শ্রমিকদের বঞ্চনা আর কত?
তাজরীনের শ্রমিকদের রক্তের দাগ শুকাতে না-শুকাতেই রানা প্লাজায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটল। এত বড় বিপর্যয়ের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লাখ লাখ শ্রমিক যখন রাস্তায় নেমে আসেন, মালিকপক্ষ এবং সরকার তা সামাল দেওয়ার কৌশল হিসেবেই তখন মজুরির বিষয়টি সামনে আনে। মজুরি বোর্ড সর্বসাকল্যে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা নিম্নতম মজুরির প্রস্তাব করেছে। ২০১০ সালে ঘোষিত নিম্নতম মজুরির চেয়ে অঙ্কের হিসাবে দুই হাজার ৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি পেলেও বড় ধরনের ফাঁকি আছে। যেমন খাদ্য আর যাতায়াতের ভাতা বাবদ ৫০০ টাকা এবার যুক্ত করা হয়েছে। এত দিন শ্রমিকেরা মজুরির বাইরেই এ সুবিধা পেতেন। ফলে তাঁর প্রকৃত আয় তো আরও কমে গেল। যাঁদের জন্য এই নিম্নতম মজুরি, সেই হেলপাররা সংখ্যায় ২০ শতাংশ। অন্যান্য গ্রেডের শ্রমিকেরা, যাঁদের সংখ্যা বেশি, সেসব গ্রেডে আনুপাতিক হারে বেসিক খুবই কম বৃদ্ধি করা হয়েছে। অপর দিকে আট হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি শ্রমিকদের সর্বসম্মত দাবি। কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, প্রথমত, ২০১০ সালে যে কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে মজুরি বৃদ্ধি হয়েছিল, সেটি সেই সময়ে শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেই মজুরি এবার যদি দ্বিগুণও হয়, তাতে অনেকেই বগল বাজাতে পারেন কিন্তু শ্রমিক সন্তুষ্টি অর্জন হবে না। দ্বিতীয়ত, মজুরি বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধি কতটুকু শ্রমিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেছেন? দর-কষাকষিটা এমন, শ্রমিকপক্ষ দুই হাজার টাকা ছাড় দেয়, মালিকপক্ষ ২০০ টাকা বাড়ায়।
আবার শ্রমিকপক্ষ দাবি ৫০০ টাকা কমালে মালিকপক্ষ আরও ৫০ টাকা দিতে রাজি হয়। এভাবেই লেখা হয় শ্রমিকের ভাগ্য। শ্রমিক এখানেও প্রতারিত। মালিকপক্ষ প্রস্তাবে স্বাক্ষর না করে সভা থেকে ওয়াকআউট করেছে। প্রস্তাবিত মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই কৌশল অনেক পুরোনো। বিষয়টা এমন যে মালিকেরা এটাই দিতে চান না, তোমরা মেনে নাও। এ অবস্থা সরকারের জন্য মালিকদের খুশি রেখে, শ্রমিক ঠকিয়েও শ্রমিকবন্ধু সাজার দারুণ সুযোগ। আবার কেউ কেউ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ধোয়া তুলে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরতে চাইছেন। ভুলে যাচ্ছেন, শ্রমিকেরা আরও কয়েক বছরের জন্য আটক হতে যাচ্ছেন অন্যায্য মজুরির বন্দিশালায়। তাঁরা ভুলে যান শ্রমিকের দাবিকে ধারণ করতে না পারলে আন্দোলনের রাশ টানা তো দূর, নাগালও পাওয়া যায় না। পরে ষড়যন্ত্র খুঁজতে হয়। চতুর্থ বিষয়টি আট হাজার টাকার যৌক্তিকতা। আট হাজার টাকার বিপক্ষে একটি বাদে আর কোনো যুক্তিই শোনা যায় না বা হালে পানি পায় না। আর যে যুক্তিটি দিয়ে মালিকপক্ষ মজুরি কম দিতে চাইছে, অন্যথায় শিল্প বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে,
সেটি কিন্তু যুক্তি নয়, দোহাই। এই দোহাই দিয়ে সবই জায়েজ করা যায়। অনিরাপদ কারখানায় শ্রমিক মরে। কারণ, শিল্পের সক্ষমতা নেই। শ্রমিকের কোনো অধিকার শ্রমিক পায় না। কারণ, শিল্পের সক্ষমতা নেই। এই দোহাই দিয়ে, শিল্প বাঁচানোর কথা বলে মালিকেরা কত সুবিধা আদায় করেন, অন্যায়-অপকর্ম ঢাকেন। শ্রমিক না বাঁচলে কি শিল্প বাঁচে! গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ অন্যান্য পোশাকশ্রমিক সংগঠনগুলো মজুরি বোর্ডের প্রস্তাব ও মালিকদের অযৌক্তিক অবস্থানের প্রতিবাদ জানিয়েছে। দাবি করেছে, প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করার। এই শিল্পে তীব্র শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছেই। অবৈধ ছাঁটাই, বরখাস্ত, নির্যাতন, হামলা-মামলার মাধ্যমেই শ্রমিকদের দমন করা হয়। জরুরি প্রশ্নটি হলো, প্রস্তাবিত মজুরি কি শ্রমিকদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে? দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এই প্রধান খাতটি কি লুটের ধারায় গলগণ্ডের মতো বাড়তে থাকবে? মালিকদের পক্ষ থেকে শিল্পের সক্ষমতার কথা বলা হচ্ছে। এখন তো আনাচকানাচে পোশাক কারখানা গড়ে উঠছে। অক্ষম-অদক্ষ একজন মালিককে সক্ষম করার যে দায়িত্ব মালিকপক্ষ বোধ করছে, সেটা ভালো। তা করতে গিয়ে চরম শোষণ ও শ্রম লুণ্ঠন শ্রমিকের ওপর কী প্রভাব ফেলছে,
এটা ভাববে কে? তৈরি পোশাক খাতকে একটা আদর্শ শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে মালিক আর সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই? সক্ষমতার বিষয়টি তাঁরা একতরফাভাবেই বোঝেন, আমাদের তো অনুরূপ বোঝাতে চাইলে হবে না। শিল্প রক্ষার সঙ্গে শ্রমিকের সক্ষমতার সম্পর্ক বিবেচনায় নিতে হবে। আজ যখন অসংখ্য শ্রমিক শ্রমশক্তি হারিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত হচ্ছেন, সে দায়দায়িত্ব মালিকদের নিতে হচ্ছে না। পোশাকশ্রমিকেরা গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। শ্রমিকের সস্তা শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলা পাঁচ হাজার ৮০০ জন মালিকের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা, যাঁদের সস্তা শ্রমে দেশ চলে, গত ৪০ বছরে তাঁদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? শ্রমিকের সন্তান তো স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। বরং উল্টো দিকে শ্রমিক লাশ হয়ে, পঙ্গু হয়ে বাড়ি ফিরছেন। যে বৃদ্ধ মা-বাবাকে প্রতিপালন করার কথা, উল্টো তাঁদের বোঝায় পরিণত হচ্ছেন। এই তীব্র শ্রম শোষণ শিল্পের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। তাই অপকৌশল আর চতুরতা পরিহার করে মজুরি পুনর্বিবেচনা করা এবং নিম্নতম মজুরি আট হাজার টাকার দাবি বাস্তবায়ন করা জরুরি।
জলি তালুকদার: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
Joly_talukder@yahoo.com
জলি তালুকদার: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
Joly_talukder@yahoo.com
No comments