পারমাণবিক বিদ্যুৎ- সাশ্রয়ী ও নিরাপদ বিদ্যুতের ছয় দশক by আবদুল মতিন
আজ ২৭ জুন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৬০
বছর পূর্তি হচ্ছে। ১৯৫৪ সালের এই দিনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান
রাশিয়ার ওবনিনসক নামক স্থানে পাঁচ মেগাওয়াট ই ক্ষমতাসম্পন্ন এপিএস-১
প্লান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া থেকে বিদ্যুৎ
উৎপাদন রাতারাতি শুরু হয়নি।
বিশ শতকের শুরুতে রেডিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার হওয়ার পর আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সূত্র E = mc2 অনুসারে ভর থেকে শক্তি উৎপাদনের কলাকৌশল আবিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এদিকে ১৯৩২ সালে জেমস চ্যাডউইক নিউট্রন নামক এক ক্ষুদ্র পরমাণু আবিষ্কার করেন।এটা দিয়ে ইউরেনিয়াম পরমাণুতে ফিশন ঘটানো সম্ভব হয়। আর ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর এনরিকো ফারমি শিকাগোতে প্রথম পরমাণু শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হন।
তারপর ১৯৩০-এর দশকে পরমাণুশক্তিবিষয়ক গবেষণার লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পর পর দুটি পরমাণু বোমা ফেলা হলে বিশ্ববাসী পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা দেখে থমকে যায়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরমাণুশক্তির ওপর গবেষণা হয়েছে মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে, একই সঙ্গে নৌশক্তি বৃদ্ধিতেও তা ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইদাহোর পরীক্ষামূলক ইবিআর-১ স্টেশনে ১৯৫১ সালের ২০ ডিসেম্বর পরীক্ষাগারে পরমাণু রি-অ্যাক্টরের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। পরমাণু শক্তিধর সাবমেরিন ইউএসএস নটিলাস উদ্বোধন করা হয় ১৯৫৪ সালের ২১ জানুয়ারি।
এপিএস-১-এর নিরাপত্তায় মডারেটর হিসেবে গ্রাফাইট ব্যবহার করা হয়েছে, আর তা ঠান্ডা রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে পানি। মডারেটরের কাজ হচ্ছে মূলত নিউট্রনের গতি কমিয়ে দেওয়া এবং রি-অ্যাক্টরের ভেতরে পরমাণুর ফিশনের হার বাড়িয়ে দেওয়া। আর শীতলকারক রি-অ্যাক্টর ঠান্ডা রাখে, তাপ কমিয়ে দেয়, যাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। ইংল্যান্ডের উইন্ডস্কেলে ক্যাল্ডার হলে মডারেটর হিসেবে গ্রাফাইট ব্যবহার করা হয়, শীতলকারক হিসেবে ব্যবহার করা হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড৷ এটি ১৯৫৬ সালে উৎপাদনে আসে। আর যুক্তরাষ্ট্রের শিপিং পোর্টে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম পারমাণবিক রি-অ্যাক্টর স্থাপন করা হয় ১৯৫৭ সালে, সেখানে মডারেটর ও শীতলকারক হিসেবে পানি ব্যবহার করা হয়েছে।
কানাডার ওনটারিওর রলফটনে ২২ মেগাওয়াট ই ক্ষমতাসম্পন্ন নিউক্লিয়ার পাওয়ার ডেমোনস্ট্রেশন (এনডিপি) রি-অ্যাক্টর স্থাপন করা হয় ১৯৬২ সালে। এতে মডারেটর ও শীতলকারক হিসেবে ভারী পানি ব্যবহৃত হয়েছে।
এগুলো হচ্ছে প্রথম প্রজন্মের পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরের আদিরূপ। বর্তমানে যেসব রি-অ্যাক্টর ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর জন্ম হয়েছে এই আদিরূপ থেকেই। বর্তমানে যেসব পারমাণবিক রি-অ্যাক্টর ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলো হলো: প্রেশারাইজড ওয়াটার রি-অ্যাক্টর (পিডব্লিউআর), বয়লিং ওয়াটার রি-অ্যাক্টর (বিডব্লিউআর), প্রেশারাইজড হেভি ওয়াটার রি-অ্যাক্টর (পিডব্লিউএইচআর) প্রভৃতি। রি-অ্যাক্টরের মডারেটর হিসেবে গ্রাফাইটের (ইউকে ও রাশিয়া যেগুলো আলাদা আলাদভাবে তৈরি করেছিল: এজিআর ও আরবিএমকে) ব্যবহার এখন আর নেই বললেই চলে।
এখন মূলত দ্বিতীয় প্রজন্মের রি-অ্যাক্টর ব্যবহৃত হচ্ছে, এগুলোও আবার ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। এর জায়গায় আসবে তৃতীয় প্রজন্মের রি-অ্যাক্টর, যার ব্যবহার ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এই তৃতীয় প্রজন্মের হালকা পানির রি-অ্যাক্টরের মধ্যে আছে অ্যাডভান্সড বয়লিং ওয়াটার রি-অ্যাক্টর (এবিডব্লিউআর) এবং অ্যাডভান্সড প্রেশারাইজড ওয়াটার রি-অ্যাক্টর (এপিডব্লিউআর)। দ্বিতীয় প্রজন্মের রি-অ্যাক্টরগুলোর তুলনায় এগুলো অধিক নিরাপদ। আবার চতুর্থ প্রজন্মের রি-অ্যাক্টরগুলো আরও ছোট, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হবে বলে আশা করা যায়। এটা এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এগুলো বাজারে আসতে পারে।
