এশিয়া নিয়ে ইংলাকের স্বপ্ন by ধীরাজ কুমার নাথ
দ্রুত
বিকাশমান এশিয়াকে নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখছেন এ মহাদেশের নেতারা। থাই
প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা তাদেরই একজন। সম্প্রতি টোকিওতে অনুষ্ঠিত
‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সম্মেলনে চমৎকার একটি ভাষণ দিয়েছেন তিনি। মুগ্ধ
বিস্ময়ে পড়লাম সে ভাষণের টেক্সট। এ ভাষণের লক্ষণীয় দিক হলো, এতে এশিয়া
মহাদেশ সম্পর্কে তার অত্যন্ত উদার একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
ইংলাক বলেছেন, এশিয়া বৈচিত্র্যময়। যেখানে বৈচিত্র্যের সমাহার, সেখানে অনেক
সময় বিরোধপূর্ণ স্বার্থ থাকতে পারে। এশিয়ার উচিত জাতীয় স্বার্থ ছাপিয়ে
সামগ্রিকভাবে গোটা অঞ্চলের স্বার্থের দিকে তাকানো। আমাদের প্রয়োজন একটি
বহির্মুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অভিন্ন এশীয় সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ার চিন্তাভাবনা
শুরু করা। এটা পরস্পরের স্বার্থ ভাগাভাগি করে নিতে এবং চ্যালেঞ্জগুলো
একত্রে মোকাবেলা করতে সহায়ক হবে। কারণ আজকের বিশ্বে আমরা সবাই যুক্ত। ইউরোপ
ও যুক্তরাষ্ট্রের লাগাতার অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো এশিয়ার জন্য একটি বড়
পরীক্ষা। এশিয়ার মৌলভিত্তি শক্তিশালী। এখন আমরা কী করব, তার ওপর নির্ভর
করবে আমাদের ভবিষ্যৎ। বোঝা যাচ্ছে, ইংলাকের দর্শন বা ব্রত হলো, ‘সকলের তরে
সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। তিনি এশিয়ার সম্ভাবনাগুলোকে
পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেয়ার কথা বলছেন। তবে এশিয়ায় এ
ধরনের দর্শনের বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সবাই ইংলাকের মতো
উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী নন। এশিয়ার অনেক নেতাই রক্ষণশীল বা অন্তর্মুখী।
তাছাড়া প্রতিটি দেশের নেতা নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত। এশিয়ার দেশগুলো উপ-আঞ্চলিক পর্যায়েও বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জের
সম্মুখীন। এসব চ্যালেঞ্জ বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক
বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এসবের
গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। যেমন- পরিবেশের অবক্ষয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়,
জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি। এ বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রেই
এক দেশের সমস্যায় অন্য দেশ চোখ বুজে থাকতে পারে না। সেটা যদি কোনো ধরনের
হস্তক্ষেপ বা নাক গলানো পর্যায়ে পৌঁছায় তাহলে বিরোধ অবধারিত। যেখানে
উপ-আঞ্চলিক পর্যায়েই দেশগুলো নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে তারা
জাতীয় স্বার্থ ছাপিয়ে গোটা অঞ্চলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে কিভাবে?
