নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণার আবেদন হাইকোর্টে
রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার জন্য
সেনাবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। এ জন্য
তাকে অযোগ্য ঘোষণার জন্য লাহোর হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে গতকাল। রাজনৈতিক
সমস্যা সমাধানে তিনি সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে কার্যত তিনি
কর্তৃত্ব তুলে দিয়েছেন সেনাপ্রধানের হাতে। পাকিস্তানে দীর্ঘ দিনের সামরিক
অভ্যুত্থানের ইতিহাস আছে। কর্তৃত্ব সেনাবাহিনী হাতে পেয়ে কার্যত তারা এখন
প্রধানমন্ত্রীকে দেখাচ্ছে কে আসল বস! সমালোচকরা এমন পরিস্থিতিকে পাকিস্তানে
‘নীরব অভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। ওয়াশিংটন পোস্টে গতকাল এ বিষয়ে
একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। এর শিরোনাম- তবে কি এরই মধ্যে পাকিস্তানে
নীরব সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে গেছে? এ প্রতিবেদনটির লেখক টাইম ম্যাগাজিনের
সাবেক সিনিয়র সম্পাদক ইশান ঠারুর। ওদিকে নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণার আবেদনে
বলা হয়েছে, দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের মাঝে সেনাবাহিনীকে ডেকে তিনি অযোগ্যতার
প্রমাণ দিয়েছেন। তাই তাকে অযোগ্য করা উচিত। ইনসাফ ল’য়ারস ফোরামের সিনিয়র
সভাপতি এডভোকেট গওহর নওয়াজ আজ এ পিটিশন দাখিল করেছেন। উল্লেখ্য, শুক্রবার
পার্লামেন্টে ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেন, তিনি
সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফকে পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)-এর
ইমরান খান ও পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি)-এর প্রধান তাহিরুল কাদরির
সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে সরকার ও এই দু’নেতার সঙ্গে
মধ্যস্থতা করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। নওয়াজ শরিফের এই বক্তব্য
প্রত্যাখ্যান করেছেন ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি। তারা বলেছেন, এতে
সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আলাদা বক্তব্যে তারা বলেন, এর মাধ্যমে
প্রধানমন্ত্রী জাতির সামনে মিথ্যা কথা বলেছেন। পরে অবশ্য মুখ খোলে
সেনাবাহিনী। তারা সংক্ষিপ্ত একটি বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, তারা শুধু
সরকারের পক্ষে দেশের চলমান সঙ্কট উত্তরণে সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করছে। এ
ঘটনার পরই আজ নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণার দাবিতে লাহোর হাইকোর্টে ওই আবেদন
করলেন গওহর নওয়াজ। ইশান ঠারুর ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেন, পাকিস্তানে যখন
থেকেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তারপর থেকেই এর রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার
করেছে সেনাবাহিনী। বেসামরিক শাসনে হস্তক্ষেপ ও নাক গলানোর দীর্ঘ ইতিহাস আছে
এদেশের জেনারেলদের। প্রায় ৭ দশকের মধ্যে গত বছর পাকিস্তানে যে নির্বাচনে
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নওয়াজ শরিফ তাতে প্রমাণ হয়েছে, শান্তিপূর্ণ
উপায়ে পাকিস্তান বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে সক্ষম। কিন্তু
এখন আরও একবার সেনাবাহিনীর আবির্ভাব বড় করে দেখা হচ্ছে। রাজপথের উত্তেজনা
থামাতে এ সপ্তাহে নওয়াজ শরিফ সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে সম্মত হয়েছেন। এরই
মধ্যে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ বর্তমানে বিক্ষোভকারী বড়
দু’টি দলের মূল নেতা- ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই
দু’নেতাই নওয়াজ শরিফের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রিপোর্ট
অনুযায়ী, দেশের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন
নওয়াজ শরিফ, যাতে তারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। নওয়াজ শরিফের জন্য
এটা একটি কঠিন পরিস্থিতি। ১৯৯৯ সালে তিনি যখন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী
তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন সেনা
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এখন আবার সেনাবাহিনী নওয়াজকে দেখিয়ে দিচ্ছেন- আসল বস
কে। এ বিষয়ে ইসলামাবাদ ভিত্তিক বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, এবার যদি
নওয়াজ শরিফ টিকে যান তাহলে তার ক্ষমতার বাকি মেয়াদে তিনি হয়ে থাকবেন একজন
আনুষ্ঠানিক প্রধানমন্ত্রী। বিশ্ব তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না। এরই মধ্যে
পাকিস্তানে নীরব অভ্যুত্থান ঘটে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো- এই অভ্যুত্থান কতটা
কঠিন হবে।
