মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন by আলী ইমাম মজুমদার
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত কর্মকর্তা
পর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া নতুনভাবে শুরু
করতে মিয়ানমার সম্মত হয়েছে। খবরে জানা যায়, দুই মাসের মধ্যে এ প্রক্রিয়া
শুরু হবে। প্রথম পর্যায়ের তালিকায় রয়েছে দুই হাজার ৪১৫ জনের নাম।
প্রায় এক দশক পর পুনরায় শুরু হতে যাওয়া এই প্রক্রিয়া আশাব্যঞ্জক। ২০০৫ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। উল্লেখ করা যায়, শিবিরে এখন রয়েছে ৩২ হাজার রোহিঙ্গা। শিবিরের বাইরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার কোনো কোনো স্থানে অনিবন্ধিত আরও তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হয়। উল্লিখিত তিনটি জেলার, বিশেষ করে কক্সবাজারের শ্রমঘন কাজ মূলত এদেরই আওতায় রয়েছে। দেশি শ্রমিকদের চেয়ে তুলনামূলক কম বেতনে তারা কাজ করে। শিবিরে বসবাসকারী অবশিষ্ট শরণার্থীদের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে—এমনটাই বলেছে মিয়ানমার। শিবিরের বাইরে অবস্থানকারী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে রয়েছে নীরব।
প্রায় এক দশক পর পুনরায় শুরু হতে যাওয়া এই প্রক্রিয়া আশাব্যঞ্জক। ২০০৫ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। উল্লেখ করা যায়, শিবিরে এখন রয়েছে ৩২ হাজার রোহিঙ্গা। শিবিরের বাইরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার কোনো কোনো স্থানে অনিবন্ধিত আরও তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হয়। উল্লিখিত তিনটি জেলার, বিশেষ করে কক্সবাজারের শ্রমঘন কাজ মূলত এদেরই আওতায় রয়েছে। দেশি শ্রমিকদের চেয়ে তুলনামূলক কম বেতনে তারা কাজ করে। শিবিরে বসবাসকারী অবশিষ্ট শরণার্থীদের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে—এমনটাই বলেছে মিয়ানমার। শিবিরের বাইরে অবস্থানকারী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে রয়েছে নীরব।
শিবিরে বসবাসকারী শরণার্থীরা জাতিগত দাঙ্গার শিকার হয়ে ১৯৯১-৯২ সালে এ দেশে চলে আসা প্রায় আড়াই লাখ শরণার্থীর অবশিষ্টাংশ। অন্যরা ২০০৫ সালের আগে নিজ দেশে ফেরত গেছে। এর আগে ১৯৭৮ সালে চলে এসেছিল প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা। ১৯৭৯ সালের শেষাবধি তাদের সবার প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়েছিল। আবার ২০১২ সালের জাতিগত দাঙ্গার সময় এ দেশে আসার নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়েছিল বহু রোহিঙ্গা। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যায় ভারাক্রান্ত জনবহুল এ দেশে আমরা তাদের আশ্রয় দিইনি। আবার শিবিরের বাইরে থাকা শরণার্থীরা বিভিন্ন সময়ে নীরবে ঠাঁই নিয়েছে আমাদের দেশে। কিন্তু কেন ছেড়ে চলে আসে তারা মিয়ানমারের আরাকানের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর উর্বর ভূমির দেশ? সহজ জবাব, প্রাণ ও পেট উভয়ের দায়ে।
জাতিসংঘের বিশ্লেষণ অনুসারে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ১৯৫০ সাল থেকে মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলেই স্বীকার করে না। তাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত। প্রায়ই দিতে হয় বাধ্যকর শ্রম। তাও অনেক কম, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিনা মজুরিতে। ন্যায়নীতি-বহির্ভূত কর দিতে হয় তাদের। এমনকি বিয়ের জন্যও কর আছে। কারণে-অকারণে জমিজমা বাজেয়াপ্ত করা হয়। উচ্ছেদ করা হয় ভিটেবাড়ি থেকে। এগুলো কোনো লুকোছাপা বিষয় নয়। সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে বারবার আলোচিত হয়েছে এসব বিষয়। শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘ হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করছে। মূলত তাদের আর্থিক সহায়তায়ই শিবিরের শরণার্থীরা জীবন ধারণ করে।
রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা আরব বংশোদ্ভূত। অষ্টম শতাব্দী থেকে আরাকানে তাদের বাস। মিয়ানমার সরকার ১৯৫০ সালের নাগরিকত্ব আইনে সেই দাবি নাকচ করে দেয়। তাদের মতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে তারা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। তাও তো আজ শতাব্দীর ব্যাপার। আর একেবারেই পাশাপাশি অবস্থান এবং বেশ কিছু বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকদের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক নৈকট্য সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এখন মিয়ানমারে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এদিক-সেদিক চলে গেছে অনেকে। হাজারো বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বেশ কিছু ঢুকে পড়েছে বলে জানা যায়। কিছু গেছে থাইল্যান্ডের দিকে। এক লাখ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়ে আছে দেশের শিবিরগুলোতে। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে তাদের মালয়েশিয়া যাওয়ার দুঃসাহসিক চেষ্টার কথা আমরা প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি। মানুষ কখন এতটা মরিয়া হতে পারে, তা সহজে অনুমেয়। বাংলাদেশে আসা কিছু রোহিঙ্গা এ দেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবেও পাড়ি দিয়েছে। এ দেশে রোহিঙ্গা সমস্যাটি লাভ করেছে বহুমাত্রিকতা। শিক্ষাদীক্ষা-বঞ্চিত ও অবহেলিত ব্যক্তিদের একটি অংশ বড় অপরাধীদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর তা-ই হচ্ছে। জঙ্গিবাদ, চোরাচালানসহ অপরাধের পৃষ্ঠপোষকেরা রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে সহজেই ব্যবহার করতে পারছে। ফলে, নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর। সমস্যাটির একটি যৌক্তিক এবং ন্যায়সংগত সমাধান না হলে মিয়ানমারের নিকট-প্রতিবেশী বাংলাদেশ সদা ভারাক্রান্ত থাকবে।
রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বিশ্বসমাজ বারবার অনুরোধ জানাচ্ছে মিয়ানমারকে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট সে দেশ সফরকালেও একই অনুরোধ করেছেন। এতে কার্যকর কোনো ফলোদয় হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। অতি সম্প্রতি সে দেশে জনগণনা অনুষ্ঠিত হয়। সেই গণনার ফলাফল অনুসারে, ১৯৮৩ সালের চেয়ে তাদের জনসংখ্যা কমেছে ৯০ লাখ। কোথাও কিছু ভুল থাকতে পারে। তবে সেই জনগণনায় রোহিঙ্গারা অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তথ্য নিবন্ধন ফরমে জাতিসত্তার তালিকায় ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিই ছিল না। তা ছাড়া বিদ্রোহী–অধ্যুষিত কাচিন প্রদেশ গণনার বাইরেই রয়ে গেছে। এ জনগণনা থেকে বাদ পড়ে রোহিঙ্গারা একটি নেতিবাচক বার্তা পেল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শরণার্থী সমস্যা বিভিন্নভাবে সমাধান করা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে এতে আবশ্যক হয়েছে আন্তর্জাতিক সহায়তা। উনিশ শতকের শেষ দিকে ভুটানের দক্ষিণাঞ্চলে নেপালি ভাষাভাষী বেশ কিছু লোক বসতি স্থাপন করে। ১৯৮৫ সালে ভুটানে নাগরিকত্ব আইন নতুনভাবে প্রণীত হয়। জনগণনা করা হয় ১৯৮৮ সালে। নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দাঙ্গা হয় ১৯৯০ সাল থেকে কয়েক বছর। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নেপালি ভাষাভাষীরা আশ্রয় নেয় নেপালে। ইউএনএইচসিআর শিবির স্থাপন করে ত্রাণ কার্যক্রম চালায় সেখানে। সেসব শিবিরে জনসংখ্যা একপর্যায়ে দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ সাত হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ এদের পুনর্বাসনের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসে। ২০১৪ সালের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৮৮ হাজার ৭৭০ জন পুনর্বাসিত হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ হাজার যুক্তরাষ্ট্রে আর ১৩ হাজার ৭৭০ জন অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এমন ব্যবস্থা তো নেওয়া যেত ২৩ বছর শিবির জীবনযাপনকারী কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্যও। পাশ্চাত্যের পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশ এদের ধারণ করতে সক্ষম নয়। এটা সবারই জানা। জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলে ভুটানি শরণার্থীদের প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি অংশ এভাবে পুনর্বাসিত হতে পারে।
মিয়ানমারের সঙ্গে কর্মকর্তা পর্যায়ে সাম্প্রতিক বৈঠকের ফলাফল আমাদের মধ্যে নতুন আশাবাদের সঞ্চার করেছে। তবে এ বিষয়ে তাদের অতীত ভূমিকায় আমরা কিছুটা সন্ধিহানও থাকছি। দীর্ঘকাল সামরিক বাহিনী দেশটি শাসন করেছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও বিচ্ছিন্ন ছিল সারা বিশ্বের চিন্তাচেতনা থেকে। সম্প্রতি কিছুটা গণতন্ত্রায়ণ হয়েছে। তবে চেতনার জগতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। রোহিঙ্গারা ২০১২ সালের দাঙ্গায় বিপন্ন হলে তাদের পক্ষে কোনো বক্তব্য নিয়ে অবস্থান নেননি শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি। অথচ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জীবনের মূল্যবান সময় বন্দিদশাতেই কাটিয়েছিলেন। মনে করা হচ্ছে, এখানে ভোটের রাজনীতির ঊর্ধ্বে তিনিও উঠতে সক্ষম হননি।
মিয়ানমার আমাদের নিকট-প্রতিবেশী একটি দেশ। তাদের সঙ্গে সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশই ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হতে পারে। অতীতে যা-ই ঘটুক, এখন তাকানো দরকার সামনের দিকে। শিবিরে থাকা শরণার্থীদের এক ক্ষুদ্র অংশকে সে দেশের প্রত্যাবর্তনে সম্মত হওয়া তাদের সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবেই আমরা ধরে নেব। পাশাপাশি প্রয়োজন, যারা সেখানে আছে, তাদের শান্তি, নিরাপত্তা আর মর্যাদাপূর্ণ জীবনধারণের অধিকার। মিয়ানমার আজ গণতন্ত্রের পথযাত্রী। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমার্থক।
মানবাধিকারের ন্যূনতম বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে এ সমস্যা ধীরে ধীরে সমাধান হয়ে যাবে। তবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে মিয়ানমারকে সংশয় কাটাতে হবে। সমস্যাটি শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর শান্তি ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে প্রাসঙ্গিকও বটে। যে সদিচ্ছার সূচনা কর্মকর্তা পর্যায়ের সাম্প্রতিক বৈঠকে হলো, তা ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হোক—এ প্রত্যাশা সবার।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments