বাংলাদেশ নিয়ে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কি বড় মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশের
সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিকে সামনে নিয়ে হঠাৎ একটি নতুন
প্রচারণা শুরু হয়েছে। প্রচারণাটি হল, ঢাকায় হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখার
প্রশ্নে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে মতানৈক্য ঘটেছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন
রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার সাম্প্রতিক দিল্লি-ওয়াশিংটন ছোটাছুটি তার প্রমাণ।
ওয়াশিংটন বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল এবং দিল্লি আওয়ামী লীগকে সমর্থনদানে
অনড় থাকতে চাইছে। এই প্রচারণায় বেশি হাওয়া দিচ্ছেন ড. ইউনূসের ক্যাম্পের
দুটি মিডিয়া। ড. ইউনূসও এখন দেশে-বিদেশে প্রকাশ্যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইনে নেমেছেন। সম্প্রতি তিনি এক সম্মেলনে
যারা গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত বর্তমান সরকারের আইন সংশোধন করবে না তাদের
ভোট না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত আইনটি বাতিল করে
ব্যাংকটি ড. ইউনূসের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেছে বিএনপি। সুতরাং এই
নোবেলজয়ী যে বিএনপিকেই ভোটদানের জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তাতে
সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে সরকারই ক্ষমতায় বসুক, তাকে সমর্থন দেয়া বা না দেয়ার ব্যাপারে ভারত এবং আমেরিকা দুই দেশই নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। দিল্লিতে বিজেপি সরকার ও ওয়াশিংটনে বুশ প্রশাসন ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রতি তাদের যে আনুকূল্যের মনোভাব ছিল, পরবর্তীকালে আমেরিকায় ওবামা ও দিল্লিতে কংগ্রেস সরকারের আমলে তা অনেকটাই পাল্টে যায়।
এই পাল্টানোর পেছনে ছিল ‘ইসলামিক টেরোরিজম’ দমনে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সমস্বার্থভিত্তিক ঘনিষ্ঠতা এবং প্রতিযোগী বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানকে ঠেকানোর জন্য দিল্লিকে ব্যবহারে ওয়াশিংটনের আগ্রহ। ফলে মনমোহন সরকার পরমাণু সহযোগিতার প্রশ্নে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি করে তার দেশীয় বাম মিত্রদের চটাতে দ্বিধা করেননি।
দিল্লি ও ওয়াশিংটনের এস্টাবলিশমেন্টের একটা বড় অংশ মনে করে বাংলাদেশে সেক্যুলারিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে হবে না। জঙ্গিবাদ দমন সহজ হবে। অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় এলে জামায়াত ও জঙ্গিবাদী বিভিন্ন গ্র“পের ওপর তার নির্ভরতার দরুন জঙ্গিবাদ মাথা তোলার আশংকাই বেশি। এই সহজ সরল হিসাব থেকেই বাংলাদেশের সম্পর্কে নিজেদের নীতিনির্ধারণ করছে দিল্লি ও ওয়াশিংটন। বাংলাদেশের কোনো দলের প্রতি অতিরিক্ত প্রেমের দরুন এই নীতি নির্ধারিত হয় না। তাছাড়া বাংলাদেশের তেল, গ্যাস, নৌঘাঁটি, নৌবন্দর, ট্রানজিট সুবিধা ইত্যাদি নিয়েও বিবেচনা তো আছেই।
এজন্য সেক্যুলারিস্ট ও জঙ্গিবিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতি দিল্লি ও ওয়াশিংটনের নীতি বর্তমানে অনুকূল হলেও বিএনপিকেও তারা চটাতে চায় না। এজন্যই ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে খালেদা জিয়ার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন এবং ভারত কোনো বিশেষ দলের বন্ধু নয় বলে তাকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন। বরং খালেদা জিয়াই প্রণব বাবু রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঢাকায় এলে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যাননি। এর পেছনেও বিএনপি-নেত্রীর একটি কূটকৌশল কাজ করেছে। তিনি ইঙ্গিতে ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগের মতো তিনি দুই দেশের সঙ্গেই সমান সম্পর্ক রাখতে চান না। তিনি আমেরিকার মিত্রতাকেই বেশি দাম দেন।
এটা ওয়াশিংটনের এস্টাবলিশমেন্টের আরেকটা অংশকে খুশি করেছে। তারা ভারতের ঘনিষ্ঠ মৈত্রী চায়, কিন্তু উপমহাদেশে আমেরিকাকে ডিঙিয়ে তার একাধিপত্য চায় না। তাই পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গি দমনে ভারতের চাপ সে মানছে না এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের ‘ভালো অংশের’ সঙ্গে আপস করতে এগোতে গিয়ে দিল্লির অসন্তোষকে সে গ্রাহ্য করছে না। বাংলাদেশেও জামায়াতকে তারা ‘পোষ্য ও বশমানানো মৌলবাদী’ মনে করে এবং বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে তা উপমহাদেশে তার আধিপত্যবাদী স্ট্র্যাটেজির বেশি সহায়ক বিবেচনা করে। তাই বলে বহু সাধনায় পাওয়া ভারতীয় মিত্রতা ক্ষুণ্ন হতে পারে এ ধরনের কোনো বড় ঝুঁকি সে নেবে না।