কিছু কিছু রি-অ্যাক্টরে দ্রুতগতির নিউট্রনের কারণে পারমাণবিক ফিশন হয়। এসব রি-অ্যাক্টরকে দ্রুত রি-অ্যাক্টর বলা হয়৷ এগুলো থেকে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন হয়। কিছু কিছু দ্রুতগতির রি-অ্যাক্টর যে পরিমাণ জ্বালানি খায়, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ফিসাইল জ্বালানি উৎপাদন করে, এগুলোকে বলা হয় ফাস্ট ব্রিডার রি-অ্যাক্টর (এফবিআর)। বিভিন্ন দেশেই এখন এগুলো নির্মাণে গবেষণা হচ্ছে।
পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরের নিরাপত্তা বিগত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও এই শিল্প শুরু থেকেই নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। তিনটি বড় দুর্ঘটনায় এই িশল্প বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে: যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৯ সালে থ্রি মাইল দ্বীপের দুর্ঘটনা, ১৯৮৬ সালের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা এবং জাপানে ২০১১ সালে ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনা। ইউরোপের অনেক দেশ যেমন জার্মানি, সুইডেন, ইতালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাপান তার সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা না করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাণহানির নিরিখে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অন্য উৎসগুলোর তুলনায়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতে প্রাণহানির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, কয়লা থেকে প্রতি ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট বা ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপদানে ১৭০ জন মানুষ মারা যায়। তেলের ক্ষেত্রে তা ৩৬ হাজার। আর পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রে তা ৯০ জন।
বর্তমানে বিশ্বের ৩১টি দেশে ৪৩৬টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সম্মিলিতভাবে তিন লাখ ৭৪ হাজার মেগাওয়াট ই বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, যা বিশ্বের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১১ শতাংশের বেশি। সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলে অন্যান্য জ্বালানি যেমন কয়লা, তেল প্রভৃতির মূল্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। শুধু জার্মানিতেই পারমাণবিক বিদ্যুতের জায়গায় নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে এক ট্রিলিয়ন ইউরোর দরকার হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের আগস্ট ২০১২ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘জাপানের সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলে সে দেশের পরিষেবা খাতের চারটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে।’ জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহারের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, এগুলোর অতিরিক্ত দামের কারণে অর্থনৈতিক মন্দাও সৃষ্টি হতে পারে।
ফ্রান্সের ৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় পারমাণবিক শক্তি থেকে। সেখানে তৃতীয় প্রজন্মের একটি রি-অ্যাক্টরও নির্মীয়মাণ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৬টি রি-অ্যাক্টর আছে, সেখানকার মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৮ শতাংশই আসে এই পারমাণবিক শক্তি থেকে। ২০৩০ সালের মধ্যে তারা আরও ১৬ জিডব্লিউই বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সেখানে বর্তমানে ১০৪টি রি-অ্যাক্টর রয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি নতুন রি-অ্যাক্টর সেখানে স্থাপন করা হবে। এদিকে রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচির ক্রমসম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে চারটি রি-অ্যাক্টর নির্মীয়মাণ আছে। তুরস্ক, বেলারুশ, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ তাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয় না। জীবাশ্ম জ্বালানি বা নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে এটা সাশ্রয়ী। এর নিরাপত্তাব্যবস্থা ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। আর এর সাশ্রয়ী চরিত্র ও উন্নত রি-অ্যাক্টরগুলোর নির্ভরযোগ্যতার কারণে পারমাণুশক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ আরও বহুকাল মানুষের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আবদুল মতিন: বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী৷
No comments