নওয়াজ শরিফ গত বছর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। তখন থেকেই তিনি পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া কঠিন করেছেন, বেসামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছেন। এ দু’টি কারণে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া, ভারতের সঙ্গে নওয়াজ শরিফ সম্পর্ক উন্নত করার কথা বলেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধের এক ইতিহাস। তাদের নিজস্ব ব্যবসা আছে। এ বাহিনীতে রয়েছে ৫ লাখের মতো শক্তিশালী স্ট্যান্ডিং সেনা সদস্য। ১৯৪৭ সালে বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর চারটি যুদ্ধ করেছে এই দেশ দু’টি। পাকিস্তানি বিশ্লেষক মোশাররফ জাইদি বলেন, পাকিস্তান ও ভারত যদি স্বাভাবিক প্রতিবেশী হতো তাহলে স্বাভাবিকভাবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমে যেতো। কিন্তু তা সহজে হওয়ার নয়। নওয়াজ শরিফকে বেষ্টন করে আছে তার অনুগত ও চাটুকার উপদেষ্টা, আমলারা। এতেই তার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শানিয়ে নিয়েছেন। ইমরান খানের অভিযোগ, ২০১৩ সালের নির্বাচন ছিল কারচুপির। ওই কারচুপির নির্বাচনের সুবিধা ভোগ করছেন নওয়াজ শরিফ। তিনি চান, এই সরকার ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন। নিরপেক্ষ বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, যে অনিয়মগুলো পাকিস্তানে আছে নতুন নির্বাচন দিয়ে তা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে তাহিরুল কাদরি তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তবে দেশে রয়েছে তার বিপুল সংখ্যক অনুসারী। তিনি পাকিস্তানের গণতন্ত্রে স্বচ্ছতার আহ্বান জানিয়েছেন। দু’সপ্তাহ ধরে ইমরান খান ও কাদরির কয়েক হাজার সমর্থক রাজধানী ইসলামাবাদের রাজপথে রয়েছেন। তুলনামূলক তাদের সংখ্যা কম হলেও তারা দেশকে দৃশ্যত অচল করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সাংবাদিক ও লেখক রাজা রুমি বলেন, এমন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানে নতুন নয়। দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে সেনা শাসন ও দুর্বল বেসামরিক সরকারের মধ্যে বোঝাপড়া আটকে আছে বহুদিন ধরে। ওদিকে পার্লামেন্টে নওয়াজ শরিফ এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ। তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। তা সত্ত্বেও ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে তিনি দুর্বল। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের পাকিস্তান ব্যুরো প্রধান টিম ক্রেইগ বলেন, ১৯৯৯ সালে পারভেজ মোশাররফের অভ্যুত্থান যখন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে তার বাসভবন থেকে বের করে এনেছিল সেই অনুভূতির কথা মনে করে নওয়াজ শরিফ হয়তো বিকল হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি অবমাননার ভয় করেছিলেন। এখন আবার তাকে দৃশ্যত অনেক বেশি নার্ভাস দেখা যাচ্ছে। যখন তিনি সঙ্কট মোকাবিলা করতে যাচ্ছেন তখন তাকে দেখা যাচ্ছে খুব বেশি সতর্ক। যদি তিনি ইমরান খান ও কাদরির সমর্থকদের বিক্ষোভের অনুমতি দিতেন পার্লামেন্টের সামনে তাহলে মিডিয়ায় তা নিয়ে রহস্য সৃষ্টি করা হতো না। কিন্তু নওয়াজ শরিফ তার পরিবর্তে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে চলে গেলেন এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি ইমরান খান ও কাদরির বিরুদ্ধে কোন ফলপ্রসূ পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো নিজেকে নিজের ঘরের মধ্যে বন্দি করে ফেললেন। এর ফলে নওয়াজ এখন দৃশ্যত অনেকটা দুর্বল ও অকার্যকর। পাকিস্তানের মতো দেশে যে নেতা একবার দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি সেখানে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেন না। তবে এখনও পুরোপুরি সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে- এমনটা বলা যাচ্ছে না। তবে জাইদি বলেন, প্রতিবেশী ভারত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে চলমান লড়াই কেমন হবে সে বিষয়ে এখন সেনাবাহিনী তার অবস্থান জানাতে পারে।
ওদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তা গত কয়েকদিনেই স্পষ্ট হয়েছে। কারণ, তিন দিনের মধ্যে সেনাবাহিনী দু’বার সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। সেখানে তারা দেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে কথা বলেন। এরপর শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ জাতীয় পরিষদে ভাষণে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য মধ্যস্থতা করার অনুমতি দেয়ার কথা স্বীকার করেন। এরপর সেনাপ্রধান ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গতকাল দ্বিতীয় দফা ইমরান খানের সঙ্গে স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায় আলোচনায় বসার কথা জেনারেল রাহিল শরিফের। ওদিকে, তাহিরুল কাদরির পিএটি বলেছে, সেনাবাহিনী যে হস্তক্ষেপ করেছে এ বিষয়ে তারা আশ্বস্ত হয়েছে।
No comments