ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চার শেষ মুঘলের বিদায় by ড. মাহফুজ পারভেজ
সরদার ফজলুল করিম আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। এ তথ্যটি অবশ্যই উল্লেখ করার মতো এ জন্য যে, আমার জীবনে যত শিক্ষক পেয়েছি, তিনি তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আশির দশকের শেষ দিকে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে খ-কালীন শিক্ষকতায় যুক্ত হন। ততদিনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিকাল সমাপ্ত করেছেন এবং যেহেতু তিনি গতানুগতিক শিক্ষক রাজনীতি করতেন না, তাই ঢাকায় তিনি চাকরির মেয়াদ বাড়াতে পারেন নি। এতে অবশ্য জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা লাভবানই হয়েছিল তাকে পেয়ে। তিনি স্নাতকোত্তর স্তরে আমাদের পড়াতেন ওরিয়েন্টাল পলিটিক্যাল থট বা প্রাচ্য রাজনৈতিক চিন্তা নামের কোর্স। বিখ্যাত বেসাম-এর ‘ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’ নামের ক্লাসিক বই থেকে তিনি পাঠ দিতেন। প্রাচ্য দেশের সংখ্যা, ন্যায়, চার্বাক দর্শন থেকে শুরু করে মৌর্য যুগ আর কৌটিল্যের ওপর সরদার স্যারের বিস্তারিত পাঠদানের স্মৃতি আজও তাজা। তখনই তার বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি ছিলেন তাজা-সবুজ-তরুণ। ঢাকার শ্যামলী থেকে পাবলিক বাসে চড়ে চলে আসতেন সাভারের ক্যাম্পাসে। তার সঙ্গী হয়ে দেখেছি বিদ্যাচর্চার বাইরে আর কোন বিষয়েই তার আগ্রহ ছিল না। পাঠের পরিধি ছাড়িয়ে নিজের ব্যক্তিগত কোন বিষয়ই তিনি আলোচনা করতেন না। আত্মপ্রচার তো নয়ই। আমরা যারা তার সংগ্রামী জীবন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া, বাম আন্দোলন ইত্যাদি সম্পর্কে নানা লেখা পাঠের মাধ্যমে অবহিত ছিলাম, তারা বিভিন্ন সময়ে সে সব নিয়ে ক্লাসে প্রশ্ন করলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে গেছেন। পরে ব্যক্তিগত আড্ডা ও আলাপে কিছু কিছু প্রসঙ্গ ও স্মৃতিচারণ নিজে থেকেই করতেন। শিক্ষকতায় তার শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান ও বিদ্যা বিতরণেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রবলভাবে প্রণোদিত করতে সক্ষম ছিলেন। জানার ও পড়ার আগুন ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ে প্রজ্বলিত করার মহৎ কৃতিত্বের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার একটি উল্লেখযোগ্য উক্তি হলো, পরীক্ষা পাসের জন্য নয়, জানার ও শেখার জন্য পড়ো, পরীক্ষা এমনিতেই পাস হয়ে যাবে। তিনি জোর দিতেন শিক্ষার্থীদের মৌলিক চিন্তা ও বিশ্লেষণের ওপর। বলতেন, তুমি যদি যুক্তি দিয়ে কোন বক্তব্য বা প্রসঙ্গ সত্যি সত্যিই প্রমাণ করতে পারো, তবে তুমি ঠিক। আমি তোমাকে নম্বর দেবো। নোট মুখস্ত করে লিখলে বেশি নম্বর পাবে না। নিজের মৌলিক চিন্তার মাধ্যমে উত্তর দান করো, অবশ্যই ভাল নম্বর পাবে। ক্লাসে নোট টুকে গ-িবদ্ধ পড়াতে তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি পড়াতেন একটি বিশাল ক্যানভাস নিয়ে। একটি বিষয় পড়াতে গিয়ে নিয়ে আসতেন আরও শত সহযোগী বিষয়। প্রাচীন ভারত পড়ানোর প্রয়োজনে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন প্রাচীন গ্রিস, প্রাচীন চীনের কনফুসিয়াস এবং প্রাচীন পারস্যের জরথুষ্ট্রকে। উচ্চতর বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চায় মহীরুহসম পা-ত্িযের অধিকারী সরদার স্যার বিনয় ও সারল্যের প্রতীক ছিলেন। ক্লাসে কাউকে ধমক দেয়ার কথা তিনি ভাবতেও পারতেন না। অসচেতন ছাত্রছাত্রীরা অমনোযোগী হয়ে পাঠ-গ্রহণ না করলে তিনি তাদেরকে চিহ্নিত করে মজার মজার গল্প বলতেন। যে গল্পের মোর্যাল বা মর্মকথায় এমন কিছু উপদেশ থাকতো, যা সেই বেখেয়ালি ছেলে বা মেয়েটির অন্তর্চক্ষু উন্মীলনে সাহায্য করতো। আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, কিছু কিছু উদাসীন, বিষয়জ্ঞানহীন মানুষ আমাদের সমাজে সব কিছু ছেড়ে প্রার্থনা বা আরাধনার মতো বিদ্যাক্ষেত্রে-জ্ঞানচর্চার জগতে সন্তরণশীল আছেন। তাদের কারণে আমাদের মনন ঋদ্ধ হয়। আমাদের সৃষ্টিশীলতা বিকাশ লাভ করে। আমাদের চিন্তা-দর্শন নান্দনিক আলোয় উজ্জ্বল হয়। এমন মানুষ ছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। ড. আহমদ শরীফ। প্রফেসর এম. আসাদুজ্জামান। আহমদ ছফা। এদেরই শেষ প্রতিনিধি সরদার ফজলুল করিম। শেষ মুঘলই তিনি জ্ঞানচর্চার ধ্রুপদী ঘরানার- যারা ক্লাসিক্যাল আমেজে বিদ্যাচর্চা করেন এবং জ্ঞান আহরণের আনন্দে জীবন কাটান। এমন মানুষ এখন আর নেই বললেই চলে। থাকলেও তারা সংখ্যায় খুবই কম। সরদার ফজলুল করিম আমাদের বিদ্যাবত্তা ও জ্ঞানচর্চার জগৎ আলোকোজ্জ্বল কারী মুষ্টিমেয় মহতী মানুষের অন্যতম। তার মৃত্যুতে উচ্চতর বিদ্যায়তনে এবং চিন্তাশীল-জ্ঞানচর্চার জগতের বিরাট ক্ষতি হবে, সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তন প্রক্রিয়াও এতে ক্ষুণ্ন হবে। প্রাচীন জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক তথ্যগত বিদ্যার সমন্বয় সাধনের যোগ্যতাসম্পন্ন প্রাচীন পুরুষেরা একে একে চলে গেলে আমাদের ঐতিহ্যের নদীটিই যেন ক্ষীণ হয়ে যেতে থাকে। সরদার ফজলুল করিমের মৃত্যুতে বেদনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ক্ষতির ক্ষতটিও বড় স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
No comments