পদ্মা সেতু প্রকল্প- আসুন, দুর্নীতির কাছে জিম্মি হই by এ কে এম জাকারিয়া

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের কাজ চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো পাবে কি না, তা নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রশ্ন তুলেছিলেন অর্থমন্ত্রী (সূত্র, দ্য ডেইলি স্টার, ৫ আগস্ট)। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি যে কীর্তিকলাপ করেছে এবং এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় যে খবর বের হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে চিন্তাভাবনা হোক, সেটাই চেয়েছিলেন তিনি। বৈঠকে এর যা জবাব মিলেছে তা অনেকটা এ রকম: নদীশাসনের কাজে প্রতিষ্ঠানটি অভিজ্ঞ, কোম্পানিটি বিশ্বব্যাংকের তালিকাভুক্ত এবং কাজের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই (বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ না মানলেও এই প্রতিষ্ঠানটির সার্টিফিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ)। চার লেন প্রকল্পে সিনোহাইড্রো তাদের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে পারেনি। কারণ, কিছু মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল সরানোর জন্য অনেক দেন-দরবার করতে হয়েছে এবং তা করতে গিয়ে দেরি হয়েছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সিনোহাইড্রোর কোনো মুখপাত্র বা স্থানীয় প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না, থাকারও কথা নয়। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীকে সম্ভবত সে কারণেই এই দায়িত্ব নিতে হলো! অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অসার প্রমাণ করতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এভাবেই যুক্তি দিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী। চীনের যে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করলেন আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী, তাদের কিছু কীর্তি-কলাপ পাঠকদের আবার নতুন করে মনে করিয়ে দিতে চাই।
১০ ভাগে বিভক্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন কাজের সাত ভাগ পেয়েছিল এই চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে। এখন ২০১৪ সালের আগস্ট মাস, সে হিসাবে নির্ধারিত সময়ের পর পার হয়ে গেছে দেড় বছর। এ সময়ে কাজের অগ্রগতি কী? অর্ধেকও শেষ হয়নি, এ বছরের মে মাস পর্যন্ত মাত্র শতকরা ৩৫ ভাগের কাছাকাছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের এই যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে গত বছরের অক্টোবর মাসে কাজ শেষ করার জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কাছে বাড়তি ৫১১ কোটি টাকা দাবি করে বসে সিনোহাইড্রো। শুধু দাবি নয়, দাবি আদায়ে চার মাস কাজও বন্ধ রাখে তারা। এর সঙ্গে ছিল এক অনানুষ্ঠানিক শর্ত; পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজ পেলে চার লেনের কাজ দ্রুত শেষ করে দেবে তারা। ‘জিম্মি’ করা বলতে আমরা যা বুঝি, এটা কি তার চেয়ে আলাদা কিছু?
এক হাজার ১৫১ কোটি টাকার প্রকল্পে বাড়তি ৫১১ কোটি টাকা দাবি! সমালোচকেরা বলেন, চীনা কোম্পানিগুলোর এটাই নাকি কৌশল! যেকোনোভাবে কাজ নাও, পরে নানা কৌশলে টাকাপয়সা বাড়িয়ে নাও! যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, অস্বাভাবিক কম দর দেখিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার কাজটি নিয়েছিল তারা। এখন দেখা যাচ্ছে, পদ্মা সেতুর নদীশাসনের কাজেও তাদের দরপত্র সবচেয়ে কম। শুরুতে যে দাম দিয়েছিল, শেষ সময়ে দরপত্র খোলার আগে চিঠি দিয়ে আরও ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রকল্পের কাজ পেতে যে কৌশল নিয়েছিল সিনোহাইড্রো, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও সম্ভবত একই পথ ধরেছে তারা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের কাজ পেতে দরপত্র জমা দিয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠান। সিনোহাইড্রো দর দিয়েছে আট হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাকি দুটির মধ্যে কোরীয় কোম্পানি হুন্দাই ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা ও বেলজিয়ামের জান ডে নাল ১৬ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকার দর প্রস্তাব দিয়েছে। সিনোহাইড্রো নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হুন্দাইয়ের চেয়ে চার হাজার কোটি টাকা কম দর দিয়েছে। এক হাজার ১৫১ কোটি টাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ নিয়ে যদি কোম্পানিটি ৫১১ কোটি টাকা বাড়তি দাবি করতে পারে, তবে আট হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রকল্পে কাজ শুরু করে পরে বাড়তি হাজার চারেক টাকা দাবি ও আদায় করে নেওয়া খুব কঠিন হবে বলে মনে হয় না।
আগে একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম এমন কিছু তথ্য, আবারও তুলে ধরছি। প্রাসঙ্গিক কি না তা বিবেচনার ভার পাঠকদের। আন্তর্জাতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির হালহকিকত নিয়ে মাঝেমধ্যে জরিপ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। প্রতিষ্ঠানটির ২০১১ সালের সর্বশেষ ‘ব্রাইব পেয়ার্স ইনডেক্স’-এ বিশ্বের ২৮টি দেশের কোম্পানিগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। বিদেশে কাজ পাওয়া নিয়ে ঘুষের লেনদেনে যে দেশের কোম্পানিগুলো সবচেয়ে এগিয়ে, এমন দুটি দেশের একটি হচ্ছে চীন। ২৮টি দেশের মধ্যে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান ২৭ নম্বরে।
যোগাযোগমন্ত্রীরা কেন জানি সরকারপ্রধানের বাড়তি সমর্থন ও আনুকূল্য পান। আবুল হোসেন যত দিন ছিলেন পেয়েছেন, এখন ওবায়দুল কাদের পাবেন, এটাই যেন স্বাভাবিক। মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুহিত-কাদের বিতর্কে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন গেছে ওবায়দুল কাদেরের দিকেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার জনগণের জন্য কাজ করে যাবে (সূত্র, দ্য ডেইলি স্টার, ৫ আগস্ট)। সবচেয়ে কম দরদাতা হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের কাজ চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রোর পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতই বলতে হচ্ছে।
অস্বাভাবিক কম খরচ দেখিয়ে কাজ নেওয়ার পর বাড়তি অর্থ দাবি, সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারা ও এক কাজ আটকে (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) রেখে অন্য কাজ (পদ্মা সেতুর নদীশাসন) পাওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া—এমন প্রতিষ্ঠানই সম্ভবত বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত! টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচকে দেশ হিসেবে একেবারে শেষের দিকে থাকা বাংলাদেশ ব্রাইব পেয়ার্স ইনডেক্সের সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উপযুক্ত হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! আসুন, আমরা চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে আবার জিম্মি হই। এখন যে দরে তারা কাজ নিয়েছে, সামনে তা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি থাকি। সেতু যেহেতু ‘নিজস্ব অর্থায়নে’ হবে, তাই ‘দাতা’ বা ‘উন্নয়ন–সহযোগীদের’ খবরদারি করারও কিছু থাকবে না। আর উন্নয়নের যে ‘জোয়ার’ বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, তা আপাতত থামার যেহেতু কোনো আশঙ্কা নেই, তাই সামনে পদ্মা সেতুর কাজ আটকে এর চেয়ে বড় কোনো প্রকল্পের কাজ পেতেও সিনোহাইড্রোর কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না! আসুন, দুর্নীতির কাছে আমরা জিম্মি হই।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.