স্বামীকে ফিরে পাওয়া কি অপরাধ? by এ কে এম জাকারিয়া

শুরুতে যা অপহরণ, পরে অনেক ক্ষেত্রেই তা এখন ‘গুম’। কেউ অপহরণ হয়েছেন শুনলেই এখন আতঙ্ক চেপে বসে; শেষ পর্যন্ত গুম হয়ে যাবেন না তো? আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত অপহূত হয়েছেন ২৬৮ জন। এঁদের মধ্যে ফিরে আসার সংখ্যা সবচেয়ে কম, মাত্র ২৪ জন। লাশ উদ্ধার হয়েছে ৪৩ জনের আর এখনো নিখোঁজ আছেন ১৮৭ জন। যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁরা ও তাঁদের পরিবারের লোকজন সৌভাগ্যবান। দুর্ভাগা পরিবারগুলো ফেরত পেয়েছে লাশ। আর যাঁরা এখনো নিখোঁজ তাঁদের পরিবারগুলোর অবস্থা? তাঁরা কি আশা ছেড়ে দিয়েছেন? নাকি এখনো অসময়ে দরজায় টোকা পড়লে চমকে ওঠেন, অপরিচিত নম্বরের ফোন রিসিভ করেন কোনো অবাস্তব ও অসম্ভব আশা নিয়ে! সবচেয়ে হতভাগা এঁরাই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এ বি সিদ্দিক যখন অপহরণ হলেন তখন একই আতঙ্ক-উদ্বেগ আমাদের সবার পেয়ে বসেছিল; তাঁকে ফিরে পাওয়া যাবে তো? রিজওয়ানা হাসান একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব, তাঁর স্বামীর অপহরণের খবরটি তাই স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যমে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি ৩৫ ঘণ্টা নিখোঁজ ছিলেন, এই সময়টি রিজওয়ানা ও তাঁর তিন সন্তানের কীভাবে কেটেছে, তা অনুমান করাও আমাদের জন্য কঠিন। গভীর রাতে যখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে তাঁর খোঁজ পাওয়ার খবর প্রচারিত হলো তখন আমরা স্বস্তি নিয়েই ঘুমাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই স্বস্তি যে কারও কারও জন্য এত ‘অস্বস্তি’ নিয়ে আসবে বা আসতে পারে তা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন!
স্বামীকে উদ্ধারের জন্য রিজওয়ানা তাঁর চেষ্টার শেষটুকু করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তিনি নিশ্চয়ই তা করেছেন। স্বামীকে পাওয়ার পর তিনি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়া এত দ্রুত উদ্ধার সম্ভব ছিল না। তিনি গণমাধ্যমের কর্মীদেরও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এটা আমরা অনুমান করতে পারি যে যারাই অপহরণ করে থাকুক না কেন বিষয়টি গণমাধ্যমসহ সরকারের বিভিন্ন মহলে গুরুত্ব পাওয়ায় একটি চাপ তৈরি হয়েছে এবং সেটা তাঁর ছাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে। কিন্তু বিষয়টি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে স্বামীকে ফেরত পাওয়াটাই যেন রিজওয়ানার জন্য বড় পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
অনেক হতভাগ্য পরিবার তাদের অপহূত বা গুম হওয়া স্বজনদের ফিরে আসার আশায় বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সাধারণ শত্রুতা—যে কারণেই তাঁরা অপহরণের শিকার বা গুম হয়ে থাকুক না কেন বা যারাই এর সঙ্গে জড়িত থাকুক, সবাই তাঁদের পরিবারের
কাছে ফিরে আসুক, সেটাই তো আমাদের সবার চাওয়া। রিজওয়ানার স্বামীর ক্ষেত্রে আমাদের সেই চাওয়াটি পূরণ হয়েছে। স্বামীকে ফিরে পেয়ে তিনি নিজেও বলেছেন, এটাই যেন অপহরণের শেষ ঘটনা হয়।
কিন্তু পরে এসব কী প্রতিক্রিয়া দেখছি? অনেকের আক্ষেপটা অনেকটা এ রকম যে এত লোক অপহরণের পর নিখোঁজ বা গুম হয়ে যান সেখানে রিজওয়ানা তাঁর স্বামীকে ফেরত পেলেন কেন বা কীভাবে? এ ধরনের নির্মম প্রশ্ন যদি কারও মনে উঠেও থাকে তাঁর ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আমরা কারও কারও মুখে এমন দাবিও শুনছি যে রিজওয়ানাকেই নাকি প্রমাণ করতে হবে যে তাঁর স্বামী কোথায় ছিলেন, কারা তাঁকে অপহরণ করেছেন, ইত্যাদি ইত্যদি। কী নিষ্ঠুর চাওয়া!
