শোকের দহনে স্বজনেরা-রানা প্লাজা ধস: ১১৩৫ প্রাণহানির এক বছর by আশীষ-উর-রহমান
তপ্ত দুপুর শরীরের সব পানি নিংড়ে নিচ্ছে।
দোকানের সামনে মোটা কাপড় দিয়ে রোদ ঠেকানোর ব্যবস্থা। ভেতরে লেনদেনে ব্যস্ত
কামাল হোসেন। ভিড় একটু কমতেই প্রশ্নটি করলাম। শুনেই ভরদুপুরে সন্ধ্যার মলিন
ছায়া নেমে এল তাঁর মুখে।
>>গত বছর এই দিনে সর্বনাশ হয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ের রাবিয়া বেগমের। রানা প্লাজা ধসে নিখোঁজ হলো মেয়ে রেহেনা পারভীন। আজও সন্ধান মেলেনি তাঁর। মেয়ের ছবি হাতে সন্তানহারা এই মায়ের বুকফাটা নিষ্করুণ আহাজারিতে গতকাল ভারী হয়েছিল বাতাস। রানা প্লাজার সামনে থেকে তোলা ছবি । সাহাদাত পারভেজ
রানা
প্লাজার উত্তর পাশে ছোট্ট দোকান কামালের। ‘টাঙ্গাইল মুসলিম কনফেশনারী’। এত
কাছে যখন, নিশ্চয়ই রানা প্লাজার কর্মীরা এখানে কেনাকাটা করতে আসতেন,
তাঁদের কারও কথা কি মনে পড়ে?
কামাল বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকে আসত।’
কামাল ভাবেন, কারও নাম মনে পড়ছে না। গত এক বছরে স্মৃতির পাতায় বেশ ধুলো জমেছে। এক বছর হয়ে গেল রানা প্লাজা ধসের। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই চোখের তারা একটু উজ্জ্বল হলো যেন।
‘ও হ্যাঁ, একটা ছেলের কথা মনে পড়ছে। ওর নাম মিল্লাত। লাইন সুপারভাইজার ছিল হয়তো। লাঞ্চের সময় প্রায়ই আসত। ও...হ্যাঁ, ...রিফাত রিফাত....আরেকজনের কথা মনে পড়ছে। গায়ের রং একটু চাপা ছিল। খুব হাসিখুশি। উত্তরবঙ্গের ওদিকে বাড়ি...।’ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতির ভেলায় ভাসতে থাকেন কামাল।
রানা প্লাজা ধসে তাঁর কোনো স্বজন হতাহত হননি। কোনো আর্থিক ক্ষতি হয়নি তাঁর। তবু এক বছর পর হারিয়ে যাওয়া চেনা মুখগুলো মনে করে বেদনায় মলিন হয়ে উঠেছিল তাঁর চেহারা।
কারণ, এই দোকানের সামনে দিয়েই সকাল-সন্ধ্যায় যাতায়াত ছিল ওঁদের। এক বছর ধরে না দেখা অনেকের নাম মনে নেই, মুখটি মনে আছে। ‘মনে হলে খুব খারাপ লাগে’ কামালের। সেই খারাপ লাগা এড়াতেই গত সোমবার ভরদুপুরে ক্রেতাহীন দোকানের তাক থেকে অযথাই এটা-ওটা ওঠানামা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি।
রানা প্লাজা—কেউ বলে অভিশপ্ত ভবন। কারও মতে মৃত্যুফাঁদ। পুকুর বুজিয়ে কাঁচা মাটির ওপর নয়তলা ভবন। রোদঝলমলে এক সকালে ধসে পড়ল তাসের ঘরের মতো। সেখানে এখন আবার সেই গভীর খাদ। টিনের বেড়ায় ঘেরা।
পাশেই ‘নিখোঁজ’ ছেলে বিল্লালের ছবি নিয়ে রোজ এসে বসে থাকেন বৃদ্ধ চান মিয়া। মেয়ে পারভিন আক্তারের ছবি নিয়ে আবুল কাশেম মোল্লা। আসেন সখিনা বেগমও।
কেন আসেন?
