সবার কথা শুনতে হবে by ধীরাজ কুমার নাথ
গত
৬ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হিন্দু
বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক সভায় কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি দাবি
করেন, বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য
কমপক্ষে ৬০টি পৃথক আসন নির্ধারিত করা হোক। এ ব্যাপারে তারা সব বৃহৎ
রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ দাবি সমর্থনের জন্য আবেদন
করেছেন। এমন একটি দাবি এত বছর পর দেশবাসীকে চমক দিয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান একসঙ্গে সংগ্রাম করেছে,
সেখানে এ ধরনের দাবি কেমন যেন বেমানান বলে অনেকে মনে করছেন। আমাদের একটি
অনন্য সংবিধান রয়েছে, যে সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে অঙ্গীকার
ব্যক্ত করা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা
জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।’
এ ছাড়াও সংবিধানের ২৯ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ,
নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে
নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য
করা যাইবে না।’
এ ছাড়াও সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
এমন একটি সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকার পরও পৃথকভাবে নির্বাচন করা বা সংরক্ষিত আসন সৃষ্টি করে সংবিধান সংশোধন করে একটি নতুন অনুচ্ছেদের সংযোজন করা ব্যতিক্রমধর্মী ভাবনা বলেই মনে হয়। অনেকের অভিমত, এমন দাবি স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মুক্তিযুদ্ধে মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একযোগে একই ক্যাম্প বা বাংকারে থেকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, অনেকে শহীদ হয়েছে। তবে এ কথাও সত্য, ১৯৮৮ সালে যখন সংবিধানে ৮ম সংশোধনী আনা হয়, তখন একবারও সংবিধানের উল্লিখিত ধারা বা প্রস্তাবনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে গণভোট গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করা হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ের উদ্যানে (ডাকঘরের সামনে) সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর উদ্দেশে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে সকলের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এ দেশ থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাবনা নির্মূল হয়েছে।’ অথচ ১৯৭৫ সালেই খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করার পাঁয়তারা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার দর্শন এবং ক্ষমতাসীনদের ভাবনার সঙ্গে মনে হয়, অনেক ক্ষেত্রে কোনো সঙ্গতি নেই।
সংখ্যালঘুদের এ ফোরাম প্রধানত নির্বাচনকালে এবং নির্র্বাচন-পরবর্তী সময়ে ধর্মভিত্তিক যে প্রচারণা বা সহিংসতা লক্ষ্য করা যায়, তার প্রেক্ষাপটে এসব দাবি উত্থাপন করেছে বলে মনে হয়। তাছাড়া সংবিধানে সংখ্যালঘুদের সমতার কথা বলা হয়েছে সত্য, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বা রক্ষাকবচের লক্ষ্যে কোনো প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়নি বলে তারা প্রশ্ন তুলেছেন। এ ফোরাম থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আগৈলঝড়াসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে এবং এজন্য শাহাবুদ্দিন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার কোনো ফলাফল দেশবাসী দেখতে পায়নি অদ্যাবধি। সরকার কোনো ধরনের প্রতিকারের কথা ভাবেনি।
এসব কারণেই তাদের মতে, ২০০১ সালের পর কয়েক লাখ সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করেছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে যেখানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ ভাগ, সেখানে এখন তা ৯ ভাগে উপনীত হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের ড. মীজানুর রহমানের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশে কোনো হিন্দু থাকবে না। মূলত পাকিস্তানে যা হয়েছে, তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখানে। তাহলে স্বাধীনতার চেতনা বা তার সুফল কোথায়?
