আক্রান্তের পাশে দাঁড়াও
রামু থেকে পাবনার সাঁথিয়া। সংখ্যালঘুরা কেবল নির্যাতনের শিকার হলেই পত্রিকার হেডলাইনে পরিণত হন। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ধ্বংসযজ্ঞের স্মারক হিসেবে পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় তছনছ হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, আগুনে পোড়া বসতভিটা, আহাজারিরত হিন্দু নারী, বড়জোর লুণ্ঠিত বাড়ির উঠানে পুলিশের উপস্থিতি—যা দিয়ে আক্রমণ-পরবর্তী একধরনের রাষ্ট্রীয় স্বস্তি তৈরি করা হয়। যদিও এসব মেটাফোর দিয়ে সংখ্যালঘুদের অন্তর্গত আতঙ্ক ও সামষ্টিক হতাশার সামান্যই প্রকাশ করা যায়।
হামলার দিন ২ নভেম্বর রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কালীপূজা ও দীপাবলি উৎসব ছিল। কে জানত, প্রদীপ কিংবা মোমবাতির মৃদু আলোর বদলে ২৬টি বসতভিটা পুড়ে যাওয়ার আগুনে প্রকাশ্য দিবালোকে ধ্বংসের দীপাবলি হবে, যা পোড়াবে এমনকি দেবালয়ও। সাঁথিয়ার বনগ্রামে আক্রমণের শিকার পরিবারগুলোর বসবাস বাজার, মহাসড়ক এবং পুলিশ স্টেশন থেকে খুব দূরে নয়। সংখ্যালঘুদের ব্যবসাকেন্দ্র ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের আগে ভাঙচুর ও লুণ্ঠন করা হয়েছে। সাধারণভাবে আক্রমণকারীদের আমজনতা মনে হলেও তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল। হামলার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য পরিকল্পিতভাবে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগমন প্রতিহত করতে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। হামলার কারণ হিসেবে ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তির অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রধান অভিযুক্ত দশম শ্রেণীর ছাত্র, যার আদৌ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে কি না, কিংবা সে ছবি আঁকতে পারে কি না, তা আক্রমণকারীরাও নিশ্চিত করতে পারেনি।
অভিযুক্ত ছাত্রের বাবা একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী, যার ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই। মাত্র কয়েক মাস আগে রামুতে ঠিক একই অভিযোগ তুলে কী ঘটেছিল, তা আমাদের অজানা নয়। সামনেই দেশের সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর এই হামলা নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির আগাম আলামত কি না, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। কেননা, ২০০১ সালের ঘটনা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমাগতভাবেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। সারা বছর ধরেই সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বেদখল হয় এবং তাঁরা ভীষণ আতঙ্কে ভুগতে থাকেন, বিশেষ করে যেসব পরিবারে কিশোরী-তরুণী থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই নাজুকতা আরও বেশি। কোনো ধরনের আইনি প্রতিকারের সম্ভাবনা না থাকায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, যা তাঁদের আপসকামী ও পলায়নপর করে তোলে। সংখ্যালঘুদের পক্ষে এ কথা ভাবা অসম্ভব যে তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাবেন, ন্যায়বিচার পাবেন, কিংবা ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলার শিকার হবেন না। সাঁথিয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন তাদের দায় এড়াতে পারে না। স্থানীয় জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ কথিত অভিযুক্ত ছাত্রের বাবাকে প্রাণে রক্ষা করার মধ্যেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রেখেছে।
তবু লুণ্ঠন ও ধ্বংস থামানো যায়নি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো কারণ ছাড়াই যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা যায়। এতে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের তরফ থেকে খুব স্বল্পমাত্রার সীমাবদ্ধ প্রতিরোধ হবে, যাতে এক কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নির্যাতিত ব্যক্তিরা আশ্বস্ত হতে পারেন না। তবে তাঁরা সান্ত্বনা পেতে পারেন এই ভেবে যে, তাঁদের আক্রমণের কারণ হিসেবে এখনো অন্তত যেকোনো একটি অজুহাত সামনে আনা হচ্ছে। যেখানে কোনো কারণ ছাড়াই আক্রমণ সংগত, সেখানে অজুহাত প্রদর্শন একধরনের ভদ্রতাই বটে! এই পরিস্থিতিতে আমরা কয়েকটি দাবি তুলে ধরছি। এক. এ ঘটনার তদন্ত করা হোক; দুই. দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হোক; তিন. ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে; চার. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দীর্ঘ সময় ধরে আক্রান্ত এলাকায় মোতায়েন রাখতে হবে; পাঁচ. সব রাজনৈতিক দলকে স্থানীয় পর্যায়ে অঙ্গীকার করতে হবে যে, যেকোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করবে এবং সংখ্যালঘুরা কোনো রাজনৈতিক দলের ‘খেলাধুলা’র শিকার হবেন না; ছয়. প্রশাসন এবং সব সামাজিক-রাজনৈতিক নেতাকে আক্রান্ত পরিবারগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে। লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
No comments