‘ক্যান আসি কইতে পারি না। হারাক্ষণ বুকের মইদ্যে হা-হুতাশ অয়। মাইয়াডা এইখানে কাম করত। মনডা ছুইট্যা আসে।’ বলছিলেন সখিনা বেগম। মারা গেছেন তাঁর অষ্টাদশী মেয়ে সালমা আক্তার। লাশ পেয়েছিলেন তিন দিন পর। থাকেন সাভার ব্যাংক কলোনিতে। মসলা বাটেন সাভার বাজারে এক হোটেলে। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি যা-ই থাক, দিনে একবার খাদটির সামনে তাঁর আসা চাই।
আশপাশের লোকেরা জানালেন, প্রতিদিনই স্বজনহারা, আহত, ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ না কেউ এখানে আসেন। শুক্রবারে নাকি ‘মেলার মতো’ লোক হয়।
সে তো হতেই পারে। এক ঝটকায় মারা গেলেন হাজারের বেশি মানুষ। জীবিত উদ্ধার করা ২৪৩৮ জনও আহত কমবেশি। তাঁদের পরিবার আছে, আত্মীয়স্বজন আছে। কেউ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, কেউ পাননি। কেউ আরও কিছু পাওয়ার আশা রাখেন। সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি অনেকে।
মিলন শেখের স্ত্রী লাকি কোমরে আঘাত পেয়েছিলেন। ভালো করে হাঁটতে পারেন না। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, মনের মধ্যে ঢুকেছে ‘ভয়’, ঘর থেকে বের হতেই চান না। মিলন দিনমজুর। স্ত্রীর কোনো অঙ্গহানি না হওয়ায় তেমন কোনো আর্থিক সাহায্যও পাননি। দুজনের আয়ে সংসার চলত। সাভারেই বাঁশপট্টিতে ২২০০ টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। এখন একার আয়ে সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম খান মিলন। যদি কিছু পাওয়া যায়, সেই দুরাশায় মাঝেমধ্যে ছুটে আসেন এখানে।
এভাবে নিয়মিত আসতে আসতে এই মানুষগুলো একে অন্যের আপন হয়ে উঠেছেন। গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত বন্ধন। সাহায্য-সহযোগিতার কিছু আভাস-ইঙ্গিত মিললে ফোন-টোন করে দ্রুত সবাই একত্র হন টিনে ঘেরা খাদটির সামনে, যে খাদটি তাঁদের এই খাদে ফেলেছে।
অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই দেখা হয়ে গেল মুনজেলা বেগমের সঙ্গে। তাঁর ফোন নম্বরটি ছিল। পুরোনো নোটবই খুঁজে সেই নম্বরে ফোন করতেই ভেসে এল, ‘দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ কলড ইজ নট ইন সার্ভিস’।
মুনজেলার কথা হয়তো অনেকের মনে থাকবে। ভবনধসের দিনে (গত বছরের ২৪ এপ্রিল) এক অজ্ঞাতনামা যুবককে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। মাথায়, কোমরে, পায়ে গুরুতর আঘাত। তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। মানিকগঞ্জের এক মা ২৬ এপ্রিল এসে যুবকটিকে তাঁর ছেলে জাহাঙ্গীর বলে দাবি করেন। হাসপাতালের খাতায় জাহাঙ্গীর নামে পরিচয় পান যুবকটি। এরপর ২৮ এপ্রিল মিঠাপুকুরের জায়গীরহাটের মুনজেলা বেগম এসে দাবি করেন, যুবকটি তাঁর ছেলে মনোয়ার হোসেন। যুবকটিকে ঘিরে দুই পরিবার হাসপাতালে অপেক্ষায় থাকে। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘কাছের মা দূরের মা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যুবকটি মারা যান ১০৭ দিন পর। তত দিনে মুনজেলাই তাঁর আসল মা, এই পরিচয় নিশ্চিত হয়।
