গোড়াতেই গলদ by শামীমুল হক
কাদের পেটে নাকি ঘি হজম হয় না। যদিও বা কখনও তারা ঘি খেয়ে ফেলে তাহলে দেখা যায় তাদের গায়ের সব লোম উঠে গেছে। শুধু চামড়া নিয়ে বেঁচে আছে। বিশ্রী এক অবস্থা। তাদেরকে জাত ভাইয়েরাও ঘৃণা করে। মানুষ তো দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়। কথা হচ্ছিল ফরমালিন নিয়ে। ফলমূল, শাকসবজি, মাছ সব কিছুতেই এখন ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। বাজারে তরতাজা, জিভে পানি আসা সব ফল দেখে মানুষ এগিয়ে যায়। কিনে নেয়। কিন্তু অর্থ দিয়ে যে তিনি বিষ কিনে নিলেন নিজে কি তা জানেন? হয়তো জানেন। হয়তো না। কিন্তু একটি কথা তো ঠিক- আমরা সবাই অবগত ফরমালিন সম্পর্কে। তারপরও উপায়হীন আমরা। অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি সবাই। এই রসমধুর মাসে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড দেখা যায়। যেখানে লেখা ‘এখানে ফরমালিনবিহীন আম পাওয়া যায়’। আশ্চর্যের বিষয় পরীক্ষা করে দেখা গেছে এসব আমেও রয়েছে ফরমালিন। এ অবস্থা হলে মানুষ যাবে কোথায়? কাকেই বা বিশ্বাস করবে। গত সপ্তাহ খানেক ধরে পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। যেখানে ফল বোঝাই ট্রাক থামিয়ে ফরমালিন আছে কিনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। যেসব ট্রাকে পরীক্ষা করা হয়েছে তার সব ক’টিতে পাওয়া গেছে ফরমালিন। প্রশাসন এসব ফল নষ্ট করে দিয়ছে। প্রশ্ন হলো এসব ট্রাকে আসা ফল সরাসরি বাগান থেকেই আনা হয়েছে। তাহলে বোঝা যায় বাগানেই ফরমালিন মেশানো হয়েছে। আসলে গোড়াতেই গলদ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখন প্রতিটি বাগানেই একটি করে চেক পোস্ট বসাতে হবে। কড়া নজরদারিতে আনতে হবে বাগানগুলো। কলা, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, আনারস সব কিছুতেই মেশানে হচ্ছে ফরমালিন। শুধু তাই নয়, কাঁচা ফল পাকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বাইড। মফস্বলের ছোট্ট এক শহরে এক রাতে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দেখলাম চেনা এক ফল ব্যবসায়ী ট্রাক থেকে একেবারে কাঁচা আনারস নামাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আরে এমন কাঁচা ফল ক’দিনে পাকবে? তিনি বললেন, একটু দাঁড়ান। তিনি ফল নামিয়ে গুদাম ঘরে নিয়ে গোল করে সাজিয়ে রাখলেন। আর ঠিক মাঝখানে রেখে দিলেন এক টুকরো কার্বাইড। তারপর বললেন, সকালে আসবেন। তখন দেখবেন আসল খেলা। বাসায় গিয়ে অধীর আগ্রহ কখন সকাল হবে। কখন ওই ব্যবসায়ীর গুদাম ঘরে যাবো। কি দেখবো? ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ঘড়িতে সকাল ৮টা। দৌড়ে গেলাম গুদাম ঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যবসায়ী এলেন। গুদামের তালা খুললেন। একি! রাতে কি দেখলাম আর এখন কি দেখছি। সব আনারস হলুদ হয়ে গেছে। যেন এইমাত্র বাগান থেকে কেটে আনা আনারস। তিনি বললেন, এই কার্বাইড না দিলে আনারস এক সপ্তাহেও পাকতো না। বরং শুকিয়ে যেতো। ব্যবসায় ক্ষতি হতো। এর পরের অবস্থা হলো-ফরমালিন মেশানো। হলুদ আনারস যেন দ্রুত না পচে সেজন্য। কলাও ঠিক একই ভাবে কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। এসব না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলে আসছে। সব ওপেন সিক্রেট। প্রশাসন