অনেকে আবার মনে করছেন, বর্তমান জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘুদের নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এ বছর ২৮ ফেব্র“য়ারির পর বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির ভাঙার যে মহোৎসব শুরু হয়েছে এবং এখনও যা অব্যাহত আছে, এবারের বাজেট অধিবেশনে তার ওপর কোনো বক্তব্য, কোনো প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়নি, পয়েন্ট অব অর্ডার তো নয়ই। সংসদে অনেক গ্রাম্য ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ভাষা বা বাক্য ব্যবহার করা হয়নি। তাই সংসদে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি থাকতে হবে, যারা আদিবাসীদের বেদনার কথা বলবেন, সংখ্যালঘুদের প্রতি উপেক্ষার কাহিনী তুলে ধরবেন। তাদের ভূমি দখল, মন্দির ও প্যাগোডা দখল, পরিবারের প্রতি অসম্মানের চিত্র তুলে ধরবেন এবং তার প্রতিকার চাইবেন। দলীয়ভাবে নির্বাচিত সংখ্যালঘু সদস্যদের দ্বারা এসব কথা বলা সম্ভব নয়। তারা শুধু দলীয় নেতার প্রশংসা বা ভাবনার কথা বারবার বলতে ভালোবাসেন। দেশের কথা, দশের কথা তাদের চিন্তায় থাকলেও ভাষায় প্রকাশের সাহস বা সময় তাদের নেই।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এ ধরনের বিছিন্ন ভাবনা বাংলাদেশে উঠে আসবে, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এমনটা ভাবিনি। ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে দেশ গড়ার স্বপ্নে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষাকে বরণ করে নিয়েছে দেশবাসী। ভুলে গেছে অনেক নির্যাতনের কথা, হিংসা ও বেদনার কথা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, তাদের ভুল সংশোধন করে জাতির মূল স্রোতে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিতে এবং একযোগে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেদন করতে আহ্বান করেছেন। দারিদ্র্যকে দূরীভূত করে, সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটিয়ে, সহিংসতাকে নির্মূল করে, এক ভাষা এক জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার ভাবনাকে বিকশিত করার স্বপ্নে সবাই ছিল বিভোর। কিন্তু দেশ যেন প্রগতিশীল ভাবনা থেকে দিনের পর দিন দূরে সরে যাচ্ছে। উদার মানসিকতাকে আজকাল দুর্বলতা হিসেবে মনে করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে।
অনেক দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে লক্ষ্য করা যায়, সবাই তা সমর্থন করে না। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীনতার পর সবাই দেশের মূলস্রোতে ফিরে আসে, দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করে। বাংলাদেশে কেন জানি তা হচ্ছে না। অনেকের ধারণা, এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম দুর্বলতা। অনেক রাজনৈতিক নেতা দেশ পরিচালনাকে মনে করেন ছেলেখেলা, যেমন খুশি তেমন সাজো, যেমন মন চায় তেমন বলো। তাদের সামনে কোনো দর্শন নেই, কোনো আদর্শ অথবা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। আমলাতন্ত্রের মধ্যে ‘ইয়েস স্যার, ইয়েস মিনিস্টার’ লক্ষ্য করা যায়। এ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই। কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে প্রেসিডিয়ামের মধ্যে ভাবনা হয়, গবেষণা কোষ থাকে, নিজস্ব মনিটরিং সেল থাকে। জনগণের ভাবনা এবং সরকার ও বিরোধী দল সম্পর্কে তৃণমূল থেকে তথ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে দলীয় প্রেক্ষাপট বা কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। দলের কর্মসূচি প্রণীত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হয় এমনটি আদৌ হচ্ছে না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনা ও দলীয় কর্মসূচি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনে জিততে হবে, এমনটা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের অহর্নিশি ভাবনা। রাজনীতি কি শুধু নির্বাচিত হওয়ার জন্য? টাকা খরচ করলে ভোট পাওয়া যাবে, এ ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। জনগণ অনেক সচেতন, গণমাধ্যমের দৃষ্টি অনেক প্রখর।