মুনজেলার নতুন ফোন নম্বর দিলেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক রওশন আক্তার চৌধুরী। জানালেন, পত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি তখন প্রায় নয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন মনোয়ারের জন্য। মুনজেলা গত সপ্তাহে সাভারে এসেছিলেন। উঠেছেন ফুলবাড়ীতে এক আত্মীয়ের কাছে। সেখানেই কথা হলো। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দেওয়া এক লাখ টাকা অনুদান নিতেই মুনজেলার আসা।
এর আগে পাওয়া টাকা থেকে চার লাখ রেখেছেন ব্যাংকে। বাকি টাকায় তিন বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে আবাদ করছেন। স্বামী আবুল হোসেনের কাজের সামর্থ্য নেই। নিজেই ধরেছেন সংসারের হাল। কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘টাকা তো পাইছি। কিন্তু আমার বাজানের মুখে একবার মা ডাক শুনতে পাইলাম না।’
পুরোনো নোটবইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ‘ফজলু মিয়া’ নামটির ওপর চোখ আটকে গেল। অধর চন্দ্র স্কুল মাঠ, যেখানে রানা প্লাজায় নিহত ব্যক্তিদের লাশ এনে রাখা হতো, সেখানে দেখা হয়েছিল গত বছরের ২৮ এপ্রিল। পাগলপ্রায় অবস্থা। স্ত্রী পারভিন বেগমকে খুঁজতে হাসপাতাল, মর্গ, কবরস্থান, স্কুলে ছুটছিলেন মাইক্রোবাস নিয়ে। সাভারের এক রেন্ট-এ-কারের মাইক্রোবাস চালাতেন তিনি। নিজে ধ্বংসস্তূপের চারতলা পর্যন্ত নেমেছিলেন। গত সোমবার জানালেন, ঘটনার ১০ দিন পর পেয়েছিলেন স্ত্রীর লাশ। শনাক্ত করার কাহিনিও মর্মস্পর্শী। পারভিনের সঙ্গে আইডি কার্ড বা মোবাইল ফোন কিছু ছিল না। কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ফজলু মিয়া জানান, পারভিনের কোমরের ঘুনসিতে ঘরের একটি চাবি বাঁধা আছে। একই তালার আরেকটি চাবি থাকে তাঁর কাছে। বাসা থেকে তালা এনে লাশের কোমর থেকে পাওয়া চাবি দিয়ে তা খোলা হলো। পাওয়া গেল লাশের পরিচয়।
ফজলুর বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। একটি মেয়ে। সাত বছরে পড়েছে ফাইজা খাতুন। মায়ের জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। ঢাকায় ফজলুরও মন টিকছিল না। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। মুদিখানা দিয়েছেন গাড়ি চালানো ছেড়ে।
