অপরিণামদর্শী রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
অপরিণামদর্শী
রাজনীতির কারণে চরম অনিশ্চয়তায় আছে বাংলাদেশের মানুষ। সামনের কয়েকটি মাস
দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে
শংকা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। মানুষ স্বস্তিতে নেই। দেশ কোন দিকে যাচ্ছে,
নির্বাচন হবে কিনা; হলেও কিভাবে হবে, সব দলকে নিয়ে হবে নাকি একতরফা হবে-
এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মাঝে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার
যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছে। এজন্য নিজেদের স্বার্থে সংবিধান
সংশোধন করেছে। নির্বাচনে কেউ আসুক না আসুক, সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারা
নির্বাচন করতে চায়। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শোচনীয় ব্যর্থতার সমাধান
খোঁজার পরিবর্তে নিত্যনতুন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। তারা জেনেশুনে নির্বাচন
সামনে রেখে দেশজুড়ে একটা চরম নৈরাজ্য ও অচলাবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।
সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সরকারের
কর্তব্য। কিন্তু মনে হয়, সরকার ইচ্ছা করেই তা করছে না। তারা বিরোধী দলকে
নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারের এ পরিকল্পনা
কোনোদিনই বাস্তবায়ন হবে না।
রাজনীতিকদের অবশ্যই একটি দল থাকে, থাকে দলের আদর্শ-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি। তবু একজন রাজনীতিকের চিন্তা থাকতে হয় সর্বজনীন, সবার চিন্তাই তাকে করতে হয়। এ বাস্তবতা যদি রাজনীতিকরা উপলব্ধি না করেন, তাহলে দেশ বিভক্ত হয়; জাতি বিভক্ত হয়, চূড়ান্তভাবে তা রাষ্ট্র ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ঠিক এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ক্ষমতাসীনদের অপরিণামদর্শী রাজনীতির কারণে এখানে ধর্মে-ধর্মে, ভাইয়ে-ভাইয়ে তৈরি হয়েছে বিরোধ, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে, ধর্মীয় উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; সর্বোপরি রাষ্ট্রের পরতে পরতে বিরোধ ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একই ধর্ম ও ভাষার মানুষের মধ্যে এমন বিভক্তি তৈরি করা নিশ্চয় একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। এ বিভক্তির ফলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে। দেশের শিল্পোৎপাদন, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক শিল্প চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, জিডিপি নিচের দিকে নামছে।
নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বাংলাদেশ অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে এ দেশের রাজনীতিকরাও। একটি অনিবার্য সংঘাত ও রক্তপাত বাংলাদেশের দোরগোড়ায়, যা ধ্বংস করবে সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। ধ্বংস করবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ধারা, মানুষ হারাবে তাদের ভোটের অধিকার। ধ্বংস করা রাজনীতিকদের কাজ নয়, রাজনীতিকদের কাজ গড়া। যেটুকু উন্নতি বাংলাদেশের হয়েছে, তা জাতি হিসেবে আমরা এক থাকার কারণেই হয়েছে আর এটি করেছেন রাজনীতিকরাই। এখনও যে বিপদ বাংলাদেশের সামনে কড়া নাড়ছে- রাজনীতিকদের ঐক্যই এ বিপদ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে পারে।
সংবিধান, আইন সবকিছুই পরিবর্তন সম্ভব হয়, যখন সবাই এক হয়। মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা রাজনীতিকদের কাজ নয়। এখন রাজনীতিকদের এক হওয়ার সময়, সময় দেশপ্রেম জাগ্রত করার; সময় বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়ার, কারণ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের নজর কাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘ এগিয়ে এসেছে, আমেরিকা এগিয়ে এসেছে; এগিয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব বিশ্ব, চীন, ভারত, কানাডা ও অন্য সব রাষ্ট্র। এক কথায়, এসব দেশ বাংলাদেশের ভালো চায়; বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতি অব্যাহত রাখার স্বার্থেই রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এসব দেশ এগিয়ে এসেছে। এসব দেশের উপলব্ধিতে হয়তো এসেছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব দেশ একটি পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিকদের পরামর্শ দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উচিত এসব দেশের আবেগের মূল্য দেয়া।
ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে আগামী জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নির্ভরশীল। বাংলাদেশ বিশ্বে কোন মর্যাদায় আসীন হবে- তা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনের ওপর। এ নির্বাচন একতরফা করার চিন্তা করা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের অসীম সম্ভাবনা ধ্বংস করার শামিল। দেশের ভালো চাইলে প্রধান একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চিন্তা মাথা থেকে অবশ্যই ঝেড়ে ফেলতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা করতে হবে।
ভোটের রাজনীতিতে শাসক দল এতটা অসহায় হয়ে পড়েছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনলেই তারা ভয় পায়। সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিএনপিকে বাদ দিয়ে একটা যেনতেন নির্বাচন করাই ক্ষমতাসীনদের এখন একমাত্র সান্ত্বনা। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হারার পর ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পারছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই তারা একতরফা নির্বাচনের পথে পা বাড়িয়েছে।
