পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কতটা ঝুঁকিমুক্ত? by মো. আসাদ উল্লাহ খান
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার
ভিত্তিতে পাবনার অদূরে রূপপুরে একেকটি ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বসানোর জন্য ২০১৩ সালে একটি সমঝোতা স্মারক
স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দেশের খুব কম মানুষই জানে যে পারমাণবিক চুল্লিতে
দুর্ঘটনা ঘটলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কারণে কী মারাত্মক বিপর্যয় নেমে
আসতে পারে! সহজ কথায় তেজস্ক্রিয়তা দীপ্তিহীন এবং দ্যুতিহীন এক ধরনের
বিকিরণ, যা স্বাস্থ্য, খাদ্যপণ্য ও জীবনযাপন প্রণালির ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর
প্রভাব ফেলে জীবনহানি, বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মসহ দুরারোগ্য ক্যানসার ব্যাধি
সৃষ্টি করে।
বর্তমানে
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪৩৭টি পারমাণবিক চুল্লি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য
কাজ করছে। এই চুল্লিগুলোর একেকটির আয়ুষ্কাল প্রায় ৩০ থেকে ৪০ বছর। উল্লেখ
করা যেতে পারে, ১৯৯৬ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নতুন কোনো চুল্লি
ইউরোপ ও আমেরিকায় বসেনি। এটাও ঠিক যে এই ৪৩৭টি পারমাণবিক চুল্লিতে
দুর্ঘটনার আশঙ্কা মাত্র দশমিক ৪ শতাংশ। তেজস্ক্রিয়তার এই ভয়াবহতা
চর্মচক্ষুতে দৃশ্যমান নয়, এমনকি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও নয়। দুর্ঘটনাস্থল ছাড়িয়ে
হাজার মাইল দূরে এই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে।
১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর তেজস্ক্রিয়তা সুদূর জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর জার্মানিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎবিরোধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার কারণে, সাতটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে বাকি সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।
অনেকগুলো কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথম কারণ হলো, শক্তি উৎপাদন-প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় ত্রুটি, কর্মীদের অসতর্কতা, আত্মসন্তুষ্টি কিংবা আত্মবিশ্বাস। এ ছাড়া যান্ত্রিক কিংবা ডিজাইন ত্রুটির কারণে যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খল বিক্রিয়া বিশৃঙ্খল হয়ে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেমনটি হয়েছিল ফুকুশিমা এবং চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। অতিরিক্ত উত্তাপে চুল্লির অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে চুল্লির অভ্যন্তরভাগ গলে যাবে এবং শীতলীকরণ প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যাবে। তেজস্ক্রিয় গ্যাস অর্থাৎ ফিশন খণ্ডাংশ বাইরে বেরিয়ে এসে মাটি, গাছপালা, এমনকি ভূপৃষ্ঠের নিচে পানির স্তরেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। সংকট একবার সৃষ্টি হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। যদি জরুরি তাপ সরানোর প্রক্রিয়া কার্যকর না হয়, তাহলে বিপদ আরও ঘনীভূত হবে। অতিরিক্ত উত্তাপে যে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হবে তার প্রভাবে নিউট্রন আটকে রাখার জন্য কঠিন পুরুত্বের স্টিল ও কংক্রিটের বেষ্টনী দেয়াল উত্তাপে গলে যাবে। ফলে মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তাপূর্ণ গ্যাস আবহাওয়ামণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে।
১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্লিনে গ্লোবাল রেডিয়েশন ভিকটিমস কনফারেন্সে ড. জে এফ ল্যাপিন জানিয়েছেন, চেরনোবিলের এই দুর্ঘটনায় ১৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ত্রাণকর্মীদের বেশির ভাগই ভুগছেন তেজস্ক্রিয়াজনিত ব্যাধিতে। সারা বিশ্বে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১৯৭২-৯৩ পর্যন্ত ছিল ১৮ শতাংশ, কিন্তু এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে বার্ষিক ৪ শতাংশে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং চেরনোবিল ও ফুকুশিমার দুর্ঘটনার আলোকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। এখানে চুল্লি নির্বাচনের বিষয়টা অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশের রূপপুরে যে ভিভিইআর-১০০০ চুল্লিটি বসানো হবে তা তৃতীয় জেনারেশনের এবং ইতিপূর্বে রাশিয়ায় ব্যবহূত জইগক চুল্লি থেকে ভিন্ন ও উন্নত।
তবু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে অনেক প্রশ্ন থেকে যাবে। প্রথম প্রশ্ন হলো, আমরা কি একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর মতো দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেছি? যেহেতু রাশিয়ান চুল্লি এখানে বসানো হবে, তাই স্বাভাবিকভাবেই পারমাণবিক চুল্লি পরিচালনা-সংক্রান্ত বইপুস্তক, ম্যানুয়াল সবই রাশিয়ান ভাষায় তৈরি করা আছে। আমাদের দেশের প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের প্রথমে রাশিয়ান ভাষা শিখতে হবে, তারপর পরিচালনা কাজে অংশগ্রহণ করার প্রশ্ন আসবে। এখানে দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণ ছাড়াও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ ও সতর্কতার প্রয়োজন আছে। এসব পরীক্ষায় কি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারব? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: পদ্মার তীরবর্তী রূপপুরে পলিগঠিত নমনীয় মাটিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারটা কতটা ঝুঁকিমুক্ত, সেটাও বিভিন্ন পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে খতিয়ে দেখতে হবে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার বিশেষজ্ঞ মহল থেকে জানা গেছে, রূপপুর ভূচ্যুতির ওপর অবস্থিত। এ ধরনের ভূচ্যুতি ভূমিকম্পের উৎসস্থল হয়। কাজেই জায়গাটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো : পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকআপ শীতলীকরণ ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা জরুরি। রূপপুরে যেখানে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপিত হতে যাচ্ছে, ওই স্থানের নিকটবর্তী কোনো পানির উৎস নেই। কোনো অজ্ঞাত কারণে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে চুল্লির বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হবে, তখন বাইরের উৎসের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে পাম্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে পানি এনে চুল্লি ঠান্ডা করার কাজ চালু করতে হবে। এরপর জরুরিভাবে মানুষ সরিয়ে কোথায় নেওয়া যাবে?
তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফুকুশিমা থেকে প্রথম পর্যায়ে ৮০ হাজার এবং পরে দুই লাখ মানুষ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফুকুশিমার পারমাণবিক চুল্লির তেজস্ক্রিয়তা ওই স্থান থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে টোকিও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। জাপানের ঘরে ঘরে এখন তেজস্ক্রিয়তা মাপার জন্য ‘ডোসিমিটার’ ব্যবহার হচ্ছে।
একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো পরিচালন ব্যয় নেই ঠিকই, কিন্তু চালু করার আগে অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবে ত্রুটিমুক্ত অবকাঠামো তৈরি, জ্বালানি এবং তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিখুঁতভাবে পরিচালনা, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা, কেন্দ্রের কাছাকাছি কর্মীদের বাসস্থান ও লবণমুক্ত পানির অবারিত উৎস এবং একটি বিশাল দক্ষ পারমাণবিক প্রকৌশল জ্ঞানসম্পন্ন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা।
স্মরণ করা যেতে পারে, জীবন বাজি রেখে ফুকুশিমার প্ল্যান্টের কর্মীরা কাজ করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, সমগ্র কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বিধান এবং জনগণকে ঝুঁকি এবং লাভের বিষয়টা পরিষ্কারভাবে জানানো। অর্থাৎ দেশবাসী অবশ্যই জানবে দেশের বা অঞ্চলের পরিবেশগত অবস্থার নিরিখে এবং ঝুঁকির মাপকাঠিতে প্রাপ্তি কতটা বেশি বা কম। একটি কথা মনে রাখা দরকার: ফুকুশিমা চুল্লি দুর্ঘটনার বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে আনতে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেন্দ্রের ধারেকাছে স্বাদু পানির উৎসের অভাব। উত্তপ্ত চুল্লি ঠান্ডা করতে সাগরের লোনা পানি ব্যবহার করার জন্য চুল্লিগুলো একেবারে অকার্যকর হয়ে গেছে।
এখানে জানা দরকার, পারমাণবিক চুল্লি কীভাবে কাজ করে? নিয়ন্ত্রিত ফিশন শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মাধ্যমে পারমাণবিক চুল্লি শক্তি উৎপাদন করে। ফিশন কথার অর্থ হলো ভেঙে ফেলা। পারমাণবিক বিক্রিয়ার প্রধান জ্বালানি হলো ইউরেনিয়াম ধাতু। প্রাকৃতিকভাবে এই ইউরেনিয়াম ধাতু বাংলাদেশ ছাড়া অনেক দেশেই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে ফিশনযোগ্য ট-২৩৫-এর পরিমাণ মাত্র ০ দশমিক ৭ শতাংশ, বাকি সব ট-২৩৮, যা ফিশনযোগ্য নয়। শ্লথগতির নিউট্রন দ্বারা ভারী ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে আঘাত করা হলে এটা নিউট্রন শোষণ করে ট-২৩৬ নিউক্লিয়াস গঠন করে ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে দুটি হালকা ফিশনযোগ্য নিউক্লিয়াসে বিভক্ত হয়ে শক্তি উৎপাদন করে এবং একই সঙ্গে আরও কয়েকটি নিউট্রন অবমুক্ত করে। এভাবে স্বয়ংক্রিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটতে থাকে।
রূপপুরে যে চাপযুক্ত হালকা পানির তৃতীয় জেনারেশনের চুল্লি বসানো হবে, তাতে চারটি দরকারি উপাদান থাকবে। এগুলো হলো: শক্তি উৎপাদনের জন্য ইউরেনিয়াম ধাতু, যা প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হবে, নিউট্রনের গতি শ্লথ করার জন্য মডারেটর, চুল্লির কেন্দ্র থেকে তাপ সরিয়ে নেওয়ার জন্য শীতক যন্ত্র, নিউট্রনের গতি শ্লথ করা, কিংবা গতি বাড়ানো অথবা পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া একেবারে বন্ধ করার জন্য নিয়ন্ত্রক দণ্ড। তেজস্ক্রিয় ফিশন উপাদানসমূহ যাতে কোনোভাবেই বাইরে আসতে না পারে, সে জন্য ইউরেনিয়াম দণ্ডগুলো জারকোনিয়াম সংকর ধাতুর অত্যন্ত কঠিন আবরণে আবৃত করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, প্লুটোনিয়ামের মতো বিশাল অর্ধ-জীবনের তেজস্ক্রিয় ফিশন খণ্ডাংশ এবং ব্যবহূত তেজস্ক্রিয় জ্বালানি নিরাপদ ভান্ডারজাতকরণ, রাশিয়ায় নিরাপদ পরিবহন ও তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় ভস্ম পানি ছিটিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যায় না, এটা নিষ্ক্রিয় হবে ফিশন খণ্ডাংশের অর্ধ-জীবনের স্কেলে। তাই পারমাণবিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই।
মো. আসাদ উল্লাহ খান: বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
aukhandk@gmail.com
১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর তেজস্ক্রিয়তা সুদূর জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর জার্মানিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎবিরোধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার কারণে, সাতটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে বাকি সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।
অনেকগুলো কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথম কারণ হলো, শক্তি উৎপাদন-প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় ত্রুটি, কর্মীদের অসতর্কতা, আত্মসন্তুষ্টি কিংবা আত্মবিশ্বাস। এ ছাড়া যান্ত্রিক কিংবা ডিজাইন ত্রুটির কারণে যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খল বিক্রিয়া বিশৃঙ্খল হয়ে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেমনটি হয়েছিল ফুকুশিমা এবং চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। অতিরিক্ত উত্তাপে চুল্লির অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে চুল্লির অভ্যন্তরভাগ গলে যাবে এবং শীতলীকরণ প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যাবে। তেজস্ক্রিয় গ্যাস অর্থাৎ ফিশন খণ্ডাংশ বাইরে বেরিয়ে এসে মাটি, গাছপালা, এমনকি ভূপৃষ্ঠের নিচে পানির স্তরেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। সংকট একবার সৃষ্টি হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। যদি জরুরি তাপ সরানোর প্রক্রিয়া কার্যকর না হয়, তাহলে বিপদ আরও ঘনীভূত হবে। অতিরিক্ত উত্তাপে যে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হবে তার প্রভাবে নিউট্রন আটকে রাখার জন্য কঠিন পুরুত্বের স্টিল ও কংক্রিটের বেষ্টনী দেয়াল উত্তাপে গলে যাবে। ফলে মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তাপূর্ণ গ্যাস আবহাওয়ামণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে।
১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্লিনে গ্লোবাল রেডিয়েশন ভিকটিমস কনফারেন্সে ড. জে এফ ল্যাপিন জানিয়েছেন, চেরনোবিলের এই দুর্ঘটনায় ১৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ত্রাণকর্মীদের বেশির ভাগই ভুগছেন তেজস্ক্রিয়াজনিত ব্যাধিতে। সারা বিশ্বে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১৯৭২-৯৩ পর্যন্ত ছিল ১৮ শতাংশ, কিন্তু এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে বার্ষিক ৪ শতাংশে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং চেরনোবিল ও ফুকুশিমার দুর্ঘটনার আলোকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। এখানে চুল্লি নির্বাচনের বিষয়টা অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশের রূপপুরে যে ভিভিইআর-১০০০ চুল্লিটি বসানো হবে তা তৃতীয় জেনারেশনের এবং ইতিপূর্বে রাশিয়ায় ব্যবহূত জইগক চুল্লি থেকে ভিন্ন ও উন্নত।
তবু আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে অনেক প্রশ্ন থেকে যাবে। প্রথম প্রশ্ন হলো, আমরা কি একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর মতো দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেছি? যেহেতু রাশিয়ান চুল্লি এখানে বসানো হবে, তাই স্বাভাবিকভাবেই পারমাণবিক চুল্লি পরিচালনা-সংক্রান্ত বইপুস্তক, ম্যানুয়াল সবই রাশিয়ান ভাষায় তৈরি করা আছে। আমাদের দেশের প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের প্রথমে রাশিয়ান ভাষা শিখতে হবে, তারপর পরিচালনা কাজে অংশগ্রহণ করার প্রশ্ন আসবে। এখানে দীর্ঘ সময়ের প্রশিক্ষণ ছাড়াও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ ও সতর্কতার প্রয়োজন আছে। এসব পরীক্ষায় কি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারব? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: পদ্মার তীরবর্তী রূপপুরে পলিগঠিত নমনীয় মাটিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারটা কতটা ঝুঁকিমুক্ত, সেটাও বিভিন্ন পরিবেশগত সমীক্ষার মাধ্যমে খতিয়ে দেখতে হবে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার বিশেষজ্ঞ মহল থেকে জানা গেছে, রূপপুর ভূচ্যুতির ওপর অবস্থিত। এ ধরনের ভূচ্যুতি ভূমিকম্পের উৎসস্থল হয়। কাজেই জায়গাটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো : পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকআপ শীতলীকরণ ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা জরুরি। রূপপুরে যেখানে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপিত হতে যাচ্ছে, ওই স্থানের নিকটবর্তী কোনো পানির উৎস নেই। কোনো অজ্ঞাত কারণে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে চুল্লির বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হবে, তখন বাইরের উৎসের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে পাম্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে পানি এনে চুল্লি ঠান্ডা করার কাজ চালু করতে হবে। এরপর জরুরিভাবে মানুষ সরিয়ে কোথায় নেওয়া যাবে?
তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফুকুশিমা থেকে প্রথম পর্যায়ে ৮০ হাজার এবং পরে দুই লাখ মানুষ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফুকুশিমার পারমাণবিক চুল্লির তেজস্ক্রিয়তা ওই স্থান থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে টোকিও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। জাপানের ঘরে ঘরে এখন তেজস্ক্রিয়তা মাপার জন্য ‘ডোসিমিটার’ ব্যবহার হচ্ছে।
একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো পরিচালন ব্যয় নেই ঠিকই, কিন্তু চালু করার আগে অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবে ত্রুটিমুক্ত অবকাঠামো তৈরি, জ্বালানি এবং তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিখুঁতভাবে পরিচালনা, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা, কেন্দ্রের কাছাকাছি কর্মীদের বাসস্থান ও লবণমুক্ত পানির অবারিত উৎস এবং একটি বিশাল দক্ষ পারমাণবিক প্রকৌশল জ্ঞানসম্পন্ন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা।
স্মরণ করা যেতে পারে, জীবন বাজি রেখে ফুকুশিমার প্ল্যান্টের কর্মীরা কাজ করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, সমগ্র কার্যক্রমে স্বচ্ছতা বিধান এবং জনগণকে ঝুঁকি এবং লাভের বিষয়টা পরিষ্কারভাবে জানানো। অর্থাৎ দেশবাসী অবশ্যই জানবে দেশের বা অঞ্চলের পরিবেশগত অবস্থার নিরিখে এবং ঝুঁকির মাপকাঠিতে প্রাপ্তি কতটা বেশি বা কম। একটি কথা মনে রাখা দরকার: ফুকুশিমা চুল্লি দুর্ঘটনার বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণে আনতে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেন্দ্রের ধারেকাছে স্বাদু পানির উৎসের অভাব। উত্তপ্ত চুল্লি ঠান্ডা করতে সাগরের লোনা পানি ব্যবহার করার জন্য চুল্লিগুলো একেবারে অকার্যকর হয়ে গেছে।
এখানে জানা দরকার, পারমাণবিক চুল্লি কীভাবে কাজ করে? নিয়ন্ত্রিত ফিশন শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মাধ্যমে পারমাণবিক চুল্লি শক্তি উৎপাদন করে। ফিশন কথার অর্থ হলো ভেঙে ফেলা। পারমাণবিক বিক্রিয়ার প্রধান জ্বালানি হলো ইউরেনিয়াম ধাতু। প্রাকৃতিকভাবে এই ইউরেনিয়াম ধাতু বাংলাদেশ ছাড়া অনেক দেশেই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে ফিশনযোগ্য ট-২৩৫-এর পরিমাণ মাত্র ০ দশমিক ৭ শতাংশ, বাকি সব ট-২৩৮, যা ফিশনযোগ্য নয়। শ্লথগতির নিউট্রন দ্বারা ভারী ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে আঘাত করা হলে এটা নিউট্রন শোষণ করে ট-২৩৬ নিউক্লিয়াস গঠন করে ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে দুটি হালকা ফিশনযোগ্য নিউক্লিয়াসে বিভক্ত হয়ে শক্তি উৎপাদন করে এবং একই সঙ্গে আরও কয়েকটি নিউট্রন অবমুক্ত করে। এভাবে স্বয়ংক্রিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটতে থাকে।
রূপপুরে যে চাপযুক্ত হালকা পানির তৃতীয় জেনারেশনের চুল্লি বসানো হবে, তাতে চারটি দরকারি উপাদান থাকবে। এগুলো হলো: শক্তি উৎপাদনের জন্য ইউরেনিয়াম ধাতু, যা প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হবে, নিউট্রনের গতি শ্লথ করার জন্য মডারেটর, চুল্লির কেন্দ্র থেকে তাপ সরিয়ে নেওয়ার জন্য শীতক যন্ত্র, নিউট্রনের গতি শ্লথ করা, কিংবা গতি বাড়ানো অথবা পারমাণবিক ফিশন বিক্রিয়া একেবারে বন্ধ করার জন্য নিয়ন্ত্রক দণ্ড। তেজস্ক্রিয় ফিশন উপাদানসমূহ যাতে কোনোভাবেই বাইরে আসতে না পারে, সে জন্য ইউরেনিয়াম দণ্ডগুলো জারকোনিয়াম সংকর ধাতুর অত্যন্ত কঠিন আবরণে আবৃত করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, প্লুটোনিয়ামের মতো বিশাল অর্ধ-জীবনের তেজস্ক্রিয় ফিশন খণ্ডাংশ এবং ব্যবহূত তেজস্ক্রিয় জ্বালানি নিরাপদ ভান্ডারজাতকরণ, রাশিয়ায় নিরাপদ পরিবহন ও তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় ভস্ম পানি ছিটিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যায় না, এটা নিষ্ক্রিয় হবে ফিশন খণ্ডাংশের অর্ধ-জীবনের স্কেলে। তাই পারমাণবিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই।
মো. আসাদ উল্লাহ খান: বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
aukhandk@gmail.com
No comments