দুর্দিনের মৌসুমি সাদিকের জীবনসঙ্গী by কমল জোহা খান
পায়ের নিচে ভিত নড়ে উঠেছিল তাঁদের। ধসে পড়েছিল ছাদ। একটা খুঁটির পাশে
আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পান তাঁরা। দুই মানব-মানবীর দুর্দিন কাছে আসার সেই টান
এখন মজবুত বিয়ের বন্ধনে। একছাদের নিচে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করছেন
তাঁরা।
>>নিজ বাসায় সাদিক ও মৌসুমি। ছবি: ছবি কমল জোহা খান
রানা প্লাজা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া এই দুজন হলেন সাদিক ও মৌসুমি। সে দিনের ঘটনা যা ছিল—হঠাত্ ধস। পাশে থাকা মেয়েটির হাত ধরে টেনে পিলারের নিচে আশ্রয় নেন রানা প্লাজার নিউ ওয়েব বটম লিমিটেডের কোয়ালিটি মাস্টার কিউএমএ সাদিক। চলে বাঁচার বিরামহীন লড়াই। চতুর্থ দিন উদ্ধার হন মেয়েটি। পরদিন সকালে সাদিক। চরম দুর্দিনের সঙ্গী সেই মেয়ে মৌসুমি আক্তারকে শেষ পর্যন্ত জীবনসঙ্গী করেছেন সাদিক। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর বিয়ে করেছেন তাঁরা। এখন চলছে তাঁদের সুখের সংসার।
গত বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই ভবনধসের প্রথম বর্ষপূর্তি আজ বৃহস্পতিবার। ওই দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে গতকাল বুধবার রাতে রানা প্লাজার সামনে আলোক প্রজ্বালন অনুষ্ঠান হয়। সেখানে উপস্থিত সাদিকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর।
রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় আটকা পড়েছিলেন ২৮ বছরের যুবক সাদিক। টানা পাঁচ দিন, ঘড়ির কাঁটা হিসাবে ১০০ ঘণ্টা বাঁচার লড়াই করেন তিনি। এরপর ২৮ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই তাঁকে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সেখানে তিন দিন তাঁর চিকিত্সা চলে। ডান পায়ের ভাঙা পাতায় ব্যান্ডেজ লাগানো হয়। পরে তাঁকে সেখান থেকে চলে আসতে হয়। চার মাস নিজেই নিজের চিকিত্সা চালিয়ে যান। সাভারের ব্যাংক কলোনির ভাড়া বাসা থেকে কখনো পাশের সিআরপি, কখনো পঙ্গু হাসপাতালে ছোটাছুটি করেন তিনি।
উদ্ধারের পর সাদিককে নিয়ে গণমাধ্যমে দিন কয়েক বেশ আলোচনা চলে। কয়েকটি এফএম রেডিওর অনুষ্ঠানে দুর্বিষহ সেই দিনগুলোর গল্পও শুনিয়েছেন তিনি। তবে দুর্দিনে চিকিত্সার জন্য মাত্র ১০ হাজার টাকা সাহায্য পেয়েছেন তিনি।
সাদিক জানান, তাঁর বাবা আহসান ফারুক সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অন্তত ৫০টি জায়গায় সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু একটি টাকাও সাহায্য আসেনি। নিজের ব্যবস্থায় চিকিত্সা চালাতে হয়েছে।
এখন হাঁটতে পারেন সাদিক। তবে ডান পায়ের পাতা বেঁকে গেছে। ফোলা ফোলা ভাব আছে। হাঁটতে গেলে যন্ত্রণা হয়। কথাগুলো বলতে গিয়ে যন্ত্রণার অনুভূতিটা তাঁর চোখে-মুখে ফুটে ওঠে।
দুর্ঘটনার পর প্রায় ১০ মাস বেকার জীবন কাটিয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সাদিক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আশুলিয়ার পূর্ব নরসিংহপুরে সারাফ অ্যাপারেলস নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছেন তিনি।
মৃতপুরী থেকে বেঁচে আসার পর আবার পোশাক কারাখানায় চাকরি! জানান, এ ছাড়া গতি নেই তাঁর। এই চাকরিই তাঁর নিয়তি। সাদিকের বিশ্বাস, এবার আর ভবনধস হবে না, ‘নতুন গার্মেন্টসের পিলার বেশ মজবুত।’
সাদিক জানান, পোশাক কারাখানার পাশাপাশি ডাটা এন্ট্রিসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন তিনি। হোটেল ম্যানেজমেন্টে অনার্সে আট সেমিস্টারের মধ্যে পাঁচ সেমিস্টার শেষ করেছেন। তবে পড়াশোনাটা আর এগোয়নি।
আলোক প্রজ্বালন অনুষ্ঠানে সাদিকের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকা মোমবাতিগুলোর দিকে। হতাশা আছে। তবুও স্বস্তি, ‘চাপা পইড়্যা মরলে আজ আমার জন্যও মোমবাতি জ্বলত।’
মোমবাতি না হয়ে জীবনে প্রদীপ জ্বালছেন সাদিক। রানা প্লাজা ধসের বছর পূর্তিতে নতুন অফিস থেকে আজ ছুটি নিয়েছেন তিনি। সারা দিন বাসায় কাটাবেন মা-বাবা, ছোট বোন আর স্ত্রী মৌসুমিকে নিয়ে। বিকেলে স্ত্রীকে নিয়ে বের হবেন ঘুরতে—জীবনের খোঁজে।
No comments