তবে সত্যিই যদি এটা সম্ভব হয়, তাহলে এশিয়ার সামনে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা- যা ধরা পড়েছে ইংলাকের দূরদৃষ্টিতে : এশিয়া উঠে দাঁড়াচ্ছে। এ মহাদেশের রয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ ও বিশাল ভূখণ্ড, যা দুই বৃহৎ মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। এর ফলে বিশ্বে আমাদের প্রভাব ব্যাপক। এশিয়ার ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, অতীতে যেমনটা করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রটি এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। আশির দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে এশিয়ার অর্থনীতির নেতৃত্ব দিয়েছে জাপান। গত দশকে চীন ও ভারত বিশ্ব প্রবৃদ্ধি অর্জনের নতুন চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর এ অঞ্চলে গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে তা দাঁড়াবে প্রায় ৬ শতাংশে। সীমিত মুদ্রাস্ফীতি ও সরকারি পর্যায়ে পরিশোধযোগ্য ঋণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হয়েছে। একই সঙ্গে একটি উৎপাদনশীল শ্রমশক্তি, তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতা এবং নতুন প্রযুক্তির সহায়তা এ অঞ্চলে টেকসই প্রবৃদ্ধি বজায় রাখবে। বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জিডিপিতে এশিয়ার অংশ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫১ শতাংশ হবে। এশিয়ায় ভোক্তার সংখ্যা ও ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত বাড়বে। বিশ্বে মোট মধ্যবিত্তের ৬৬ শতাংশ হবে এশীয়। বর্তমানে এ হার মাত্র ২৮ শতাংশ। এশিয়ার আন্তর্জাতিক রিজার্ভও খুব ভালো, ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অর্থ উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার হলে এটি একটি সত্যিকারের ‘এশীয় শতাব্দী’ নির্মাণে সহায়ক হবে।
তবে এজন্য দরকার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন এবং জনগণ পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে তোলা। আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবহনের কারণে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার হচ্ছে। যারা এ থেকে দূরে সরে থাকছে, তারা এ সুযোগ হারাচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংহতির মাধ্যমে দেশগুলোর অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত হতে পারে। এর মাধ্যমে দেশগুলোতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবপর হয়ে উঠবে। দ্রারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পাবে। উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হবে। ফলে দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়নের ব্যবধান কমে আসবে। এটা সম্ভব হলে এশিয়া হয়ে উঠবে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। আসুন দেখি এ বিষয়ে ইংলাক কী ভাবছেন : আমরা একসঙ্গে একটি প্রাণচঞ্চল আঞ্চলিক বাজার গড়ে তুলতে পারি সবার পণ্য ও সেবা বিক্রির জন্য। একই সময়ে বাড়তি তহবিল গোটা অঞ্চলের সুবিধার্থে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে সব দেশের মধ্যে সহযোগিতা হওয়া উচিত যাতে সবাই একসঙ্গে এর সুফল পেতে পারে। আমাদের বিনিয়োগ যোগাযোগ সম্প্রসারণে- স্থল ও সমুদ্রপথ উভয় ক্ষেত্রে- পরিচালনা করা উচিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূখণ্ডের মহাদেশ এশিয়া। স্থলভাগে রেল যোগাযোগ সবচেয়ে কার্যকর। উচ্চগতির রেল যোগাযোগের জন্য একটি আধুনিক সিল্ক রোড নির্মাণ করতে হবে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সুবিধা সংবলিত এ পথ এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপকে যুক্ত করবে। একই সঙ্গে আমরা সড়ক, বিমান ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ বাড়াতে থাকব।
তবে এ যাত্রাপথ সহজ নয়। নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং তা এ অগ্রগতিকে সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রসীমা নিয়ে উত্তেজনা একটি সমস্যা। একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল নিরাপত্তার পরিবেশ ছাড়া এশিয়ার জন্য টেকসই উন্নয়ন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি হতে পারে না। অপেক্ষাকৃত একটি ভালো ভবিষ্যতের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা অপরিহার্য। যেমন অপরিহার্য বাণিজ্য ক্ষেত্রে সমতা। মুক্তবাণিজ্য ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে অসম বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে পারে। এ ধরনের বাণিজ্যে অধিকতর উন্নত দেশই বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। কারণ অসম বিনিময়ের কারণে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়টি বেশি উন্মুক্ত হয়ে যায়। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে এশিয়ার দেশগুলোকে তাদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে হবে। কাজটি সহজ নয়। ইংলাক কি তা অনুধাবন করেন? নিশ্চয়ই করেন, তার ভাষণে এর কিছুটা আভাস রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটি এশীয় ইউনিয়নের স্বপ্ন দেখছেন ইংলাক। যদিও আসিয়ান নিয়ে এ ধরনের চিন্তা আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। সম্ভবত ইংলাকের ভাবনা আরও বৃহত্তর পরিসরে, এশিয়ার সব দেশকে ঘিরে। তিনি মনে করেন, ২০১৫ সালে সীমান্তবিহীন আসিয়ান চালু করা কঠিন হবে। ‘কিন্তু আমরা যদি এশিয়ার অন্যান্য উপ-অঞ্চলকে অধিকতর ঘনিষ্ঠ করতে পারি, তাহলে এশিয়া একসঙ্গে উঠে দাঁড়াতে পারবে। সমস্যাগুলো একত্রে মোকাবেলার জন্য আমার প্রস্তাব, আমরা উইন-উইন ইস্যুতে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতা গড়ে তুলব, যা গোটা এশিয়ার গুরুত্ব বাড়িয়ে দেবে। এ ধরনের ইস্যুর মধ্যে থাকবে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা। পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ আমাদের অঞ্চলের উন্নয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করবে। ‘এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করা দরকার। এশিয়ার ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে। সবার জন্য টেকসই উন্নয়নের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের প্রজন্মের। এটা এমন একটি পথ যেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করব, একে অন্যের কাছ থেকে শিখব এবং উন্নত হব একসঙ্গে। এটা শুধু আমাদের অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
লক্ষ্য করুন, ইংলাক ‘একসঙ্গে’ কথাটি বারবার বলেছেন। সত্যিই যদি এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি অভিন্ন বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাহলে কোনো দেশ আর পিছিয়ে থাকবে না। এতে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ শুধু নয়- এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে সহজেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। যদি এশিয়ার পানি, উৎপাদিত বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ সব দেশ ভাগাভাগি করে নিতে পারে, তাহলে আর কোনো দেশে এসবের অভাব থাকবে না। যদি এক দেশের পরিবেশের ক্ষতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনুধাবন করে অপর দেশ দূষণ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে, তাহলে কতই না ভালো হয়। আমাদের প্রশ্ন, এসব কি শুধুই অলীক কল্পনা? নাকি ইংলাকের মতো এশিয়ার অন্যান্য নেতাও এসব উপলব্ধি করবেন?
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
তবে সত্যিই যদি এটা সম্ভব হয়, তাহলে এশিয়ার সামনে রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা- যা ধরা পড়েছে ইংলাকের দূরদৃষ্টিতে : এশিয়া উঠে দাঁড়াচ্ছে। এ মহাদেশের রয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ ও বিশাল ভূখণ্ড, যা দুই বৃহৎ মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। এর ফলে বিশ্বে আমাদের প্রভাব ব্যাপক। এশিয়ার ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, অতীতে যেমনটা করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রটি এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। আশির দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে এশিয়ার অর্থনীতির নেতৃত্ব দিয়েছে জাপান। গত দশকে চীন ও ভারত বিশ্ব প্রবৃদ্ধি অর্জনের নতুন চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর এ অঞ্চলে গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে তা দাঁড়াবে প্রায় ৬ শতাংশে। সীমিত মুদ্রাস্ফীতি ও সরকারি পর্যায়ে পরিশোধযোগ্য ঋণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হয়েছে। একই সঙ্গে একটি উৎপাদনশীল শ্রমশক্তি, তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতা এবং নতুন প্রযুক্তির সহায়তা এ অঞ্চলে টেকসই প্রবৃদ্ধি বজায় রাখবে। বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জিডিপিতে এশিয়ার অংশ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫১ শতাংশ হবে। এশিয়ায় ভোক্তার সংখ্যা ও ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত বাড়বে। বিশ্বে মোট মধ্যবিত্তের ৬৬ শতাংশ হবে এশীয়। বর্তমানে এ হার মাত্র ২৮ শতাংশ। এশিয়ার আন্তর্জাতিক রিজার্ভও খুব ভালো, ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অর্থ উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার হলে এটি একটি সত্যিকারের ‘এশীয় শতাব্দী’ নির্মাণে সহায়ক হবে।
