এএসপিকে হুমকি- জাত চেনালেন শামীম ওসমান
‘ভোটকেন্দ্র দখলের সুযোগ না দেওয়ায়’
নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. বশিরউদ্দীনকে মুঠোফোনে
হুমকি ও গালিগালাজ করেছেন সরকারদলীয় সাংসদ শামীম ওসমান। তিনি
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করে পুলিশ কর্মকর্তাকে কাবু করার
চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট
গ্রহণের সময় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। এ আসনে শামীম ওসমানের
ভাই সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম দলবল নিয়ে মদনপুর কেওঢালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্র দখল করতে যান। তিনি সেলিম ওসমানের পক্ষে কাজ করছিলেন। সালাম চেয়ারম্যান ওই কেন্দ্রে গিয়ে হুমকি দিয়ে বলেন, ভোটকেন্দ্রটি তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে৷ অন্যথায় সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ মাথা নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন না। এর কিছুক্ষণের মধ্যে এএসপি বশিরউদ্দীন ওই কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে বিষয়টি জানতে পারেন এবং তা জেলা পুলিশ সুপারকে (এসপি) জানান। এসপি সালাম চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। এরপরই শামীম ওসমান এএসপি বশিরের মুঠোফোনে কল করেন।
পরে ঘটনার বিবরণ দিয়ে এএসপি বশির সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এ উপনির্বাচনে মদনপুর ইউনিয়ন ও ধামকর ইউনিয়নের দায়িত্বে ছিলেন। বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে তিনি কেওঢালা কেন্দ্রে গেলে সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ভ্রাম্যমাণ সহায়ক দলের (মোবাইল স্ট্রাইকিং ফোর্স) কর্মকর্তারা তাঁকে জানান, মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করেছেন। তিনি হুমকি দিয়েছেন, তাঁকে কেন্দ্র ছেড়ে না দিলে পুলিশ, আনসার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ মাথা নিয়ে যেতে পারবেন না।
এএসপি বশির বলেন, ‘অভিযোগ পেয়ে আমি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চাই৷ খবর দেওয়ার পরও চেয়ারম্যান আসেননি৷ তিনি একজনের মুঠোফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেন৷ আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি ভোট দিয়েছেন?” উনি বললেন, “হ্যাঁ দিয়েছি”। আমি বললাম, আজকের জন্য আপনি শুধু একজন ভোটার, এর বেশি কিছু নন। আপনি ভোট দিলে ভোট দিয়ে চলে যান, আপনি কারও ভোটে ডিস্টার্ব করবেন না, আপনার ভোটেও কেউ ডিস্টার্ব করবে না। উনি বললেন, “আপনি কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছেন?” আমি বললাম, থ্রেট তো আপনি দিলেন আমার লোকজনকে। আপনি বলছেন, পুলিশের কেউ মাথা নিয়ে যেতে পারবে না। এরপর চেয়ারম্যান বললেন, “আপনি কে, আপনার নাম কী, পরিচয় কী? আপনি থাকেন ওখানে, আমি দেখাচ্ছি।”’
এএসপি জানান, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেলা পুলিশ সুপারকে জানান। পুলিশ সুপার ওই চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন।
এএসপি বশির জানান, নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি র্যাব ও বিজিবির টহল দল ডেকে পাঠান এবং সালাম চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর মুঠোফোনে একটি কল আসে। তিনি বলেন, ‘ওই প্রান্ত থেকে বলা হয়, “আমি সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলছি।” আমি বললাম, আপনি কেমন আছেন? উনি বললেন, “তুমি আমার চেয়ারম্যানকে অ্যারেস্ট করার প্রিপারেশন নিচ্ছ কেন?” আমি বলি, কেন্দ্র দখল করতে এলে আমি অ্যারেস্ট করব না? আর আপনার চেয়ারম্যান কি না, এটা তো দেখার বিষয় না।’
বশির সাংবাদিকদের বলেন, ‘...এরপর তিনি বলেন, “প্লিজ, আমি শামীম ওসমান বলছি, আমি কাউকে প্লিজ বলি না। আমি বলছি, গিভ হিম দ্য ক্লিয়ারেন্স। তুমি কেন্দ্রটা ছেড়ে দাও, তুমি তোমার মতো করে চলে যাও। সময় দ্রুত ফুরাইয়ে যাচ্ছে, চারটার মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ পারসেন্ট ভোট কাস্ট করতে হবে, তুমি কেন্দ্রটা ছেড়ে দাও এবং চলে যাও।” আমি বললাম, আমি পারব না। এখন আমার চাকরি ইলেকশন কমিশনের আন্ডারে। আমি এখানে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে এসেছি, প্রজাতন্ত্রের চাকরি করতে এসেছি।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এরপর শামীম ওসমান আবার ফোন করেন। তিনি আমাকে ফোনে লাইনে রেখে আরেক ফোনে প্রধানমন্ত্রীর পিএস-ওয়ান মালেক সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন। ওই ফোনে তিনি বললেন, “তুমি প্রধানমন্ত্রীকে বলো, আমি রাজনীতি করব কি করব না।” তিনি এ কথা আমাকে শোনালেন ফোনে। তখন আমি বললাম, আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন, সেটা দেখার বিষয় না, আমি খুব ছোট অফিসার। আমি এখানে দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। আমার দায়িত্বটা আমাকে পালন করতে দিন। এরপর তিনি “কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, বাস্টার্ড” গালি দিয়ে বলেন, “তুই কী পারবি কর। তোরে আমি দেইখা নিব।”’