সরকার, বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভাবতে হবে, কিভাবে দেশের সব মানুষকে প্রগতির পথে এক সূত্রে গাঁথা যায়। এ কাজ সহজ নয়। বিভেদ থাকবে, আদর্শগত অবস্থান ভিন্নতর হবে, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু কিছু বৃহৎ কর্মকাণ্ডে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে কোনো অসুবিধা নেই। এজন্য চাই সদিচ্ছা। দলীয় স্বার্থ বা অহমিকার ঊর্ধ্বে উঠে আলোচনা সভার আয়োজন করা দরকার। প্রয়োজনে গণভোট নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে এমন গণভোট হয়েছে। আরও হতে ক্ষতি কী? মনে রাখতে হবে, জনগণ এখন রাজনৈতিকভাবে অনেক সচেতন। তারা জানে কোন কথা কেন বলা হচ্ছে। কোনটা দুর্নীতি, কোনটা জনহিতকর কাজ, সে পার্থক্য তাদের কাছে স্পষ্ট। কিভাবে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়- এ নিয়ে ভাবনার সুযোগ আছে, পথ ও পদ্ধতি আছে। সংকট সৃষ্টি করা সহজ, সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানোর মধ্যেই রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় মেলে। দেশবাসীকে চরম আশংকা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে রেখে লাভ নেই, সুদিনের স্বপ্ন দৃশ্যমান করতে হবে। সংখ্যালঘুদের কারও ভোটব্যাংক ভাবলে তা সঠিক হবে না। তাদের প্রতিনিধিদের কথা শুনতে হবে মনোযোগের সঙ্গে। সবার কথা শুনতে হবে, জাতীয় স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, কলাম লেখক
এ ছাড়াও সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
এমন একটি সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকার পরও পৃথকভাবে নির্বাচন করা বা সংরক্ষিত আসন সৃষ্টি করে সংবিধান সংশোধন করে একটি নতুন অনুচ্ছেদের সংযোজন করা ব্যতিক্রমধর্মী ভাবনা বলেই মনে হয়। অনেকের অভিমত, এমন দাবি স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মুক্তিযুদ্ধে মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একযোগে একই ক্যাম্প বা বাংকারে থেকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, অনেকে শহীদ হয়েছে। তবে এ কথাও সত্য, ১৯৮৮ সালে যখন সংবিধানে ৮ম সংশোধনী আনা হয়, তখন একবারও সংবিধানের উল্লিখিত ধারা বা প্রস্তাবনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে গণভোট গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করা হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সচিবালয়ের উদ্যানে (ডাকঘরের সামনে) সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর উদ্দেশে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে সকলের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এ দেশ থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাবনা নির্মূল হয়েছে।’ অথচ ১৯৭৫ সালেই খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করার পাঁয়তারা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার দর্শন এবং ক্ষমতাসীনদের ভাবনার সঙ্গে মনে হয়, অনেক ক্ষেত্রে কোনো সঙ্গতি নেই।
সংখ্যালঘুদের এ ফোরাম প্রধানত নির্বাচনকালে এবং নির্র্বাচন-পরবর্তী সময়ে ধর্মভিত্তিক যে প্রচারণা বা সহিংসতা লক্ষ্য করা যায়, তার প্রেক্ষাপটে এসব দাবি উত্থাপন করেছে বলে মনে হয়। তাছাড়া সংবিধানে সংখ্যালঘুদের সমতার কথা বলা হয়েছে সত্য, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বা রক্ষাকবচের লক্ষ্যে কোনো প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়নি বলে তারা প্রশ্ন তুলেছেন। এ ফোরাম থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আগৈলঝড়াসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে এবং এজন্য শাহাবুদ্দিন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার কোনো ফলাফল দেশবাসী দেখতে পায়নি অদ্যাবধি। সরকার কোনো ধরনের প্রতিকারের কথা ভাবেনি।
এসব কারণেই তাদের মতে, ২০০১ সালের পর কয়েক লাখ সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করেছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে যেখানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ ভাগ, সেখানে এখন তা ৯ ভাগে উপনীত হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের ড. মীজানুর রহমানের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশে কোনো হিন্দু থাকবে না। মূলত পাকিস্তানে যা হয়েছে, তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখানে। তাহলে স্বাধীনতার চেতনা বা তার সুফল কোথায়?
