কণ্ঠরোধের চেষ্টা
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। নীতিমালাকে একটি বিপদ হিসেবে অভিহিত করে তারা বলেছেন, এর মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশে সামরিক শাসন অথবা জরুরি অবস্থা জারি করা না হলেও গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। সম্প্রচার নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করে তারা বলেছেন, এ নীতিমালা নিয়ন্ত্রণমূলক। তা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করবে, গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। সম্পাদক পরিষদের আয়োজনে গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারা এ অভিমত দেন। তারা বলেন, সম্প্রচার নীতিমালার আলোকে সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে সম্পাদকদের আর কোন কাজ থাকবে না। এ নীতিমালা সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে নিরস্ত্র করার উদ্যোগ। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের সভাপতিত্বে আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় বেশির ভাগ আলোচকই গণমাধ্যমের জন্য কোন নীতিমালার প্রয়োজন নেই বলে মত দেন। তারা বলেন, নীতিমালা বা আচরণবিধি যদি করতেই হয় সাংবাদিকরা নিজেরাই তা প্রণয়ন করবে।
শুরুতে আলোচনা সভার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, সম্পাদক পরিষদ প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদকদের সংগঠন হলেও গণমাধ্যম বলতে আমরা ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট, অনলাইন সব ধরনের মিডিয়াকেই বুঝে থাকি। সম্প্রচার নীতিমালাকে আমরা স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম প্রসারের পরিপন্থি মনে করি। তিনি বলেন, গণমাধ্যম স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্জন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা কিছু অশুভ উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। জেলা প্রশাসকদের হাতে আগে পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা ছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অস্থায়ী সরকারের সময় আইন সংশোধন করে সে ক্ষমতা রহিত করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে সে ক্ষমতার পুনর্বহাল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের জন্যও আইন তৈরি হচ্ছে। আর পর্দার আড়াল থেকে সম্প্রচার নীতিমালা এরই মধ্যে সামনে এসে গেছে। মাহফুজ আনাম বলেন, কোন ধরনের নীতিমালা ছাড়াই আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ভাল কাজ করছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আমাদের সংবাদ মাধ্যম জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তাহলে নীতিমালার কেন প্রয়োজন হবে? আর বিদ্যমান আইনেই মিডিয়ার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ এলে তার বিচার সম্ভব। তিনি বলেন, নীতিমালায় কোন ইতিবাচক কথা নেই। একটি কথাই কেবল বলা হয়েছে পারবেন না, পারবেন না। এ নীতিমালার মাধ্যমে মিডিয়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, উন্নয়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। যে সব দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন সেসব দেশে দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা কমে যায়।
বিএফইউজে’র একাংশের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ শুধু নীতিমালাই নয়। গণমাধ্যমের সামনে আরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ওয়েজ বোর্ড, সময়মতো বেতন পরিশোধ এসবও গণমাধ্যমের জন্য চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা হঠাৎ করে আসেনি। দীর্ঘদিন থেকেই এ নিয়ে আলোচনা চলে আসছে। তিনি বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে আমরা চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম। টেলিভিশনের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চাকরির সুরক্ষা এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে জানিয়েছি সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে সংবাদ মাধ্যমের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে। কোন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা অথবা আমলাকে আমরা সম্প্রচার কমিশনে মেনে নেবো না। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সম্পাদকীয় নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। ডেইলি স্টার, প্রথম আলো এবং ভোরের কাগজের সম্পাদকীয় নীতিমালা এক হবে না। এটাই স্বাভাবিক।
বিএফইউজে’র অপরাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, মাহফুজ আনাম যে বক্তব্য রেখেছেন আমি তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। সম্প্রচার নীতিমালা স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি এক ধরনের বিদ্রূপ। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গণমাধ্যমের সংঘাত ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। আর গণমাধ্যম সবসময়ই জনগণের পক্ষে ছিল। তিনি বলেন, আমরা কখনও গণমাধ্যমের জন্য কোন নীতিমালা চাইনি। কারণ আমরা জানতাম কার হাতে নীতিমালা গেলে কি হবে। এ নীতিমালা বাতিল করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা নেই। কিন্তু ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হিসেবেই স্বীকৃত।
টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সংগঠন-এটকো’র সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল আই’র পরিচালক (বার্তা) শাইখ সিরাজ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা মতামত দিয়েছিলাম। একটি বৈঠকে আমরা যোগ দিয়েছি। আমাদের কিছু মতামত গ্রহণ করা হয়েছে, কিছু মতামত গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু আমাদেরকে বাইপাস করেই মন্ত্রিসভায় নীতিমালা উত্থাপন করা হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর আমাদেরকে তা দেখানো হয়নি। তিনি বলেন, মানুষকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে টেলিভিশন ঈর্ষণীয় সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, অংশীজনদের মতামত নেয়ার কৌশল কার্যকর না করেই এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। যারা সরকারকে এ কাজটি করতে উৎসাহিত করেছেন তারা সরকারের বন্ধু নন। এর মাধ্যমে তারা সরকারের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন আপনারা সবাই মিলেও তা করতে পারবেন না। সরকারকে যারা এ বুদ্ধি দিয়েছে সে উপদেষ্টাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তারা আসলেই উপদেষ্টা থাকার যোগ্য কিনা তা-ও দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, নীতিমালায় বলা হয়েছে সংবাদমাধ্যমের জবাবদিহি নিশ্চিত করে সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ধরনের কথা পৃথিবীতে আর কোনদিন হয়তো শোনা যায়নি। তিনি নিজেদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করার জন্য সম্পাদক পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা ছাড়াও গণমাধ্যমের জন্য আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালা প্রয়োজন কিনা এ নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। যেহেতু গণমাধ্যমগুলো নিজেদের জন্য কোন নীতিমালা প্রণয়ন করেনি তাই তথ্য মন্ত্রণালয় সুযোগ পেয়ে একটি নীতিমালা চাপিয়ে দিয়েছে। নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা এমনিতেই অনেক বিপদের মধ্যে রয়েছি। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা একটি বিপদ এবং আপদ। আশার কথা হচ্ছে সম্পাদক পরিষদ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। গণমাধ্যমের ওপর যে আক্রমণ আসছে তার একটি কারণ সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য নেই। তাদের বিভাজন অত্যন্ত দুঃখজনক। পাকিস্তান আমলেও দেখা গেছে, করাচি থেকে কক্সবাজার-সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। সে সময় সাংবাদিকরা যতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করেছেন তা তাদের ঐক্যের কারণেই পেরেছেন। তিনি বলেন, দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি, সামরিক শাসন জারি করা হয়নি। অথচ গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে, কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনিতেই আমাদের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। মালিক, সরকার, বিজ্ঞাপনদাতাদের দ্বারা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। এখন নতুন করে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল গণমাধ্যম। সে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ১১৫ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। ইংরেজ কবি জন মিল্টন তার সমর্থনপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছিলেন। কারণ সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের চিন্তা করার স্বাধীনতা। তিনি বলেন, এখন জনগণকে ভয়ঙ্কর মনে করা হচ্ছে। এ কারণে ভয়ঙ্কর নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
গোলাম সারওয়ার বলেন, সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে তা নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। তথ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, এটা ঠিক নীতিমালা নয়, একটা গাইডলাইন। উনি টিভি চ্যানেলগুলোকে স্পষ্ট করে বললেই হয় বিটিভি যেভাবে চলছে আপনারা সেভাবেই চলুন। স্বাধীন গণমাধ্যমের উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের গণমাধ্যমের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতারা সরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। ১৯৯১ সালের পর আমরা যে শক্তিশালী গণতন্ত্র পেয়েছি তা গণমাধ্যমের কারণেই সম্ভবপর হয়েছে। যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে সম্প্রচার কমিশন গঠনের দাবি রেখে তিনি বলেন, আমাদের দেশে কমিশনের নামে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে থাকে। তাই একজন যোগ্য ব্যক্তির সমন্বয়ে কমিশন গঠন করে তার মাধ্যমে একটা নীতিমালা হতে পারে। গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়বদ্ধতাও আছে। পত্রিকা, টিভিতে অনেক সময় ভুল তথ্য পরিবেশন হওয়ার সুযোগ থাকে। এগুলো সংশোধন করা দরকার। গণমাধ্যমগুলোর নিজেদের উদ্যোগে একটি আচরণবিধি তৈরি করার আহ্বান জানান তিনি।
সম্প্রচার নীতির ত্রুটির কারণে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে উল্লেখ করে এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নী সাহা বলেন, এতে নতুন প্রজন্ম উৎসাহিত হয়েছে। তিনি গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সকলকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা গণমাধ্যমের জন্য সহায়ক নয় এটা স্পষ্ট। এই নীতিমালা বাতিল করা হোক। নীতিমালা যদি করতেই হয় তবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যক্তির নেতৃত্বে সম্প্রচার কমিশন গঠন করে অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা নীতিমালা করতে হবে।
এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ. ই. মামুন বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের জন্য একটা নীতিমালা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যে সম্প্রচার নীতিমালা তা সংবিধানের ওই নীতিমালার বিস্তারিত রূপ। এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের জন্য তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, এই নীতিমালার উদ্দেশ্য গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ নয়। সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চাইলে পুরাতন আইন দিয়েই করতে পারে। এরকম অনেক আইন আছে। নীতিমালার অনেকগুলো অংশের ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। তবে স্বাধীনতার সীমাটাও বিতর্কের মাধ্যমে নির্ধারণ করা দরকার।
একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু সম্প্রচার নীতিমালার বিপক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, যার টাকা ও যোগ্যতা আছে সে টেলিভিশনের লাইসেন্স পাবে। ভাল-মন্দ জনগণ বিচার করবে। শুধু বিশেষ কোন বাহিনী নয়, যে কাউকেই কটাক্ষ করার অধিকার গণমাধ্যমের নেই। এই নীতিমালা শুধু গণমাধ্যম নয় পুরো বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যম জনগণের অধিকার নিশ্চিত করে। গণমাধ্যমের অধিকার খর্ব হলে নাগরিক অধিকার খর্ব হয়। সম্প্রচার নীতিমালাকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যমান কিছু আইনের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক হবে। নীতিমালার বাক্য গঠনে কিছু কপটতা ও ছলনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এই নীতিমালার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানে কমিশনের ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলেন, নীতিমালা অনুসারে কমিশন শুধু লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশ করতে পারবে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবে মন্ত্রণালয়।
মাছরাঙা টেলিভিশনের চিফ এডিটর সৈয়দ ফাহিম মুনএম বলেন, আমরা কিভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করবো এটা অন্যরা বলে দেবে- আমরা বিষয়টি নিয়ে লজ্জিত। সরকার নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিটি হাউজে নীতিমালা রয়েছে বলে জানা নেই। এটার কোন প্রয়োজনও নেই। দেশের প্রচলিত আইনকেই নীতিমালা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
নিউজ টুডে পত্রিকার সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা দিয়ে গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছে। এর নিচে পর্বত অপেক্ষা করছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে আইন করে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে। এটাকে নীতিমালা বলা যায় না। এটা গণমাধ্যমের জন্য একটা ভীতিমালা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমরা যেন সেলফ সেন্সরশিপ গ্রহণ করি সে উদ্দেশ্যেই এটা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য নীতিমালা করছে দাবি করে তিনি বলেন, এই নীতিমালা দেশকে গণতন্ত্রহীনতার দিকে নিয়ে যাবে। এটাকে প্রতিরোধ করতে হবে।
[গত ৪ঠা আগস্ট মন্ত্রিসভা সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন করে। পরে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।]
শুরুতে আলোচনা সভার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, সম্পাদক পরিষদ প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদকদের সংগঠন হলেও গণমাধ্যম বলতে আমরা ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট, অনলাইন সব ধরনের মিডিয়াকেই বুঝে থাকি। সম্প্রচার নীতিমালাকে আমরা স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম প্রসারের পরিপন্থি মনে করি। তিনি বলেন, গণমাধ্যম স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্জন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা কিছু অশুভ উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। জেলা প্রশাসকদের হাতে আগে পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা ছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অস্থায়ী সরকারের সময় আইন সংশোধন করে সে ক্ষমতা রহিত করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে সে ক্ষমতার পুনর্বহাল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের জন্যও আইন তৈরি হচ্ছে। আর পর্দার আড়াল থেকে সম্প্রচার নীতিমালা এরই মধ্যে সামনে এসে গেছে। মাহফুজ আনাম বলেন, কোন ধরনের নীতিমালা ছাড়াই আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ভাল কাজ করছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আমাদের সংবাদ মাধ্যম জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তাহলে নীতিমালার কেন প্রয়োজন হবে? আর বিদ্যমান আইনেই মিডিয়ার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ এলে তার বিচার সম্ভব। তিনি বলেন, নীতিমালায় কোন ইতিবাচক কথা নেই। একটি কথাই কেবল বলা হয়েছে পারবেন না, পারবেন না। এ নীতিমালার মাধ্যমে মিডিয়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, উন্নয়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। যে সব দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন সেসব দেশে দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা কমে যায়।