শামীম ওসমানের এই হুমকির কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন কি না—সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে এএসপি বশির বলেন, ‘আমি আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারকে জানিয়েছি এবং মোবাইলে যখন উনি (শামীম ওসমান) কথা বলছিলেন, র্যাবের মেজর সোহেল সাহেবও তা শুনেছেন, আমি লাউড িস্পকারে কথা বলেছি৷ আমার বডিগার্ড, আমার ড্রাইভার, তারাও শুনেছে। আমি পুলিশের কন্ট্রোলকে জানিয়েছি, কন্ট্রোল এটা নোট নিয়েছে।’ এ ঘটনায় শঙ্কিত বলেও জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উিদ্দন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোটের সময় এ ধরনের টুকটাক কথাবার্তা হয়। এগুলো এমন কিছু নয়, এগুলোকে তেমন বড় করে দেখারও কিছু নেই। তার পরেও বশিরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।’
শামীম ওসমানের সঙ্গে ফোনালাপের সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এএসপি বশিরের কাছাকাছি ছিলেন। তাঁকে সে সময় বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল বলে জানান সাংবাদিকেরা। তিনি হাত নাড়িয়ে কথা বলছিলেন। পরে সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি শামীম ওসমানের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন বিষয়টি বলেন।
এ পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত সালাম চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। বরং এরপর সালামের অনুসারীরা কেওঢালা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিছিল করেন। বিকেলে পার্শ্ববর্তী আরেকটি কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে সেখানেও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিছিল করেন এবং অঙ্গুলি নির্দেশ করে আজেবাজে কথাও বলেন শামীম ওসমানের অনুসারীরা।
ভোট নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন শামীম ওসমান। পুলিশ কর্মকর্তাকে হুমকি ও গালিগালাজের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে শামীম ওসমান বলেন, ‘এটা হান্ড্রেড পারসেন্ট মিথ্যা কথা। আমার নাম করে শুধু তাঁকে (এএসপি বশির) নয়, আরও অনেককে টেলিফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছে।’
সাংবাদিকেরা বলেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত করে বলেছেন, শামীম ওসমানই তাঁকে ফোন করে হুমকি দিয়েছেন। এটা ঠিক কি না? জবাবে শামীম ওসমান বলেন, ‘তাঁর (এএসপি) ব্যাপারে স্থানীয় একজন চেয়ারম্যান একটা অনৈতিক কাজের অভিযোগ তুলেছেন। সেই অভিযোগটি নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে।’
‘তার মানে আপনার সঙ্গে ওই এএসপির কোনো কথা হয়নি?’ সাংবাদিকেরা আবার এ প্রশ্ন করার পর শামীম ওসমান কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর কিছুটা ইতস্তত করে টেলিফোন করার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন, ‘অনৈতিক কাজের বিষয়ে তাঁকে (এএসপি) আমি প্রশ্ন করেছি, তুমি িক এটা করেছ? এর উত্তরে সে তার অতীত রাজনৈতিক পরিচয় আমার সামনে তুলে ধরে। তখন আমি বলি, তোমার অতীত রাজনৈতিক পরিচয় কী, সেটা আমার জানার দরকার নেই।’ শামীম ওসমান দাবি করেন, ‘আমি সেই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে জানিয়েছি। তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ডিপার্টমেন্টাল ইনকোয়ারি শুরু হয়েছে এবং তারা মনে হয় কিছু প্রমাণও পেয়েছে।’
কেওঢালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম সকালে লোকজন নিয়ে কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করেন এটা সত্য। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সফল হননি।
অবশ্য গত বুধবার রাতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম আকরাম (প্রতীক আনারস) সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ওই রাতে কেওঢালা কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটে সেলিম ওসমানের প্রতীকে (লাঙ্গল) সিল মারছেন চেয়ারম্যান আবদুস সালামের লোকজন। অভিযোগ পেয়ে ওই রাতেই প্রথম আলো মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেছিলেন, ব্যালটে সিল মারার প্রশ্নই ওঠে না।
তবে গতকাল ভোট শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই কেওঢালা কেন্দ্রের ফলাফল দেয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, সেলিম ওসমান পেয়েছেন এক হাজার ২৬৯ ভোট এবং এস এম আকরাম পেয়েছেন ১৬৮ ভোট।
কেন্দ্র দখলের চেষ্টা ও পুলিশ কর্মকর্তাকে হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম আকরামের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আইনজীবী মাহবুবুর রহমান মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীন৷ তাদের কোনোরকম অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করা বা হুমকি দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ৷ শামীম ওসমান একজন আইনপ্রণেতা হয়ে বিসিএস ক্যাডারের একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে যে ভাষায় গালিগালাজ করেছেন, তা কোনো সভ্য মানুষ করতে পারেন না৷
No comments