দেশীয় কয়লা ও গ্যাস ব্যবহার নিশ্চিত করুন -বিশেষ সাক্ষাৎকারে ম. তামিম -সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
সরকার সম্প্রতি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির
দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ) আইন’–এর মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানের উদ্যোগ
নিয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরিপন্থী এই আইনের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ
নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ও সামগ্রিকভাবে দেশের বিদ্যুৎ খাত
নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল
বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার
জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম।
প্রথম আলো
: দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার যে জরুরি আইন করেছে, চার বছর কার্যকর
থাকার পর সম্প্রতি সরকার এর মেয়াদ আরও চার বছর বাড়িয়েছে। এটাকে কতটুকু
যৌক্তিক বলে মনে করেন?
ম. তামিম : সরকার এক বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রথমে দুই বছরের জন্য এই আইন করেছিল, পরে আরও দুই বছর বাড়িয়েছে। এটুকু হয়তো ঠিকই ছিল, কিন্তু নতুন করে এই আইনের মেয়াদ বাড়ানোর কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কারণ, যে বিশেষ বা জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এই আইন করা হয়েছিল, তা এখন আর নেই। এই আইনের মূল ব্যাপারটি ছিল টেন্ডার এড়ানো, সময় বাঁচানো। এই বিষয়গুলো এখনো কার্যকর থাকার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ, এখন সরকারের সামনে একটি পরিকল্পনা আছে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী টেন্ডার ডেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে কাজ দিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই জরুরি আইনের মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে মনে করি না।
প্রথম আলো : চার বছর ধরে যে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ) আইন’ কার্যকর রয়েছে, এর প্রয়োজনীয়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? বিদ্যুৎ খাতে এর কী সুফল পাওয়া গেছে?
ম. তামিম : ২০০৯-১০ সালে দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি যখন চরমে পৌঁছায়, তখন দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই আইন করা হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল টেন্ডারে দীর্ঘসূত্রতা এড়ানো। তখন বিদ্যুৎ খাতে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তা সামাল দিতে এই আইন কাজ দিয়েছে। সরকারের পক্ষে দ্রুত অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
প্রথম আলো : কিন্তু এ ধরনের আইন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরিপন্থী। কারণ, কাজ দিতে হয় টেন্ডার ছাড়া এবং এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না।
ম. তামিম : এ ধরনের আইনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে, তা সত্যি। এ ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতার বিষয়টি শুরু থেকেই উপেক্ষিত ছিল। তবে আমি মনে করি, সরকার একটি ভালো কাজ করেছে এবং তা হচ্ছে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ—এই দুই ক্ষেত্রেই ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা গাইডলাইন মেনে কাজ করেছে। ফলে, দামের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম হওয়ার সুযোগ কম ছিল।
প্রথম আলো : তাহলে অনিয়ম হয়েছে কোথায়?
ম. তামিম :আসলে কাকে কাজ দেওয়া হবে, সে ক্ষেত্রে অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু দামের ক্ষেত্রে হয়নি। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে, যাদের হয়তো কাজ করার যোগ্যতা নেই। বর্তমান সরকারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর অনেকগুলো সফল হয়নি। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ উৎপাদনে আসতে পারেনি বা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার জন্য যদি যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেত, তবে শুধু প্রকৃত ও যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পাওয়ার জন্য এগিয়ে আসত।
প্রথম আলো : কিন্তু কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার শর্তটি তো আপনি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তখনই বাদ দেওয়া হয়েছে।
ম. তামিম : আমরা তখন কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার শর্তটি বাদ দিয়েছিলাম। কারণ, আমরা চেয়েছিলাম এই খাতে দেশীয় নতুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসুক। এই বিবেচনা থেকেই তখন তা করা হয়েছিল। আমরা যখন এই শর্ত বাদ দিয়েছিলাম, তখন হয়তো এর যথার্থতা ছিল। কিন্তু আমি মনে করি, এরপর এখন ছয় বছর কেটে গেছে, ফলে এখন উচিত অভিজ্ঞতার শর্তটি জুড়ে দেওয়া। এই সময়ে যে কোম্পানিগুলো ভালো করেছে, যাদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো, নতুন কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরই বিবেচনায় রাখা উচিত। সেটা না পাওয়া গেলে অভিজ্ঞ বাইরের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া উচিত।
প্রথম আলো : এই আইনের অধীনে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া গেছে, কিন্তু বিদ্যুতের যে দাম পড়ছে, তেল আমদানিতে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সেই চাপ বাংলাদেশ কত দিন নিতে পারবে?
