়েছে।
সুতরাং আল-কায়েদা না হোক, আইএসের মাধ্যমে ইসলামি জঙ্গিবাদ ভারত উপমহাদেশে, এমনকি বাংলাদেশেও মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে বাংলাদেশে তারা হয়তো সুবিধা করতে পারবে না, কারণ এ দেশে ধর্মের নামে সহিংস তৎপরতার পক্ষে সামাজিক সমর্থন নেই, যা আছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন দুষ্কৃতকারীদের মতো আচরণ করেও তারা যে সমাজের শান্তি যথেষ্ট মাত্রায় বিঘ্নিত করতে পারে, তার কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি ও বাংলা ভাইয়ের জাগ্রত মুসলিম জনতার দৌরাত্ম্যের সময়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
No comments