একতরফা কোনো নির্বাচনের পরিবেশ দেশে এখন আর নেই। দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় দেশে অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, মানুষ যার যার ভোট নিজে দিতে শিখেছে; এখন ইচ্ছা করলেও একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারেন না বা দেয়ার পরিবেশও নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যম বহুদূর এগিয়েছে। বলা যায়, বিশ্বমানের গণমাধ্যম বাংলাদেশে কাজ করছে, যারা মানুষের ভোটাধিকার রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট। একে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির নেই। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যেই যে কোনো খবর সম্প্রচার হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। তাই নির্বাচনে জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি করে কেউ পার পাবে না। ফুটেজ থেকে যাবে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে; এ ভয়ে নির্বাচনে জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি করতে কেউ উৎসাহী হবে না।
তাছাড়া একতরফা নির্বাচন করার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। একতরফা নির্বাচনের মানসিকতা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বেশিদূর এগোতে পারবে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে সব দল একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। বিরোধী জোটের বাইরেও জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, সিপিবি, বিকল্পধারা, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ আরও অনেক দল একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।
একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কোনো ফায়দা আছে বলে মনে হয় না। একতরফা নির্বাচন করে দেশ ও দলের ক্ষতি করে কোনো লাভ নেই। একতরফা নির্বাচনে গঠিত সরকারের স্থায়িত্ব হবে ক্ষীণ, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি। দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার পর সুষ্ঠু নির্বাচন হলে লাভ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের ক্ষতি না করে- আগে। কেবল তাহলেই দেশ উপকৃত হবে। উপকৃত হবে দেশের মানুষ।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে না নিয়ে, লগি-বৈঠার আন্দোলন করে দেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছিল। ফলে দেশে ১/১১’র আবির্ভাব ঘটেছিল। ১/১১’র দুই বছরের দুঃশাসনের পর দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে, ১/১১’র দুই বছরে দেশ অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে; ক্ষতির শিকার হয়েছেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও দেশের সাধারণ মানুষ। কাজেই দেশের ক্ষতি করে পরে সুষ্ঠু নির্বাচন করে লাভ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে দেশের ক্ষতি না করে। তাহলেই রাজনীতিকদের ভাবমর্যাদা বাড়বে, অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ঐক্যের দিক থেকে একটা নজির স্থাপন করেছিল। কিন্তু এটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এখন জাতি হিসেবে সব দিক থেকেই আমরা বিভক্ত। ক্ষুদ্র একটি আঘাত সহ্য করার মতো শক্তিও আমাদের নেই। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। সবকিছু বিপন্ন হওয়ার আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং সংকট দূর করে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে ধাবিত করা। এর জন্য সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি শাসক দলকে অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে, জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে হবে; হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ক্রান্তিসময় অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
রাজনীতিকদের অবশ্যই একটি দল থাকে, থাকে দলের আদর্শ-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি। তবু একজন রাজনীতিকের চিন্তা থাকতে হয় সর্বজনীন, সবার চিন্তাই তাকে করতে হয়। এ বাস্তবতা যদি রাজনীতিকরা উপলব্ধি না করেন, তাহলে দেশ বিভক্ত হয়; জাতি বিভক্ত হয়, চূড়ান্তভাবে তা রাষ্ট্র ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ঠিক এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ক্ষমতাসীনদের অপরিণামদর্শী রাজনীতির কারণে এখানে ধর্মে-ধর্মে, ভাইয়ে-ভাইয়ে তৈরি হয়েছে বিরোধ, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে, ধর্মীয় উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; সর্বোপরি রাষ্ট্রের পরতে পরতে বিরোধ ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একই ধর্ম ও ভাষার মানুষের মধ্যে এমন বিভক্তি তৈরি করা নিশ্চয় একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। এ বিভক্তির ফলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে। দেশের শিল্পোৎপাদন, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক শিল্প চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, জিডিপি নিচের দিকে নামছে।
নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বাংলাদেশ অনিবার্য ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে এ দেশের রাজনীতিকরাও। একটি অনিবার্য সংঘাত ও রক্তপাত বাংলাদেশের দোরগোড়ায়, যা ধ্বংস করবে সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। ধ্বংস করবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ধারা, মানুষ হারাবে তাদের ভোটের অধিকার। ধ্বংস করা রাজনীতিকদের কাজ নয়, রাজনীতিকদের কাজ গড়া। যেটুকু উন্নতি বাংলাদেশের হয়েছে, তা জাতি হিসেবে আমরা এক থাকার কারণেই হয়েছে আর এটি করেছেন রাজনীতিকরাই। এখনও যে বিপদ বাংলাদেশের সামনে কড়া নাড়ছে- রাজনীতিকদের ঐক্যই এ বিপদ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে পারে।