ম. তামিম : দেখুন, কুইক রেন্টালের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ও জরুরি ভিত্তিতে বিদ্ু্যৎ উৎপাদন। এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার নয়। তিন-চার বছরের ব্যাপার। আর কোনো দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এর ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। সরকার জরুরি পরিস্থিতিতে এই উদ্যোগ নিয়েছিল এবং পরিকল্পনা ছিল যে এই সময়ের মধ্যে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। দেশীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু যে গতিতে হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। কুইক রেন্টাল ও বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ—এ দুটি একই সঙ্গে শুরু হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ছিল তিন থেকে পাঁচ বছর। এগুলোর মেয়াদ এখন বাড়াতে হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়তির দিকেই থাকবে সামনের দিনগুলোয় এবং তেলভিত্তিক বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৮ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। সেটা হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিকে এই চাপ নিতে হবে।
প্রথম আলো : বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সরকার যে নীতি নিয়েছে, সেখানে কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করেন কি?
ম. তামিম : দেখুন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানিসংকট। তেলনির্ভর বিদু্যৎ উৎপাদন কোনোভাবেই টেকসই নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অব্যাহত তেলনির্ভরতা আমাদের অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করবে, অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যানবাহনের জন্য তেলনির্ভরতা ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশের অর্থনীতি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন তেলের ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের সামনে এ ক্ষেত্রে যে বিকল্প রয়েছে, তা হচ্ছে নিজস্ব গ্যাস, আমদানি করা গ্যাস, নিজস্ব কয়লা, আমদানি করা কয়লা। বর্তমানে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে। সবকিছু ঠিকমতো চললে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের পর এই কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ আসতে পারে। বড়পুকুরিয়ায় ওপেন পিট মাইনিংয়ের মাধ্যমে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা শোনা গিয়েছিল, কিন্তু এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি শূন্য।
প্রথম আলো : নিজেদের গ্যাস বা আমদানি করা গ্যাস?
ম. তামিম : গ্যাস বা এলএনজি আমদানির একটি উদ্যোগ রয়েছে, কিন্তু এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই ব্যয়বহুল হবে। বাড়িঘরে, যানবাহনের সিএনজি হিসেবে ব্যবহার বা অন্যান্য কাজে এই গ্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম এই পর্যায়ে বাড়ানো উচিত, যাতে তা এলপিজি বা পেট্রলের দামের কাছাকাছি হয়। এ ক্ষেত্রে ভারত বা অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এই গ্যাস কীভাবে ব্যবহার করা আমাদের জন্য কার্যকর হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত সমীক্ষা দরকার। আর নিজেদের গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর তো কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানের উদ্যোগ জোরদার করার পাশাপাশি ভূখণ্ডে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। আমি মনে করি, বাপেক্স যদি সম্ভাবনাময় কোনো ব্লক বা অঞ্চল নিজেদের জন্য রাখতে চায়, তা রেখে বাকি সব বিদেশি কোম্পানির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। দেশীয় কয়লা বা গ্যাস ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সমস্যা থেকেই যাবে।
ম. তামিম : সরকার এক বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রথমে দুই বছরের জন্য এই আইন করেছিল, পরে আরও দুই বছর বাড়িয়েছে। এটুকু হয়তো ঠিকই ছিল, কিন্তু নতুন করে এই আইনের মেয়াদ বাড়ানোর কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কারণ, যে বিশেষ বা জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এই আইন করা হয়েছিল, তা এখন আর নেই। এই আইনের মূল ব্যাপারটি ছিল টেন্ডার এড়ানো, সময় বাঁচানো। এই বিষয়গুলো এখনো কার্যকর থাকার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ, এখন সরকারের সামনে একটি পরিকল্পনা আছে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী টেন্ডার ডেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে কাজ দিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই জরুরি আইনের মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে মনে করি না।
প্রথম আলো : চার বছর ধরে যে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ) আইন’ কার্যকর রয়েছে, এর প্রয়োজনীয়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? বিদ্যুৎ খাতে এর কী সুফল পাওয়া গেছে?
ম. তামিম : ২০০৯-১০ সালে দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি যখন চরমে পৌঁছায়, তখন দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই আইন করা হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল টেন্ডারে দীর্ঘসূত্রতা এড়ানো। তখন বিদ্যুৎ খাতে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তা সামাল দিতে এই আইন কাজ দিয়েছে। সরকারের পক্ষে দ্রুত অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
প্রথম আলো : কিন্তু এ ধরনের আইন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরিপন্থী। কারণ, কাজ দিতে হয় টেন্ডার ছাড়া এবং এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না।
ম. তামিম : এ ধরনের আইনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে, তা সত্যি। এ ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতার বিষয়টি শুরু থেকেই উপেক্ষিত ছিল। তবে আমি মনে করি, সরকার একটি ভালো কাজ করেছে এবং তা হচ্ছে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ—এই দুই ক্ষেত্রেই ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা গাইডলাইন মেনে কাজ করেছে। ফলে, দামের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম হওয়ার সুযোগ কম ছিল।
প্রথম আলো : তাহলে অনিয়ম হয়েছে কোথায়?