এখন নড়েচড়ে বসলেও সব জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা করা তাদের পক্ষে কি সম্ভব? গতকাল গাড়িতে করে আসছিলাম। ডেমরা ব্রিজের সামনে পুলিশের চেকপোস্ট। গাড়ি থামার ইশারা দিলেন এক পুলিশ সদস্য। গাড়ি থেমে গেল। এক পুলিশ সদস্য এগিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি লিফলেট। এ লিফলেটের মাধ্যমে ফরমালিন নিয়ে ক্রেতাদের সচেতন করা হচ্ছে। ফরমালিন কি, এর ক্ষতিকারক দিক এবং ফরমালিন মিশ্রিত কোন ফল না কিনতে বলা হয়েছে। এমনকি কোথাও যদি ফরমালিন সম্পর্কিত কোন তথ্য থাকে তা-ও জানিয়ে দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। দু’টি ফোন নাম্বারও দেয়া হয়েছে ডিএমপির দু’জন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তার। লিফলেট পড়তে পড়তে মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিলো। মানুষকে সচেতন করে লাভ কি? আমরা সবাই সচেতন হলাম। কিন্তু বাজারে ফরমালিন ছাড়া কোন ফল নাই। তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? ফলের মাসে ফল খেতে কে না পছন্দ করে। ফরমালিনের জন্য কি ফল খাওয়া বন্ধ করে দেবে? না ফল খাওয়া বন্ধ করবে না। তারা ফরমালিন আছে কিনা তা পরীক্ষা না করে ফল কিনছে। খাচ্ছে। প্রশাসন সচেতন হওয়ার পর বাজারে ফলের দাম বেড়ে গেছে। তিন শ’ টাকার লিচুর শ’ হয়ে গেছে পাঁচ শ’ টাকা। বলা হচ্ছে ফরমালিনবিহীন হওয়ায় এর দাম বেশি? ফরমালিনবিহীন হলে দাম কেন বেশি হবে? এর কোন উত্তর নেই ব্যবসায়ীর কাছে। এক আড্ডায় এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল। এক লোক একটি গল্প শুনিয়ে দিলেন। গল্পটি এমন- এক মেথর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি একটি সুগন্ধির দোকানের সামনে গিয়ে পৌঁছলেন। যে দোকানে আতর, সেন্টসহ নানা সুগন্ধি বিক্রি করা হয়। ওই দোকান পার হওয়ার সময় তার নাকে এসে লাগে সুগন্ধ। এ গন্ধে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। মানুষজন তাকে ঘিরে ফেলেন। কেউ তার নাকে মুখে পানি ছিটিয়ে দেন। কেউ বা মৃগী ব্যারাম মনে করে নাকের কাছে চামড়ার জুতা ধরেন। না! কোন কিছুতেই তার সংজ্ঞা ফিরে আসছে না। ওই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন আরেক মেথর। তিনি বিষয়টি টের পেলেন। কাছে গিয়ে সবাইকে বললেন, আপনারা কেউ কিছু করতে হবে না। আমাকে একটু সুযোগ দিন, চেষ্টা করে দেখি। তিনি সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত পাশেই কচু গাছের পাতা ছিড়ে নিলেন। আর পাশের বাসার বাথরুমে ঢুকে তাতে বিষ্ঠা নিয়ে এলেন। আর ওই বিষ্ঠা আনা পাতা মেথরের নাকে লাগাতেই তিনি সংজ্ঞা ফিরে পেলেন। এ গল্প শুনিয়ে লোকটি বললেন, বাঙালির অবস্থাও হয়েছে এমন। বিষ মেশানো খাবার খেতে খেতে আমাদের শরীরে বিষ মিশে গেছে। এখন ভাল খাবার পেটে হজম হবে না। আর খেলেও ওই কুকুরের মতো শরীরে পশম আর থাকবে না। অন্য একজন বললেন, তাই বলে কি আমরা ফরমালিন মেশানো খাবারই খাবো? লোকটি বললেন না! আমাদের বিষ মেশানো খাবার থেকে দূরে থাকতে হলে আর কখনও যেন ফরমালিন বাজারে না আসতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। একেবারে বাজার ভেজালমুক্ত করতে হবে। বেচাকেনায়, আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। তাহলেই যদি কিছু বদলায় পরিস্থিতি!
No comments