এক্ষেত্রে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মনান্তর নেই, কৌশলের পার্থক্য আছে। দিল্লি আওয়ামী লীগকে বিশ্বস্ত মিত্র মনে করে, কিন্তু নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে উৎসাহী নয়। উৎসাহী হলে তিস্তা, ছিটমহল, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে নিত্য হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়গুলো মীমাংসা না করে ঝুলিয়ে রাখত না। বিজেপির কোনো কোনো নেতা তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিএনপি বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকলে তাদের সুবিধা। বিএনপির ভারত বিরোধিতার নীতিকে ছুতো হিসেবে খাড়া করে গঙ্গা ও তিস্তার পানি থেকে শুরু করে সব বিষয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধ জিইয়ে রাখা যায় এবং বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য না দিলেও চলে। জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদের সামরিক শাসনামলে তারা গঙ্গার এক ফোঁটা পানি বাংলাদেশকে দেয়নি কিন্তু হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গার পানি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি করতে হয়েছে।
এই হিসাবটা দিল্লির কংগ্রেস সরকারের মাথাতেও আছে। সুতরাং পূর্ব ভারতে তাদের নিরাপত্তা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় স্বার্থে হাসিনা সরকারকে যতটা সুবিধা না দিলে নয়, ততোটাই তারা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সব সমস্যার মীমাংসা করছেন না। এই ব্যাপারে কংগ্রেস সরকারের চাণক্য নীতিও রয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিজেদের স্বার্থে তারা অবশ্যই ক্ষমতায় দেখতে চান; কিন্তু বিএনপিকেও হাতছাড়া করতে চান না। প্রণব বাবু অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসেই ছুটে গিয়েছিলেন বিএনপি-নেত্রীর দর্শনে। আবার দিল্লি বিএনপি-নেত্রীকে দিল্লি সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে মহা-আড়ম্বরে তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। তাদের ভাবনা, যদি আখেরে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
এই ব্যাপারে আমেরিকার ওবামা প্রশাসনের কূটনৈতিক খেলা আরও একটু স্পষ্ট। বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর বিএনপির অনুকূলে জনসমর্থন ঘুরছে এটা অনুমান করে ওয়াশিংটনও বাংলাদেশ-নীতিতে তার নতুন অবস্থান দ্রুত নিতে চেয়েছিল। এই অবস্থানটি হল বিএনপিকে এই বলে আশ্বস্ত করা যে, ওয়াশিংটন প্রয়োজনে তাকে সমর্থন দেবে। লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গেও এজন্যই মার্কিন দূতের সাক্ষাৎকার। উদ্দেশ্য তাকে বাজিয়ে দেখা। আমেরিকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না এ কথা জানানোর জন্য মার্কিন দূত তারেকের সঙ্গে দেখা করেননি।
এ কাজটা আমেরিকা ভারতের বেলাতেও আরও ন্যক্কারজনকভাবে করেছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস-নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বিশাল নির্বাচন জয় দ্বারা ক্ষমতায় আসার পর স্বয়ং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কলকাতায় ছুটে যান মমতার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। দিল্লির কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রককে ডিঙিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ছোটা, এটা ছিল বিশ্ব কূটনীতিতে অকল্পনীয় ঘটনা।
এটাও কংগ্রেসের বদলে তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থনদানের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মোড় পরিবর্তন ছিল না। তখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আকস্মিকভাবে যে একটা মমতা-হাওয়া দেখা দিয়েছিল, তাতে আগেভাগেই মার্কিন প্রশাসন মমতা ব্যানার্জিকে একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। আরও চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট-প্রভাব উচ্ছেদ করার জন্য মমতাকে কতটা ব্যবহার করা যায় তা দেখতে। বাংলাদেশেও সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর বিএনপি পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হবে এই সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় ওয়াশিংটন তারেক রহমানকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছে। চেয়েছে বিএনপি বাংলাদেশে ক্ষমতায় এলে তার সরকারকে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকতে না দিয়ে কতটা মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে তা বুঝে নিতে। বিএনপি বা তারেককে সমর্থন জানাতে এই সাক্ষাৎকার নয়। ভারতের একশ্রেণীর পত্রিকায় এ সম্পর্কে (তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায়) যে আশংকা ও গুজব ছড়ানো হয়েছে, বাংলাদেশের একশ্রেণীর মিডিয়া সেই তিলকে তাল করে প্রচার করেছে। বিশেষ করে ইউনূস শিবিরের মিডিয়া দুটি।