ম. তামিম :আসলে কাকে কাজ দেওয়া হবে, সে ক্ষেত্রে অনিয়ম ও রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু দামের ক্ষেত্রে হয়নি। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে, যাদের হয়তো কাজ করার যোগ্যতা নেই। বর্তমান সরকারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর অনেকগুলো সফল হয়নি। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ উৎপাদনে আসতে পারেনি বা ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার জন্য যদি যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেত, তবে শুধু প্রকৃত ও যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পাওয়ার জন্য এগিয়ে আসত।
প্রথম আলো : কিন্তু কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার শর্তটি তো আপনি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তখনই বাদ দেওয়া হয়েছে।
ম. তামিম : আমরা তখন কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার শর্তটি বাদ দিয়েছিলাম। কারণ, আমরা চেয়েছিলাম এই খাতে দেশীয় নতুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসুক। এই বিবেচনা থেকেই তখন তা করা হয়েছিল। আমরা যখন এই শর্ত বাদ দিয়েছিলাম, তখন হয়তো এর যথার্থতা ছিল। কিন্তু আমি মনে করি, এরপর এখন ছয় বছর কেটে গেছে, ফলে এখন উচিত অভিজ্ঞতার শর্তটি জুড়ে দেওয়া। এই সময়ে যে কোম্পানিগুলো ভালো করেছে, যাদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো, নতুন কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরই বিবেচনায় রাখা উচিত। সেটা না পাওয়া গেলে অভিজ্ঞ বাইরের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া উচিত।
প্রথম আলো : এই আইনের অধীনে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া গেছে, কিন্তু বিদ্যুতের যে দাম পড়ছে, তেল আমদানিতে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সেই চাপ বাংলাদেশ কত দিন নিতে পারবে?
ম. তামিম : দেখুন, কুইক রেন্টালের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ও জরুরি ভিত্তিতে বিদ্ু্যৎ উৎপাদন। এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার নয়। তিন-চার বছরের ব্যাপার। আর কোনো দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন এর ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। সরকার জরুরি পরিস্থিতিতে এই উদ্যোগ নিয়েছিল এবং পরিকল্পনা ছিল যে এই সময়ের মধ্যে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। দেশীয় কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু যে গতিতে হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। কুইক রেন্টাল ও বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ—এ দুটি একই সঙ্গে শুরু হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ছিল তিন থেকে পাঁচ বছর। এগুলোর মেয়াদ এখন বাড়াতে হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়তির দিকেই থাকবে সামনের দিনগুলোয় এবং তেলভিত্তিক বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৮ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। সেটা হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিকে এই চাপ নিতে হবে।
প্রথম আলো : বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সরকার যে নীতি নিয়েছে, সেখানে কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করেন কি?
ম. তামিম : দেখুন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানিসংকট। তেলনির্ভর বিদু্যৎ উৎপাদন কোনোভাবেই টেকসই নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অব্যাহত তেলনির্ভরতা আমাদের অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করবে, অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যানবাহনের জন্য তেলনির্ভরতা ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশের অর্থনীতি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন তেলের ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের সামনে এ ক্ষেত্রে যে বিকল্প রয়েছে, তা হচ্ছে নিজস্ব গ্যাস, আমদানি করা গ্যাস, নিজস্ব কয়লা, আমদানি করা কয়লা। বর্তমানে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে। সবকিছু ঠিকমতো চললে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের পর এই কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ আসতে পারে। বড়পুকুরিয়ায় ওপেন পিট মাইনিংয়ের মাধ্যমে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা শোনা গিয়েছিল, কিন্তু এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি শূন্য।
প্রথম আলো : নিজেদের গ্যাস বা আমদানি করা গ্যাস?
ম. তামিম : গ্যাস বা এলএনজি আমদানির একটি উদ্যোগ রয়েছে, কিন্তু এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই ব্যয়বহুল হবে। বাড়িঘরে, যানবাহনের সিএনজি হিসেবে ব্যবহার বা অন্যান্য কাজে এই গ্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম এই পর্যায়ে বাড়ানো উচিত, যাতে তা এলপিজি বা পেট্রলের দামের কাছাকাছি হয়। এ ক্ষেত্রে ভারত বা অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এই গ্যাস কীভাবে ব্যবহার করা আমাদের জন্য কার্যকর হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত সমীক্ষা দরকার। আর নিজেদের গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর তো কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানের উদ্যোগ জোরদার করার পাশাপাশি ভূখণ্ডে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। আমি মনে করি, বাপেক্স যদি সম্ভাবনাময় কোনো ব্লক বা অঞ্চল নিজেদের জন্য রাখতে চায়, তা রেখে বাকি সব বিদেশি কোম্পানির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। দেশীয় কয়লা বা গ্যাস ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সমস্যা থেকেই যাবে।
No comments