সংবিধান, আইন সবকিছুই পরিবর্তন সম্ভব হয়, যখন সবাই এক হয়। মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা রাজনীতিকদের কাজ নয়। এখন রাজনীতিকদের এক হওয়ার সময়, সময় দেশপ্রেম জাগ্রত করার; সময় বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়ার, কারণ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের নজর কাড়ছে। বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘ এগিয়ে এসেছে, আমেরিকা এগিয়ে এসেছে; এগিয়ে এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব বিশ্ব, চীন, ভারত, কানাডা ও অন্য সব রাষ্ট্র। এক কথায়, এসব দেশ বাংলাদেশের ভালো চায়; বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতি অব্যাহত রাখার স্বার্থেই রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এসব দেশ এগিয়ে এসেছে। এসব দেশের উপলব্ধিতে হয়তো এসেছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব দেশ একটি পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিকদের পরামর্শ দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উচিত এসব দেশের আবেগের মূল্য দেয়া।
ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে আগামী জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নির্ভরশীল। বাংলাদেশ বিশ্বে কোন মর্যাদায় আসীন হবে- তা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনের ওপর। এ নির্বাচন একতরফা করার চিন্তা করা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের অসীম সম্ভাবনা ধ্বংস করার শামিল। দেশের ভালো চাইলে প্রধান একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চিন্তা মাথা থেকে অবশ্যই ঝেড়ে ফেলতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা করতে হবে।
ভোটের রাজনীতিতে শাসক দল এতটা অসহায় হয়ে পড়েছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনলেই তারা ভয় পায়। সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিএনপিকে বাদ দিয়ে একটা যেনতেন নির্বাচন করাই ক্ষমতাসীনদের এখন একমাত্র সান্ত্বনা। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হারার পর ক্ষমতাসীনরা বুঝতে পারছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই তারা একতরফা নির্বাচনের পথে পা বাড়িয়েছে।
একতরফা কোনো নির্বাচনের পরিবেশ দেশে এখন আর নেই। দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় দেশে অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, মানুষ যার যার ভোট নিজে দিতে শিখেছে; এখন ইচ্ছা করলেও একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারেন না বা দেয়ার পরিবেশও নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যম বহুদূর এগিয়েছে। বলা যায়, বিশ্বমানের গণমাধ্যম বাংলাদেশে কাজ করছে, যারা মানুষের ভোটাধিকার রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট। একে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির নেই। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যেই যে কোনো খবর সম্প্রচার হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। তাই নির্বাচনে জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি করে কেউ পার পাবে না। ফুটেজ থেকে যাবে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে; এ ভয়ে নির্বাচনে জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি করতে কেউ উৎসাহী হবে না।
তাছাড়া একতরফা নির্বাচন করার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। একতরফা নির্বাচনের মানসিকতা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বেশিদূর এগোতে পারবে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে সব দল একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। বিরোধী জোটের বাইরেও জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, সিপিবি, বিকল্পধারা, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ আরও অনেক দল একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।
একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কোনো ফায়দা আছে বলে মনে হয় না। একতরফা নির্বাচন করে দেশ ও দলের ক্ষতি করে কোনো লাভ নেই। একতরফা নির্বাচনে গঠিত সরকারের স্থায়িত্ব হবে ক্ষীণ, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি। দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার পর সুষ্ঠু নির্বাচন হলে লাভ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের ক্ষতি না করে- আগে। কেবল তাহলেই দেশ উপকৃত হবে। উপকৃত হবে দেশের মানুষ।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে না নিয়ে, লগি-বৈঠার আন্দোলন করে দেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছিল। ফলে দেশে ১/১১’র আবির্ভাব ঘটেছিল। ১/১১’র দুই বছরের দুঃশাসনের পর দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে, ১/১১’র দুই বছরে দেশ অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে; ক্ষতির শিকার হয়েছেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও দেশের সাধারণ মানুষ। কাজেই দেশের ক্ষতি করে পরে সুষ্ঠু নির্বাচন করে লাভ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে দেশের ক্ষতি না করে। তাহলেই রাজনীতিকদের ভাবমর্যাদা বাড়বে, অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ঐক্যের দিক থেকে একটা নজির স্থাপন করেছিল। কিন্তু এটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এখন জাতি হিসেবে সব দিক থেকেই আমরা বিভক্ত। ক্ষুদ্র একটি আঘাত সহ্য করার মতো শক্তিও আমাদের নেই। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। সবকিছু বিপন্ন হওয়ার আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং সংকট দূর করে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে ধাবিত করা। এর জন্য সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি শাসক দলকে অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে, জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে হবে; হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ক্রান্তিসময় অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments