সাক্ষরসমাজের স্বপ্ন ও বানু বিবির প্রশ্ন by রাশেদা কে চৌধূরী
নাম তাঁর বানু বিবি। বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে, নেত্রকোনার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রায় দুই দশক আগে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসেছিলেন। সেই থেকে আমার গৃহে তিনি আমার সহকর্মী। প্রথাগতভাবে ‘গৃহকর্মী’ হিসেবে পরিচিত হলেও পেশাগত দায়িত্ব পালনে আমার অফিসের সহকর্মীরা যেমন আমাকে সহায়তা করেন, ঠিক তেমনি গৃহস্থালির কাজে বানু বিবির সহায়তা আমাকে আশ্বস্ত করে।
বানু বিবিকে স্বামী-পরিত্যক্তা বলা যাবে না। পর পর তিন-তিনটি মেয়েসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে (!) স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় বানু বিবি সন্তানদের নানার বাড়ি রেখে নিজেই স্বামীকে পরিত্যাগ করে জীবিকার খোঁজে রাজধানীমুখী হয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু তাঁর সংগ্রাম। নিজে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু সন্তানদের শিক্ষার জন্য দীর্ঘদিন নিজের রোজগারের পুরোটাই ব্যয় করেছেন। একটি মেয়ে অল্প বয়সে মারা গেলেও বাকি দুজন এসএসসি পাস করেছেন। একজন আজ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, আরেকজন একটি পোশাকশিল্পে সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। শিক্ষার আলো তাঁদের জীবিকার সন্ধান দিয়েছে, কর্মজীবনকে দিয়েছে মর্যাদা। বানু বিবির ভাষায়, ‘আমি একলা একজন মানুষ যদি আমার মাইয়াদের ভবিষ্যৎ ভালো করার জন্য আমার সবকিছু দিয়া লেখাপড়া শিখাইতে পারি, তয় সরকার কেন সারা দেশের হগল মানুষেরে এই সুযোগ কইরা দিতে পারে না? তেনারা তো আমাগোর ভালোর কথা বইলাই আমাগো ভোট নিয়া সরকারে যায়!’
বানু বিবির প্রশ্ন চিরন্তন, শাশ্বত। নাগরিকের সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্রের যথাযথ ভূমিকা প্রত্যেক মানুষের কাম্য। কিন্তু সাক্ষরতা তো শুধু একটি প্রত্যাশা নয়, প্রত্যেক মানবসন্তানের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের আহ্বানে প্রতিবছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বর্ষ পরিক্রমায় ফিরে আসা ৮ সেপ্টেম্বরের এই দিনে ইউনেসকো তার তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মানবসমাজকে স্মরণ করিয়ে দেয় সাক্ষরতার নিরিখে কত কোটি মানবসন্তান এখনো জ্ঞানের রাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারেনি, রাষ্ট্রনেতৃত্বের দেওয়া অসংখ্য প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিশ্বে প্রায় ৭৮১ মিলিয়ন মানুষ এখনো ন্যূনতম সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত।
কী বিচিত্র এই পৃথিবী! একদিকে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি, অর্থ প্রাচুর্য আর বিত্ত-বৈভবের নগ্ন প্রকাশ, অন্যদিকে খেটে খাওয়া বিত্তহীন অগণিত মানুষের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম। এখনো নানা দেশে গণতন্ত্রের নামে চলে সাধারণ জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের প্রয়াস, ধর্মরক্ষার অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে প্রাণ হারায় অগণিত নারী, শিশু, অসহায় মানুষ। সমরাস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারের লাগামহীন প্রয়াস মানবসমাজের অগ্রগতিকে করে প্রশ্নবিদ্ধ।
কিন্তু গত শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে হিসাব কষলে মানব উন্নয়নে অর্জনও নেহাত কম নয়। বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের হার কমছে, সাক্ষরতার হারও বাড়ছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অসাক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল ৯৬০ মিলিয়ন। সহস্রাব্দের শুরুতে তা হ্রাস পেয়ে হয় ৮৮০ মিলিয়ন। কিন্তু এখনো প্রায় ৭৮১ মিলিয়ন মানবসন্তান ন্যূনতম সাক্ষরতার আলো থেকে বঞ্চিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার সব স্তরে, বিশেষ করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য—নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শহর-গ্রামের এ বৈষম্য মানব উন্নয়নের সব সূচককে পশ্চাদমুখী করে তুলছে। ইউনেসকোর হিসাব অনুযায়ী ঊ-৯ বলে পরিচিত নয়টি জনবহুল দেশ, যেখানে সাক্ষরতার হারও কম৷ তার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। এতদঞ্চলে বিশ্বের অসাক্ষর জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের বসবাস, যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী!
এমন এক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আজ বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। নারী ও কন্যাশিশুর শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরার প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করছে। দেশ-বিদেশের বহু বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, নাগরিক সমাজ ও নীতিনির্ধারকেরা একত্র হবেন; শিক্ষা ও সাক্ষরতা নিরিখে কোথায় অবস্থান করছে বিশ্বসমাজ, নারী ও কন্যাশিশুর সাক্ষরতার অন্তরায়গুলো কী কী, সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার কীভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে ইত্যাদি নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে, সুপারিশ প্রণীত হবে, হয়তো একটি ‘ঢাকা ঘোষণা’ও স্বাক্ষরিত হবে।
কন্যাশিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বস্বীকৃত, প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ ভর্তির সরকারি দাবিও অনেক ক্ষেত্রে সত্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালে, বিশেষ করে গত দুই দশকে সাক্ষরতার হারও বেড়েছে—নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে। ১৯৯০ সালে বয়স্ক শিক্ষার হার ছিল ৩৭ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। নৈর্ব্যক্তিক আত্মসমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, আলোকিত, সাক্ষরসমাজ বিনির্মাণে আরও অনেক দূর পথ চলতে হবে আমাদের। সেই পথে কি এগোচ্ছি আমরা?
ইউনেসকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেকোনো ভাষায় পড়তে, বুঝতে ও লিখতে পারা এবং সাধারণ অঙ্কের জ্ঞান থাকলে যেকোনো মানুষকে সাক্ষর হিসেবে গণ্য করা যায়। তাদের হিসাবে, সাক্ষরতার হারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়া ও সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো। এই অঞ্চলের জনসংখ্যা যেমন বিশাল, তেমনি তাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা, বহুমুখী সাংস্কৃতিক কাঠামো, সীমাহীন পরিবেশগত বৈচিত্র্য—সবকিছুই নানামুখী চ্যালেঞ্জের পরিচায়ক। কিন্তু এতদঞ্চলের শিক্ষা ও সাক্ষরতার ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে অসংখ্য প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও যথাযথ বিনিয়োগ একটি দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার আলোয় নিষিক্ত করতে পারে। আমাদের কাছের দেশ শ্রীলঙ্কা এর উজ্জ্বল উদাহরণ। দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নানাবিধ টানাপোড়েন—কোনো কিছুই শ্রীলঙ্কার সাক্ষরতার অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি থাকলেও এডুকেশন ওয়াচের বিভিন্ন সময়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে যে গত চার দশকে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর সময়ে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার ক্ষেত্রে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রাথমিক শিক্ষার বৈপ্লবিক অগ্রগতি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী জনগোষ্ঠীর অনেকে হয়তো জীবিকার তাগিদে পরবর্তী সময়ে ঝরে পড়েছে, কিন্তু তার স্কুলে পড়ার সামান্য সুযোগটুকু তাকে করে তুলেছে সাক্ষরসমাজ বিনির্মাণের প্রথম ধাপের যাত্রী। কিন্তু যারা ঝরে গেল, অসচ্ছলতা ও বয়সের কারণে যারা আর কখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পেল না, তাদের জন্য কী করেছি, কতটুকু করেছি আমরা? সরকারের কিছু উপানুষ্ঠানিক ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম, হাতে গোনা কিছু এনজিওর সমন্বিত কর্মসূচি ইত্যাদি এতই অপ্রতুল ও প্রকল্পভিত্তিক যে এগুলো এখনো বয়স্ক সাক্ষরতার ক্ষেত্রে তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে পারেনি।
নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে তৎকালীন সরকার পরিচালিত ‘সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন’ বা কর্মসূচি কিছু চমক তৈরি করলেও দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই কোনো ফল নিয়ে আসেনি। চমকপ্রদ সব নাম দিয়ে চালু হয়েছিল টিএলএম—এর যাত্রা আলোকিত মাগুরা, উজ্জীবিত নওগাঁ ইত্যাদি। কিন্তু নানাবিধ প্রতিকূলতায় হারিয়ে গেছে সেগুলো, তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে প্রায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। দলীয় সরকারে নির্বাচন-পরবর্তী নেতৃত্বের পালাবদলে এ কর্মসূচি পরিচালনায় নতুন নীতিনির্ধারকদের অনীহার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কর্মসূচির অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অপবাদ।
শুধু কি তা-ই? আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় এ ধরনের আন্দোলনমুখী একটি কার্যক্রম যে কাঙ্ক্ষিত ধারায় চলতে পারে না, স্থানীয় সরকার ও সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া এমন কর্মসূচির ফসল যে ঘরে তোলা যাবে না, সেটি ভেবে দেখা হয়নি। যথাযথ কৌশল ও জন-অংশগ্রহণের অভাবে একটি মহতী লক্ষ্য এভাবেই অপূর্ণ থেকে যায়, ব্যর্থ হয় জাতীয় বিনিয়োগ।
সার্বিক সাক্ষরতার লক্ষ্য অর্জন কঠিন হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে যদি যথাযথ পরিকল্পনা, যথার্থ ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ যুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে মানবসক্ষমতা উন্নয়নের যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করা দুরূহ নয়। দৌলতদিয়া ঘাটে ডিম বিক্রেতা কিশোর নুরু মিয়া যেমন অবলীলায় বলেছিল, ‘পরিবারের খরচ চালানোর জন্য স্কুলে পড়া হয়নি। এখন বয়স চলে গেছে, কোনো স্কুল তো আমাকে নেবে না। কিন্তু যেদিন দেখলাম আমাদের গ্রামে একটা এনজিও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছে, আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের জন্য, সেদিন আর সুযোগ ছাড়িনি। এখানের পড়া শেষ হলে কী করব জানি না। সরকার কি আমাদের জন্য ব্যবস্থা করতে পারে না?’
নুরুকে বলতে চেয়েছিলাম, ‘নিশ্চয়ই পারে’, কিন্তু বলতে পারিনি। আমরা যারা শিক্ষার আলো পেয়েছি, তারা কি কখনো ভাবি এ ধরনের শত-সহস্র নুরু মিয়ার কথা? শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে যাদের সংখ্যা অনেক দেশের মোট জনসংখ্যারও বেশি, ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী ১২৬ মিলিয়ন! প্রতিবছর ৮ সেপ্টেম্বর আমরা নানা আয়োজনে পালন করব আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। কিন্তু সেই দিবসটি কবে আসবে, যেদিন আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারব যে এই দিবসের আর প্রয়োজন নেই অথবা দিবসটি অন্য আঙ্গিকে, অন্য লক্ষ্য নিয়ে পালন করব—দিনটি আর কত দূরে?
রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
বানু বিবিকে স্বামী-পরিত্যক্তা বলা যাবে না। পর পর তিন-তিনটি মেয়েসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে (!) স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় বানু বিবি সন্তানদের নানার বাড়ি রেখে নিজেই স্বামীকে পরিত্যাগ করে জীবিকার খোঁজে রাজধানীমুখী হয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু তাঁর সংগ্রাম। নিজে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু সন্তানদের শিক্ষার জন্য দীর্ঘদিন নিজের রোজগারের পুরোটাই ব্যয় করেছেন। একটি মেয়ে অল্প বয়সে মারা গেলেও বাকি দুজন এসএসসি পাস করেছেন। একজন আজ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, আরেকজন একটি পোশাকশিল্পে সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। শিক্ষার আলো তাঁদের জীবিকার সন্ধান দিয়েছে, কর্মজীবনকে দিয়েছে মর্যাদা। বানু বিবির ভাষায়, ‘আমি একলা একজন মানুষ যদি আমার মাইয়াদের ভবিষ্যৎ ভালো করার জন্য আমার সবকিছু দিয়া লেখাপড়া শিখাইতে পারি, তয় সরকার কেন সারা দেশের হগল মানুষেরে এই সুযোগ কইরা দিতে পারে না? তেনারা তো আমাগোর ভালোর কথা বইলাই আমাগো ভোট নিয়া সরকারে যায়!’
বানু বিবির প্রশ্ন চিরন্তন, শাশ্বত। নাগরিকের সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্রের যথাযথ ভূমিকা প্রত্যেক মানুষের কাম্য। কিন্তু সাক্ষরতা তো শুধু একটি প্রত্যাশা নয়, প্রত্যেক মানবসন্তানের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের আহ্বানে প্রতিবছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বর্ষ পরিক্রমায় ফিরে আসা ৮ সেপ্টেম্বরের এই দিনে ইউনেসকো তার তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মানবসমাজকে স্মরণ করিয়ে দেয় সাক্ষরতার নিরিখে কত কোটি মানবসন্তান এখনো জ্ঞানের রাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারেনি, রাষ্ট্রনেতৃত্বের দেওয়া অসংখ্য প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিশ্বে প্রায় ৭৮১ মিলিয়ন মানুষ এখনো ন্যূনতম সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত।
কী বিচিত্র এই পৃথিবী! একদিকে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি, অর্থ প্রাচুর্য আর বিত্ত-বৈভবের নগ্ন প্রকাশ, অন্যদিকে খেটে খাওয়া বিত্তহীন অগণিত মানুষের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম। এখনো নানা দেশে গণতন্ত্রের নামে চলে সাধারণ জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের প্রয়াস, ধর্মরক্ষার অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে প্রাণ হারায় অগণিত নারী, শিশু, অসহায় মানুষ। সমরাস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারের লাগামহীন প্রয়াস মানবসমাজের অগ্রগতিকে করে প্রশ্নবিদ্ধ।
কিন্তু গত শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে হিসাব কষলে মানব উন্নয়নে অর্জনও নেহাত কম নয়। বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের হার কমছে, সাক্ষরতার হারও বাড়ছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অসাক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল ৯৬০ মিলিয়ন। সহস্রাব্দের শুরুতে তা হ্রাস পেয়ে হয় ৮৮০ মিলিয়ন। কিন্তু এখনো প্রায় ৭৮১ মিলিয়ন মানবসন্তান ন্যূনতম সাক্ষরতার আলো থেকে বঞ্চিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার সব স্তরে, বিশেষ করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য—নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শহর-গ্রামের এ বৈষম্য মানব উন্নয়নের সব সূচককে পশ্চাদমুখী করে তুলছে। ইউনেসকোর হিসাব অনুযায়ী ঊ-৯ বলে পরিচিত নয়টি জনবহুল দেশ, যেখানে সাক্ষরতার হারও কম৷ তার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। এতদঞ্চলে বিশ্বের অসাক্ষর জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের বসবাস, যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী!
এমন এক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আজ বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। নারী ও কন্যাশিশুর শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরার প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করছে। দেশ-বিদেশের বহু বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, নাগরিক সমাজ ও নীতিনির্ধারকেরা একত্র হবেন; শিক্ষা ও সাক্ষরতা নিরিখে কোথায় অবস্থান করছে বিশ্বসমাজ, নারী ও কন্যাশিশুর সাক্ষরতার অন্তরায়গুলো কী কী, সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার কীভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে ইত্যাদি নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে, সুপারিশ প্রণীত হবে, হয়তো একটি ‘ঢাকা ঘোষণা’ও স্বাক্ষরিত হবে।
কন্যাশিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বস্বীকৃত, প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ ভর্তির সরকারি দাবিও অনেক ক্ষেত্রে সত্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালে, বিশেষ করে গত দুই দশকে সাক্ষরতার হারও বেড়েছে—নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে। ১৯৯০ সালে বয়স্ক শিক্ষার হার ছিল ৩৭ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। নৈর্ব্যক্তিক আত্মসমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, আলোকিত, সাক্ষরসমাজ বিনির্মাণে আরও অনেক দূর পথ চলতে হবে আমাদের। সেই পথে কি এগোচ্ছি আমরা?
ইউনেসকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেকোনো ভাষায় পড়তে, বুঝতে ও লিখতে পারা এবং সাধারণ অঙ্কের জ্ঞান থাকলে যেকোনো মানুষকে সাক্ষর হিসেবে গণ্য করা যায়। তাদের হিসাবে, সাক্ষরতার হারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়া ও সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো। এই অঞ্চলের জনসংখ্যা যেমন বিশাল, তেমনি তাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা, বহুমুখী সাংস্কৃতিক কাঠামো, সীমাহীন পরিবেশগত বৈচিত্র্য—সবকিছুই নানামুখী চ্যালেঞ্জের পরিচায়ক। কিন্তু এতদঞ্চলের শিক্ষা ও সাক্ষরতার ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে অসংখ্য প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও যথাযথ বিনিয়োগ একটি দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার আলোয় নিষিক্ত করতে পারে। আমাদের কাছের দেশ শ্রীলঙ্কা এর উজ্জ্বল উদাহরণ। দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নানাবিধ টানাপোড়েন—কোনো কিছুই শ্রীলঙ্কার সাক্ষরতার অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি থাকলেও এডুকেশন ওয়াচের বিভিন্ন সময়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে যে গত চার দশকে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর সময়ে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার ক্ষেত্রে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রাথমিক শিক্ষার বৈপ্লবিক অগ্রগতি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী জনগোষ্ঠীর অনেকে হয়তো জীবিকার তাগিদে পরবর্তী সময়ে ঝরে পড়েছে, কিন্তু তার স্কুলে পড়ার সামান্য সুযোগটুকু তাকে করে তুলেছে সাক্ষরসমাজ বিনির্মাণের প্রথম ধাপের যাত্রী। কিন্তু যারা ঝরে গেল, অসচ্ছলতা ও বয়সের কারণে যারা আর কখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পেল না, তাদের জন্য কী করেছি, কতটুকু করেছি আমরা? সরকারের কিছু উপানুষ্ঠানিক ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম, হাতে গোনা কিছু এনজিওর সমন্বিত কর্মসূচি ইত্যাদি এতই অপ্রতুল ও প্রকল্পভিত্তিক যে এগুলো এখনো বয়স্ক সাক্ষরতার ক্ষেত্রে তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে পারেনি।
নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে তৎকালীন সরকার পরিচালিত ‘সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন’ বা কর্মসূচি কিছু চমক তৈরি করলেও দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই কোনো ফল নিয়ে আসেনি। চমকপ্রদ সব নাম দিয়ে চালু হয়েছিল টিএলএম—এর যাত্রা আলোকিত মাগুরা, উজ্জীবিত নওগাঁ ইত্যাদি। কিন্তু নানাবিধ প্রতিকূলতায় হারিয়ে গেছে সেগুলো, তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে প্রায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। দলীয় সরকারে নির্বাচন-পরবর্তী নেতৃত্বের পালাবদলে এ কর্মসূচি পরিচালনায় নতুন নীতিনির্ধারকদের অনীহার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কর্মসূচির অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অপবাদ।
শুধু কি তা-ই? আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় এ ধরনের আন্দোলনমুখী একটি কার্যক্রম যে কাঙ্ক্ষিত ধারায় চলতে পারে না, স্থানীয় সরকার ও সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া এমন কর্মসূচির ফসল যে ঘরে তোলা যাবে না, সেটি ভেবে দেখা হয়নি। যথাযথ কৌশল ও জন-অংশগ্রহণের অভাবে একটি মহতী লক্ষ্য এভাবেই অপূর্ণ থেকে যায়, ব্যর্থ হয় জাতীয় বিনিয়োগ।
সার্বিক সাক্ষরতার লক্ষ্য অর্জন কঠিন হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে যদি যথাযথ পরিকল্পনা, যথার্থ ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ যুক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে মানবসক্ষমতা উন্নয়নের যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করা দুরূহ নয়। দৌলতদিয়া ঘাটে ডিম বিক্রেতা কিশোর নুরু মিয়া যেমন অবলীলায় বলেছিল, ‘পরিবারের খরচ চালানোর জন্য স্কুলে পড়া হয়নি। এখন বয়স চলে গেছে, কোনো স্কুল তো আমাকে নেবে না। কিন্তু যেদিন দেখলাম আমাদের গ্রামে একটা এনজিও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছে, আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের জন্য, সেদিন আর সুযোগ ছাড়িনি। এখানের পড়া শেষ হলে কী করব জানি না। সরকার কি আমাদের জন্য ব্যবস্থা করতে পারে না?’
নুরুকে বলতে চেয়েছিলাম, ‘নিশ্চয়ই পারে’, কিন্তু বলতে পারিনি। আমরা যারা শিক্ষার আলো পেয়েছি, তারা কি কখনো ভাবি এ ধরনের শত-সহস্র নুরু মিয়ার কথা? শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে যাদের সংখ্যা অনেক দেশের মোট জনসংখ্যারও বেশি, ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী ১২৬ মিলিয়ন! প্রতিবছর ৮ সেপ্টেম্বর আমরা নানা আয়োজনে পালন করব আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। কিন্তু সেই দিবসটি কবে আসবে, যেদিন আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারব যে এই দিবসের আর প্রয়োজন নেই অথবা দিবসটি অন্য আঙ্গিকে, অন্য লক্ষ্য নিয়ে পালন করব—দিনটি আর কত দূরে?
রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
No comments