আহমদ ছফার জল্লাদ সময় by সিদ্দিকুর রহমান খান
দুঃসময়,
জল্লাদ সময় ও আমাদের সময় শিরোনামের কবিতা তিনটির ঠিকানা ‘আহমদ ছফার কবিতা’
গ্রন্থের ১৪৩, ১৪২ ও ১৪১ পৃষ্ঠায়। জল্লাদ সময় কবিতার শুরু এমন : খড়গ হস্তে
নৃত্য কর জল্লাদ সময়/তোমার সুস্থির হওয়া বড় প্রয়োজন/সকলে বিশদ জানে তবু হয়
অন্ধকারে খুন/অস্ত্রহীন তাই কেউ বিনা খুনে দায়ভাগী হয়। সময়ের জানু চিরে
বেরিয়েছো জারজ সময়/টাটকা মনষ্য প্রাণ মনে করো খেলার পুতুল/ইচ্ছেমতো ভাঙ্গো
তুমি মর্জি মতো বসাও মাশুল/তোমার গর্ভের পাপে বঙ্গদেশে জেগেছে প্রলয়।
আমাদের সময়’র শুরু : আমাদের এ সময় সুসময় নয়/জোয়ারে হিন্দোল দোলা, ভাটায়
মন্থর/চেনাজানা ভদ্র নদী ভেবে/যেজন ভাসাবে ডিঙ্গা পৈতৃক বিশ্বাসে/জেনে রাখ
সর্বনাশ সম্মুখে তোমার। পাঠক, ‘দুঃসময়’ কবিতার দুটি লাইন উল্লেখের আগেই
বলে নিচ্ছি আজকের এ লেখায় মনীষী লেখক ও কবি আহমদ ছফার কবিতার কাব্যমূল্য
বিশ্লেষণ বা আলোচনা করার ধৃষ্টতা দেখানের চিন্তাও করবো না। বরং ছফার
সান্নিধ্য পাওয়ার সুবাদে তাঁর কবিতা সম্পর্কে তাঁর পোষণ করা ধারণা এবং
কবিতায় সমকালীন সমাজ বাস্তবতার কিঞ্চিৎ চিত্রালোচনা করবো।
গা গতরে চিকন ‘জল্লাদ সময়’ কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৭৫ খৃস্টাব্দ। জল্লাদ সময় ও আমাদের সময় কবিতা দুটির রচনাকালও এ সময়। ব্যক্তিগত জীবনে শিরা-উপশিরায় প্রতিবাদী কবি তাঁর কাব্যে চিত্রায়ন করেন ‘জল্লাদ সময়’ আর প্রবন্ধে ‘চন্ডশাসন’। ‘চন্ডশাসনের’ এ নিষ্ঠুর দিনগুলোতে তিনি জ্বলে উঠতে পেরেছিলেন এবং এর প্রায় দুই দশক পরে এ নিয়ে গর্ববোধ করেন, রচনা করেন সম্প্রসারিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস : সাম্প্রতিক বিবেচনা’।
সারা জীবনে মোট চারটি কবিতার সংকলন প্রকাশ হয়েছে ছফার। ‘দুঃসময়’ কবিতার রচনাকাল অজানা। তবে এটা জানা, ‘আহমদ ছফার কবিতা’-ই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কাব্যগ্রন্থ। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা-খ্যাত ও ছফার বন্ধু বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশ এ বইয়ের প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পী। ২০০০ খৃস্টাব্দের একুশে ফেব্র“য়ারি প্রকাশিত বইটিতে ‘দুঃসময়’ কবিতাটি পাই। এখানে কবি বলছেন : নদীতে বইছে বেগে খরতর খলস্রোত/দুকূলে নামছে ধ্বস, অবিরত চলছে ভাঙ্গন/ভাঙ্গন ভাঙ্গন শুধু চারদিকে ভাঙনের ক্ষণ। দুঃসময় শিকারী বাজের মতো চঞ্চু মেলে গুনছে প্রহর/গ্রামগুলো সর্বস্বান্ত বৃক্ষপত্রে জাগে আর্তস্বর/বলির পাঁঠার মতো চোখ মেলে কাঁপছে শহর। আবার এ কাব্যগ্রন্থেই ঠাঁই হয়েছে, ১৯৯৬ খৃস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় প্রথম প্রকাশিত ‘কবি ও সম্রাট’ নামের দীর্ঘ কবিতাটি। ছফা একে নাট্যসংলাপ আখ্যা দিয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছেন, ‘পৃথিবীতে