অনেকে আবার মনে করছেন, বর্তমান জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘুদের নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এ বছর ২৮ ফেব্র“য়ারির পর বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির ভাঙার যে মহোৎসব শুরু হয়েছে এবং এখনও যা অব্যাহত আছে, এবারের বাজেট অধিবেশনে তার ওপর কোনো বক্তব্য, কোনো প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়নি, পয়েন্ট অব অর্ডার তো নয়ই। সংসদে অনেক গ্রাম্য ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ভাষা বা বাক্য ব্যবহার করা হয়নি। তাই সংসদে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি থাকতে হবে, যারা আদিবাসীদের বেদনার কথা বলবেন, সংখ্যালঘুদের প্রতি উপেক্ষার কাহিনী তুলে ধরবেন। তাদের ভূমি দখল, মন্দির ও প্যাগোডা দখল, পরিবারের প্রতি অসম্মানের চিত্র তুলে ধরবেন এবং তার প্রতিকার চাইবেন। দলীয়ভাবে নির্বাচিত সংখ্যালঘু সদস্যদের দ্বারা এসব কথা বলা সম্ভব নয়। তারা শুধু দলীয় নেতার প্রশংসা বা ভাবনার কথা বারবার বলতে ভালোবাসেন। দেশের কথা, দশের কথা তাদের চিন্তায় থাকলেও ভাষায় প্রকাশের সাহস বা সময় তাদের নেই।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এ ধরনের বিছিন্ন ভাবনা বাংলাদেশে উঠে আসবে, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এমনটা ভাবিনি। ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে দেশ গড়ার স্বপ্নে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষাকে বরণ করে নিয়েছে দেশবাসী। ভুলে গেছে অনেক নির্যাতনের কথা, হিংসা ও বেদনার কথা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, তাদের ভুল সংশোধন করে জাতির মূল স্রোতে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিতে এবং একযোগে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিবেদন করতে আহ্বান করেছেন। দারিদ্র্যকে দূরীভূত করে, সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটিয়ে, সহিংসতাকে নির্মূল করে, এক ভাষা এক জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার ভাবনাকে বিকশিত করার স্বপ্নে সবাই ছিল বিভোর। কিন্তু দেশ যেন প্রগতিশীল ভাবনা থেকে দিনের পর দিন দূরে সরে যাচ্ছে। উদার মানসিকতাকে আজকাল দুর্বলতা হিসেবে মনে করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে।
অনেক দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে লক্ষ্য করা যায়, সবাই তা সমর্থন করে না। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীনতার পর সবাই দেশের মূলস্রোতে ফিরে আসে, দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করে। বাংলাদেশে কেন জানি তা হচ্ছে না। অনেকের ধারণা, এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম দুর্বলতা। অনেক রাজনৈতিক নেতা দেশ পরিচালনাকে মনে করেন ছেলেখেলা, যেমন খুশি তেমন সাজো, যেমন মন চায় তেমন বলো। তাদের সামনে কোনো দর্শন নেই, কোনো আদর্শ অথবা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। আমলাতন্ত্রের মধ্যে ‘ইয়েস স্যার, ইয়েস মিনিস্টার’ লক্ষ্য করা যায়। এ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই। কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে প্রেসিডিয়ামের মধ্যে ভাবনা হয়, গবেষণা কোষ থাকে, নিজস্ব মনিটরিং সেল থাকে। জনগণের ভাবনা এবং সরকার ও বিরোধী দল সম্পর্কে তৃণমূল থেকে তথ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে দলীয় প্রেক্ষাপট বা কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। দলের কর্মসূচি প্রণীত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হয় এমনটি আদৌ হচ্ছে না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনা ও দলীয় কর্মসূচি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনে জিততে হবে, এমনটা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের অহর্নিশি ভাবনা। রাজনীতি কি শুধু নির্বাচিত হওয়ার জন্য? টাকা খরচ করলে ভোট পাওয়া যাবে, এ ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। জনগণ অনেক সচেতন, গণমাধ্যমের দৃষ্টি অনেক প্রখর।
সরকার, বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভাবতে হবে, কিভাবে দেশের সব মানুষকে প্রগতির পথে এক সূত্রে গাঁথা যায়। এ কাজ সহজ নয়। বিভেদ থাকবে, আদর্শগত অবস্থান ভিন্নতর হবে, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু কিছু বৃহৎ কর্মকাণ্ডে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে কোনো অসুবিধা নেই। এজন্য চাই সদিচ্ছা। দলীয় স্বার্থ বা অহমিকার ঊর্ধ্বে উঠে আলোচনা সভার আয়োজন করা দরকার। প্রয়োজনে গণভোট নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে এমন গণভোট হয়েছে। আরও হতে ক্ষতি কী? মনে রাখতে হবে, জনগণ এখন রাজনৈতিকভাবে অনেক সচেতন। তারা জানে কোন কথা কেন বলা হচ্ছে। কোনটা দুর্নীতি, কোনটা জনহিতকর কাজ, সে পার্থক্য তাদের কাছে স্পষ্ট। কিভাবে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়- এ নিয়ে ভাবনার সুযোগ আছে, পথ ও পদ্ধতি আছে। সংকট সৃষ্টি করা সহজ, সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানোর মধ্যেই রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় মেলে। দেশবাসীকে চরম আশংকা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে রেখে লাভ নেই, সুদিনের স্বপ্ন দৃশ্যমান করতে হবে। সংখ্যালঘুদের কারও ভোটব্যাংক ভাবলে তা সঠিক হবে না। তাদের প্রতিনিধিদের কথা শুনতে হবে মনোযোগের সঙ্গে। সবার কথা শুনতে হবে, জাতীয় স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments