দেশের মানুষ দমবন্ধ অবস্থার অবসান চায় -বিশেষ সাক্ষাৎকারে মির্জা আব্বাস by মিজানুর রহমান খান
সাবেক পূর্তমন্ত্রী ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস বর্তমানে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটিরও সদস্য, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো :ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি কবে দিচ্ছেন?
মির্জা আব্বাস :১৮ বছর এ কমিটি নিষ্ক্রিয় ছিল। দু-তিনবারই আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে এবং একই ব্যক্তিরা এতে ছিলেন।
প্রথম আলো :কিন্তু এই কমিটি রেখেই তো আন্দোলন করেছেন, সরকারে এসেছেন।
মির্জা আব্বাস : বিএনপির সরকার গড়তে এই কমিটির ভূমিকা ছিল না।
প্রথম আলো :অতীতে আন্দোলনে বিএনপির অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের তুলনায় এই কমিটির ভূমিকা কেমন ছিল?
মির্জা আব্বাস :আমি মনে করি না তেমন ভূমিকা ছিল। দল সরকারে গেলে সাধারণত যত্নের অভাবে সংগঠন নষ্ট হয়। সেই দলের প্রধান যদি মন্ত্রী হন, তাহলে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
প্রথম আলো :জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?
মির্জা আব্বাস :তিনি ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর আমলে সংসদে বিএনপিবিরোধী বহু লোক নির্বাচিত হন এবং তাঁরা যথেষ্ট কথা বলার সুযোগ পান।
প্রথম আলো :১৫ আগস্টে জন্মদিন পালন, জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি বলা অনেক পরের ঘটনা। তিনি এসব বিতর্কমুক্ত ছিলেন, কিন্তু আপনারা তা আমদানি করলেন কেন?
মির্জা আব্বাস :সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিত ছিল একরকম। তখন যে প্রশ্ন ছিল না, সেই প্রশ্নগুলো পরে এসেছে। আমি তখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বিবেচনায় বিশেষ কতিপয় ব্যক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিলাম। সাহস করে বলেছিলাম, আমি তাদের সঙ্গে রাজনীতি করতে পারব না। জিয়ার অনন্য গুণ ছিল যে আমার সঙ্গে বিরোধিতা না করে বরং আশ্বস্ত করেছিলেন।
প্রথম আলো :ভিন্নমত প্রকাশে জিয়ার সঙ্গে যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন, সেটা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কতটুকু করছেন?
মির্জা আব্বাস :আপনি অন্য প্রশ্নে যাচ্ছেন। জিয়া বোঝালেন, তুমি নিশ্চয় আমার চেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা নও। এটা দেশ বিভক্তির সময় নয়। দেশকে বিভক্ত করে জাতিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। তাঁর এই কথা একটি সর্বকালীন সত্য। জিয়ার এই পরামর্শ চাইলে আজকের প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন।
প্রথম আলো :আপনি কি এর মাধ্যমে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দিকে ইঙ্গিত করছেন?
মির্জা আব্বাস :যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমি সাক্ষাৎকার দিচ্ছি না। আমি আমার নেতার কথা বলছি। অনেকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার দৃষ্টান্ত দেন, বর্তমান সরকারও দেয়। দুই দেশেই ভালো-মন্দ আছে। তবে জাতি গঠনের দৃষ্টান্তের জন্য জিয়াউর রহমানের চেয়ে দ্বিতীয় উৎকৃষ্ট উদাহরণ আছে বলে মনে করি না।
প্রথম আলো :আপনাকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি বিশেষ সন্ধিক্ষণে চালকের আসনে বসানো হয়েছে। কী কৌশলে, কত তাড়াতাড়ি মিত্রদের সংগঠিত করে এই সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য করবেন, তেমন একটা চ্যালেঞ্জ আপনার সামনে?
মির্জা আব্বাস :আপনার প্রশ্নটা ব্যাখ্যামূলক। আপনিই তো সব বলে দিলেন।
প্রথম আলো :আপনি দলের একটি ব্যর্থতা ও হতাশার প্রেক্ষাপটে রাজধানীর হাল ধরেছেন?
মির্জা আব্বাস :নিজেকে সংগঠক মনে করি। ১৮ বছর যুবদলে থেকে অন্তত সাতবার কাউন্সিল করেছি। ১৯৭৮ সালে প্রথম গোপন ব্যালটে যুবদলের প্রেসিডেন্ট হলাম।
প্রথম আলো :ইতিহাসের ভালো পুনরাবৃত্তি কি দেখব? আপনি আহ্বায়ক থেকে গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হবেন?
মির্জা আব্বাস :না, আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাব না।
প্রথম আলো :কর্মীরা চাইলে সর্বস্তরে গোপন ব্যালটে হতে দেবেন, নাকি পকেট কমিটি চাপাবেন?
মির্জা আব্বাস :পকেট কমিটির প্রশ্নই আসে না। এর কোনো পথ খোলা নেই।
প্রথম আলো :কত দিনের মধ্যে কমিটি করবেন?
মির্জা আব্বাস :বলতে পারব না। তবে খুব সময় লাগবে না। আমি ২৪ ঘণ্টায় নয় ঘণ্টার বেশি কাজ করছি। ইতিমধ্যে বহু পদক্ষেপ নিয়েছি, যা এখন প্রকাশ করব না। ৫৩ সদস্যের কমিটির মধ্যে চারজনের সঙ্গে কথা বলে আমি সাধারণত সিদ্ধান্ত নিই।
প্রথম আলো :খালেদা জিয়ার করা কমিটি নিয়ে আপনার অভিযোগ কী? অভিমান করেছিলেন কি?
মির্জা আব্বাস :ঠিক অভিমান নয়। আমার মনে হয়েছিল যে বিষয়টি যেভাবে এসেছে, তা আমার জন্য সুবিধাজনক নয়। আমি ফেয়ার পলিটিকস করি। পেছনের দরজা দিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা কখনো করিনি।
প্রথম আলো :কিন্তু আপনার সমালোচকেরা বলে থাকেন যে সন্ত্রাসী ও মাস্তানেরা আপনার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।
মির্জা আব্বাস :আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমার হাত দিয়ে ঢাকায় বা বাংলাদেশে কোনো মাস্তান তৈরি হয়নি। ঢাকায় আমি যত দিন মিছিল করেছি, তাতে কোনো দিন বোমাবাজি হয়নি। একজন সন্ত্রাসীও সৃষ্টি করিনি।
প্রথম আলো :কথিতমতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ডা. ইকবালের মিছিল থেকে করা গুলিতে কতজন নিহত হয়েছিল এবং তাদের পরিবারের প্রতি কী কর্তব্য পালন করেছেন?
মির্জা আব্বাস :একজন মহিলা পথচারীসহ ছয়জন নিহত হন। এর মধ্যে চারজন বিএনপির কর্মী। তাদের পরিবারের পাশে সব সময় ছিলাম ও আছি।
প্রথম আলো :ক্ষমতায় গিয়ে তাঁদের জন্য কী করেছিলেন? প্রশ্নটি আপনার জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক, কারণ আপনি হাইকোর্টের আদেশে রাষ্ট্রের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন?
মির্জা আব্বাস :বাস্তবে নিইনি। সরকারকে জরিমানা করা হয়েছে জেনেই সন্তুষ্ট ছিলাম। না, নিহতদের পরিবারের জন্য সরকারিভাবে কিছু করা হয়নি।
প্রথম আলো :সাধারণ নির্বাচন কখন চান?
মির্জা আব্বাস :যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হওয়া উচিত। দেশের মানুষ দমবন্ধ অবস্থার অবসান চায়। আপনার পত্রিকা যদিও ভিন্নমতের, তবু বলব, আপনি রাস্তায় বেরিয়ে যাকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনিই সরকারের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করবেন।
প্রথম আলো :নির্বাচন ইস্যুতে প্রথম আলো কিন্তু সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে।
মির্জা আব্বাস :সেটা হয়েছেন। আবার অনেকের বিরুদ্ধে অযথা লিখেছেন।
প্রথম আলো :নির্দিষ্ট করে বলুন।
মির্জা আব্বাস :সত্য প্রকাশে প্রথম আলো হিম্মত রাখে। যখন করে না, তখন দুঃখ লাগে। আমি মন্ত্রী থাকতে রমনা পার্কে কিছু ইউক্যালিপটাস কাটা হলো। স্বাস্থ্যের জন্য এই গাছ মারাত্মক ক্ষতিকর। দিনে একটি গাছ সাড়ে সাত লিটার পানি শোষণ করে। অথচ এসব কারণ আপনার পত্রিকা লিখল না; বরং একটি বাজে কথাও ছাপা হলো। লিখে দিল, আমি নাকি বোমা মারার কথা বলেছি। এটা ছিল ডাহা মিথ্যা।
প্রথম আলো :আপনি প্রতিবাদ করে সঠিক বক্তব্য দিতে পারতেন।
মির্জা আব্বাস :দিয়েছিলাম। কিন্তু তা ছাপা হলো অনুল্লেখযোগ্যভাবে। আমি সব সময় বৃক্ষপ্রেমী ছিলাম। রমনা পার্কে আগে হাঁটতে যেতাম, গুপ্তহত্যা শুরুর পরে আর যাই না।
প্রথম আলো :এক-এগারোর দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি সমর্থন করে প্রথম আলো আপনাদের বিরাগভাজন হয়েছিল। ১৮ বাড়ি মামলায় রাষ্ট্রের ২০০ কোটির বেশি টাকা ক্ষতি করায় আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য। সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্য আমরা পেলে এখনো ছাপতে পারি।
মির্জা আব্বাস :এর ব্যাখ্যা দিয়েছি। জেলে যাওয়ার আগে কোন কোন পত্রিকা কখন কী কারণে আমার বিরুদ্ধে লিখেছে, সব বলেছি। কিন্তু আপনারা ছাপেননি।
প্রথম আলো :আপনি পূর্তমন্ত্রী হিসেবে কেন আগের সরকারের সিদ্ধান্ত রদ করেননি? ১৫টি বাড়ি বেচে দেওয়া কি অপরিহার্য ছিল?
মির্জা আব্বাস :এটা যদি আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন ভালো হবে। কারণ, এই বিক্রির প্রক্রিয়া তিনিই শুরু করে যান। তাঁর আমলেও সাবেক পাসপোর্ট অফিসসহ ১০টি বাড়ি বিক্রি হয়। মাত্র ১০ লাখ টাকায় কাঠা বিক্রি করেন। সেখানে আমি ২৭ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। ওই সময়ে গুলশানে ২০ লাখ টাকায় কাঠা বিক্রি হতো। ১৫টি বাড়ির ব্যাপারে যেভাবে তদবির আসতে শুরু করে, সেটা রাখা সম্ভব ছিল না। এগুলো কাজেও লাগছিল না। জাল দলিল করেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমি বাড়ি বেচে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার করেছি।
প্রথম আলো :২০০৮ সালে কেন নির্বাচন করেননি? কর ফাঁকির মামলায় দণ্ডজনিত অযোগ্যতার কারণেই?
মির্জা আব্বাস :না। অন্য কারণ ছিল। সেটা আমি বলব না। তবে দণ্ড থাকার কারণে নির্বাচন করিনি, সেটা ঠিক নয়।
প্রথম আলো :এখন বলুন, মামলার কী অবস্থা?
মির্জা আব্বাস :৪১টির বেশি মামলা বর্তমান সরকারই দিয়েছে। এর প্রায় ১২টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহের প্রায় সাত দিনই আদালতে হাজিরা দিই।
প্রথম আলো :মামলা সামলাবেন না আন্দোলন করবেন?
মির্জা আব্বাস :মামলা ছাড়া বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী নেই। নিচ থেকে মাথা পর্যন্ত প্রত্যেকের নামে কমপক্ষে ১০টি মামলা আছে। এত লোকের জায়গা জেলেও হবে না। তবে আমার কাছে একটি সূত্র আছে। আর সেটি হলো মানুষের মুখে ৩০-৩২টি দাঁত থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে নরম অংশ জিহ্বা কিন্তু অবাধে বিচরণ করে। দাঁতের ভয়ে জিব তার কাজ বন্ধ রাখে না।
প্রথম আলো :৫ জানুয়ারির আগেও এই জিবতত্ত্ব ছিল। আপনারা নির্বাচন ঠেকানো বা আন্দোলন—কোনোটিই পারেননি।
মির্জা আব্বাস :এ কথা সত্য নয়। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ ভোট বয়কট করেছে। শতভাগ প্রতিহত হয়েছে বলেই অবৈধ সরকার ১৫৩ আসনে ভোট করতে পারেনি।
প্রথম আলো :সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আপনার বিরোধের বিষয়ে বলুন?
মির্জা আব্বাস :বিরোধ নেই। কিছু সাংবাদিক এটি তৈরি করেছেন। গত ১৭-১৮ বছরে আমরা কেউ কারও সম্পর্কে মন্তব্য করিনি। তবে এক-এগারোর ঘটনায় কিছু ভূমিকা নিয়ে আমি তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছি। সেটা কাজকর্মের বিরোধিতা।
প্রথম আলো :কমিটি গঠনে তারেক রহমান কি ভূমিকা রাখবেন? তাঁর দেশে ফেরা?
মির্জা আব্বাস :তিনি তো কমিটি গঠনে খুব একটা হস্তক্ষেপ করেন না। আর স্বাস্থ্যগতভাবে তিনি এখনো ফিট নন। যখন ঠিক হবে, তখনই আসবেন। কেউ যদি মনে করেন, তিনি ফাঁকি দেওয়ার জন্য বসে আছেন, সেটা ঠিক নয়। আমার নেত্রী এখনো সম্পূর্ণ সামর্থ্য রাখেন। কোনো ঘাটতি নেই।
প্রথম আলো :তারেকের সঙ্গে আপনার সাম্প্রতিক কথোপকথন?
মির্জা আব্বাস :কীভাবে হবে? কোন ফোন দিয়ে হবে? সব ফোনেই তো সরকার আড়ি পেতে রাখে।
প্রথম আলো :সরকারের আশু করণীয় কী?
মির্জা আব্বাস :ঢাকাকে বাঁচাতে প্রশাসনিক দপ্তরগুলো সরিয়ে নিেত হবে। জনসভার জন্য স্থান নির্ধারণ ও মিছিলে বাধা বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগ যেভাবে সভা–সমাবেশ করেছে, সেটা বিএনপিরও প্রাপ্য।
প্রথম আলো :আপনাকে ধন্যবাদ
মির্জা আব্বাস :ধন্যবাদ।
প্রথম আলো :ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি কবে দিচ্ছেন?
মির্জা আব্বাস :১৮ বছর এ কমিটি নিষ্ক্রিয় ছিল। দু-তিনবারই আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে এবং একই ব্যক্তিরা এতে ছিলেন।
প্রথম আলো :কিন্তু এই কমিটি রেখেই তো আন্দোলন করেছেন, সরকারে এসেছেন।
মির্জা আব্বাস : বিএনপির সরকার গড়তে এই কমিটির ভূমিকা ছিল না।
প্রথম আলো :অতীতে আন্দোলনে বিএনপির অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের তুলনায় এই কমিটির ভূমিকা কেমন ছিল?
মির্জা আব্বাস :আমি মনে করি না তেমন ভূমিকা ছিল। দল সরকারে গেলে সাধারণত যত্নের অভাবে সংগঠন নষ্ট হয়। সেই দলের প্রধান যদি মন্ত্রী হন, তাহলে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
প্রথম আলো :জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?
মির্জা আব্বাস :তিনি ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর আমলে সংসদে বিএনপিবিরোধী বহু লোক নির্বাচিত হন এবং তাঁরা যথেষ্ট কথা বলার সুযোগ পান।
প্রথম আলো :১৫ আগস্টে জন্মদিন পালন, জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি বলা অনেক পরের ঘটনা। তিনি এসব বিতর্কমুক্ত ছিলেন, কিন্তু আপনারা তা আমদানি করলেন কেন?
মির্জা আব্বাস :সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিত ছিল একরকম। তখন যে প্রশ্ন ছিল না, সেই প্রশ্নগুলো পরে এসেছে। আমি তখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বিবেচনায় বিশেষ কতিপয় ব্যক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিলাম। সাহস করে বলেছিলাম, আমি তাদের সঙ্গে রাজনীতি করতে পারব না। জিয়ার অনন্য গুণ ছিল যে আমার সঙ্গে বিরোধিতা না করে বরং আশ্বস্ত করেছিলেন।
প্রথম আলো :ভিন্নমত প্রকাশে জিয়ার সঙ্গে যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন, সেটা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কতটুকু করছেন?
মির্জা আব্বাস :আপনি অন্য প্রশ্নে যাচ্ছেন। জিয়া বোঝালেন, তুমি নিশ্চয় আমার চেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা নও। এটা দেশ বিভক্তির সময় নয়। দেশকে বিভক্ত করে জাতিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। তাঁর এই কথা একটি সর্বকালীন সত্য। জিয়ার এই পরামর্শ চাইলে আজকের প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন।
প্রথম আলো :আপনি কি এর মাধ্যমে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দিকে ইঙ্গিত করছেন?
মির্জা আব্বাস :যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমি সাক্ষাৎকার দিচ্ছি না। আমি আমার নেতার কথা বলছি। অনেকে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার দৃষ্টান্ত দেন, বর্তমান সরকারও দেয়। দুই দেশেই ভালো-মন্দ আছে। তবে জাতি গঠনের দৃষ্টান্তের জন্য জিয়াউর রহমানের চেয়ে দ্বিতীয় উৎকৃষ্ট উদাহরণ আছে বলে মনে করি না।
প্রথম আলো :আপনাকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি বিশেষ সন্ধিক্ষণে চালকের আসনে বসানো হয়েছে। কী কৌশলে, কত তাড়াতাড়ি মিত্রদের সংগঠিত করে এই সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য করবেন, তেমন একটা চ্যালেঞ্জ আপনার সামনে?
মির্জা আব্বাস :আপনার প্রশ্নটা ব্যাখ্যামূলক। আপনিই তো সব বলে দিলেন।
প্রথম আলো :আপনি দলের একটি ব্যর্থতা ও হতাশার প্রেক্ষাপটে রাজধানীর হাল ধরেছেন?
মির্জা আব্বাস :নিজেকে সংগঠক মনে করি। ১৮ বছর যুবদলে থেকে অন্তত সাতবার কাউন্সিল করেছি। ১৯৭৮ সালে প্রথম গোপন ব্যালটে যুবদলের প্রেসিডেন্ট হলাম।
প্রথম আলো :ইতিহাসের ভালো পুনরাবৃত্তি কি দেখব? আপনি আহ্বায়ক থেকে গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হবেন?
মির্জা আব্বাস :না, আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাব না।
প্রথম আলো :কর্মীরা চাইলে সর্বস্তরে গোপন ব্যালটে হতে দেবেন, নাকি পকেট কমিটি চাপাবেন?
মির্জা আব্বাস :পকেট কমিটির প্রশ্নই আসে না। এর কোনো পথ খোলা নেই।
প্রথম আলো :কত দিনের মধ্যে কমিটি করবেন?
মির্জা আব্বাস :বলতে পারব না। তবে খুব সময় লাগবে না। আমি ২৪ ঘণ্টায় নয় ঘণ্টার বেশি কাজ করছি। ইতিমধ্যে বহু পদক্ষেপ নিয়েছি, যা এখন প্রকাশ করব না। ৫৩ সদস্যের কমিটির মধ্যে চারজনের সঙ্গে কথা বলে আমি সাধারণত সিদ্ধান্ত নিই।
প্রথম আলো :খালেদা জিয়ার করা কমিটি নিয়ে আপনার অভিযোগ কী? অভিমান করেছিলেন কি?
মির্জা আব্বাস :ঠিক অভিমান নয়। আমার মনে হয়েছিল যে বিষয়টি যেভাবে এসেছে, তা আমার জন্য সুবিধাজনক নয়। আমি ফেয়ার পলিটিকস করি। পেছনের দরজা দিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা কখনো করিনি।
প্রথম আলো :কিন্তু আপনার সমালোচকেরা বলে থাকেন যে সন্ত্রাসী ও মাস্তানেরা আপনার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।
মির্জা আব্বাস :আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমার হাত দিয়ে ঢাকায় বা বাংলাদেশে কোনো মাস্তান তৈরি হয়নি। ঢাকায় আমি যত দিন মিছিল করেছি, তাতে কোনো দিন বোমাবাজি হয়নি। একজন সন্ত্রাসীও সৃষ্টি করিনি।
প্রথম আলো :কথিতমতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ডা. ইকবালের মিছিল থেকে করা গুলিতে কতজন নিহত হয়েছিল এবং তাদের পরিবারের প্রতি কী কর্তব্য পালন করেছেন?
মির্জা আব্বাস :একজন মহিলা পথচারীসহ ছয়জন নিহত হন। এর মধ্যে চারজন বিএনপির কর্মী। তাদের পরিবারের পাশে সব সময় ছিলাম ও আছি।
প্রথম আলো :ক্ষমতায় গিয়ে তাঁদের জন্য কী করেছিলেন? প্রশ্নটি আপনার জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক, কারণ আপনি হাইকোর্টের আদেশে রাষ্ট্রের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন?
মির্জা আব্বাস :বাস্তবে নিইনি। সরকারকে জরিমানা করা হয়েছে জেনেই সন্তুষ্ট ছিলাম। না, নিহতদের পরিবারের জন্য সরকারিভাবে কিছু করা হয়নি।
প্রথম আলো :সাধারণ নির্বাচন কখন চান?
মির্জা আব্বাস :যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হওয়া উচিত। দেশের মানুষ দমবন্ধ অবস্থার অবসান চায়। আপনার পত্রিকা যদিও ভিন্নমতের, তবু বলব, আপনি রাস্তায় বেরিয়ে যাকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনিই সরকারের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করবেন।
প্রথম আলো :নির্বাচন ইস্যুতে প্রথম আলো কিন্তু সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে।
মির্জা আব্বাস :সেটা হয়েছেন। আবার অনেকের বিরুদ্ধে অযথা লিখেছেন।
প্রথম আলো :নির্দিষ্ট করে বলুন।
মির্জা আব্বাস :সত্য প্রকাশে প্রথম আলো হিম্মত রাখে। যখন করে না, তখন দুঃখ লাগে। আমি মন্ত্রী থাকতে রমনা পার্কে কিছু ইউক্যালিপটাস কাটা হলো। স্বাস্থ্যের জন্য এই গাছ মারাত্মক ক্ষতিকর। দিনে একটি গাছ সাড়ে সাত লিটার পানি শোষণ করে। অথচ এসব কারণ আপনার পত্রিকা লিখল না; বরং একটি বাজে কথাও ছাপা হলো। লিখে দিল, আমি নাকি বোমা মারার কথা বলেছি। এটা ছিল ডাহা মিথ্যা।
প্রথম আলো :আপনি প্রতিবাদ করে সঠিক বক্তব্য দিতে পারতেন।
মির্জা আব্বাস :দিয়েছিলাম। কিন্তু তা ছাপা হলো অনুল্লেখযোগ্যভাবে। আমি সব সময় বৃক্ষপ্রেমী ছিলাম। রমনা পার্কে আগে হাঁটতে যেতাম, গুপ্তহত্যা শুরুর পরে আর যাই না।
প্রথম আলো :এক-এগারোর দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি সমর্থন করে প্রথম আলো আপনাদের বিরাগভাজন হয়েছিল। ১৮ বাড়ি মামলায় রাষ্ট্রের ২০০ কোটির বেশি টাকা ক্ষতি করায় আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য। সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্য আমরা পেলে এখনো ছাপতে পারি।
মির্জা আব্বাস :এর ব্যাখ্যা দিয়েছি। জেলে যাওয়ার আগে কোন কোন পত্রিকা কখন কী কারণে আমার বিরুদ্ধে লিখেছে, সব বলেছি। কিন্তু আপনারা ছাপেননি।
প্রথম আলো :আপনি পূর্তমন্ত্রী হিসেবে কেন আগের সরকারের সিদ্ধান্ত রদ করেননি? ১৫টি বাড়ি বেচে দেওয়া কি অপরিহার্য ছিল?
