ছাত্রলীগ ভালো, না ছাত্রদল?

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি হতে ইচ্ছুক এমন ছয়জন নেতৃস্থানীয়কে মঞ্চে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ছাত্রলীগের দলীয় সংগীতটি জানা আছে কি না। সবাই ছিলেন নিরুত্তর। তাঁদের কাছে সংগঠনের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে জানতে চান তিনি। তখনো তাঁরা নীরব থেকেছেন। খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সভাপতি। তবে আমরা এ সংবাদ পাঠ করে তাঁর মতো বিস্মিত হতে পারিনি। কারণ, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শাখা নয়, এখন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যাঁরা আসতে চান, তাঁদের কাছে দলীয় সংগীত বা গঠনতন্ত্র সম্পর্কে জানার চেয়েও অনেক মূল্যবান হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নির্মাণ বা সংস্কারকাজে নিযুক্ত ঠিকাদারের নাম জানা। রেলওয়ের কাজের টেন্ডার জমা দেওয়ার সর্বশেষ তারিখটি তাঁদের মনে রাখতে হয়, এই টেন্ডার বাগিয়ে নেওয়ার জন্য দলের ভেতর আরও কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছেন কি না, তাঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হয়। নগরের বিলবোর্ড দখল করা, এ কাজে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ইত্যাকার অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাঁদের। ফলে দলীয় সংগীত বা গঠনতন্ত্রের মতো নিরীহ বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায় তাঁদের? ক্ষুব্ধ ও হতাশ কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেছেন, ‘সংগঠন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা ১০০ জনের চেয়ে এ সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন ১০ জনই যথেষ্ট।’ খুবই ভালো কথা, কিন্তু সেই ১০ জনের সন্ধান দেবে কে? বদিউজ্জামান সোহাগ যেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মী সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন, তার কদিন আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটে গেছে আরও একটি বিস্ময়কর ঘটনা। যদিও ছাত্ররাজনীতির, বিশেষ করে ছাত্রলীগের রাজনীতির নানা রূপ ও রং দেখে আমরা ক্রমেই বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছি, তবু এ ঘটনাকে বিস্ময়কর বলে মানতে হচ্ছে এ কারণে যে সাবেক একজন সভাপতিকে ক্যাম্পাসে এভাবে বরণের (?)
ঘটনা অন্তত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কখনোই ঘটেনি। ৬ এপ্রিল একটি স্মরণসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাসির হায়দার করিম (তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসভাপতি)। ট্যাক্সিযোগে ক্যাম্পাসে পৌঁছা মাত্র ছাত্রলীগের একাংশের কর্মীরা তাঁকে মারধর করে তাঁর পরনের শার্ট ছিঁড়ে ফেলেন এবং তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন। এ ছবি ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ছাত্রসংগঠনের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক যে আজ আর অবশিষ্ট নেই, এ ঘটনা তার প্রমাণ। তবে ব্যক্তিবিশেষ বড় কথা নয়, একজন সাবেক সভাপতি তো সংগঠনের ইতিহাসেরও অংশ। তাঁকে এভাবে অপমান করে আসলে ছাত্রলীগের এই কর্মীরা তাঁদের ইতিহাসের মুখেই কালি লেপে দিয়েছেন। অবশ্য, যাঁরা দলীয় সংগীত ও দলের গঠনতন্ত্র সম্পর্কেই জানেন না, তাঁদের মধ্যে ইতিহাস-চেতনা কতটা কার্যকর তা অনুমেয়। সিনিয়র নেতাদের লাঞ্ছিত করা, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড না ছাড়লে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ইউনিট বাতিল করার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি। যাঁদের উদ্দেশে এই হুঁশিয়ারি তাঁরা বিষয়টিকে কতটা আমলে নেবেন জানি না। কারণ, ইতিপূর্বে এ রকম কোনো ঘটনার জন্য সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত নেই। ২০১১ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আংশিক কমিটির ঘোষণা দিয়েছিল সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদ। এরও আট মাস পরে ২১৯ সদস্যের এক বিশাল পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়।
এক বছর মেয়াদি কমিটির কার্যকাল শেষ হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে। গত দুই বছরে অন্তত ৮০ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এত সব সংঘাতের ঘটনার তদন্ত ও শাস্তি যেখানো হলো না, সেখানে নতুন ‘হুঁশিয়ারি’ নতুন কোনো অর্থ বহন করার কথা তো নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের এই ‘বিপুল কর্মতৎপরতা’র বিপরীতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বর্তমান অবস্থা একেবারেই ম্রিয়মাণ। প্রায় আড়াই বছর আগে সভাপতি, সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করে জানানো হয়েছিল, কিছুদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। সেই কমিটির নাম-নিশানা পাওয়া গেল না আরও একটি বছর। এক বছর পর দলের ক্ষুব্ধ একটি অংশ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার ব্যর্থতার জন্য সভাপতি তৌহিদুল ইসলামকে দায়ী করে চড়াও হয়েছিল তাঁর ওপর। সতীর্থদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে সেই যে ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন সভাপতি আর কখনোই ওমুখো হননি তিনি। তিন সদস্যের কমিটির তিনজনেরই ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে অনেক আগে। ফলে তাঁরাও কেউ যান না ক্যাম্পাসে। কার্যত ছাত্রদলের কোনো কার্যক্রম এখন আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই বললেই চলে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ছাত্রদলের ‘শূন্য গোয়ালটি’ই আপাতত ভালো। শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন, দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের তেমন কোনো অবস্থান বা কার্যক্রম আছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া বা সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলার ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের বিশেষ আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না।
এই অনাগ্রহের কারণ খুঁজতে হবে অন্যত্র। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতাসীন না থাকায় টেন্ডার, চাঁদাবাজি বা অন্যান্য লাভজনক কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না ছাত্রদল। ভাগ-বাঁটোয়ারার বিষয় যেখানে নেই, সেখানে কোন্দল-সংঘাত-সংঘর্ষও নেই। তবে দল ক্ষমতায় যেতে পারলে তাঁরা যে পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠবেন, তার আলামত মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়। দিন কয়েক আগে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সপ্তাহ ও সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি উপলক্ষে কাজীর দেউড়ি নাসিমন ভবন কার্যালয়ের সামনে নেতা-কর্মীরা ত্রিমুখী সংঘর্ষে জড়িয়ে নিজেদের দলীয় কর্মীকে রক্তাক্ত করে জানান দিয়েছেন, তাঁরা আছেন। এ সময় বিএনপির মহানগর সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনকেও নাজেহাল করেন ছাত্রদলের একাংশের কর্মীরা। কিছুদিন আগে মহানগর ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর রাজপথে বিক্ষোভ, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ নানা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছেন নেতা-কর্মীরা। নতুন কমিটিকে ‘বাবা কমিটি’ ঘোষণা করে তাকে প্রতিহত করার উদ্যোগ-আয়োজনও করা হয়েছে তখন। এখনো নগর ছাত্রদলের যেকোনো কর্মসূচিতেই সেই পুরোনো ছাইচাপা আগুনই জ্বলে উঠতে দেখি আমরা। তবু সব মিলিয়ে, ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করলে ছাত্রদলকে অপেক্ষাকৃত ভালোই বলতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের এই ক্ষমতাকালে ছাত্রলীগের প্রকৃত স্বরূপ আমরা যেমন দেখতে পাচ্ছি, তেমনি ছাত্রদলের আসল চেহারাটি দেখার জন্যও অপেক্ষা করতে হবে বিএনপি ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.