যেকোনো অপরাধের ঘটনা যখন ঘটে তখন এর তদন্তের জন্য কিছু মোটিভ ধরে এগোতে হয়। রিজওয়ানা পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করেন, ভূমি-জলাভূমি উদ্ধারে মাঠে নামেন, দখলকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন, ফলে তাঁর শত্রু থাকা অস্বাভাবিক নয়। কেন তাঁর স্বামী অপহরণের শিকার হয়ে থাকতে পারেন, সে প্রসঙ্গে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। এ ধরনের আশঙ্কার মানে নিশ্চয়ই এটা নয় যে এ কারণেই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। রিজওয়ানার স্বামীকে কারা অপহরণ করেছিল, কেনই বা তাঁকে ছেড়ে দিল সেই রহস্যভেদ এবং অপহরণকারীদের আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, তাদের কাছে সেই দাবি আমরা করতে পারি। কিন্তু রিজওয়ানার কাছে কি এমন দাবি করা যায়?
রিজওয়ানার স্বামী অপহরণ ও ৩৫ ঘণ্টা পর তাঁকে উদ্ধার বা ফিরে পাওয়ার পর কিছু গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর প্রতিষ্ঠান পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ও হচ্ছে। বেলা কী কাজ করে, সে ব্যাপারে দেশের সচেতন নাগরিকেরা নিশ্চয়ই সচেতন আছেন। এর পরও প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরছি। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক এই লিগ্যাল প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ‘গ্লোবাল ৫০০ রোল অব অনারে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০০৭ সালে বেলা পেয়েছে সরকারের ‘পরিবেশ পুরস্কার’। রিজওয়ানা হাসান নিজে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে ‘গোল্ডম্যান এনভার্নোমেন্টাল প্রাইজ’ ও ২০১২ সালে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন।
তবে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেলা বা একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে রিজওয়ানা যত স্বনামধন্যই হোন না কেন বেলার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন হতেই পারে। সেখানে কোনো অস্বচ্ছতা বা প্রতিষ্ঠানের কোনো ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলে তা অবশ্যই তোলা যেতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি রিজওয়ানার স্বামী অপহরণের পর অনেকেই উঠেপড়ে লেগেছেন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেলা কতটা খারাপ, এমনকি কতটা ‘পরিবেশবিরোধী’ তা প্রমাণে! অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রিজওয়ানার বাবা-চাচার রাজনৈতিক অতীত তুলে ধরতে। যাঁরা এসব করছেন তাঁদের উদ্দেশ্য আসলে কী? প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেলার কোনো ত্রুটি বা সমস্যা প্রমাণিত হলে বা রিজওয়ানার বাবা-চাচাদের রাজনৈতিক অতীত কারও পছন্দ না হলে কি তাঁর স্বামীর অপহরণের বিষয়টি জায়েজ হয়ে যাবে?
রাজনৈতিক বা সামাজিক, সব ক্ষেত্রেই বিভেদ ও বিদ্বেষের মনোভাব আমাদের সবার মধ্যেই দিন দিন জোরালো হয়ে উঠেছে। এটা এমন চরমে গিয়ে ঠেকেছে যে আমাদের মানবিক বোধ ও বিচার-বিবেচনার জায়গাগুলোও সম্ভবত আর কাজ করছে না। স্বামী অপহরণ হওয়ার পর রিজওয়ানা পার করেছেন দুঃসহ ৩৫ ঘণ্টা, সেই ধাক্কা সহজে কাটিয়ে ওঠার নয়। স্বামীকে ফিরে পাওয়ার পর তাঁকে সামান্য স্বস্তি দিতেও আমরা অপারগ হয়ে গেছি! রিজওয়ানা, আমাদের ক্ষমা করবেন।

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.