ভারতেও একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া, বিশেষ করে বিজেপি ও নরেন মোদিকে যারা দেশটির পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী দেখতে চায়, তারা দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বাংলাদেশসহ কোনো কোনো বিষয়ে যে সূক্ষ্ম রাষ্ট্রীয় স্বার্থগত মতপার্থক্য আছে (যা আগেও ছিল) তাকে বড় করে দেখিয়ে বর্তমানে নানা ধরনের খবর, খবরভাষ্য ছাপাচ্ছে। বাংলাদেশের যে মহলগুলো এবং তাদের মিডিয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত দেখতে চান, তারা তা লুফে নিয়ে নিজেরা বড় বড় মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করেছেন।
ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দিল্লি ছুটেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নীতিকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করার জন্য নয়। ভারতকে প্রভাবিত করতে হলে ওয়াশিংটন ঢাকায় নিযুক্ত এক জুনিয়র কূটনীতিককে দিল্লি পাঠিয়ে ভারত সরকারকে বিব্রত ও বিরক্ত করবেন না। তারা পররাষ্ট্র দফতরের উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাকে পাঠাতেন। ‘ওয়াশিংটন পোস্টের’ খবরে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ড্যান মজিনা দিল্লিতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সম্পর্কে দিল্লির মনোভাবে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে কিনা তা জানতে এবং ঘটে থাকলে তা ওয়াশিংটনকে জানাতে। মজিনা তাই দিল্লির পর ওয়াশিংটনে ছুটেছেন। তারপরই খবর প্রকাশিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের উপমহাদেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারতের নীতির সঙ্গে সমন্বয় বিধান করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।
ভারতের একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া (নরেন মোদির সমর্থক) যে কারণে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বিদ্যমান নানা বিষয়ের (বাংলাদেশসহ) ছোট ছোট মতপার্থক্যগুলোকে এখন বড় রকমের মতান্তর বলে প্রচার শুরু করেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগবিরোধী একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া, বিশেষ করে ইউনূস শিবিরের মিডিয়া দুটি সেই প্রচার লুফে নিয়ে আরও বড়ভাবে প্রচারণা শুরু করেছেন একই কারণে।
এক গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. মুহম্মদ ইউনূসের হাসিনা-ফোবিয়া এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তিনি এবং তার অনুগত সুশীল সমাজটি (এবং তার দুটি মিডিয়া) যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন দেখতে চান। এতে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতায় আসুক এবং দেশের চরম ক্ষতি হোক তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এই লক্ষ্যে ড. ইউনূস তো বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেনই; তার ওপর ওবামা প্রশাসনের একাংশকেও প্রভাবিত করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। এটা আমার অভিযোগ নয়, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর।
এই লক্ষ্যে এই শিবিরের দুটি মিডিয়া পরপর দুটি উদ্দেশ্যমূলক জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করে পশ্চিমা দাতা দেশগুলোসহ ভারত ও আমেরিকাকে (এবং দেশের ভোটারদেরও) বোঝানোর চেষ্টা করছেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচন-জয়ের সম্ভাবনা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, বাড়ছে বিএনপি-জামায়াতের। এভাবে দেশে-বিদেশে তারা একটি ‘সাইকি’ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এখন শুরু হয়েছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে স্বাভাবিক ছোটখাটো মতপার্থ্যক্যগুলোকে বড় করে দেখিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি নিশ্চিত করতে। দেখা যাক, বাংলাদেশে গণতন্ত্র বনাম ষড়যন্ত্র এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কার জয় হয়!
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে সরকারই ক্ষমতায় বসুক, তাকে সমর্থন দেয়া বা না দেয়ার ব্যাপারে ভারত এবং আমেরিকা দুই দেশই নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। দিল্লিতে বিজেপি সরকার ও ওয়াশিংটনে বুশ প্রশাসন ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রতি তাদের যে আনুকূল্যের মনোভাব ছিল, পরবর্তীকালে আমেরিকায় ওবামা ও দিল্লিতে কংগ্রেস সরকারের আমলে তা অনেকটাই পাল্টে যায়।
এই পাল্টানোর পেছনে ছিল ‘ইসলামিক টেরোরিজম’ দমনে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সমস্বার্থভিত্তিক ঘনিষ্ঠতা এবং প্রতিযোগী বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানকে ঠেকানোর জন্য দিল্লিকে ব্যবহারে ওয়াশিংটনের আগ্রহ। ফলে মনমোহন সরকার পরমাণু সহযোগিতার প্রশ্নে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি করে তার দেশীয় বাম মিত্রদের চটাতে দ্বিধা করেননি।
দিল্লি ও ওয়াশিংটনের এস্টাবলিশমেন্টের একটা বড় অংশ মনে করে বাংলাদেশে সেক্যুলারিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশে হবে না। জঙ্গিবাদ দমন সহজ হবে। অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় এলে জামায়াত ও জঙ্গিবাদী বিভিন্ন গ্র“পের ওপর তার নির্ভরতার দরুন জঙ্গিবাদ মাথা তোলার আশংকাই বেশি। এই সহজ সরল হিসাব থেকেই বাংলাদেশের সম্পর্কে নিজেদের নীতিনির্ধারণ করছে দিল্লি ও ওয়াশিংটন। বাংলাদেশের কোনো দলের প্রতি অতিরিক্ত প্রেমের দরুন এই নীতি নির্ধারিত হয় না। তাছাড়া বাংলাদেশের তেল, গ্যাস, নৌঘাঁটি, নৌবন্দর, ট্রানজিট সুবিধা ইত্যাদি নিয়েও বিবেচনা তো আছেই।
এজন্য সেক্যুলারিস্ট ও জঙ্গিবিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতি দিল্লি ও ওয়াশিংটনের নীতি বর্তমানে অনুকূল হলেও বিএনপিকেও তারা চটাতে চায় না। এজন্যই ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে খালেদা জিয়ার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন এবং ভারত কোনো বিশেষ দলের বন্ধু নয় বলে তাকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন। বরং খালেদা জিয়াই প্রণব বাবু রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঢাকায় এলে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যাননি। এর পেছনেও বিএনপি-নেত্রীর একটি কূটকৌশল কাজ করেছে। তিনি ইঙ্গিতে ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগের মতো তিনি দুই দেশের সঙ্গেই সমান সম্পর্ক রাখতে চান না। তিনি আমেরিকার মিত্রতাকেই বেশি দাম দেন।
এটা ওয়াশিংটনের এস্টাবলিশমেন্টের আরেকটা অংশকে খুশি করেছে। তারা ভারতের ঘনিষ্ঠ মৈত্রী চায়, কিন্তু উপমহাদেশে আমেরিকাকে ডিঙিয়ে তার একাধিপত্য চায় না। তাই পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গি দমনে ভারতের চাপ সে মানছে না এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের ‘ভালো অংশের’ সঙ্গে আপস করতে এগোতে গিয়ে দিল্লির অসন্তোষকে সে গ্রাহ্য করছে না। বাংলাদেশেও জামায়াতকে তারা ‘পোষ্য ও বশমানানো মৌলবাদী’ মনে করে এবং বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে তা উপমহাদেশে তার আধিপত্যবাদী স্ট্র্যাটেজির বেশি সহায়ক বিবেচনা করে। তাই বলে বহু সাধনায় পাওয়া ভারতীয় মিত্রতা ক্ষুণ্ন হতে পারে এ ধরনের কোনো বড় ঝুঁকি সে নেবে না।
এক্ষেত্রে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মনান্তর নেই, কৌশলের পার্থক্য আছে। দিল্লি আওয়ামী লীগকে বিশ্বস্ত মিত্র মনে করে, কিন্তু নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে উৎসাহী নয়। উৎসাহী হলে তিস্তা, ছিটমহল, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে নিত্য হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়গুলো মীমাংসা না করে ঝুলিয়ে রাখত না। বিজেপির কোনো কোনো নেতা তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিএনপি বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকলে তাদের সুবিধা। বিএনপির ভারত বিরোধিতার নীতিকে ছুতো হিসেবে খাড়া করে গঙ্গা ও তিস্তার পানি থেকে শুরু করে সব বিষয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধ জিইয়ে রাখা যায় এবং বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য না দিলেও চলে। জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদের সামরিক শাসনামলে তারা গঙ্গার এক ফোঁটা পানি বাংলাদেশকে দেয়নি কিন্তু হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গার পানি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি করতে হয়েছে।
এই হিসাবটা দিল্লির কংগ্রেস সরকারের মাথাতেও আছে। সুতরাং পূর্ব ভারতে তাদের নিরাপত্তা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় স্বার্থে হাসিনা সরকারকে যতটা সুবিধা না দিলে নয়, ততোটাই তারা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সব সমস্যার মীমাংসা করছেন না। এই ব্যাপারে কংগ্রেস সরকারের চাণক্য নীতিও রয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিজেদের স্বার্থে তারা অবশ্যই ক্ষমতায় দেখতে চান; কিন্তু বিএনপিকেও হাতছাড়া করতে চান না। প্রণব বাবু অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসেই ছুটে গিয়েছিলেন বিএনপি-নেত্রীর দর্শনে। আবার দিল্লি বিএনপি-নেত্রীকে দিল্লি সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে মহা-আড়ম্বরে তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। তাদের ভাবনা, যদি আখেরে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
এই ব্যাপারে আমেরিকার ওবামা প্রশাসনের কূটনৈতিক খেলা আরও একটু স্পষ্ট। বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর বিএনপির অনুকূলে জনসমর্থন ঘুরছে এটা অনুমান করে ওয়াশিংটনও বাংলাদেশ-নীতিতে তার নতুন অবস্থান দ্রুত নিতে চেয়েছিল। এই অবস্থানটি হল বিএনপিকে এই বলে আশ্বস্ত করা যে, ওয়াশিংটন প্রয়োজনে তাকে সমর্থন দেবে। লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গেও এজন্যই মার্কিন দূতের সাক্ষাৎকার। উদ্দেশ্য তাকে বাজিয়ে দেখা। আমেরিকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না এ কথা জানানোর জন্য মার্কিন দূত তারেকের সঙ্গে দেখা করেননি।
এ কাজটা আমেরিকা ভারতের বেলাতেও আরও ন্যক্কারজনকভাবে করেছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস-নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বিশাল নির্বাচন জয় দ্বারা ক্ষমতায় আসার পর স্বয়ং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কলকাতায় ছুটে যান মমতার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। দিল্লির কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রককে ডিঙিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ছোটা, এটা ছিল বিশ্ব কূটনীতিতে অকল্পনীয় ঘটনা।
এটাও কংগ্রেসের বদলে তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থনদানের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মোড় পরিবর্তন ছিল না। তখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আকস্মিকভাবে যে একটা মমতা-হাওয়া দেখা দিয়েছিল, তাতে আগেভাগেই মার্কিন প্রশাসন মমতা ব্যানার্জিকে একটু বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। আরও চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট-প্রভাব উচ্ছেদ করার জন্য মমতাকে কতটা ব্যবহার করা যায় তা দেখতে। বাংলাদেশেও সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর বিএনপি পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হবে এই সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় ওয়াশিংটন তারেক রহমানকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছে। চেয়েছে বিএনপি বাংলাদেশে ক্ষমতায় এলে তার সরকারকে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকতে না দিয়ে কতটা মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে তা বুঝে নিতে। বিএনপি বা তারেককে সমর্থন জানাতে এই সাক্ষাৎকার নয়। ভারতের একশ্রেণীর পত্রিকায় এ সম্পর্কে (তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায়) যে আশংকা ও গুজব ছড়ানো হয়েছে, বাংলাদেশের একশ্রেণীর মিডিয়া সেই তিলকে তাল করে প্রচার করেছে। বিশেষ করে ইউনূস শিবিরের মিডিয়া দুটি।
ভারতেও একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া, বিশেষ করে বিজেপি ও নরেন মোদিকে যারা দেশটির পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী দেখতে চায়, তারা দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বাংলাদেশসহ কোনো কোনো বিষয়ে যে সূক্ষ্ম রাষ্ট্রীয় স্বার্থগত মতপার্থক্য আছে (যা আগেও ছিল) তাকে বড় করে দেখিয়ে বর্তমানে নানা ধরনের খবর, খবরভাষ্য ছাপাচ্ছে। বাংলাদেশের যে মহলগুলো এবং তাদের মিডিয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত দেখতে চান, তারা তা লুফে নিয়ে নিজেরা বড় বড় মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করেছেন।
ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দিল্লি ছুটেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নীতিকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করার জন্য নয়। ভারতকে প্রভাবিত করতে হলে ওয়াশিংটন ঢাকায় নিযুক্ত এক জুনিয়র কূটনীতিককে দিল্লি পাঠিয়ে ভারত সরকারকে বিব্রত ও বিরক্ত করবেন না। তারা পররাষ্ট্র দফতরের উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাকে পাঠাতেন। ‘ওয়াশিংটন পোস্টের’ খবরে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ড্যান মজিনা দিল্লিতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সম্পর্কে দিল্লির মনোভাবে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে কিনা তা জানতে এবং ঘটে থাকলে তা ওয়াশিংটনকে জানাতে। মজিনা তাই দিল্লির পর ওয়াশিংটনে ছুটেছেন। তারপরই খবর প্রকাশিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ওবামা মার্কিন পররাষ্ট্র কর্মকর্তাদের উপমহাদেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারতের নীতির সঙ্গে সমন্বয় বিধান করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।
ভারতের একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া (নরেন মোদির সমর্থক) যে কারণে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বিদ্যমান নানা বিষয়ের (বাংলাদেশসহ) ছোট ছোট মতপার্থক্যগুলোকে এখন বড় রকমের মতান্তর বলে প্রচার শুরু করেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগবিরোধী একশ্রেণীর বিগ মিডিয়া, বিশেষ করে ইউনূস শিবিরের মিডিয়া দুটি সেই প্রচার লুফে নিয়ে আরও বড়ভাবে প্রচারণা শুরু করেছেন একই কারণে।
এক গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ড. মুহম্মদ ইউনূসের হাসিনা-ফোবিয়া এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তিনি এবং তার অনুগত সুশীল সমাজটি (এবং তার দুটি মিডিয়া) যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন দেখতে চান। এতে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতায় আসুক এবং দেশের চরম ক্ষতি হোক তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এই লক্ষ্যে ড. ইউনূস তো বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেনই; তার ওপর ওবামা প্রশাসনের একাংশকেও প্রভাবিত করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। এটা আমার অভিযোগ নয়, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর।
এই লক্ষ্যে এই শিবিরের দুটি মিডিয়া পরপর দুটি উদ্দেশ্যমূলক জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করে পশ্চিমা দাতা দেশগুলোসহ ভারত ও আমেরিকাকে (এবং দেশের ভোটারদেরও) বোঝানোর চেষ্টা করছেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচন-জয়ের সম্ভাবনা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, বাড়ছে বিএনপি-জামায়াতের। এভাবে দেশে-বিদেশে তারা একটি ‘সাইকি’ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এখন শুরু হয়েছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে স্বাভাবিক ছোটখাটো মতপার্থ্যক্যগুলোকে বড় করে দেখিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি নিশ্চিত করতে। দেখা যাক, বাংলাদেশে গণতন্ত্র বনাম ষড়যন্ত্র এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কার জয় হয়!
No comments