পুরোনো নোটবই ঘাঁটতে গিয়ে কত মানুষের নাম, কত যন্ত্রণাকাতর মুখ ফিরে আসছে স্মৃতিতে। কম তো নয়, সহস্রাধিক মানুষের প্রাণ গেল অকারণে। অফিসে ফিরে দেখি, টেবিলে পড়ে আছে একটি নিমন্ত্রণপত্র। তাতে মোটা হরফে ছাপা ‘১১৩৪’, নিচে ছোট করে লেখা ‘সংখ্যা নয়, প্রাণ’। (সরকারি হিসাবে সংখ্যাটি ১১৩৫)। রানা প্লাজা ধসের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশেষ প্রদর্শনী হবে, তার আমন্ত্রণপত্র। কেমন যেন ধাক্কা লাগে বুকের গভীরে। তবু মনে হয়, প্রাণের চেয়ে সংখ্যাই যেন বড় এই বাণিজ্যশাসিত সময়ে। সেই সংখ্যার জোরে বিশ্বজোড়া এত তুলকালাম, এত নিন্দা, সমালোচনার ঝড়।
এসব খবরের মধ্যে চোখে ভাসে চেনা দৃশ্য। কাকভোরে পোশাকশ্রমিকেরা সারি দিয়ে চলেছেন কারখানার পথে। সন্ধ্যায় মাথা নিচু করে অবসন্ন শরীরে এক চিলতে খুপরিঘরের দিকে ফিরছেন একপেট ক্ষুধা নিয়ে। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। দুটো ঝলসানো রুটি বা কয়েক মুঠো সেদ্ধ চাল এখনো কঠিন সত্য হয়ে আছে বহু মানুষের জীবনে। এরই জন্য উদয়াস্ত খাটা, মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়া। এরই নাম বেঁচে থাকা, এরই নাম জীবন। তাই তো, আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সেই জীবনের পথ ধরে এগিয়ে যান পুত্রহারা মুনজেলা।
কামাল বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকে আসত।’
কামাল ভাবেন, কারও নাম মনে পড়ছে না। গত এক বছরে স্মৃতির পাতায় বেশ ধুলো জমেছে। এক বছর হয়ে গেল রানা প্লাজা ধসের। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই চোখের তারা একটু উজ্জ্বল হলো যেন।
‘ও হ্যাঁ, একটা ছেলের কথা মনে পড়ছে। ওর নাম মিল্লাত। লাইন সুপারভাইজার ছিল হয়তো। লাঞ্চের সময় প্রায়ই আসত। ও...হ্যাঁ, ...রিফাত রিফাত....আরেকজনের কথা মনে পড়ছে। গায়ের রং একটু চাপা ছিল। খুব হাসিখুশি। উত্তরবঙ্গের ওদিকে বাড়ি...।’ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতির ভেলায় ভাসতে থাকেন কামাল।
রানা প্লাজা ধসে তাঁর কোনো স্বজন হতাহত হননি। কোনো আর্থিক ক্ষতি হয়নি তাঁর। তবু এক বছর পর হারিয়ে যাওয়া চেনা মুখগুলো মনে করে বেদনায় মলিন হয়ে উঠেছিল তাঁর চেহারা।
কারণ, এই দোকানের সামনে দিয়েই সকাল-সন্ধ্যায় যাতায়াত ছিল ওঁদের। এক বছর ধরে না দেখা অনেকের নাম মনে নেই, মুখটি মনে আছে। ‘মনে হলে খুব খারাপ লাগে’ কামালের। সেই খারাপ লাগা এড়াতেই গত সোমবার ভরদুপুরে ক্রেতাহীন দোকানের তাক থেকে অযথাই এটা-ওটা ওঠানামা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি।
রানা প্লাজা—কেউ বলে অভিশপ্ত ভবন। কারও মতে মৃত্যুফাঁদ। পুকুর বুজিয়ে কাঁচা মাটির ওপর নয়তলা ভবন। রোদঝলমলে এক সকালে ধসে পড়ল তাসের ঘরের মতো। সেখানে এখন আবার সেই গভীর খাদ। টিনের বেড়ায় ঘেরা।
পাশেই ‘নিখোঁজ’ ছেলে বিল্লালের ছবি নিয়ে রোজ এসে বসে থাকেন বৃদ্ধ চান মিয়া। মেয়ে পারভিন আক্তারের ছবি নিয়ে আবুল কাশেম মোল্লা। আসেন সখিনা বেগমও।
কেন আসেন?