মির্জা আব্বাস :এটা যদি আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন ভালো হবে। কারণ, এই বিক্রির প্রক্রিয়া তিনিই শুরু করে যান। তাঁর আমলেও সাবেক পাসপোর্ট অফিসসহ ১০টি বাড়ি বিক্রি হয়। মাত্র ১০ লাখ টাকায় কাঠা বিক্রি করেন। সেখানে আমি ২৭ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। ওই সময়ে গুলশানে ২০ লাখ টাকায় কাঠা বিক্রি হতো। ১৫টি বাড়ির ব্যাপারে যেভাবে তদবির আসতে শুরু করে, সেটা রাখা সম্ভব ছিল না। এগুলো কাজেও লাগছিল না। জাল দলিল করেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমি বাড়ি বেচে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার করেছি।
প্রথম আলো :২০০৮ সালে কেন নির্বাচন করেননি? কর ফাঁকির মামলায় দণ্ডজনিত অযোগ্যতার কারণেই?
মির্জা আব্বাস :না। অন্য কারণ ছিল। সেটা আমি বলব না। তবে দণ্ড থাকার কারণে নির্বাচন করিনি, সেটা ঠিক নয়।
প্রথম আলো :এখন বলুন, মামলার কী অবস্থা?
মির্জা আব্বাস :৪১টির বেশি মামলা বর্তমান সরকারই দিয়েছে। এর প্রায় ১২টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহের প্রায় সাত দিনই আদালতে হাজিরা দিই।
প্রথম আলো :মামলা সামলাবেন না আন্দোলন করবেন?
মির্জা আব্বাস :মামলা ছাড়া বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী নেই। নিচ থেকে মাথা পর্যন্ত প্রত্যেকের নামে কমপক্ষে ১০টি মামলা আছে। এত লোকের জায়গা জেলেও হবে না। তবে আমার কাছে একটি সূত্র আছে। আর সেটি হলো মানুষের মুখে ৩০-৩২টি দাঁত থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে নরম অংশ জিহ্বা কিন্তু অবাধে বিচরণ করে। দাঁতের ভয়ে জিব তার কাজ বন্ধ রাখে না।
প্রথম আলো :৫ জানুয়ারির আগেও এই জিবতত্ত্ব ছিল। আপনারা নির্বাচন ঠেকানো বা আন্দোলন—কোনোটিই পারেননি।
মির্জা আব্বাস :এ কথা সত্য নয়। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ ভোট বয়কট করেছে। শতভাগ প্রতিহত হয়েছে বলেই অবৈধ সরকার ১৫৩ আসনে ভোট করতে পারেনি।
প্রথম আলো :সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আপনার বিরোধের বিষয়ে বলুন?
মির্জা আব্বাস :বিরোধ নেই। কিছু সাংবাদিক এটি তৈরি করেছেন। গত ১৭-১৮ বছরে আমরা কেউ কারও সম্পর্কে মন্তব্য করিনি। তবে এক-এগারোর ঘটনায় কিছু ভূমিকা নিয়ে আমি তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছি। সেটা কাজকর্মের বিরোধিতা।
প্রথম আলো :কমিটি গঠনে তারেক রহমান কি ভূমিকা রাখবেন? তাঁর দেশে ফেরা?
মির্জা আব্বাস :তিনি তো কমিটি গঠনে খুব একটা হস্তক্ষেপ করেন না। আর স্বাস্থ্যগতভাবে তিনি এখনো ফিট নন। যখন ঠিক হবে, তখনই আসবেন। কেউ যদি মনে করেন, তিনি ফাঁকি দেওয়ার জন্য বসে আছেন, সেটা ঠিক নয়। আমার নেত্রী এখনো সম্পূর্ণ সামর্থ্য রাখেন। কোনো ঘাটতি নেই।
প্রথম আলো :তারেকের সঙ্গে আপনার সাম্প্রতিক কথোপকথন?
মির্জা আব্বাস :কীভাবে হবে? কোন ফোন দিয়ে হবে? সব ফোনেই তো সরকার আড়ি পেতে রাখে।
প্রথম আলো :সরকারের আশু করণীয় কী?
মির্জা আব্বাস :ঢাকাকে বাঁচাতে প্রশাসনিক দপ্তরগুলো সরিয়ে নিেত হবে। জনসভার জন্য স্থান নির্ধারণ ও মিছিলে বাধা বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগ যেভাবে সভা–সমাবেশ করেছে, সেটা বিএনপিরও প্রাপ্য।
প্রথম আলো :আপনাকে ধন্যবাদ
মির্জা আব্বাস :ধন্যবাদ।
No comments