চিকিৎসকের উপাখ্যান by আতাউর রহমান
প্রত্যেক ক্রিকেটারের পেশাগত জীবনে কখনো
কখনো একটি খরা বা বন্ধ্যত্ব পিরিয়ড আসে, যেমন দেখা গেল সদ্যসমাপ্ত
টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ টুর্নামেন্টে। তেমনি প্রত্যেক লেখকও কখনো কখনো
বন্ধ্যত্বের কবলে পড়েন। সাম্প্রতিক প্রলম্বিত রোগমুক্তির পর আমার অবস্থাও
দাঁড়িয়েছিল তা-ই। যখন লেখালেখির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছিলাম, তখন হঠাৎ
আমার মনে এই ভাবনার উদয় হলো যে চিকিৎসকদের উপাখ্যান দিয়েই নাহয় বরফ গলানোর
চেষ্টা করা যাক।
বাস্তবিক হাস্যরসের উপাদান হিসেবে চিকিৎসক তথা চিকিৎসাশাস্ত্র হচ্ছে যেন একটা স্বর্ণখনি। কেননা চিকিৎসাবিদ্যা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম আদি পেশা আর মনুষ্যজীবনে জন্ম ও মৃত্যু দুই ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের উপস্থিতি প্রায় অপরিহার্য। অবশ্য সেই নির্বোধ ছেলেটির গল্পের মতো যদি হয়, তবে সেটা আলাদা ব্যাপার। তাকে এক সহপাঠী যখন একটি হাসপাতালের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, আমার জন্ম হয়েছে এই হাসপাতালে, তখন সে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল, কেন? তোর কী হয়েছিল? বোধ করি এই ছেলেটিকেই তার যুবা বয়সে শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যখন বলল, ‘কিরে, আমাকে চিনলি না? পাঠশালায় আমরা একসঙ্গে পড়তাম,’ তখন সে জবাব দিয়েছিল, ‘ফাজলামি করার আর জায়গা পেলে না? পাঠশালায় দাড়িওয়ালা কেউ আমার সঙ্গে পড়ত না।’
তা সে যা হোক। এখনকার যুগ স্পেশালাইজেশনের যুগ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রও এর ব্যত্যয় নয়। আমাদের শৈশবকালে বর্তমানে লুপ্ত এলএমএফ পাস করা হলেই মনে করা হতো, বড় ডাক্তার আর এমবিবিএস পাস হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এখন আর শুধু এমবিবিএসের ওপর ভরসা করা হয় না। সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো যেভাবে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ গজিয়ে উঠেছে, তাতে ভরসা করা যুক্তিযুক্তও নয়। এখন এমআরসিপি, এফআরসিএস ইত্যাদি বিদেশি ডিগ্রি না হলে চলে না। এঁদের বলা হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ‘বিশেষজ্ঞ’ মানে বিশেষভাবে অজ্ঞ নয়, বরং অল্প বিষয়ে অধিক জানেন তেমন একজন। তাই তো এক রোগী বাঁ চোখে ব্যথা নিয়ে জনৈক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে তিনি বলে বসলেন, ‘দুঃখিত, আমি ডান চোখ বিশেষজ্ঞ; তাই কেবল ডান চোখ দেখি, বামটা দেখি না।’
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আজকাল রোগীদেরই নির্ণয় করতে হয় তাদের কী অসুখ হয়েছে, তারপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে লাইন লাগাতে হয়। কারও কারও উপাধি ‘কনসালট্যান্ট’ এবং বলা হয়ে থাকে একজন কনসালট্যান্ট হচ্ছেন সেই চিকিৎসক, যাঁকে কল করা হয় রোগীর অন্তিম মুহূর্তে মৃত্যুজনিত অপবাদের অংশীদার হওয়ার জন্য।
আজকাল তো দেশে খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কমতি নেই; তবু নব্য ধনীর মধ্যে একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সামান্য অসুখবিসুখ হলেই বিলেত-আমেরিকা কিংবা নিদেনপক্ষে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান।
তো একবার এক লোক দেশীয় বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে চিকিৎসক তাঁকে ‘লোকাল অ্যানেসথেসিয়া’ দেওয়ার কথা শোনাতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার টাকাপয়সার অভাব নেই; আপনি লোকাল জিনিসের পরিবর্তে বিদেশি ইমপোর্টেড জিনিসের ব্যবস্থা করুন।’ আরেক নব্য ধনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক যখন প্রশ্ন করলেন, আপনার অসুখটা কী? তখন তিনি উদ্ধত ভঙ্গিতে বললেন, সেটা আপনিই তো নির্ণয় করবেন! চিকিৎসক তখন বললেন, তাহলে আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আমার এক বন্ধু আছেন পশুচিকিৎসক। তাঁকে টেলিফোন করে আনাই;
তিনি প্রশ্নোত্তর ছাড়াই ব্যবস্থাপত্র দিতে সক্ষম।
তা অন্য অনেক পেশাজীবীর মতো চিকিৎসকেরাও হিউমার ও উপস্থিত বুদ্ধির দিক দিয়ে কম যান না। আরও গোটা কয়েক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এক রোগী আরোগ্য লাভের পর যখন চিকিৎসকের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনার ঋণ কীভাবে পরিশোধ করব বুঝতে পারছি না।’ তখন ঝটপট উত্তর এল, ‘ক্যাশ অথবা চেকের মাধ্যমে।’
আরেকজনের ছোট শিশু বলপয়েন্ট কলম গিলে ফেলায় তিনি পরিচিত চিকিৎসককে টেলিফোন করলে চিকিৎসক জানালেন যে তিনি ১৫ মিনিটের মধ্যে আসছেন। অতঃপর উদ্বিগ্ন পিতার ‘ততক্ষণ কী করব’ প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক একগাল হেসে জবাব দিলেন, ততক্ষণ পেনসিল
ব্যবহার করতে থাকুন। এক নতুন পাস করা চিকিৎসক রোগীর রোগ নির্ণয় করতে না পেরে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এই রোগটা কি ইতিপূর্বেও আপনার ছিল? রোগী হ্যাঁ বলতেই তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, তাহলে জানুন, আপনার ওই পুরোনো রোগটা আবার ফিরে এসেছে।
এক চক্ষু চিকিৎসকের বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত সভায় মঞ্চের পেছনে বিরাট এক চোখ আঁকা। এই মুহূর্তে আপনার ভাবনা কী? প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক মুখে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বললেন, সেই কখন থেকে আমিও ভাবছি, ভাগ্যিস, আমি আই স্পেশালিস্ট, ‘গাইনোকলজিস্ট’ নই!
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
No comments