বিএফইউজে’র একাংশের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ শুধু নীতিমালাই নয়। গণমাধ্যমের সামনে আরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ওয়েজ বোর্ড, সময়মতো বেতন পরিশোধ এসবও গণমাধ্যমের জন্য চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা হঠাৎ করে আসেনি। দীর্ঘদিন থেকেই এ নিয়ে আলোচনা চলে আসছে। তিনি বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে আমরা চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলাম। টেলিভিশনের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চাকরির সুরক্ষা এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে জানিয়েছি সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে সংবাদ মাধ্যমের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে। কোন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা অথবা আমলাকে আমরা সম্প্রচার কমিশনে মেনে নেবো না। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সম্পাদকীয় নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। ডেইলি স্টার, প্রথম আলো এবং ভোরের কাগজের সম্পাদকীয় নীতিমালা এক হবে না। এটাই স্বাভাবিক।
বিএফইউজে’র অপরাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, মাহফুজ আনাম যে বক্তব্য রেখেছেন আমি তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। সম্প্রচার নীতিমালা স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি এক ধরনের বিদ্রূপ। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গণমাধ্যমের সংঘাত ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। আর গণমাধ্যম সবসময়ই জনগণের পক্ষে ছিল। তিনি বলেন, আমরা কখনও গণমাধ্যমের জন্য কোন নীতিমালা চাইনি। কারণ আমরা জানতাম কার হাতে নীতিমালা গেলে কি হবে। এ নীতিমালা বাতিল করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা নেই। কিন্তু ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হিসেবেই স্বীকৃত।
টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সংগঠন-এটকো’র সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল আই’র পরিচালক (বার্তা) শাইখ সিরাজ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা মতামত দিয়েছিলাম। একটি বৈঠকে আমরা যোগ দিয়েছি। আমাদের কিছু মতামত গ্রহণ করা হয়েছে, কিছু মতামত গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু আমাদেরকে বাইপাস করেই মন্ত্রিসভায় নীতিমালা উত্থাপন করা হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর আমাদেরকে তা দেখানো হয়নি। তিনি বলেন, মানুষকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে টেলিভিশন ঈর্ষণীয় সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, অংশীজনদের মতামত নেয়ার কৌশল কার্যকর না করেই এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। যারা সরকারকে এ কাজটি করতে উৎসাহিত করেছেন তারা সরকারের বন্ধু নন। এর মাধ্যমে তারা সরকারের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন আপনারা সবাই মিলেও তা করতে পারবেন না। সরকারকে যারা এ বুদ্ধি দিয়েছে সে উপদেষ্টাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তারা আসলেই উপদেষ্টা থাকার যোগ্য কিনা তা-ও দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, নীতিমালায় বলা হয়েছে সংবাদমাধ্যমের জবাবদিহি নিশ্চিত করে সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ধরনের কথা পৃথিবীতে আর কোনদিন হয়তো শোনা যায়নি। তিনি নিজেদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করার জন্য সম্পাদক পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা ছাড়াও গণমাধ্যমের জন্য আরও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালা প্রয়োজন কিনা এ নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। যেহেতু গণমাধ্যমগুলো নিজেদের জন্য কোন নীতিমালা প্রণয়ন করেনি তাই তথ্য মন্ত্রণালয় সুযোগ পেয়ে একটি নীতিমালা চাপিয়ে দিয়েছে। নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা এমনিতেই অনেক বিপদের মধ্যে রয়েছি। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা একটি বিপদ এবং আপদ। আশার কথা হচ্ছে সম্পাদক পরিষদ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। গণমাধ্যমের ওপর যে আক্রমণ আসছে তার একটি কারণ সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য নেই। তাদের বিভাজন অত্যন্ত দুঃখজনক। পাকিস্তান আমলেও দেখা গেছে, করাচি থেকে কক্সবাজার-সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। সে সময় সাংবাদিকরা যতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করেছেন তা তাদের ঐক্যের কারণেই পেরেছেন। তিনি বলেন, দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি, সামরিক শাসন জারি করা হয়নি। অথচ গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে, কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনিতেই আমাদের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। মালিক, সরকার, বিজ্ঞাপনদাতাদের দ্বারা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। এখন নতুন করে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল গণমাধ্যম। সে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ১১৫ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। ইংরেজ কবি জন মিল্টন তার সমর্থনপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছিলেন। কারণ সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের চিন্তা করার স্বাধীনতা। তিনি বলেন, এখন জনগণকে ভয়ঙ্কর মনে করা হচ্ছে। এ কারণে ভয়ঙ্কর নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