জন্মানো রক্তমাংসের আসল মানুষের সঙ্গে কবির হৃদয়ে জন্মনো মানুষের ফারাক তো অবশ্যই থাকবে’। আবার বলছেন, ‘রাজকবি পেশাগত ঈর্ষা থেকে মুক্ত নন/তবে মীর তকি মীর এক বাহাদুর কবি। খাসলতে অপদার্থ, আত্ম কিংবা পর, সকলের প্রতি তার সম অবিচার। তাহলে তো ভাড়া করে আনতে হয় আরো এক কবি, স্বভাবে কবিতা লেখে পেশায় কসাই/প্রতি বাক্যে হানে যেনো মুগুরের ঘাই’। নিজের কাব্য নিয়ে কালেভদ্রে উচ্ছসিত কবি ছফা এ লেখককে যা বলেন তার সারমর্ম এরকম : পত্রিকায় এ কবিতাটি প্রকাশের পর বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বংশধর যিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও তিনি ছফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছেন, ‘গত ২৫ বছরেও তিনি এমন কবিতা পাঠ করেননি। কবিতা পাঠ করেই ছুটে এসেছেন কবি ছফাকে ধন্যবাদ জানাতে’। ছফা আরো বলেন, পত্রিকাওয়ালারা অনেক প্রধান/অপ্রধান কবির কবিতা প্রকাশের বছর পেরিয়ে গেলেও সম্মানী দেন না। কিন্তু ছফার সব কবিতার সম্মানীই প্রকাশমাত্র হাতে পেয়েছেন। কবি ও সম্রাটের ক্ষেত্রেও তার ব্যতয় ঘটেনি। শিব নারায়ণ প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কবি লেখেন, ‘কবিতা দিয়েই আমার লেখালেখির শুরু। কিন্তু অনবিচ্ছিন্নভাবে কবিতা লেখার অভ্যাসটি আমার দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কৈফিয়ত স্বরূপ আমি একটা কথাই বলতে পারি, জীবনের দায় কবিতার দায়ের চাইতে অনেক বেশি নিষ্ঠুর। ...তারপরেও আমার কবিতা সম্পর্কে কিছু কথা অবশ্যই আমাকে বলতে হবে। কবিতা ভয়ঙ্কর জিনিস। প্রাণে কবিতার বীজ প্রবিষ্ট হলে অবশ্যই কবিতা লিখতে হয়। আমার জীবনে এমন অনেক সময় এসেছে অন্যবিধ রচনার মাধ্যমে মনের তৎকালীন অনুভবটি প্রকাশ করা যখন অসম্ভব মনে হয়েছে তখনই কবিতা লিখেছি। কবি হিসেবে পরিচিত হওয়ার আকাক্সক্ষার চাইতে তাৎক্ষণিক মনের ভাব লাঘব করার প্রয়োজনেই আমাকে কবিতা লিখতে হয়েছে।
কে কবি, কে কবি নয়, কার কবিতা যথার্থ অর্থে কবিতা, কে ভনিতা লিখেই জীবন অপচয় করে, এ নিয়ে কবিদের মধ্যেই বিতর্কের অন্ত নেই। এমন পটভূমিতে ছফার মুখে শুনি, ‘যেহেতু আমার আত্মপ্রকাশের অন্যবিধ মাধ্যম ছিলো তাই বুক ঠুকে নিজেকে কবি হিসেবে জাহির করার দুরাকাক্সক্ষা আমার হয়নি। তবু কোনো ব্যক্তি যখন আমাকে কবি শনাক্ত করতে চেষ্টা করেছেন, সেটাকে আমি নেহায়েত সৌজন্যের প্রকাশ বলে ধরে নিয়েছি’। সমকালীন অনেক নাম-ডাকওয়ালা কবিরা যখন প্রধান, অপ্রধান, শ্রেষ্ঠ কবি, কবিশ্রেষ্ঠ ইত্যাদি তকমা ছিনতাই করতে ব্যস্ত কিংবা কবি হিসেবে পুরস্কার-টুরুস্কারের পেছনে নিরন্তর ছুটছেন তখন স্পষ্টবাদী ছফা লেখেন, ‘কবি হিসেবে পরিচয় অপরিচয়ের ব্যাপারটি কখনো আমার চিত্তদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। বরঞ্চ উল্টো আমি মনকে এই বলে শান্ত করতে চেষ্টা করেছি, তোমাকে সবকিছু হয়ে উঠতে হবে কেনো?’
অমৃতসমান শিশুতোষ ছড়া ‘গো হাকিম’ প্রকাশের পরপরই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় হয়েছেন। গো হাকিম’র শুরুটা এরকম : একদিন এক মাস্টার বুড়ো/দুপুর বেলা ইসকুলে/মনের ভিতর জমে থাকা/পিত্তথলির বিষ তুলে/দাঁত খিচিয়ে বেত উঁচিয়ে করতে গিয়ে গালমন্দ/গরু ডাকেন গাধা ডাকেন/যখন যেমন পছন্দ। একটি ছড়াই শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয় একটি বই হতে পারে। ২০০০ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত ছফার কাব্যগ্রন্থে এ ছড়াটি ঠাঁই পেয়েছে।
হিন্দুস্তান কিংবা পাকিস্তান নয় ছফার শুভজন্ম পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শাসনামলের অস্থির সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৩ খৃস্টাব্দের ৩০ জুন। চাটগাঁর গাছবাড়িয়ায়। জন্মেই দেখেছেন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহের ডামাডোল আর নিজ দেশ স্বাধীনতা লাভের আন্দোলনে ভেতরে বাইরে অস্থির। ‘জল্লাদ সময়’ আর ‘আমাদের সময়’ কবিতাদুটির রচনাকাল ১৯৭৫ খৃস্টাব্দের অস্থির সময়ে। ২০০১ খৃস্টাব্দের ২৮ জুলাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শ্রাবণের এক ঘন বৃষ্টিরদিনে বাংলামোটরের ছায়াঘেরা, পাখিডাকা বাড়িতে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলেও কমিউনিটি হাসপাতালের কমরেড কাজী কামরুজ্জামানের জবানীতে ভক্তকুলকে শুনতে হয়েছে কবির গত হওয়ার দুঃসংবাদ। ইহলোকত্যাগকালটাও ছফার জন্য ছিল অসময় বা দুঃসময়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসে প্রকাশিত স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ’কার ছফা। নাম ‘জাগ্রত বাংলা’। ভক্তরা ছফার মৃতদেহ দাফনের আগে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিন বা রাষ্ট্রীয় সম্মান পেতে সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা হতে হয়। ওই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেওয়ার একমাত্র ঠিকাদার ছিলেন অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী। ছফা কোন সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ করেছেন তার ঠিকুজি-কূলজি ঠাওরাতে পারেননি চৌধুরী সাহেব। ফলাফল রাষ্ট্রীয় সম্মান জোটেনি ছফার কফিনের ভাগ্যে। কবি হিসেবে পুরস্কার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেটের পাত্তা না দেওয়া ছফা কবরে গিয়ে হয়তো লিখছেন, ‘রাজাদের দিন গ্যাছে/ ভজাদের ধন যাবে/বাবুদের গিরি যাবে/স্বর্গের পিড়ি যাবে/সময়ের চাবি যাবে/জল্লাদেরও কল্লা যাবে!
গা গতরে চিকন ‘জল্লাদ সময়’ কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৭৫ খৃস্টাব্দ। জল্লাদ সময় ও আমাদের সময় কবিতা দুটির রচনাকালও এ সময়। ব্যক্তিগত জীবনে শিরা-উপশিরায় প্রতিবাদী কবি তাঁর কাব্যে চিত্রায়ন করেন ‘জল্লাদ সময়’ আর প্রবন্ধে ‘চন্ডশাসন’। ‘চন্ডশাসনের’ এ নিষ্ঠুর দিনগুলোতে তিনি জ্বলে উঠতে পেরেছিলেন এবং এর প্রায় দুই দশক পরে এ নিয়ে গর্ববোধ করেন, রচনা করেন সম্প্রসারিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস : সাম্প্রতিক বিবেচনা’।
সারা জীবনে মোট চারটি কবিতার সংকলন প্রকাশ হয়েছে ছফার। ‘দুঃসময়’ কবিতার রচনাকাল অজানা। তবে এটা জানা, ‘আহমদ ছফার কবিতা’-ই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কাব্যগ্রন্থ। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা-খ্যাত ও ছফার বন্ধু বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশ এ বইয়ের প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পী। ২০০০ খৃস্টাব্দের একুশে ফেব্র“য়ারি প্রকাশিত বইটিতে ‘দুঃসময়’ কবিতাটি পাই। এখানে কবি বলছেন : নদীতে বইছে বেগে খরতর খলস্রোত/দুকূলে নামছে ধ্বস, অবিরত চলছে ভাঙ্গন/ভাঙ্গন ভাঙ্গন শুধু চারদিকে ভাঙনের ক্ষণ। দুঃসময় শিকারী বাজের মতো চঞ্চু মেলে গুনছে প্রহর/গ্রামগুলো সর্বস্বান্ত বৃক্ষপত্রে জাগে আর্তস্বর/বলির পাঁঠার মতো চোখ মেলে কাঁপছে শহর। আবার এ কাব্যগ্রন্থেই ঠাঁই হয়েছে, ১৯৯৬ খৃস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় প্রথম প্রকাশিত ‘কবি ও সম্রাট’ নামের দীর্ঘ কবিতাটি। ছফা একে নাট্যসংলাপ আখ্যা দিয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছেন, ‘পৃথিবীতে জন্মানো রক্তমাংসের আসল মানুষের সঙ্গে কবির হৃদয়ে জন্মনো মানুষের ফারাক তো অবশ্যই থাকবে’। আবার বলছেন, ‘রাজকবি পেশাগত ঈর্ষা থেকে মুক্ত নন/তবে মীর তকি মীর এক বাহাদুর কবি। খাসলতে অপদার্থ, আত্ম কিংবা পর, সকলের প্রতি তার সম অবিচার। তাহলে তো ভাড়া করে আনতে হয় আরো এক কবি, স্বভাবে কবিতা লেখে পেশায় কসাই/প্রতি বাক্যে হানে যেনো মুগুরের ঘাই’। নিজের কাব্য নিয়ে কালেভদ্রে উচ্ছসিত কবি ছফা এ লেখককে যা বলেন তার সারমর্ম এরকম : পত্রিকায় এ কবিতাটি প্রকাশের পর বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বংশধর যিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও তিনি ছফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছেন, ‘গত ২৫ বছরেও তিনি এমন কবিতা পাঠ করেননি। কবিতা পাঠ করেই ছুটে এসেছেন কবি ছফাকে ধন্যবাদ জানাতে’। ছফা আরো বলেন, পত্রিকাওয়ালারা অনেক প্রধান/অপ্রধান কবির কবিতা প্রকাশের বছর পেরিয়ে গেলেও সম্মানী দেন না। কিন্তু ছফার সব কবিতার সম্মানীই প্রকাশমাত্র হাতে পেয়েছেন। কবি ও সম্রাটের ক্ষেত্রেও তার ব্যতয় ঘটেনি। শিব নারায়ণ প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কবি লেখেন, ‘কবিতা দিয়েই আমার লেখালেখির শুরু। কিন্তু অনবিচ্ছিন্নভাবে কবিতা লেখার অভ্যাসটি আমার দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কৈফিয়ত স্বরূপ আমি একটা কথাই বলতে পারি, জীবনের দায় কবিতার দায়ের চাইতে অনেক বেশি নিষ্ঠুর। ...তারপরেও আমার কবিতা সম্পর্কে কিছু কথা অবশ্যই আমাকে বলতে হবে। কবিতা ভয়ঙ্কর জিনিস। প্রাণে কবিতার বীজ প্রবিষ্ট হলে অবশ্যই কবিতা লিখতে হয়। আমার জীবনে এমন অনেক সময় এসেছে অন্যবিধ রচনার মাধ্যমে মনের তৎকালীন অনুভবটি প্রকাশ করা যখন অসম্ভব মনে হয়েছে তখনই কবিতা লিখেছি। কবি হিসেবে পরিচিত হওয়ার আকাক্সক্ষার চাইতে তাৎক্ষণিক মনের ভাব লাঘব করার প্রয়োজনেই আমাকে কবিতা লিখতে হয়েছে।
কে কবি, কে কবি নয়, কার কবিতা যথার্থ অর্থে কবিতা, কে ভনিতা লিখেই জীবন অপচয় করে, এ নিয়ে কবিদের মধ্যেই বিতর্কের অন্ত নেই। এমন পটভূমিতে ছফার মুখে শুনি, ‘যেহেতু আমার আত্মপ্রকাশের অন্যবিধ মাধ্যম ছিলো তাই বুক ঠুকে নিজেকে কবি হিসেবে জাহির করার দুরাকাক্সক্ষা আমার হয়নি। তবু কোনো ব্যক্তি যখন আমাকে কবি শনাক্ত করতে চেষ্টা করেছেন, সেটাকে আমি নেহায়েত সৌজন্যের প্রকাশ বলে ধরে নিয়েছি’। সমকালীন অনেক নাম-ডাকওয়ালা কবিরা যখন প্রধান, অপ্রধান, শ্রেষ্ঠ কবি, কবিশ্রেষ্ঠ ইত্যাদি তকমা ছিনতাই করতে ব্যস্ত কিংবা কবি হিসেবে পুরস্কার-টুরুস্কারের পেছনে নিরন্তর ছুটছেন তখন স্পষ্টবাদী ছফা লেখেন, ‘কবি হিসেবে পরিচয় অপরিচয়ের ব্যাপারটি কখনো আমার চিত্তদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। বরঞ্চ উল্টো আমি মনকে এই বলে শান্ত করতে চেষ্টা করেছি, তোমাকে সবকিছু হয়ে উঠতে হবে কেনো?’
অমৃতসমান শিশুতোষ ছড়া ‘গো হাকিম’ প্রকাশের পরপরই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় হয়েছেন। গো হাকিম’র শুরুটা এরকম : একদিন এক মাস্টার বুড়ো/দুপুর বেলা ইসকুলে/মনের ভিতর জমে থাকা/পিত্তথলির বিষ তুলে/দাঁত খিচিয়ে বেত উঁচিয়ে করতে গিয়ে গালমন্দ/গরু ডাকেন গাধা ডাকেন/যখন যেমন পছন্দ। একটি ছড়াই শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয় একটি বই হতে পারে। ২০০০ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত ছফার কাব্যগ্রন্থে এ ছড়াটি ঠাঁই পেয়েছে।
হিন্দুস্তান কিংবা পাকিস্তান নয় ছফার শুভজন্ম পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শাসনামলের অস্থির সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৩ খৃস্টাব্দের ৩০ জুন। চাটগাঁর গাছবাড়িয়ায়। জন্মেই দেখেছেন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহের ডামাডোল আর নিজ দেশ স্বাধীনতা লাভের আন্দোলনে ভেতরে বাইরে অস্থির। ‘জল্লাদ সময়’ আর ‘আমাদের সময়’ কবিতাদুটির রচনাকাল ১৯৭৫ খৃস্টাব্দের অস্থির সময়ে। ২০০১ খৃস্টাব্দের ২৮ জুলাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শ্রাবণের এক ঘন বৃষ্টিরদিনে বাংলামোটরের ছায়াঘেরা, পাখিডাকা বাড়িতে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলেও কমিউনিটি হাসপাতালের কমরেড কাজী কামরুজ্জামানের জবানীতে ভক্তকুলকে শুনতে হয়েছে কবির গত হওয়ার দুঃসংবাদ। ইহলোকত্যাগকালটাও ছফার জন্য ছিল অসময় বা দুঃসময়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসে প্রকাশিত স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ’কার ছফা। নাম ‘জাগ্রত বাংলা’। ভক্তরা ছফার মৃতদেহ দাফনের আগে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিন বা রাষ্ট্রীয় সম্মান পেতে সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা হতে হয়। ওই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেওয়ার একমাত্র ঠিকাদার ছিলেন অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী। ছফা কোন সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ করেছেন তার ঠিকুজি-কূলজি ঠাওরাতে পারেননি চৌধুরী সাহেব। ফলাফল রাষ্ট্রীয় সম্মান জোটেনি ছফার কফিনের ভাগ্যে। কবি হিসেবে পুরস্কার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেটের পাত্তা না দেওয়া ছফা কবরে গিয়ে হয়তো লিখছেন, ‘রাজাদের দিন গ্যাছে/ ভজাদের ধন যাবে/বাবুদের গিরি যাবে/স্বর্গের পিড়ি যাবে/সময়ের চাবি যাবে/জল্লাদেরও কল্লা যাবে!
No comments