তবে এজন্য দরকার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন এবং জনগণ পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে তোলা। আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবহনের কারণে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার হচ্ছে। যারা এ থেকে দূরে সরে থাকছে, তারা এ সুযোগ হারাচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংহতির মাধ্যমে দেশগুলোর অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত হতে পারে। এর মাধ্যমে দেশগুলোতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবপর হয়ে উঠবে। দ্রারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পাবে। উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হবে। ফলে দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়নের ব্যবধান কমে আসবে। এটা সম্ভব হলে এশিয়া হয়ে উঠবে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। আসুন দেখি এ বিষয়ে ইংলাক কী ভাবছেন : আমরা একসঙ্গে একটি প্রাণচঞ্চল আঞ্চলিক বাজার গড়ে তুলতে পারি সবার পণ্য ও সেবা বিক্রির জন্য। একই সময়ে বাড়তি তহবিল গোটা অঞ্চলের সুবিধার্থে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে সব দেশের মধ্যে সহযোগিতা হওয়া উচিত যাতে সবাই একসঙ্গে এর সুফল পেতে পারে। আমাদের বিনিয়োগ যোগাযোগ সম্প্রসারণে- স্থল ও সমুদ্রপথ উভয় ক্ষেত্রে- পরিচালনা করা উচিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূখণ্ডের মহাদেশ এশিয়া। স্থলভাগে রেল যোগাযোগ সবচেয়ে কার্যকর। উচ্চগতির রেল যোগাযোগের জন্য একটি আধুনিক সিল্ক রোড নির্মাণ করতে হবে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সুবিধা সংবলিত এ পথ এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপকে যুক্ত করবে। একই সঙ্গে আমরা সড়ক, বিমান ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ বাড়াতে থাকব।
তবে এ যাত্রাপথ সহজ নয়। নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং তা এ অগ্রগতিকে সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রসীমা নিয়ে উত্তেজনা একটি সমস্যা। একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল নিরাপত্তার পরিবেশ ছাড়া এশিয়ার জন্য টেকসই উন্নয়ন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি হতে পারে না। অপেক্ষাকৃত একটি ভালো ভবিষ্যতের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা অপরিহার্য। যেমন অপরিহার্য বাণিজ্য ক্ষেত্রে সমতা। মুক্তবাণিজ্য ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে অসম বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে পারে। এ ধরনের বাণিজ্যে অধিকতর উন্নত দেশই বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। কারণ অসম বিনিময়ের কারণে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়টি বেশি উন্মুক্ত হয়ে যায়। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে এশিয়ার দেশগুলোকে তাদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে হবে। কাজটি সহজ নয়। ইংলাক কি তা অনুধাবন করেন? নিশ্চয়ই করেন, তার ভাষণে এর কিছুটা আভাস রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো একটি এশীয় ইউনিয়নের স্বপ্ন দেখছেন ইংলাক। যদিও আসিয়ান নিয়ে এ ধরনের চিন্তা আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। সম্ভবত ইংলাকের ভাবনা আরও বৃহত্তর পরিসরে, এশিয়ার সব দেশকে ঘিরে। তিনি মনে করেন, ২০১৫ সালে সীমান্তবিহীন আসিয়ান চালু করা কঠিন হবে। ‘কিন্তু আমরা যদি এশিয়ার অন্যান্য উপ-অঞ্চলকে অধিকতর ঘনিষ্ঠ করতে পারি, তাহলে এশিয়া একসঙ্গে উঠে দাঁড়াতে পারবে। সমস্যাগুলো একত্রে মোকাবেলার জন্য আমার প্রস্তাব, আমরা উইন-উইন ইস্যুতে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতা গড়ে তুলব, যা গোটা এশিয়ার গুরুত্ব বাড়িয়ে দেবে। এ ধরনের ইস্যুর মধ্যে থাকবে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা। পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ আমাদের অঞ্চলের উন্নয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করবে। ‘এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করা দরকার। এশিয়ার ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে। সবার জন্য টেকসই উন্নয়নের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের প্রজন্মের। এটা এমন একটি পথ যেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করব, একে অন্যের কাছ থেকে শিখব এবং উন্নত হব একসঙ্গে। এটা শুধু আমাদের অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
লক্ষ্য করুন, ইংলাক ‘একসঙ্গে’ কথাটি বারবার বলেছেন। সত্যিই যদি এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি অভিন্ন বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাহলে কোনো দেশ আর পিছিয়ে থাকবে না। এতে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ শুধু নয়- এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে সহজেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে। যদি এশিয়ার পানি, উৎপাদিত বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ সব দেশ ভাগাভাগি করে নিতে পারে, তাহলে আর কোনো দেশে এসবের অভাব থাকবে না। যদি এক দেশের পরিবেশের ক্ষতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনুধাবন করে অপর দেশ দূষণ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে, তাহলে কতই না ভালো হয়। আমাদের প্রশ্ন, এসব কি শুধুই অলীক কল্পনা? নাকি ইংলাকের মতো এশিয়ার অন্যান্য নেতাও এসব উপলব্ধি করবেন?
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
No comments