গোলাম সারওয়ার বলেন, সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে তা নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। তথ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন, এটা ঠিক নীতিমালা নয়, একটা গাইডলাইন। উনি টিভি চ্যানেলগুলোকে স্পষ্ট করে বললেই হয় বিটিভি যেভাবে চলছে আপনারা সেভাবেই চলুন। স্বাধীন গণমাধ্যমের উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের গণমাধ্যমের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতারা সরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। ১৯৯১ সালের পর আমরা যে শক্তিশালী গণতন্ত্র পেয়েছি তা গণমাধ্যমের কারণেই সম্ভবপর হয়েছে। যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে সম্প্রচার কমিশন গঠনের দাবি রেখে তিনি বলেন, আমাদের দেশে কমিশনের নামে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে থাকে। তাই একজন যোগ্য ব্যক্তির সমন্বয়ে কমিশন গঠন করে তার মাধ্যমে একটা নীতিমালা হতে পারে। গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়বদ্ধতাও আছে। পত্রিকা, টিভিতে অনেক সময় ভুল তথ্য পরিবেশন হওয়ার সুযোগ থাকে। এগুলো সংশোধন করা দরকার। গণমাধ্যমগুলোর নিজেদের উদ্যোগে একটি আচরণবিধি তৈরি করার আহ্বান জানান তিনি।
সম্প্রচার নীতির ত্রুটির কারণে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে উল্লেখ করে এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নী সাহা বলেন, এতে নতুন প্রজন্ম উৎসাহিত হয়েছে। তিনি গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সকলকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা গণমাধ্যমের জন্য সহায়ক নয় এটা স্পষ্ট। এই নীতিমালা বাতিল করা হোক। নীতিমালা যদি করতেই হয় তবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যক্তির নেতৃত্বে সম্প্রচার কমিশন গঠন করে অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা নীতিমালা করতে হবে।
এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ. ই. মামুন বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে গণমাধ্যমের জন্য একটা নীতিমালা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে যে সম্প্রচার নীতিমালা তা সংবিধানের ওই নীতিমালার বিস্তারিত রূপ। এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের জন্য তিনি সংবিধান বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য এজেএম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, এই নীতিমালার উদ্দেশ্য গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ নয়। সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চাইলে পুরাতন আইন দিয়েই করতে পারে। এরকম অনেক আইন আছে। নীতিমালার অনেকগুলো অংশের ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। তবে স্বাধীনতার সীমাটাও বিতর্কের মাধ্যমে নির্ধারণ করা দরকার।
একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু সম্প্রচার নীতিমালার বিপক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, যার টাকা ও যোগ্যতা আছে সে টেলিভিশনের লাইসেন্স পাবে। ভাল-মন্দ জনগণ বিচার করবে। শুধু বিশেষ কোন বাহিনী নয়, যে কাউকেই কটাক্ষ করার অধিকার গণমাধ্যমের নেই। এই নীতিমালা শুধু গণমাধ্যম নয় পুরো বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যম জনগণের অধিকার নিশ্চিত করে। গণমাধ্যমের অধিকার খর্ব হলে নাগরিক অধিকার খর্ব হয়। সম্প্রচার নীতিমালাকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যমান কিছু আইনের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক হবে। নীতিমালার বাক্য গঠনে কিছু কপটতা ও ছলনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এই নীতিমালার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানে কমিশনের ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলেন, নীতিমালা অনুসারে কমিশন শুধু লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশ করতে পারবে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবে মন্ত্রণালয়।
মাছরাঙা টেলিভিশনের চিফ এডিটর সৈয়দ ফাহিম মুনএম বলেন, আমরা কিভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করবো এটা অন্যরা বলে দেবে- আমরা বিষয়টি নিয়ে লজ্জিত। সরকার নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিটি হাউজে নীতিমালা রয়েছে বলে জানা নেই। এটার কোন প্রয়োজনও নেই। দেশের প্রচলিত আইনকেই নীতিমালা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
নিউজ টুডে পত্রিকার সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা দিয়ে গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছে। এর নিচে পর্বত অপেক্ষা করছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে আইন করে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে। এটাকে নীতিমালা বলা যায় না। এটা গণমাধ্যমের জন্য একটা ভীতিমালা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমরা যেন সেলফ সেন্সরশিপ গ্রহণ করি সে উদ্দেশ্যেই এটা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য নীতিমালা করছে দাবি করে তিনি বলেন, এই নীতিমালা দেশকে গণতন্ত্রহীনতার দিকে নিয়ে যাবে। এটাকে প্রতিরোধ করতে হবে।
[গত ৪ঠা আগস্ট মন্ত্রিসভা সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন করে। পরে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।]
No comments