‘ক্যান আসি কইতে পারি না। হারাক্ষণ বুকের মইদ্যে হা-হুতাশ অয়। মাইয়াডা এইখানে কাম করত। মনডা ছুইট্যা আসে।’ বলছিলেন সখিনা বেগম। মারা গেছেন তাঁর অষ্টাদশী মেয়ে সালমা আক্তার। লাশ পেয়েছিলেন তিন দিন পর। থাকেন সাভার ব্যাংক কলোনিতে। মসলা বাটেন সাভার বাজারে এক হোটেলে। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি যা-ই থাক, দিনে একবার খাদটির সামনে তাঁর আসা চাই।
আশপাশের লোকেরা জানালেন, প্রতিদিনই স্বজনহারা, আহত, ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ না কেউ এখানে আসেন। শুক্রবারে নাকি ‘মেলার মতো’ লোক হয়।
সে তো হতেই পারে। এক ঝটকায় মারা গেলেন হাজারের বেশি মানুষ। জীবিত উদ্ধার করা ২৪৩৮ জনও আহত কমবেশি। তাঁদের পরিবার আছে, আত্মীয়স্বজন আছে। কেউ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, কেউ পাননি। কেউ আরও কিছু পাওয়ার আশা রাখেন। সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি অনেকে।
মিলন শেখের স্ত্রী লাকি কোমরে আঘাত পেয়েছিলেন। ভালো করে হাঁটতে পারেন না। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো, মনের মধ্যে ঢুকেছে ‘ভয়’, ঘর থেকে বের হতেই চান না। মিলন দিনমজুর। স্ত্রীর কোনো অঙ্গহানি না হওয়ায় তেমন কোনো আর্থিক সাহায্যও পাননি। দুজনের আয়ে সংসার চলত। সাভারেই বাঁশপট্টিতে ২২০০ টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। এখন একার আয়ে সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম খান মিলন। যদি কিছু পাওয়া যায়, সেই দুরাশায় মাঝেমধ্যে ছুটে আসেন এখানে।
এভাবে নিয়মিত আসতে আসতে এই মানুষগুলো একে অন্যের আপন হয়ে উঠেছেন। গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত বন্ধন। সাহায্য-সহযোগিতার কিছু আভাস-ইঙ্গিত মিললে ফোন-টোন করে দ্রুত সবাই একত্র হন টিনে ঘেরা খাদটির সামনে, যে খাদটি তাঁদের এই খাদে ফেলেছে।
অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই দেখা হয়ে গেল মুনজেলা বেগমের সঙ্গে। তাঁর ফোন নম্বরটি ছিল। পুরোনো নোটবই খুঁজে সেই নম্বরে ফোন করতেই ভেসে এল, ‘দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ কলড ইজ নট ইন সার্ভিস’।
মুনজেলার কথা হয়তো অনেকের মনে থাকবে। ভবনধসের দিনে (গত বছরের ২৪ এপ্রিল) এক অজ্ঞাতনামা যুবককে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। মাথায়, কোমরে, পায়ে গুরুতর আঘাত। তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। মানিকগঞ্জের এক মা ২৬ এপ্রিল এসে যুবকটিকে তাঁর ছেলে জাহাঙ্গীর বলে দাবি করেন। হাসপাতালের খাতায় জাহাঙ্গীর নামে পরিচয় পান যুবকটি। এরপর ২৮ এপ্রিল মিঠাপুকুরের জায়গীরহাটের মুনজেলা বেগম এসে দাবি করেন, যুবকটি তাঁর ছেলে মনোয়ার হোসেন। যুবকটিকে ঘিরে দুই পরিবার হাসপাতালে অপেক্ষায় থাকে। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘কাছের মা দূরের মা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যুবকটি মারা যান ১০৭ দিন পর। তত দিনে মুনজেলাই তাঁর আসল মা, এই পরিচয় নিশ্চিত হয়।
মুনজেলার নতুন ফোন নম্বর দিলেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক রওশন আক্তার চৌধুরী। জানালেন, পত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি তখন প্রায় নয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন মনোয়ারের জন্য। মুনজেলা গত সপ্তাহে সাভারে এসেছিলেন। উঠেছেন ফুলবাড়ীতে এক আত্মীয়ের কাছে। সেখানেই কথা হলো। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দেওয়া এক লাখ টাকা অনুদান নিতেই মুনজেলার আসা।
এর আগে পাওয়া টাকা থেকে চার লাখ রেখেছেন ব্যাংকে। বাকি টাকায় তিন বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে আবাদ করছেন। স্বামী আবুল হোসেনের কাজের সামর্থ্য নেই। নিজেই ধরেছেন সংসারের হাল। কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘টাকা তো পাইছি। কিন্তু আমার বাজানের মুখে একবার মা ডাক শুনতে পাইলাম না।’
পুরোনো নোটবইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ‘ফজলু মিয়া’ নামটির ওপর চোখ আটকে গেল। অধর চন্দ্র স্কুল মাঠ, যেখানে রানা প্লাজায় নিহত ব্যক্তিদের লাশ এনে রাখা হতো, সেখানে দেখা হয়েছিল গত বছরের ২৮ এপ্রিল। পাগলপ্রায় অবস্থা। স্ত্রী পারভিন বেগমকে খুঁজতে হাসপাতাল, মর্গ, কবরস্থান, স্কুলে ছুটছিলেন মাইক্রোবাস নিয়ে। সাভারের এক রেন্ট-এ-কারের মাইক্রোবাস চালাতেন তিনি। নিজে ধ্বংসস্তূপের চারতলা পর্যন্ত নেমেছিলেন। গত সোমবার জানালেন, ঘটনার ১০ দিন পর পেয়েছিলেন স্ত্রীর লাশ। শনাক্ত করার কাহিনিও মর্মস্পর্শী। পারভিনের সঙ্গে আইডি কার্ড বা মোবাইল ফোন কিছু ছিল না। কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ফজলু মিয়া জানান, পারভিনের কোমরের ঘুনসিতে ঘরের একটি চাবি বাঁধা আছে। একই তালার আরেকটি চাবি থাকে তাঁর কাছে। বাসা থেকে তালা এনে লাশের কোমর থেকে পাওয়া চাবি দিয়ে তা খোলা হলো। পাওয়া গেল লাশের পরিচয়।
ফজলুর বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। একটি মেয়ে। সাত বছরে পড়েছে ফাইজা খাতুন। মায়ের জন্য সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। ঢাকায় ফজলুরও মন টিকছিল না। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। মুদিখানা দিয়েছেন গাড়ি চালানো ছেড়ে।
পুরোনো নোটবই ঘাঁটতে গিয়ে কত মানুষের নাম, কত যন্ত্রণাকাতর মুখ ফিরে আসছে স্মৃতিতে। কম তো নয়, সহস্রাধিক মানুষের প্রাণ গেল অকারণে। অফিসে ফিরে দেখি, টেবিলে পড়ে আছে একটি নিমন্ত্রণপত্র। তাতে মোটা হরফে ছাপা ‘১১৩৪’, নিচে ছোট করে লেখা ‘সংখ্যা নয়, প্রাণ’। (সরকারি হিসাবে সংখ্যাটি ১১৩৫)। রানা প্লাজা ধসের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশেষ প্রদর্শনী হবে, তার আমন্ত্রণপত্র। কেমন যেন ধাক্কা লাগে বুকের গভীরে। তবু মনে হয়, প্রাণের চেয়ে সংখ্যাই যেন বড় এই বাণিজ্যশাসিত সময়ে। সেই সংখ্যার জোরে বিশ্বজোড়া এত তুলকালাম, এত নিন্দা, সমালোচনার ঝড়।
এসব খবরের মধ্যে চোখে ভাসে চেনা দৃশ্য। কাকভোরে পোশাকশ্রমিকেরা সারি দিয়ে চলেছেন কারখানার পথে। সন্ধ্যায় মাথা নিচু করে অবসন্ন শরীরে এক চিলতে খুপরিঘরের দিকে ফিরছেন একপেট ক্ষুধা নিয়ে। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। দুটো ঝলসানো রুটি বা কয়েক মুঠো সেদ্ধ চাল এখনো কঠিন সত্য হয়ে আছে বহু মানুষের জীবনে। এরই জন্য উদয়াস্ত খাটা, মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়া। এরই নাম বেঁচে থাকা, এরই নাম জীবন। তাই তো, আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সেই জীবনের পথ ধরে এগিয়ে যান পুত্রহারা মুনজেলা।
No comments